ছন্দ/ছন্দের প্রকৃতি
ছন্দের প্রকৃতি
আমাদের দেহ বহন করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভার, আর তাকে চালন করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গতিবেগ; এই দুই বিপরীত পদার্থ যখন পরস্পর মিলনে লীলায়িত হয় তখন জাগে নাচ। দেহের ভারটাকে দেহের গতি নানা ভঙ্গিতে বিচিত্র করে, জীবিকার প্রয়োজনে নয়, সৃষ্টির অভিপ্রায়ে; দেহটাকে দেয় চলমান শিল্পরূপ। তাকে বলি নৃত্য।
রূপসৃষ্টির প্রবাহই তো বিশ্ব। সেই রূপটা জাগে ছন্দে, আধুনিক পরমাণুতত্ত্বে সে কথা সুস্পষ্ট। সাধারণ বিদ্যুৎপ্রবাহ আলো দেয়, তাপ দেয়, তার থেকে রূপ দেখা দেয় না। কিন্তু বিদ্যুৎকণা যখন বিশেষ সংখ্যায় ও গতিতে আমাদের চৈতন্যের দ্বারে ঘা মারে তখনি আমাদের কাছে প্রকাশ পায় রূপ, কোনোটা দেখা দেয় সোনা হয়ে, কোনোটা হয় সীসে। বিশেষসংখ্যক মাত্রা ও বিশেষবেগের গতি এই দুই নিয়েই ছন্দ, সেই ছন্দের মায়ামন্ত্র না পেলে রূপ থাকে অব্যক্ত। বিশ্বসৃষ্টির এই ছন্দোরহস্য মানুষের শিল্পসৃষ্টিতে। তাই ঐতরেয় ব্রাহ্মণ বলছেন, শিল্পানি শংসন্তি দেবশিল্পানি। মানুষের সব শিল্পই দেবশিল্পের স্তবগান করছে। এতেষাং বৈ শিল্পানামনুকৃতীহ শিল্পম্ অধিগম্যতে। মানবলোকের সব শিল্পই এই দেবশিল্পের অনুকৃতি, অর্থাৎ বিশ্বশিল্পের রহস্যকেই অনুসরণ করে মানবশিল্প। সেই মূলরহস্য ছন্দে, সেই রহস্য আলোকতরঙ্গে, শব্দতরঙ্গে, রক্ততরঙ্গে, স্নায়ুতন্তুর বৈদ্যুততরঙ্গে।
মানুষ তার প্রথম ছন্দের সৃষ্টিকে জাগিয়েছে আপন দেহে। কেননা তার দেহ ছন্দরচনার উপযোগী। ভূতলের টান থেকে মুক্ত করে দেহকে সে তুলেছে ঊর্ধ্ব দিকে। চলমান মানুষের পদেপদেই ভারসাম্যের অপ্রতিষ্ঠতা, unstable equilibrium। এতেই তার বিপদ্, এতেই তার সম্পদ। চলার চেয়ে পড়াই তার পক্ষে সহজ। ছাগলের ছানা চলা নিয়েই জন্মেছে, মানুষের শিশু চলাকে আপনি সৃষ্টি করেছে ছন্দে। সামনে-পিছনে ডাইনে-বাঁয়ে পায়েপায়ে দেহভারকে মাত্রাবিভক্ত করে ওজন বাঁচিয়ে তবেই তার চলা সম্ভব হয়। সেটা সহজ নয়, মানবশিশুর চলার ছন্দসাধনা দেখলেই তা বোঝা যায়। যে-পর্যন্ত আপন ছন্দকে সে আপনি উদ্ভাবন না করে সে-পর্যস্ত তার হামাগুড়ি। অর্থাৎ ভারাকর্ষণের কাছে তার অবনতি, সে-পর্যন্ত সে নৃত্যহীন।
চতুষ্পদ জন্তুর নিত্যই হামাগুড়ি। তার চলা মাটির কাছে হার মেনে চলা। লাফ দিয়ে যদিবা সে উপরে ওঠে, পরক্ষণেই মাটির দরবারে ফিরে এসেই তার মাথা হেঁট। বিদ্রোহী মানুষ মাটির একান্ত শাসন থেকে দেহভারকে মুক্ত করে নিয়ে তাতেই চালায় প্রয়োজনের কাজ এবং অপ্রয়োজনের লীলা। ভূমির টানের বিরুদ্ধে ছন্দের সাহায্যে তার এই জয়লব্ধ শক্তি।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণ বলছেন, আত্মসংস্কৃতির্বাব শিল্পানি। শিল্পই হচ্ছে আত্মসংস্কৃতি। সম্যক্ রূপদানই সংস্কৃতি, তাকেই বলে শিল্প। আত্মাকে সুসংযত করে মানুষ যখন আত্মার সংস্কার করে, অর্থাৎ তাকে দেয় সম্যক্ রূপ, সেও তো শিল্প। মানুষের শিল্পের উপাদান কেবল তো কাঠপাথর নয়, মানুষ নিজে। বর্বর অবস্থা থেকে মানুষ নিজেকে সংস্কৃত করেছে। এই সংস্কৃতি তার স্বরচিত বিশেষ ছন্দোময় শিল্প। এই শিল্প নানা দেশে, নানা কালে, নানা সভ্যতায়, নানা আকারে প্রকাশিত, কেননা বিচিত্র তার ছন্দ। ছন্দোময়ং বা এতৈর্যজমান আত্মানং সংস্কুরুতে। শিল্পযজ্ঞের যজমান আত্মাকে সংস্কৃত করেন, তাকে করেন ছন্দোময়।
যেমন মানুষের আত্মার তেমনি মানুষের সমাজেরও প্রয়োজন ছন্দোময় সংস্কৃতি। সমাজও শিল্প। সমাজে আছে নানা মত, নানা ধর্ম, নানা শ্রেণী। সমাজের অন্তরে সৃষ্টিতত্ত্ব যদি সক্রিয় থাকে, তাহলে সে এমন ছন্দ উদ্ভাবন করে যাতে তার অংশ-প্রত্যংশের মধ্যে কোথাও ওজনের অত্যন্ত বেশি অসাম্য না হয়। অনেক সমাজ পঙ্গু হয়ে আছে ছন্দের এই ত্রুটিতে, অনেক সমাজ মরেছে ছন্দের এই অপরাধে। সমাজে যখন হঠাৎ কোনো একটা সংরাগ অতিপ্রবল হয়ে ওঠে তখন মাতাল সমাজ পা ঠিক রাখতে পারে না, ছন্দ থেকে হয় ভ্রষ্ট। কিংবা যখন এমন সকল মতের, বিশ্বাসের ব্যবহারের বোঝা অচল হয়ে কাঁধে চেপে থাকে, যাকে ছন্দ বাঁচিয়ে সম্মুখে বহন করে চলা সমাজের পক্ষে অসম্ভব হয়, তখন সেই সমাজের পরাভব ঘটে। যেহেতু জগতের ধর্ম ই চলা, সংসারের ধর্ম স্বভাবতই সরতে থাকা, সেইজন্যেই তার বাহন ছন্দ। যে গতি ছন্দ রাখে না, তাকেই বলে দুর্গতি।
মানুষের ছন্দোময় দেহ কেবল প্রাণের আন্দোলনকে নয় তার ভাবের আন্দোলনকেও যেমন সাড়া দেয়, এমন আর কোনো জীবে দেখিনে। অন্য জন্তুর দেহেও ভাবের ভাষা আছে কিন্তু মানুষের দেহভঙ্গির মতো সে ভাষা চিন্ময়তা লাভ করেনি, তাই তার তেমন শক্তি নেই, ব্যঞ্জনা নেই।
