ছন্দ/আমার ছন্দের গতি

আমার ছন্দের গতি

 মনে হয় কবিতা যখন ছাপা হত না তখনই তার স্বরূপ উজ্জ্বল ছিল; কারণ কণ্ঠে আবৃত্তিতেই ছন্দের বিশেষত্ব ভালো করে প্রকাশ পায়। ছাপায় আমরা চোখ দিয়ে কবিতাকে দেখি, তার পংক্তি, গঠন লক্ষ্য করি। মনে মনে ধ্বনি উচ্চারণ করে কবিতাকে সম্ভোগ করতে আমরা আজকাল শিখেছি। কিন্তু কবিতা নিঃশব্দে পড়বার বস্তু নয়, কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়েই তার রূপ ভালো করে প্রকাশ পায়, স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাল্যকালের সেই ইচ্ছাই ছিল স্বাভাবিক— শোনালেই কবিতার সম্পূর্ণ রস পাওয়া যায়, নইলে অভাব ঘটে।...

 অল্পবয়সে প্রথমটা কিছুকাল অন্যের অনুকরণ অবশ্য করেছি। আমাদের বাড়িতে যে কবিদের সমাদর ছিল মনে করতুম তাঁদের মতো কবিতা লিখতে পারলে ধন্য হব। তাই তখনকার প্রচলিত ছন্দ অনুকরণের চেষ্টা অল্পকাল কিছু করেছি। অকস্মাৎ একসময় খাপছাড়া হয়ে কেমন ভাবে নিজের ছন্দে পৌঁছলাম। শুধু এইটুকু মনে আছে, একদিন তেতলার ছাদে স্লেট হাতে, মনটা বিষণ্ণ— কাগজে পেনসিলে নয়, স্লেটে লিখতে, অভ্যাসের পরিবর্তনেই হয়তো ছন্দের একটা পরিবর্তন এল যেটা তৎকালপ্রচলিত নয়, আমি বুঝতে পারলুম এটা আমার নিজস্ব। তারই প্রবল আনন্দে সেই নূতন ধারাতে চললাম। ভয় করিনি।[১] ...

 আমার কাব্যজীবনে দেখছি ক্রমাগত এক পথ থেকে অন্য পথে চলবার প্রবণতা, নদী যেমন করে বাঁক ফেরে। এক-একটা ছন্দ বা ভাবের পর্ব যখন শেষ হয়ে এসেছে বোধ হয় তখন নূতন ছন্দ বা ভাব মনে না এলে আর লিখিইনে।...

 ‘মানসী’তে আবার নূতন ভাঙন লেগেছিল, অন্যপথে চলেছিলাম, ছন্দেরও কতকগুলি বিশেষ ভঙ্গি চেষ্টা করেছিলাম। একথা মনে রাখতে অনুরোধ করি যে কৌতূহলবশত বাহাদুরি নেবার জন্য আমি কখনও নূতন ছন্দ বানাবার চেষ্টা করিনি, সেটা আমার কাছে অদ্ভুত বলে মনে হয়। মানসীতে যে ছন্দের পরিবর্তন এসেছিল সেটা ধ্বনির দিক্ থেকে। লক্ষ্য করেছিলাম, বাংলা কবিতায় জোর পাওয়া যায় না, তার মধ্যে ধ্বনির উচ্চনীচতা নেই, বাংলা কবিতা অতি দ্রুত গড়িয়ে চলে যায়। ইংরেজিতে একসেন্‌ট্, সংস্কৃতে তরঙ্গায়িততা আছে। বাংলায় তা নেই বলেই পূর্বে পয়ারে সুর করে পড়া হত, টেনে টেনে অতিবিলম্বিত করে পড়া হত, তাই অর্থবোধে কষ্ট হত না। লক্ষ্য করেছি বাংলা কবিতা কানের ভিতর ধরে না, বোঝবার সম্ভাবনাও ঝাপসা হয়ে যায়।[২] এর প্রতিকার চাই। বাংলায় দীর্ঘহ্রস্ব উচ্চারণ চালানোটা হাস্যকর, সেটা হাস্যরসেই প্রযুক্ত হতে পারে, যেমন আমার বড়োদাদা চালিয়ে ছিলেন।[৩]

