ছড়া/ঝিনেদার জমিদার কালাচাঁদ রায়রা
ঝিনেদার জমিদার কালাচাঁদ রায়রা
সে বছর পুষেছিল এক পাল পায়রা।
বড়ােবাবু খাটিয়াতে বসে বসে পান খায়,
পায়রা আঙিনা জুড়ে খুটে খুটে ধান খায়
হাঁসগুলাে জলে চলে আঁকা-বাঁকা রকমে,
পায়রা জমায় সভা বক্-বক্-বকমে।
খবরের কাগজেতে shock দিল বক্ষে,
প্যারাগ্রাফে ঠোক্কর লাগে তার চক্ষে।
তিন দিন ধরে নাকি দুই দলে পােড়াদয়
ঘুড়ি-কাটাকাটি নিয়ে মাথা-ফাটাফাটি হয়
কেউ বলে ঘুড়ি নয়, মনে হয় সন্ধ
পােলিটিকালের যেন পাওয়া যায় গন্ধ।
‘রানাঘাট সমাচারে’ লিখেছে রিপাের্টার
আঠারােই অঘ্রানে শুরু হতে ভােরটার
বেশি বৈ কম নয় ছয়-সাত হাজারে
গুণ্ডার দল এল সবজির বাজারে।
এ খবর একেবারে লুকোনােই দরকার,
গাপ করে দিল তাই ইংরেজ সরকার।
ভয় ছিল কোনােদিন প্রশ্নের ধাক্কায়
পার্লিয়ামেণ্টের হাওয়া পাছে পাক খায়।
এডিটর বলে, এতে পুলিসের গাফেলি;
পুলিস বলে যে, চলাে বুঝেসুঝে পা ফেলি।
ভাঙল কপাল যত কপালেরই দোষ সে,
এ-সব ফসল ফলে কন্গ্রেসি শস্যে।
সবজির বাজারেতে মুলাে মােচা সস্তায়
পাওয়া গেল বাসি মাল ঝকা ঝুড়ি বস্তায়।
ঝুড়ি থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেরেছিল চালতা,
যশােরের কাগজেতে বেরিয়েছে কাল তা।
‘মহাকাল’ লিখেছিল, ভাষা তার শানানাে,
চালতা ছোড়ার কথা আগাগােড়া বানানো—
বড়ো বড়াে লাউ নাকি ছুড়েছে দু পক্ষে,
শচীবাবু দেখেছে সে আপনার চক্ষে।
দাঙ্গায় হাঙ্গামে মিছে ক'রে লােক গােনা,
সংবাদী সমাজের কখনাে এ যােগ্য না।
আর এক সাক্ষীর আর এক জবানি—
বেল ছুঁড়ে মেরেছিল দেখেছে তা ভবানী।
যার নাকে লেগেছিল সে গিয়েছে ভেবড়ে,
ভাগ্যেই নাক তার যায় নাই থেবড়ে।
শুনে এডিটর বলে, এ কি বিশ্বাস্য,
কে না জানে নাসাটা যে সহজেই নাশ্য
জানি না কি ও পাড়ায় কোনােখানে নাই বেল!