কিন্তু এই যথেষ্ট নয়। মানুষ সৃষ্টিকর্তা। সৃষ্টি করতে গেলে ব্যক্তিগত তথ্যকে দাঁড় করাতে হয় বিশ্বগত সত্যে। সুখদুঃখ রাগবিরাগের অভিজ্ঞতাকে আপন ব্যক্তিগত ঐকান্তিকতা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সেটাকে রূপসৃষ্টির উপাদান করতে চায় মানুষ। ‘আমি ভালোবাসি’, এই কথাটিকে ব্যক্তিগত ভাষায় প্রকাশ করা যেতে পারে ব্যক্তিগত সংবাদ বহন করবার কাজে। আবার ‘আমি ভালোবাসি’, এই কথাটিকে ‘আমি’ থেকে স্বতন্ত্র করে সৃষ্টির কাজে লাগানো যেতে পারে যে-সৃষ্টি সর্বজনের, সর্বকালের। যেমন সাজাহানের বিরহশোক দিয়ে সৃষ্ট হয়েছে তাজমহল, সাজাহানের সৃষ্টি অপরূপ ছন্দে অতিক্রম করেছে ব্যক্তিগত সাজাহানকে।
নৃত্যকলার প্রথম ভূমিকা দেহচাঞ্চল্যের অর্থহীন সুষমায়। তাতে কেবলমাত্র ছন্দের আনন্দ। গানেরও আদিম অবস্থায় একঘেয়ে তালে একঘেয়ে সুরের পুনরাবৃত্তি; সে কেবল তালের নেশা-জমানো, চেতনাকে ছন্দের দোল-দেওয়া। তার সঙ্গে ক্রমে ভাবের দোলা মেশে। কিন্তু এই ভাবব্যক্তি যখন আপনাকে ভোলে, অর্থাৎ ভাবের প্রকাশটাই যখন লক্ষ্য না হয়, তাকে উপলক্ষ্য করে রূপসৃষ্টিই হয় চরম, তখন নাচটা হয় সর্বজনের ভোগ্য; সেই নাচটা ক্ষণকালের পরে বিস্মৃত হলেও যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ তার রূপে চিরকালের স্বাক্ষর লাগে।
নাচতে দেখেছি সারসকে। সেই নাচকে কেবল আঙ্গিক বলা যায় না, অর্থাৎ টেক্নিকেই তার পরিশেষ নয়। আঙ্গিকে মন নেই, আছে নৈপুণ্য। সারসের নাচের মধ্যে দেখেছি ভাব এবং তার চেয়েও আরো কিছু বেশি। সারস যখনি মুগ্ধ করতে চেয়েছে আপন দোসরকে, তখনি তার মন সৃষ্টি করতে চেয়েছে নৃত্যভঙ্গির সংস্কৃতি, বিচিত্র ছন্দের পদ্ধতি। সারসের মন আপন দেহে এই নৃত্যশিল্প রচনা করতে পেরেছে, তার কারণ তার দেহভারটা অনেক মুক্ত।
কুকুরের মনে আবেগের প্রবলতা যথেষ্ট, কিন্তু তার দেহটা বন্ধক দেওয়া মাটির কাছে। মুক্ত আছে কেবল তার ল্যাজ। ভাবাবেগের চাঞ্চল্যে কুক্কুরীয় ছন্দে ঐ ল্যাজটাতেই চঞ্চল হয় তার নৃত্য, দেহ আঁকুবাকু করে বন্দীর মতো।
মানুষের সমগ্র মুক্তদেহ নাচে, নাচে মানুষের মুক্তকণ্ঠের ভাষা। তাদের মধ্যে ছন্দের সৃষ্টিরহস্য যথেষ্ট জায়গা পায়। সাপ অপদস্থ জীব, মানুষের মতো পদস্থ নয়। সমস্ত দেহ সে মাটিকে সমর্পণ করে বসেছে। সে কখনো নিজে নাচে না। সাপুড়ে তাকে নাচায়। বাহিরের উত্তেজনায় ক্ষণকালের জন্য দেহের এক অংশকে সে মুক্ত করে নেয়, তাকে দোলায় ছন্দে। এই ছন্দ সে পায় অন্যের কাছ থেকে, এ তার আপন ইচ্ছার ছন্দ নয়। ছন্দ মানেই ইচ্ছা।[১] মানুষের ভাবনা রূপগ্রহণের ইচ্ছা করেছে নানা শিল্পে, নানা ছন্দে। কত বিলুপ্ত সভ্যতার ভগ্নাবশেষে বিস্মৃত যুগের ইচ্ছার বাণী আজও ধ্বনিত হচ্ছে তার কত চিত্রে, জলপাত্রে, কত মূর্তিতে। মানুষের আনন্দময় ইচ্ছা সেই ছন্দোলীলার নটরাজ, ভাষায় ভাষায় তার সাহিত্যে সেই ইচ্ছা নব নব নৃত্যে আন্দোলিত।
মানুষের সহজ চলায় অব্যক্ত থাকে নৃত্য, ছন্দ যেমন প্রচ্ছন্ন থাকে গদ্যভাষায়। কোনো মানুষের চলাকে বলি সুন্দর, কোনোটাকে বলি তার উলটো। তফাতটা কিসে। সে কেবল একটা সমস্যাসমাধান নিয়ে। দেহের ভার সামলিয়ে দেহের চলা একটা সমস্যা। ভারটাই যদি অত্যন্ত প্রত্যক্ষ হয়, তাহলেই অসাধিত সমস্যা প্রমাণ করে অপটুতা। যে চলায় সমস্যার সমুৎকৃষ্ট মীমাংসা সেই চলাই সুন্দর।
পালে-চলা নৌকো সুন্দর, তাতে নৌকোর ভারটার সঙ্গে নৌকোর গতির সম্পূর্ণ মিলন; সেই পরিণয়ে শ্রী উঠেছে ফুটে, অতিপ্রয়াসের অবমান হয়েছে অন্তর্হিত। এই মিলনেই ছন্দ। দাঁড়ি দাঁড় টানে, সে লগি ঠেলে, কঠিন কাজের ভারটাকে সে কমিয়ে আনে কেবল ছন্দ রেখে। তখন কাজের ভঙ্গি হয় সুন্দর। বিশ্ব চলেছে প্রকাণ্ড ভার নিয়ে বিপুল দেশে নিরবধি কালে সুপরিমিতির ছন্দে। এই সুপরিমিতির প্রেরণায় শিশিরের ফোঁটা থেকে সূর্যমণ্ডল পর্যন্ত সুগোল ছন্দে গড়া। এইজন্যেই ফুলের পাপড়ি সুবঙ্কিম, গাছের পাতা সুঠাম, জলের ঢেউ সুডোল।
জাপানের ফুলদানিতে ফুল সাজাবার একটি কলাবিদ্যা আছে। যেমন-তেমন আকারে পুঞ্জীকৃত পুষ্পিত শাখায় বস্তুভারটাই প্রত্যক্ষ; তাকে ছন্দ দিয়ে যেই শিল্প করা যায় তখন সেই ভারটা হয় অগোচর, হালকা হয়ে গিয়ে অন্তরে প্রবেশ করে সহজে।
প্রাচীন জাপানের একজন বিখ্যাত বীর এই ফুলসাজানো দেখতে ভালোবাসতেন। তিনি বলতেন এই সজ্জাপ্রকরণ থেকে তাঁর মনে আসত আপন যুদ্ধব্যবসায়ের প্রেরণা। যুদ্ধও ছন্দে-বাঁধা শিল্প, ছন্দের সমুৎকর্ষ থেকেই তার শক্তি। এই কারণেই লাঠি খেলাও নৃত্য।
জাপানে দেখেছি চা-উৎসব। তাতে চা-তৈরি, চা-পরিবেষণের প্রত্যেক অংশই সযত্ন-সুন্দর। তার তৎপর্য এই যে, কর্মের সৌষ্ঠব এবং কর্মের নৈপুণ্য একসঙ্গে গাঁথা। গৃহিণীপনা যদি সত্য হয় তাকে সুন্দর হতেই হবে, অকৌশল ধরা পড়ে কুশ্রীতায়, কর্মের ও লোক-ব্যবহারের ছন্দোভঙ্গে। ভাঙা ছন্দের ছিদ্র দিয়েই লক্ষ্মী বিদায় নেন।