বিলাতে পালাতে ছটফট করে নব্য-গউড়ে।

কিন্তু সাধারণ ব্যবহারে সেটা অচল। এজন্য আমি যুক্তাক্ষরগুলিকে পুরোমাত্রার ওজন দিয়ে ছন্দ রচনা মানসীতে আরম্ভ করেছিলাম। এখন সেটা চলতি হয়ে গেছে; ছন্দের ধ্বনিগাম্ভীর্য তাতে বেড়েছে।[৪] পরে পরে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছি। ‘ক্ষণিকা’ যখন লিখলুম তখন লোকের ধাঁধা লেগে গেল।•••এমনি করে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছি। ‘বলাকা’য় নূতন পর্ব এসেছে, ভাব ভাষা ও ছন্দ নূতন পথে গেছে। দেখেছি কাব্যের নূতন রূপ স্বীকার করে নিতে সময় লাগে, অনভ্যস্ত ধ্বনি ও ভাবের রস গ্রহণে মন স্বভাবতই বিমুখ হয়।•••

 বাংলায় নূতন ছন্দ অনেক আমিই প্রবর্তিত করেছি। একসময় যা রীতিবিরুদ্ধ ছিল আজ সেটাই orthodox, classical হয়ে গেছে। আমার এখনকার কবিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ এই, যা গদ্য তা কখনো কবিতা হতে পারে না।... ভাষার যে একটুখানি আড়াল কাব্যে মাধুর্য জোগায় গদ্যে তার অভাব; গদ্য হচ্ছে কথার ভাষা, খবর দেবার ভাষা। যে ভাষা সর্বদা প্রচলিত নয় তার মধ্যে যে একটা দূরত্ব আছে তারই প্রয়োগে কাব্যের রস জমে ওঠে। অধুনা ‘শেষসপ্তক’ প্রভৃতি গ্রন্থে আমি যে ভাষা, ছন্দ প্রয়োগ করেছি তাকে ‘গদ্য’ বিশেষণে অভিহিত করা হয়েছে। গদ্যের সঙ্গে তার সাদৃশ্য আছে বলে কেউ কেউ তাকে বলেছেন গদ্যকাব্য, সোনার পাথরবাটি। আমি বলি, যাকে সচরাচর আমরা গদ্য বলে থাকি সেটা আর আমার আধুনিক কাব্যের ভাষা এক নয়,[৫] তার একটা বিশেষত্ব আছে যাতে সেটা কাব্যের বাহন হতে পারে; সে ভাষায় ও ভঙ্গিতে কোনো সাপ্তাহিক পত্রিকা লিখিত হলে তার গ্রাহকসংখ্যা কমবেই, বাড়বে না। এর একটা বিশেষত্ব আছে যাকে আমার মন কাব্যের ভাষা বলে স্বীকার করে নিয়েছে। এই ভঙ্গিতে আমি যা লিখেছি, আমি জানি তা অন্য কোনো ছন্দে বলতে পারতুম না।... অনেকে মনে করেন কবিতা লেখা এতে সহজ হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় বাঁধা ছন্দেই তো রচনা হুহু করে চলে, ছন্দই প্রবাহিত করে নিয়ে যায়; কিন্তু যেখানে বন্ধন নেই অথচ ছন্দ আছে, সেখানে মনকে সর্বদা সতর্ক করে রাখতে হয়।

 প্রবাসী—১৩৪৩ আষাঢ়

  1. দ্রষ্টব্য ‘সন্ধ্যাসংগীতএর ছন্দ’ পৃ ১৭৯।
  2. দ্রষ্টব্য পৃ ১৭৩ পাদটীকা ৩, পৃ ২১৬ পাদটীকা ১।
  3. তুলনীয়: আমার বড়োদাদা•••কৌতুক করিয়া পৃ ৫, তার অসংগতি••• মেটাতে পারে পৃ ১২২-২৩। দ্রষ্টব্য পৃ ২০০ পাদটীকা ১।
  4. দ্রষ্টব্য ‘বাংলা ছন্দে যুক্তাক্ষর’ পৃ ১৮১।
  5. তুলনীয়: গদ্য বললে অতিব্যাপ্তি দোষ ঘটে।...তৈজস গদ্য। পৃ ২০৩।