ভবানী লিখল, এ যে আগাগােড়া লাইবেল।
মাঝে থেকে গায়ে প’ড়ে চেঁচায় আদিত্য―
আমারে আরােপ করা মিথ্যাবাদিত্ব।
কোন্ বংশে-যে মোর জন্য তা জান তাে,
আমার পায়ের কাছে করে মাথা আনত;
আমার বােনের যোগ বিবাহের সূত্রে
ভজু গােস্বামীদের পুত্রের পুত্রে।
এডিটর লেখে, তব ভগ্নীর স্বামী যে
গো বটে গোয়ালবাসী জানি তাহা আমি যে।
ঠাট্টার অর্থটা ব্যাকরণে খুঁজতে
দেরি হল, পরদিনে পারল সে বুঝতে।
মহ রেগে বলে, তব কলমের চালনা
এখনি ঘুচাতে পারি, বাড়াবাড়ি ভালো না।
ফাঁস করে দিই যদি, হবে সে কি খোশনাম,
কোথায় তলিয়ে যাবে সাতকড়ি ঘােষ নাম।
জানি তব জামাইয়ের জ্যাঠাইয়ের যে বেহাই
আদালতে কত করে পেয়েছিল সে রেহাই।
ঠাণ্ডা মেজাজ মাের সহজে তাে রাগি নে,
নইলে তােমার সেই আদরের ভাগিনে
তার কথা বলি যদি―এই ব’লে বলাটা
শুরু করে ঘেঁটে দি পঙ্কের তলাটা।
তার পরে জানা গেল গাঁজাখুরি সবটাই,
মাথা-ফাটাফাটি আদি মিছে জনরবটাই।
মাছ নিয়ে বকাবকি করেছিল জেলেটা,
পচা কলা ছুঁড়ে তারে মেরেছিল ছেলেটা।
আসল কথাটা এই অটলা ও পটলা
বাধালাে ধর্মঘটে জন ছয়ে জটলা।
শুধু কুলি চার জন করেছিল গােলমাল,
লাল-পাগড়ি সে এসে বলেছিল ‘তােল্ মাল’।
গুড়ের কল্সিখান মেতে উঠে ফেটেছিল,
রাজ্যের খেকিগুলাে শুঁকে শুঁকে চেটেছিল;
বক্তৃতা করেছিল হরিহর শিকদার—
দোকানিরা বলেছিল, এ যে ভারি দিকদার।
সাদা এই প্রতিবাদ লিখেছিল তারিণী,
গ্রামের নিন্দে সে যে সইতেই পারে নি।
নেহাত পারে না যারা পাবলিশ না ক’রে
সব-শেষ পাতে দিল বর্জই আখরে।
প্রতিবাদটুকু কোনাে রেখা নাহি রেখে যায়,
বেল থেকে তাল হয়ে গুজবটা থেকে যায়।
ঠিকমত সংবাদ লিখেছিল সজনী—
সহ্য না হল সেটা, শুনেছে বা ক’জনই।
জ্যাঠাইয়ের বেহাইয়ের মামলাটা ছাড়াতে
যা ঘটেছে হাসি তার থেকে গেল পাড়াতে।
আদরের ভাগনের কী কেলেঙ্কারি সে,
বারাসতে বরিশালে হয়ে গেছে জারি সে।
হিতসাধনী সভার চাঁদা-চুরি কাণ্ড
ছড়িয়ে পড়েছে আজ সারা ব্রহ্মাণ্ড।
ছেলেরা দু-ভাগ হল মাগুরার কলেজে—
এরা যদি বলে বেল, ওরা লাউ বলে যে।
চালতার দল থাকে উভয়ের মাঝেতে,
তারা লাগে দু-দলের সভা-ভাঙা কাজেতে।
দলপতি পশ্চাতে রব তােলে বাহুবার,
তার পরে গােলেমালে হয়ে পড়ে যা হবার।
ভয়ে ভয়ে ছি ছি বলে কলেজের কর্তারা,
তার পরে মাপ চেয়ে চলে যায় ঘর তারা।
একদা দু এডিটরে দেখা হল গাড়িতে,
পনেরাে মিনিট শুধু ছিল ট্রেন ছাড়িতে।
ফোঁস ক'রে ওঠে ফের পুরাতন কথা সেই,
ঝাঁজ তার পুরাে আছে আগে ছিল যথা সেই
একজন বলে বেল,লাউ বলে অন্যে,
দুজনেই হয়ে ওঠে মারমুখখা হন্যে।
দেখছি যা ব্যাপার সে নয় কম তর্কের,
মুখে বুলি ওঠে আত্মীয় সম্পর্কের।
পয়লা দলের knave, idiot কি কেবল,
liar সে, humbug, cad unspeakable—
এইমত বাছা বাছা ইংরেজি কটুতা,
প্রকাশ করিতে থাকে দুজনের পটুতা।
অনুচর যারা, তারা খেপে ওঠে কেউ কেউ—
কুকুরটা কী ভেবে যে ডেকে ওঠে ভেউ-ভেউ।
হাওড়ায় ভিড় জমে, দেখে সবে রঙ্গ—
গার্ড্ এসে করে দিল যাত্রাই ভঙ্গ।
গার্ড্কে সেলাম করি, বলি— ভাই, বাঁচালি,
টার্মিনাসেতে এল বেল-ছোঁড়া পাঁচালি।
ঝিনেদার জমিদার বসে বসে পান খায়,
পায়রা আঙিনা জুড়ে খুঁটে খুঁটে ধান খায়।
হেলে দুলে হাঁসগুলো চলে বাঁকা রকমে,
পায়রা জমায় সভা বক্-বক্-বকমে।
উদয়ন
১ মার্চ ১৯৪০