এতক্ষণ ছন্দকে দেখা গেল নৃত্যে। কেননা ছন্দের প্রথম উল্লাস মানুষের বাক্যহীন দেহেই। তারপরে দেহের ইশারা মেলে ভাষার ইশারায়। এবার ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যাক ছন্দকে।
সেই একই কথা, ভার আর গতি, সেই দুইয়ের যোগে ওজন বাঁচিয়ে চলা। জন্তুর আওয়াজের পরিধি কতটুকুই বা; তাতে জোর থাকতে পারে কিন্তু ভার সামান্য। কুকুর যতই ডাকুক, শেয়াল যতই চেঁচাক, ধ্বনির ওজন বাঁচিয়ে চলবার সমস্যা তাদের নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু আভাস পাওয়া যায়। গাধার ’পরে অবিচার করতে চাইনে। সে শুধু পরের ময়লা কাপড় বহন করে তা নয়, এ-পর্যন্ত কণ্ঠস্বর সম্বন্ধে আপন প্রভূত অখ্যাতি বহন করে এসেছে। কিন্তু যখনি সে নিজের ডাককে দীর্ঘায়িত করে, তখনি পর্যায়ে পর্যায়ে তাকে ধ্বনির ওজন ভাগ করতে হয়। নিজের ব্যবসায়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে এই ব্যাপারকে ছন্দ বলতে কুণ্ঠিত হচ্ছি; কিন্তু আর কী বলব জানিনে।
মানুষকে বহন করতে হয় ভাষার সুদীর্ঘতা। প্রলম্বিত ভাষার ওজন তাকে রাখতেই হয়। মানুষের সেই বাক্যের সঙ্গে তার গানের সুর যখন মিশল, তখন গীতিকলা হল দীর্ঘায়ত। নানাবিধ তাল নিযুক্ত হয়েছে তার ভার বইতে। কিন্তু তাল অর্থাৎ ছন্দকে কেবল ভারবাহক বললে চলবে না। সে তো ধ্বনিভারের ঝাঁকামুটে নয়। ভারগুলিকে নানা আয়তনে বিভক্ত করে যেই সে তাকে গতি দেয়, অমনি রূপ নিয়ে সংগীত আমাদের চৈতন্যকে আঘাত করে। ভাষা অবলম্বন করে যখন আমরা খবর দিতে চাই তখন বিবরণের সত্যতা রক্ষা করাই আমাদের একমাত্র দায়িত্ব; কিন্তু যখন রূপ দিতে চাই তখন সত্যতার চেয়ে বেশি আবশ্যক হয় ছন্দের।
‘একদা এক বাঘের গলায় হাড় ফুটিয়াছিল’, এটা নিছক খবর। গল্প হিসাবে বা ঘটনা হিসাবে সত্য হলে এর আর কোনোই জবাবদিহি নেই। কিন্তু গলায় হাড়বেঁধা জন্তুটার ল্যাজ যদি প্রত্যক্ষভাবে চৈতন্যের মধ্যে আছড়িয়ে নিতে চাই তবে ভাষায় লাগাতে হবে ছন্দের মন্ত্র।
বিদ্যুৎ-লাঙ্গুল করি ঘন তর্জন
বজ্রবিদ্ধ মেঘ করে বারি বর্জন।
তদ্রূপ যাতনায় অস্থির শার্দুল
অস্থিবিদ্ধগলে করে ঘোর গর্জন।
কাব্যসাহিত্য কেবল রসসাহিত্য নয়, তা রূপসাহিত্য। সাধারণত ভাষায় শব্দগুলি অর্থবহন করে, কিন্তু ছন্দে তারা রূপগ্রহণ করে।
ছন্দ সম্বন্ধে এই গেল আমার সাধারণ বক্তব্য। বিশ্বের ভাষায় মানুষের ভাষায় রূপ দেওয়া তার কাজ। এখন বাংলা কাব্যছন্দ সম্বন্ধে বিশেষভাবে কিছু বলবার চেষ্টা করা যাক।
২
[সবচেয়ে সহজ ও প্রাথমিক ছন্দ হচ্ছে দুই ধ্বনিমাত্রার দুই পদপাতন। ছাত্র-অবস্থায় তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’। আমার ঘরের কাছে মেহেদি গাছের বেড়া। খবর নিতে গেলেম তার ছন্দটা কী। দেখি ডাঁটার ডাইনে একটি পাতা বাঁয়ে একটি পাতা, তার পরেই একটি যতি। এই তো সমান ভাগে দুই মাত্রার ছন্দ। দ্বিপদীর চাল।[২] অন্যগাছে অন্যমাত্রার ছন্দ। যেমন শিমুল গাছ ছাতিম গাছ। এক সময়ে বনচ্ছায়ায় যখন গাছের অলংকারশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি তখন তাদের ছন্দের খবর কিছু আদায় করতে পেরেছিলেম।]
দুই মাত্রা বা দুই মাত্রার গুণক নিয়ে যেসব ছন্দ তারা পদাতিক; বোঝা সামলিয়ে ধীরপদক্ষেপে তাদের চাল। এই জাতের ছন্দকে পয়ারশ্রেণীয় বলব। সাধারণ পয়ারে প্রত্যেক পংক্তিতে দুটি করে ভাগ, ধ্বনির মাত্রা ও যতির মাত্রা মিলিয়ে প্রত্যেক ভাগে আটটি করে মাত্রা, সুতরাং সমগ্র পয়ারের ধ্বনিমাত্রাসংখ্যা চোদ্দ এবং তার সঙ্গে মিলেছে যতিমাত্রাসংখ্যা দুই, অতএব সর্বসমেত ষোল মাত্রা।
বচন নাহি তো মুখে | তবু মুখখানি • •
হৃদয়ের কানে বলে | নয়নের বাণী • •।
আট মাত্রার উপর ঝোঁক না রেখে প্রত্যেক দুই মাত্রার উপর ঝোঁক যদি রাখি তবে সেই দুলকি চালে পয়ারের পদমর্যাদার লাঘব হয়।
কেন | তার | মুখ | ভার | বুক | ধুক | ধুক | • •,
চোখ | লাল | লাজে | গাল | রাঙা | টুক | টুক | • •।
অথবা প্রত্যেক চার মাত্রায় ঝোঁক দিয়ে পয়ার পড়া যেতে পারে। যমন—
সুনিবিড় | শ্যামলতা | উঠিয়াছে | জেগে • •
ধরণীর | বনতলে | গগনের | মেঘে • •।
ছন্দের দুটি জিনিস দেখবার আছে— এক হচ্ছে তার সমগ্র অবয়ব, আর তার সংঘটন। পয়ারের অবয়বের মাত্রাসমষ্টি ষোল সংখ্যায়। এই ষোল মাত্রা সংঘটিত হয়েছে দুই মাত্রার অংশযোজনায়। ধ্বনিরূপসৃষ্টিতে ‘দুই’ সংখ্যার একটি বিশেষ প্রভাব আছে, ‘তিন’ সংখ্যা থেকে তা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। দৃষ্টান্ত দেখাই।
শ্রাবণ-ধারে সঘনে
কাঁদিয়া মরে যামিনী,
ছোটে তিমির-গগনে
পথহারানো দামিনী।
