ছন্দ/কৌতুককাব্যের ছন্দ

কৌতুককাব্যের ছন্দ

 পদ্যকে সমিল গদ্যরূপে চালাইবার কোনো হেতু নাই।[১] ইহাতে পদ্যের স্বাধীনতা বাড়ে না, বরঞ্চ কমিয়া যায়। কারণ কবিতা পড়িবার সময় পদ্যের নিয়ম রক্ষা করিয়া পড়িতে স্বতই চেষ্টা জন্মে, কিন্তু মধ্যে মধ্যে যদি স্খলন হইতে থাকে তবে তাহা বাধাজনক ও পীড়াদায়ক হইয়া উঠে।

 বায়রনের ডন জুয়ানে কবি অবলীলাক্রমে যথেচ্ছ কৌতুকের অবতারণা করিয়াছেন। কিন্তু নির্দোষ ছন্দের সুকঠিন নিয়মের মধ্যেই সেই অনায়াস অবলীলাভঙ্গি পাঠককে এরূপ পদে পদে বিস্মিত করিয়া তোলে। ইনগোলডসবি-কাহিনী[২] প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণীর কৌতুককাব্যেও ছন্দের অস্খলিত পারিপাট্য বিশেষরূপে লক্ষিত হয়।

 বস্তুত ছন্দের শৈথিল্যে হাস্যরসের নিবিড়তা নষ্ট করে। কারণ হাস্যরসের প্রধান দুইটি উপাদান অবাধ দ্রুতবেগ ও অভাবনীয়তা। যদি পড়িতে গিয়া ছন্দে বাধা পাইয়া যতিস্থাপন সম্বন্ধে দুই-তিন বার দুই-তিন রকম পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হয় তবে সেই চেষ্টার মধ্যে হাস্যের তীক্ষ্ণতা আপন ধার নষ্ট করিয়া ফেলে।[৩]

 অবশ্য কোনো নূতন ছন্দ প্রথম পড়িতে কষ্ট হয় এবং যাঁহাদের ছন্দে স্বাভাবিক কান নাই তাঁহারা পরের উপদেশ ব্যতীত তাহা কোনো কালেই পড়িতে পারেন না। কিন্তু আলোচ্য ছন্দের প্রধান বাধা তাহার নূতনত্ব নহে। তাহার সর্বত্র এক নিয়ম বজায় থাকে নাই, এইজন্য পড়িতে পড়িতে আবশ্যকমতো কোথাও টানিয়া কোথাও ঠাসিয়া কমি-বেশি করিয়া চলিতে হয়। এমন করিয়া বরঞ্চ মনে মনে পড়া চলে, কিন্তু কাহাকেও পড়িয়া শুনাইতে হইলে পদে পদে অপ্রতিভ হইতে হয়। •••

 অথচ ছন্দের এবং মিলের উপর গ্রন্থকারের যে আশ্চর্য দখল তাহাতে সন্দেহ নাই। উত্তপ্ত লৌহচক্রে হাতুড়ি পড়িতে থাকিলে যেমন স্ফুলিঙ্গবৃষ্টি হইতে থাকে তাঁহার ছন্দের প্রত্যেক ঝোঁকের মুখে তেমনি করিয়া মিলবর্ষণ হইয়াছে। সেই মিলগুলি বন্দুকের ক্যাপের মতো আকস্মিক হস্যোদ্দীপনায় পরিপূর্ণ। ছন্দের কঠিনতাও যে কবিকে দমাইতে পারে না, তাহারও অনেক উদাহরণ আছে। কবি নিজেই তাঁহার অপেক্ষাকৃত পরবর্তী রচনাগুলিকে নিয়মিত ছন্দের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে স্থায়িত্ব এবং উপযুক্ত মর্যাদা দান করিয়াছেন। তাঁহার ‘বাঙালিমহিমা’, ‘ইংরেজস্তোত্র’, ‘ডিপুটিকাহিনী’ ও ‘কর্ণবিমর্দন’ সর্বত্র উদ্ধৃত, পঠিত ও ব্যবহৃত হইবার পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল হইয়াছে। এই লেখাগুলির মধ্যে যে সুনিপুণ হাস্য ও সুতীক্ষ্ণ বিদ্রূপ আছে তাহা শাণিত সংযত ছন্দের মধ্যে সর্বত্র ঝকঝক করিতেছে।

 ভারতী—১৩০৫ অগ্রহায়ণ

  1. এই রচনাংশটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘আষাঢ়ে’ (১৩০৫) কাব্যের ছন্দ-সমালোচনা। উক্ত কাব্যের ভূমিকার গ্রন্থকার লিখেছেন, “এ-কবিতাগুলির...ছন্দোবব্ধ অতীব শিথিল। ইহাকে সমিল গদ্য নামেই অভিহিত করা সংগত”।
  2. বস্তুত ‘আষাঢ়ে’র কবিতাগুলি Rev. R. A. Burham রচিত Ingoldsby Legends-এর অনুকরণেই লেখা। দ্রষ্টব্য নবকৃষ্ণ ঘোষের ‘দ্বিজেন্দ্রলাল’, একাদশ পরিচ্ছেদ।
  3. তুলনীয়: কোন্‌খানে হাঁপ ছাড়িতে হইবে...বাহির করিতে হয় পৃ ১৭০।