এই ছন্দটির সমগ্র অবয়ব ষোল মাত্রায়। সেই ষোল মাত্রাটি সংঘটিত হচ্ছে তিন-দুই তিন মাত্রার যোগে, এইজন্যেই পয়ারের মতো এর চালচলন নয়। যে আট মাত্রা দুইয়ের অংশ নিয়ে সে চলে সোজা সোজা পা ফেলে, কিন্তু যে আট মাত্রা তিন-দুই-তিনের ভাগে সে চলছে হেলতে দুলতে মরালগমনে।
চেয়ে থাকে মুখপানে,
সে চাওয়া নীরব গানে
মনে এসে বাজে,
যেন ধীর ধ্রুবতারা
কহে কথা ভাবাহারা
জনহীন সাঁঝে।
যতিমাত্রাসমেত চব্বিশ মাত্রায় এই ত্রিপদীর অবয়ব। এই চব্বিশ মাত্রা দুই মাত্রাখণ্ডের সমষ্টি, এইজন্যেই একে পয়ারশ্রেণীতে গণ্য করব।
রিমিঝিমি বরিষে শ্রাবণধারা
ঝিল্লি ঝনকিছে ঝিনি ঝিনি;
দুরু দুরু হৃদয়ে বিরামহারা
তাকায়ে পথপানে বিরহিণী।
এ-ছন্দেরও অবয়ব চব্বিশ মাত্রায়। কিন্তু এর গড়ন স্বতন্ত্র; এর অংশগুলি দুই-তিনের মিশ্রিত মাত্রা।
পয়ার ছন্দের বিশেষ গুণ এই যে, তার বুনোনি ঠাসবুনোনি নয়, তাকে বাড়ানো-কমানো[৩] যায়। সুর করে টেনে টেনে পড়বার সময়, কেউ যদি যতির যোগে পয়ারের প্রথম ভাগে দশ ও শেষ ভাগে আট মাত্রা পড়ে তবু পয়ারের প্রকৃতি বজায় থাকে। যেমন—
মহাভারতের কথা • • | অমৃত-সমান • •
কাশীরাম দাস ভণে • • | শুনে পুণ্যবান্ • •।
অথবা
মহা • • ভারতের কথা • •| অমৃত • • সমা • •ন।
কাশীরা • • ম দাস ভণে • •| শুনে • • পুণ্যবা • • ন্।
পয়ার ছন্দ স্থিতিস্থাপক বলেই এটা সম্ভব, আর সেই গুণেই বাংলা কাব্যসাহিত্যকে সে এমন করে অধিকার করেছে।
[যাকে ‘মহাপয়ার’ নাম দেওয়া যায় সেটা পয়ারশ্রেণীর সবচেয়ে প্রশস্ত ছন্দ। সেই ছন্দ আমার পূজনীয় অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথের সৃষ্টি। আঠার মাত্রায় এর অবয়ব, এর প্রত্যেক পংক্তির প্রথম ভাগে আট মাত্রা, দ্বিতীয় ভাগে দশ মাত্রা। তাঁরি কাব্য থেকে দৃষ্টান্ত দেখাই।
গম্ভীর পাতাল যথা কালরাত্রি করালবদনা
বিস্তারে একাধিপত্য, শ্বসয়ে অযুত ফণিফণা
দিবানিশি ফাটি রোষে। ঘোর নীল বিবর্ণ অনল
শিখাসংঘ আলোড়িয়া দাপাদাপি করে দেশময়
তমোহস্ত এড়াইতে, প্রাণ যথা কালের কবল।[৪]
স্থিতিস্থাপকতা ছাড়া পয়ারজাতীয় ছন্দের আর দুটি মহদ্গুণ আছে। এক তার ভারবহনশক্তি,[৫] আর তার গাম্ভীর্য। যাকে ধ্বনিমাত্রা বলি তার আছে সরু-মোটা ভেদ। ‘চন্দনচর্চিত’ শব্দটা অক্ষরগণনায় আট মাত্রা, অন্তত সংস্কৃত ছন্দে তার এই ওজনই পাকা। দুর্বল বাহনের পিঠে চড়ালেই ওজনের কমি-বেশি পড়ে ধরা।]
তিন-তিন মাত্রায় যার গ্রন্থিযোজনা এমন একটি ছন্দের দৃষ্টান্ত দেখাই।
আঁখির পাতায় নিবিড় কাজল
গলিছে নয়ন-সলিলে।
অক্ষরসংখ্যা সমান রেখে এই দুটো পদে যুক্তবর্ণ যদি চড়াই তাহলে সেটা কেমন হয়, যেমন এক-এক সময়ে দেখা যায় জোয়ান পুরুষ ক্ষীণ স্ত্রীর ঘাড়ে বোঝা চাপিয়ে পথে চলে নির্মমভাবে। প্রমাণ দিই।
চক্ষুর পল্লবে নিবিড় কজ্জল
গলিছে অশ্রুর নির্ঝরে।
কিন্তু এই বোঝা পয়ারজাতীয় পালোয়ানের স্কন্ধে চাপালে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকবে না। প্রথমে বিনা-বোঝার চালটা দেখানো যাক।
শ্রাবণের কালো ছায়া নেমে আসে তমালের বনে
যেন দিক্-ললনার গলিত কাজল-বরিষনে।
এইটিকে গুরুভার করে দিই।
বর্ষার তমিস্রচ্ছায়া ব্যাপ্ত হল অরণ্যের তলে
যেন অশ্রুসিক্তচক্ষু দিগ্বধূর গলিত কজ্জলে।
এতটা ভারবৃদ্ধি যে সম্ভব হয় তার কারণ পয়ার স্থিতিস্থাপক।
[একদিন এই তত্ত্বটি বিশেষ করে আমার গোচর হয়েছিল, তার ইতিহাসটা বলি।
সংস্কৃত ভাষায় প্রত্যেক শব্দেই দীর্ঘহ্রস্বধ্বনির অসাম্য, ইংরেজি ভাষায় ধ্বনির অসমানতা তার এক্সেন্ট্বিদ্ধ শব্দে। মসৃণপথে তারা গড়গড় করে গড়িয়ে যায় না, ধাক্কা দিতে দিতে মনের মধ্যে দাগ রেখে রেখে চলে। বাংলাভাষায় রেলপাতা পথে ঠেলাগাড়ির মতো শব্দগুলোকে এক ঝোঁকে আট-দশ মাত্রা অনায়াসে পিছলিয়ে নিয়ে যাওয়া চলে, মনের মধ্যে তারা জোরে দাগ কাটে না; যথেষ্ট সময় পায় না নিজেকে বিশেষ করে জানান দেবার।[৬] এই ত্রুটি লাঘব করবার জন্যে মাইকেল তাঁর অমিত্রাক্ষর ছন্দে যুক্তবর্ণের ধ্বনি পদে পদে ঝংকৃত করে পয়ারের একটানা চালের মধ্যে শক্তিসঞ্চার করেছিলেন। সাধারণ পয়ারে এই শক্তির সম্ভাবনা কতদূর পর্যন্ত পৌঁছয় সে তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন। তৎসত্ত্বেও তাঁর অনবধানতা ‘মেঘনাদবধ’কাব্যের আরম্ভেই প্রকাশ পেয়েছে।
সম্মুখ-সময়ে পড়ি বীরচূড়ামণি
বীরবাহু চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ হে দেবি অমৃতভাষিণি,
কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতিপদে
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি
রাঘবারি।
এতগুলি পংক্তির আরম্ভে ও শেষে দুটিমাত্র যুক্তবর্ণের ধাক্কা। এর সঙ্গে ‘প্যারাডাইস্ লস্ট্’এর সূচনা মিলিয়ে দেখলে প্রভেদ স্পষ্ট হবে।
একদিন তৎকালপ্রচলিত বাংলা ছন্দের ক্ষীণতা-প্রতিকারের উপায় আমাকে ভাবতে হয়েছিল। সংস্কৃতের অনুকরণে বাংলা স্বরবর্ণে হ্রস্বদীর্ঘতার প্রচলন করতে গেলে এই কৃত্রিমতা বেশিক্ষণ সয় না। তার অসংগতি অধিকাংশ স্থলে ব্যঙ্গকাব্যেরই প্রয়োজন মেটাতে পারে। যথা—
বিলাতে পালাতে ছটফট করে নব্য গউড়ে
অরণ্যে যে-জন্যে গৃহগবিহগপ্রাণ দউড়ে।
স্বদেশে কাঁদে সে, গুরুজনবশে কিচ্ছু হয় না,
বিনা হ্যাট্টা কোট্টা ধুতি-পিরহনে মান রয় না।[৭]
‘মানসী’ লেখবার সময় আমার মনে প্রথম সংকল্প এল যে, যুক্তধ্বনিকে দুই মাত্রার গৌরব দিয়ে ছন্দকে ধ্বনিবন্ধুর করব।[৮] সকলেই জানেন বাংলা ছন্দে যুক্তবর্ণ তখন ঐকমাত্রিক শ্রেণীতে গণ্য ছিল। সেই জন্যেই ‘বদনমণ্ডলে ভাসিছে ব্রীড়া’ এমনতরো লাইনের সৃষ্টিতেও কবির সংকোচ ছিল না।[৯]
প্রথমত সেদিন যুক্তবর্ণকে পয়ারেও দিলেম দুই মাত্রার আসন।[১০] লিখলেম
নিম্নে যমুনা বহে স্বচ্ছশীতল,
ঊর্ধ্বে পাষাণতট শ্যাম শিলাতল।
অনতিকাল পরেই বোঝা গেল পয়ারের উপর এ-আইন চালাবার কোনোই প্রয়োজন নেই। বিনা বাধায় লেখা যেতে পারে
উন্মত্ত যমুনা বহে, আবর্তিত জল
দুর্গম শৈলের তটে উদ্দাম উচ্ছল।
যদি লেখা যায়
হিমালয় নামে গিরি নগ-অধিরাজ
তাহলে হিমালয়ের মতো অত বড়ো পদার্থেরও উপর মন চলে যায় ঘুমিয়ে-পড়া গাড়োয়ানকে নিয়ে রাতের বেলার গোরুর গাড়ির মতো। কিন্তু ঐ পয়ারেই লেখা চলে
বিখ্যাত হিমাদ্রি নামে শৈল-অধিরাজ।
এ-লাইনে হিমালয়ের মানরক্ষা হতে পারে।]
যেমন দুইমাত্রামূলক পয়ার তেমনি তিনমাত্রামূলক ছন্দও বাংলাদেশে অনেককাল থেকে প্রচলিত। পয়ারের ব্যবহার প্রধানত আখ্যানে, রামায়ণ-মহাভারত-মঙ্গলকাব্য প্রভৃতিতে। তিনমাত্রামূলক ছন্দ গীতিকাব্যে, যেমন বৈষ্ণব পদাবলীতে।[১১]
পূর্বেই বলেছি পয়ারের চাল পদাতিকের চাল, পা ফেলে ফেলে চলে।
অভিসার যাত্রাপথে হৃদয়ের ভার
পদে পদে দেয় বক্ষে ব্যথার ঝংকার।
এই পা ফেলে চলার মাঝে মাঝে যতি পাওয়া যায় যথেষ্ট, ইচ্ছা করলে তাকে বাড়ানো-কমানো চলে। কিন্তু তিনমাত্রার তালটা যেন গোল গড়নের, গড়িয়ে চলে।[১২] পরস্পরকে ঠেলে নিয়ে দৌড় দেয়।
চলিতে চলিতে চরণে উছলে
চলিবার ব্যাকুলতা,
নূপুরে নূপুরে বাজে বনতলে
মনের অধীর কথা।
এইজন্যে মাত্রা যদি কোথাও তিনের মাপের একটু বেশি হয় এ-ছন্দ তাকে প্রসন্নমনে জায়গা দিতে পারে না। দায়ে পড়ে এই অত্যাচার কখনো করিনি এমন কথা বলতে পারব না।
প্রভু বুদ্ধ লাগি আমি ভিক্ষা মাগি,
ওগো পুরবাসী, কে রয়েছ জাগি,
অনাথপিণ্ডদ কহিলা অম্বুদ—
নিনাদে।
এ-কথা বোঝা শক্ত নয় যে, ‘অনাথপিণ্ডদ’ নামটার খাতিরে নিয়ম রদ করেছিলেম। গার্ড এসে গাড়ির কামরায় বরাদ্দর বেশি মানুষকে ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়েছে, ঘুষ খেয়ে থাকবে কিংবা আগন্তুক ভারি দরের।
সেকালে অক্ষরগনতিকরা তিনমাত্রামূলক ছন্দে যুক্তধ্বনি বর্জন করে চলতুম। কিন্তু তাতে রচনায় অতিলালিত্যের দুর্বলতা এসে পৌঁছত।[১৩] সেটা যখন আমার কাছে বিরক্তিকর হল তখন যুক্তধ্বনির শরণ নিলুম। ছন্দটা একদিন ছিল যেন নবনী দিয়ে গড়া।
বরষার রাতে জলের আঘাতে
পড়িতেছে যুথী ঝরিয়া,
পরিমলে তারি সজল পবন
করুণায় উঠে ভরিয়া।
এই দুর্বলতার মধ্যে যুক্তবর্ণ এসে দেখা দিল।
নববর্ষার বারিসংঘাতে
পড়ে মল্লিকা ঝরিয়া,
সিক্তপবন সুগন্ধে তারি
কারুণ্যে উঠে ভরিয়া।
ধ্বনির দুইমাত্রা এবং তিনমাত্রা বাংলা ছন্দের আদিম এবং রূঢ়িক উপাদান। তারপরে এই দুই এবং তিনের যোগে যৌগিকমাত্রার ছন্দের উৎপত্তি। তিন+দুই, তিন+চার, তিন+দুই+চার প্রভৃতি নানা প্রকার যোগ চলেছে আধুনিক বাংলা ছন্দে। তিন+দুই-মাত্রামূলক ছন্দের দৃষ্টান্ত।
আঁধার রাতি জ্বেলেছে বাতি
অযুতকোটি তারা,
আপন কারা-ভবনে পাছে
আপনি হয় হারা।
দেখা যাচ্ছে এখানে পদশেষের অংশটিকে খর্ব করা হয়েছে। যদি লেখা যেত
আঁধার রাতি জ্বেলেছে বাতি
আকাশ ভরি অযুত তারা
তাহলে ছন্দের কাছে দেনা বাকি থাকত না। কিন্তু পূর্বোক্ত প্রথম শ্লোকটির পদশেষে পাঁচমাত্রার থেকে তিনমাত্রাকে জবাব দেওয়া হয়েছে। তাহলে বুঝতে হবে সেই তিনমাত্রা দেহত্যাগ করে ঐখানেই বসে আছে যতিকে ভর করে।
কিন্তু এই কৈফিয়তটা সম্পূর্ণ হল বলে মনে হয় না, আরো কথা আছে। প্রকৃতির কাজের অলংকরণতত্ত্বটা আলোচ্য। দুই পা দুই হাত নিয়ে দেহটা দাঁড়াল, দুই কাঁধে দুটো মুণ্ড বসালেই সম্মিতি অর্থাৎ symmetry ঘটত। তা না করে দুই কাঁধের মাঝখানে একটি মুণ্ড বসিয়ে সমাপ্তিটা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। কৃষ্ণচূড়ার গাছে ডাঁটার দুধারে দুটি করে পত্রগুচ্ছ চলতে চলতে প্রান্তে এসে থামল একটিমাত্র গুচ্ছে। অলংকরণের ধারা যেখানে পূর্ণ হয়েছে সেখানে একটিমাত্র তর্জনী, ছোটো একটি ইশারা।
সকল ভাষারই যতি আছে, কিন্তু যতিকে বাটখারাস্বরূপ করে ছন্দের ওজন পূরণ বাংলা ছন্দ ছাড়া আর কোনো ছন্দে আছে কি না জানিনে। সংস্কৃত ছন্দে এই রীতি বিরল, তবু একেবারে পাওয়া যায় না তা নয়।
বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচিকৌমুদী
হরতি দরতিমিরমতি ঘোরম্ • •।[১৪]
যতিকে কেবল বিরতির স্থান না দিয়ে তাকে পূর্তির কাজে লাগাবার অভ্যাস আরম্ভ হয়েছে আমাদের ছড়ার ছন্দ থেকে। ছড়া আবৃত্তি করবার সময় আপনি যতির জোগান দেয় আমাদের কান।
কাক কালো বটে, পিক সেও কালো,
কালো সে ফিঙের বেশ,
তাহার অধিক কালো যে কন্যা
তোমার চিকন কেশ।
এমন করে ছন্দটাকে পুরোপুরি ভরিয়ে দিলে কানের কাছে ঋণী হতে হত না। কিন্তু এতে ছড়ার জাত যেত। ছড়ার রীতি এই যে, সে কিছু ধ্বনি জোগায় নিজে, কিছু আদায় করে কণ্ঠের কাছ থেকে; এ দুয়ের মিলনে সে হয় পূর্ণ।[১৫] প্রকৃতি আমের মধুরতায় জল মিশিয়েছেন, তাকে আমসত্ত্ব করে তোলেননি; সেজন্যে রসজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই কৃতজ্ঞ। তেমনি যথেষ্ট যতি মিশোল করা হয়েছে ছড়ার ছন্দে, শিশুকাল থেকে বাঙালি তাতে আনন্দ পায়। সে সহজেই আউড়েছে
কাক কালো, কোকিল কালো,
কালো ফিঙের বেশ,
তাহার অধিক কালো কন্যে
তোমার চিকন কেশ।[১৬]
কিংবা
টুমুস টুমুস বাদ্যি বাজে,
লোকে বলে কী,
শামুকরাজা বিয়ে করে
ঝিনুকরাজার ঝি।
৩
প্রত্যেক ভাষার একটি স্বকীয় ধ্বনি-উদ্ভাবনা আছে। তার থেকে তার স্বরূপ চেনা যায়। ইংরেজিতে বেশির ভাগ শব্দে স্বরবর্ণের মধ্যস্থতা নেই বলে সে যেন হয়েছে সরোদ যন্ত্রের মতো, আঙুলের আঘাতে তার ঐকমাত্রিক ধ্বনিগুলি উচ্চকিত, ইটালিয়নে ছড়ির লম্বা টানে বেহালার টানা সুর।
বাংলাভাষারও নিজের একটা বিশেষ ধ্বনিস্বরূপ আছে। তার ধ্বনির এই চেহারা হসন্তবর্ণের যোগে। যে-বাংলা আমাদের মায়ের কণ্ঠগত, জ্যেষ্ঠতাতের লেখনীগত নয়, ইংরেজির মতো তারও সুর ব্যঞ্জনবর্ণের সংঘাতে। আজ সাধুভাষার ছন্দে জোর দেবার অভিপ্রায়ে অভিধান ঘেঁটে যুক্তবর্ণের আয়োজনে লেগেছি, অথচ প্রাকৃত-বাংলায় হসন্তের প্রাধান্য আছে বলেই যুক্তবর্ণের জোর তার মধ্যে আপনি এসে পড়ে।[১৭] এই ভাষায় একটি শ্লোক রচনা করা যাক একটিও যুক্তবর্ণ না দিয়ে।
দূর সাগরের পারের পবন
আসবে যখন কাছের কূলে,
রঙিন আগুন জ্বালবে ফাগুন
মাতবে অশোক সোনার ফুলে।
হসন্তের ধাক্কায় যুক্তবর্ণের ঢেউ আপনি উঠছে।
চীনদেশের সাংঘাই নগরে একটি আরামবাগ আছে। অনেককাল সেখানে চীনের লোকেরই প্রবেশ-নিষেধ ছিল। তেমনি বাংলাদেশের সাহিত্য-আরামবাগ থেকে বাংলাভাষার স্বকীয় ধ্বনিরূপটি পণ্ডিতপাহারাওয়ালার ধাক্কা খেয়ে অনেক কাল বাইরে বাইরে ফিরেছিল।
ভাষার শব্দে অর্থ আছে, স্বর আছে। অর্থ জিনিসটা সকল ভাষাতেই এক, স্বরটা প্রত্যেক ভাষাতেই স্বতন্ত্র। ‘জল’ শব্দে যা বোঝায় ‘water’ শব্দেও তাই বুঝি, কিন্তু ওদের সুর আলাদা। ভাষা এই সুর নিয়ে শিল্প রচনা করে, ধ্বনির শিল্প। সেই রূপসৃষ্টির যে ধ্বনিতত্ত্ব বাংলাভাষার আপন সম্বল পণ্ডিতরা তাকে অবজ্ঞা করতে পারেন। কেননা তাঁরা অর্থের মহাজন, কিন্তু যাঁরা রূপরসিক তাঁদের মূলধন ধ্বনি। প্রাকৃত-বাংলার দুয়োরানীকে যারা সুয়োরানীর অপ্রতিহতপ্রভাবে সাহিত্যের গোয়ালঘরে বাসা না দিয়ে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে সেই ‘অশিক্ষিত’-লাঞ্ছনাধারীর দল যথার্থ বাংলা ভাষার সম্পদ্ নিয়ে আনন্দ করতে বাধা পায় না। তাদের প্রাণের গভীর কথা তাদের প্রাণের সহজ ভাষায় উদ্ধৃত করে দিই।
আছে যার মনের মানুষ আপন মনে
সে কি আর জপে মালা।
নির্জনে সে বসে বসে দেখছে খেলা।
কাছে রয়, ডাকে তারে
উচ্চস্বরে
কোন্ পাগেলা,
ওরে যে যা বোঝে তাই সে বুঝে
থাকে ভোলা।
যেথা যার ব্যথা নেহাত
সেইখানে হাত
ডলামলা,
তেমনি জেনো মনের মানুষ মনে তোলা।
যে জনা দেখে সে রূপ
করিয়া চুপ,
রয় নিরালা।
আর-একটি
এমন মানব-জনম আর কি হবে।
যা কর মন ত্বরায় কর
এই ভবে।
অনঅন্তরূপ ছিষ্টি করেন সাঁই,
শুনি মানবের তুলনা কিছুই নাই।
দেবদেবতাগণ
করে আরাধন
জন্ম নিতে মানবে।•••
এই মানুষে হবে মাধুর্যভজন
তাইতে মানুষ-রূপ গঠিল নিরঞ্জন।
এবার ঠকলে আর
না দেখি কিনার
লালন কয় কাতরভাবে।[২০]
এই ছন্দের ভঙ্গি একঘেয়ে নয়। ছোটো-বড়ো নানাভাগে বাঁকে বাঁকে চলেছে। সাধুপ্রসাধনে মেজে-ঘষে এর শোভা বাড়ানো চলে, আশা করি এমন কথা বলবার সাহস হবে না কারো।
এই খাঁটি বাংলায় সকল রকম ছন্দেই সকল কাব্যই লেখা সম্ভব এই আমার বিশ্বাস। ব্যঙ্গকবিতায় এ-ভাষার জোর কত ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা থেকে তার নমুনা দিই। কুইন ভিক্টোরিয়াকে সম্বোধন করে কবি বলছেন
তুমি মা কল্পতরু,
আমরা সব পোষা গোরু
শিখিনি শিঙ-বাঁকানো,
কেবল খাব খোলবিচিলি যাস।
যেন রাঙা আমলা তুলে মামলা
গামলা ভাঙে না,
আমরা ভুষি পেলেই খুশি হব
ঘুষি খেলে বাঁচব না।[২১]
কেবল এর হাসিটা নয়, এর ছন্দের বিচিত্র ভঙ্গিটা লক্ষ্য করে দেখবার বিষয়।
অথচ এই প্রাকৃত-বাংলাতেই ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য লিখলে যে বাঙালিকে লজ্জা দেওয়া হত সে কথা স্বীকার করব না। কাব্যটা এমন ভাবে আরম্ভ করা যেত
যুদ্ধ তখন সাঙ্গ হল বীরবাহু বীর যবে
বিপুল বীর্য দেখিয়ে হঠাৎ গেলেন মৃত্যুপুরে
যৌবনকাল পার না হতেই। কও মা সরস্বতী,
অমৃতময় বাক্য তোমার, সেনাধ্যক্ষপদে
কোন্ বীরকে বরণ করে পাঠিয়ে দিলেন রণে
রঘুকুলের পরম শত্রু, রক্ষকুলের নিধি।
এতে গাম্ভীর্যের ত্রুটি ঘটেছে একথা মানব না। এই যে বাংলা বাঙালির দিনরাত্রির ভাষা এর একটি মস্ত গুণ এ-ভাষা প্রাণবান্। এইজন্যে সংষ্কৃত বল, পারসি বল, ইংরেজি বল সব শব্দকেই প্রাণের প্রয়োজনে আত্মসাৎ করতে পারে।[২২] খাঁটি হিন্দি ভাষারও সেই গুণ। যারা হেডপণ্ডিত মশায়ের কাছে পড়েনি তাদের একটা লেখা তুলে দিই।
চক্ষু আঁধার দিলের ধোঁকায়
কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়,
কী রঙ্গ সাঁই দেখছে সদাই
বসে নিগম ঠাঁই।
এখানে না দেখলেম তারে
চিনব তবে কেমন করে,
ভাগ্যেতে আখেরে তারে
চিনতে যদি পাই।[২৩]
প্রাকৃত-বাংলাকে গুরুচণ্ডালি দোষ স্পর্শ ই করে না। সাধু ছাঁদের ভাষাতেই শব্দের মিশোল সয় না।
চলতি বাংলাভাষার প্রসঙ্গটা দীর্ঘ হয়ে পড়ল। তার কারণ এ-ভাষাকে যাঁরা প্রতিদিন ঘরে দেন স্থান, তাঁদের অনেকে সাহিত্যে একে অবজ্ঞা করেন। সেটাতে সাহিত্যকে তার প্রাণরসের মূল আধার থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে জেনে আমার আপত্তিকে বড়ো করেই জানালুম। ছন্দের তত্ত্ববিচারে ভাষার অন্তর্নিহিত ধ্বনিপ্রকৃতির বিচার অত্যাবশ্যক, সেই কথাটা এই উপলক্ষ্যে বোঝাবার চেষ্টা করেছি।
8
বাংলা ছন্দের তিনটি শাখা। একটি আছে পুঁথিগত কৃত্রিম ভাষাকে অবলম্বন করে, সেই ভাষায় বাংলার স্বাভাবিক ধ্বনিরূপকে স্বীকার করেনি।[২৪] আর-একটি সচল বাংলার ভাষাকে নিয়ে, এই ভাষা বাংলার হসন্ত-শব্দের ধ্বনিকে আপন বলে গ্রহণ করেছে।[২৫] আর-একটি শাখার উদ্গম হয়েছে সংস্কৃত ছন্দকে বাংলায় ভেঙে নিয়ে।[২৬]
শিখরিণী মালিনী মন্দাক্রান্তা শার্দুলবিক্রীড়িত প্রভৃতি বড়ো বড়ো গভীরচালের ছন্দ গুরুলঘুস্বরের যথানির্দিষ্ট বিন্যাসে অসমান মাত্রাভাগের ছন্দ। বাংলায় আমরা বিষমমাত্রামূলক ছন্দ কিছু কিছু চালিয়েছি, কিন্তু বিষমমাত্রার ঘনঘন পুনরাবৃত্তির দ্বারা তারো একটা সম্মিতি রক্ষা হয়।
শিমুল রাঙা রঙে
চোখেরে দিল ভরে।
নাকটা হেসে বলে,
হার রে যাই মরে।
নাকের মতে, গুণ
কেবলি আছে ঘ্রাণে,
রূপ যে রঙ খোঁজে
নাকটা তা কি জানে।
এখানে বিষমমাত্রার পদগুলি জোড়ে জোড়ে এসে চলনের অসমানতা ঘুচিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় বিষমমাত্রার বিস্তার আরো অনেক বড়ো। এই সংস্কৃত ছন্দের দীর্ঘহ্রস্ব স্বরকে সমান করে নিয়ে কেবলমাত্র মাত্রা মিলিয়ে ছন্দ রচনা বাংলায় দেখেছি, সে বহুকাল পূর্বে ‘স্বপ্নপ্রয়াণে’।
লজ্জা বলিল, “হবে
কি লো তবে,
কতদিন পরান রবে
অমন করি।
হইয়ে জলহীন
যথা মীন
রহিবি ওলো কতদিন
মরমে মরি”।[২৭]
এর প্রত্যেক ভাগে মাত্রাসংখ্যা স্বতন্ত্র।
সংস্কৃত ছন্দে বিবিধ মাত্রার এই গতিবৈচিত্র্য যা সম্মিতি উপেক্ষা করেও ভঙ্গিলীলা বাঁচিয়ে চলে বাংলায় তার অনুকৃতি এখনো যথেষ্ট প্রচলিত হয়নি। নূতন ছন্দ বাংলায় সৃষ্টি করবার শখ যাঁদের প্রবল, এই পথে তাঁরা অনেক নূতনত্বের সন্ধান পাবেন। তবু বলে রাখি তাতে তাঁরা সংস্কৃত ছন্দের মোট আয়তনটা পাবেন, তার ধ্বনিতরঙ্গ পাবেন না। মন্দাক্রান্তার মাত্রাগোনা একটা বাংলা ছন্দের নমুনা দেওয়া যাক।
সারা প্রভাতের বাণী
বিকালে গেঁথে আনি’
ভাবিনু হারখানি
দিব গলে।
ভয়ে ভয়ে অবশেষে
তোমার কাছে এসে
কথা যে যায় ভেসে
আঁখিজলে।
দিন যবে হয় গত
না-বলা কথা যত
খেলার ভেলা-মতো
হেলাভরে
লীলা তার করে সারা
যে-পথে ঠাঁই-হারা
রাতের যত তারা
যায় সরে।[২৮]
শিখরিণীকেও এই ভাবে বাংলায় রূপান্তরিত করা যেতে পারে।
কেবলি অহরহ মনে মনে
নীরবে তোমা সনে
যা-খুশি কহি কত;
‘ছন্দের প্রকৃতি’ প্রবন্ধের এক পৃষ্ঠা
বিরহব্যথা মম নিজে নিজে
তোমারি মুরতি যে
গড়িছে অবিরত।
এ-পূজা ধায় ধবে তোমা পানে
বাজে কি কোনোখানে,
কাঁপে কি মন তব।
জান কি দিবানিশি বহুদূরে
গোপনে বাজে সুরে
বেদনা অভিনব।[২৯]
ছন্দ সম্বন্ধে আরো কিছু বলা বাকি রইল, আর কোনো সময়ে পরে বলবার ইচ্ছা আছে।[৩০] উপসংহারে আজ কেবল এই কথাটি বলতে চাই যে, ছন্দের একটা দিক্ আছে যেটাকে বলা যেতে পারে কৌশল। কিন্তু তার চেয়ে আছে বড়ো জিনিস যেটাকে বলি সৌষ্ঠব। বাহাদুরি তার মধ্যে নেই, সমগ্র কাব্যসৃষ্টির কাছে ছন্দের আত্মবিস্মৃত আত্মনিবেদনে তার উদ্ভব। কাব্য পড়তে গিয়ে যদি অনুভব করি যে ছন্দ পড়ছি, তাহলে সেই প্রগল্ভ ছন্দকে ধিক্কার দেব। মস্তিষ্ক হৃৎপিণ্ড পাকস্থলী অতি আশ্চর্য যন্ত্র, সৃষ্টিকর্তা তাদের স্বাতন্ত্র্য ঢাকা দিয়েছেন। দেহ তাদেরকে ব্যবহার করে, প্রকাশ করে না। করে প্রকাশ যখন রোগে ধরে; তখন যকৃৎটা হয় প্রবল, তার কাছে মাথা হেঁট করে লাবণ্য। শরীরে স্বাস্থ্যের মতোই কবি ছন্দকে ভুলে থাকে, ছন্দ যখন তার যথার্থ আপন হয়।
- ↑ সংস্কৃত ছন্দঃ শব্দ বাংলায় হয়েছে ছন্দ। সংস্কৃতে বিসর্গহীন ছন্দ শব্দও আছে। ছন্দঃ এবং ছন্দ শব্দের অর্থ এক নয়। ছন্দঃ মানে পদ্যবন্ধ অর্থাৎ পদ্যের ধ্বনিবিন্যাসপ্রণালী। আর ছন্দ মানে ইচ্ছা (যথা— স্বচ্ছন্দ, ছন্দানুবর্তন)। মূলে হয়তো দুই শব্দের এক অর্থই ছিল। বিধুশেখর শাস্ত্রীর ‘ছন্দঃ’ প্রবন্ধ (বিশ্বভারতীপত্রিকা, ১৩৫০ মাঘ, পৃ ২৯৯-৩০১) দ্রষ্টব্য ৷
- ↑ মানে দুইমাত্রার বা সমমাত্রার চাল। ‘দ্বিপদী’ শব্দটি এখানে পারিভাষিক অর্থে গ্রহণীয় নয়। পারিভাষিক অর্থে ‘দ্বিপদী’ মানে ‘পয়ার’।
- ↑ ৫৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
- ↑ ৪৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
- ↑ অন্যত্র (৩৮ পৃ) বলেছেন ‘শোষণশক্তি’।
- ↑ দ্রষ্টব্য পৃ ১-২, ৮-৯।
- ↑ শিখরিণী ছন্দ। অকারান্ত ধ্বনিকে অকারান্তরূপে এবং দীর্ঘস্বরান্ত ধ্বনিকে দীর্ঘরূপে উচ্চারণ করা আবশ্যক। দৃষ্টান্তটি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি রচনা (ভারতী, ১২৮৬ আশ্বিন, পৃ ২৬৪) থেকে গৃহীত।
- ↑ ৬৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
- ↑ ৫৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
- ↑ ৬৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
- ↑ দ্রষ্টব্য ৩৬-৩৭ পৃষ্ঠা।
- ↑ দ্রষ্টব্য ১৩-১৪, ৭২-৭৩ পৃষ্ঠা।
- ↑ দ্রষ্টব্য ৬৬ পৃষ্ঠা।
- ↑ দ্রষ্টব্য ১৫-১৬ পৃষ্ঠা।
- ↑ ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ ইত্যাদি ছড়াটির ছন্দ-বিশ্লেষণ (পৃ ৬২-৬৩) দ্রষ্টব্য।
- ↑ সমগ্র ছড়াটি ‘লোকসাহিত্য’ গ্রন্থের ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ নামক মূলপ্রবন্ধে সংকলিত হয়েছে। ছড়াটির আরও ‘জাদু, এতো বড়ো রঙ্গ’। উক্ত প্রবন্ধে ‘চিকন কেশ’-এর স্থলে আছে ‘মাথার কেশ’।
- ↑ দ্রষ্টব্য পৃ ৬-৭, ৪৯-৫০, ৮৩।
- ↑ লালনচন্দ্র দাস বা রায়। পরে ইনি লালন শাহ ফকির নামে পরিচিত হন। দ্রষ্টব্য: প্রবাসী ১৩৩২ শ্রাবণ পৃ ৪৯৭, ললিত চট্টোপাধ্যায় ও চারু বন্দ্যোপাধ্যায়-সম্পাদিত ‘বঙ্গবীণা’ পৃ ৪৯৩, মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন-প্রণীত ‘হারামণি’ ভূমিকা পৃ ১৸৹।
- ↑ এই গান-দুটি রবীন্দ্রনাথকর্তৃক সংগৃহীত ও প্রকাশিত; প্রবাসী ১৩২২ আশ্বিন ও পৌষ। এই পাঠ ও প্রবাসীর পাঠে কিছু পার্থক্য আছে। গ্রন্থপরিচয় দ্রষ্টব্য।
- ↑ এই গান-দুটি রবীন্দ্রনাথকর্তৃক সংগৃহীত ও প্রকাশিত; প্রবাসী ১৩২২ আশ্বিন ও পৌষ। এই পাঠ ও প্রবাসীর পাঠে কিছু পার্থক্য আছে। গ্রন্থপরিচয় দ্রষ্টব্য।
- ↑ ‘নীলকর’ নামক কবিতা থেকে উদ্ধৃত।
- ↑ দ্রষ্টব্য ৫১ পৃষ্ঠা।
- ↑ লালন-রচিত: প্রবাসী ১৩২২ আশ্বিন।
- ↑ সাধুছন্দ বা সংস্কৃত-বাংলার ছন্দ।
- ↑ ছড়ার ছন্দ বা প্রাকৃত-বাংলার ছন্দ।
- ↑ রবীন্দ্রনাথ অন্য কোথাও এ-শাখাটিকে স্বতন্ত্র নামে উল্লেখ করেননি। অসম ও বিষম মাত্রার ছন্দগুলি এর অন্তর্গত। এই শাখার প্রচলিত নাম ‘মাত্রাবৃত্ত’। পরবর্তী অংশে আলোচিত শিখরিণী প্রভৃতি সংস্কৃত-ভাঙা ছন্দগুলিও এই শ্রেণীভুক্ত।
- ↑ স্বপ্নপ্রয়াণ, দ্বিতীয় সর্গ, ১২৫। শিখরিণী ছন্দ। ‘লজ্জা’ শব্দে দুই মাত্রা গণনীয়। পৃ ১৩৫ পাদটীকা ১ দ্রষ্টব্য।
- ↑ আরেকটি নমুনা ৯৩ পৃষ্ঠার দ্রষ্টব্য।
- ↑ এটির সঙ্গে ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’এর ‘লজ্জা বলিল’ ইত্যাদি দৃষ্টান্তটির (পৃ ১৩৩) মাত্রাবিভাগগত পার্থক্য লক্ষিতব্য। সংস্কৃত-ছন্দশাস্ত্রমতে শিখরিণীর প্রতিপংক্তির দুই ভাগ; প্রথম ভাগে এগার এবং দ্বিতীয় ভাগে চোদ্দ মাত্রা (পূর্ণ বিবরণ ‘সংজ্ঞাপরিচয়’ অংশে দ্রষ্টব্য)। দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রথম ভাগের এগার মাত্রাকে ভেঙে সাত ও চার মাত্রার দুই পর্ব এবং দ্বিতীয় ভাগে চোদ্দ মাত্রাকে ভেঙে নয় ও পাঁচ মাত্রার দুই পর্ব রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে এগার মাত্রা একত্র স্থাপন করে দ্বিতীয় ভাগটিকে সাত মাত্রার দুটি পর্বে বিভক্ত করেছেন। এ-বিষয়ের বিস্তৃত আলোচনা “বাংলা কবিতায় সংস্কৃত ছন্দ” প্রবন্ধে (ভারতবর্ষ ১৩৪১ অগ্রহায়ণ পৃ ৮৫৭-৫৮) দ্রষ্টব্য।
- ↑ পরবর্তী প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।