ছন্দ/ছন্দের হসন্ত হলন্ত

ছন্দের হসন্ত হলন্ত[]

 ...আমার নিজের বিশ্বাস যে, আমরা ছন্দ রচনা করি স্বতই কানের ওজন রেখে, বাজারে প্রচলিত কোনো বাইরের মানদণ্ডের দ্বারা মেপে মেপে এ কাজ করিনে, অন্তত সজ্ঞানে নয়। কিন্তু ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন[] এই বলে আমাদের দোষ দিয়েছেন যে— আমরা একটা কৃত্রিম মানদণ্ড দিয়ে পাঠকের কানকে ফাঁকি দিয়ে তার চোখ ভুলিয়ে এসেছি, আমরা ধ্বনি চুরি করে থাকি অক্ষরের আড়ালে।

 ছন্দোবিৎ কী বলছেন ভালো করে বোঝবার চেষ্টা করা যাক। তাঁর প্রবন্ধে আমার লেখা থেকে কিছু লাইন তুলে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তস্বরূপে ব্যবহার করেছেন। যথা—

+ | + | |
উদয়দিগন্তে ঐ শুভ্র শঙ্খ বাজে।
+ |
মোর চিত্ত মাঝে,
+
চিরনূতনেরে দিল ডাক
| +
পঁচিশে বৈশাখ।

তিনি বলেন, “এখানে দণ্ডচিহ্নিত যুগ্মধ্বনিগুলিকে এক বলে ধরা হয়েছে, কারণ এগুলি শব্দের মধ্যে অবস্থিত; আর যোগচিহ্নিত যুগ্মধ্বনিগুলিকে দুই বলে ধরা হয়েছে, যেহেতু এগুলি শব্দের অন্তে অবস্থিত।” অর্থাৎ ‘উদয়’এর অয়্ হয়েছে দুই মাত্রা অথচ ‘দিগন্ত’এর অন্ হয়েছে একমাত্রা, এইজন্যে ‘উদয়’ শব্দকেও তিন মাত্রা এবং ‘দিগন্ত’ শব্দকেও তিন মাত্র। গণনা করা হয়েছে। ‘যুগ্মধ্বনি’ শব্দটার পরিবর্তে ইংরেজি সিলেব্‌ল্ শব্দ ব্যবহার করলে অনেকের পক্ষে সহজ হবে। আমি তাই করব।

 বহুকালপূর্বে একদিন বাংলার শব্দতত্ত্ব আলোচনা করেছিলুম। সেই প্রসঙ্গে ধ্বনিতত্ত্বের কথাও মনে উঠেছিল। তখন দেখেছিলুম বাংলায় স্বরবর্ণ যদিও সংস্কৃত বানানের হ্রস্বদীর্ঘতা মানে না তবু এ সম্বন্ধে তার নিজের একটি স্বকীয় নিয়ম আছে। সে হচ্ছে বাংলায় হসন্ত শব্দের পূর্ববর্তী স্বর দীর্ঘ হয়। যেমন জল, চাঁদ। এ দুটি শব্দের উচ্চারণে জ-এর অ এবং চাঁ-এর আ আমরা দীর্ঘ করে টেনে পরবর্তী হসন্তের ক্ষতিপূরণ করে থাকি। জল এবং জলা, চাঁদ এবং চাঁদা শব্দের তুলনা করলে এ কথা ধরা পড়বে। এ সম্বন্ধে বাংলার বিখ্যাত ধ্বনিতত্ত্ববিৎ সুনীতিকুমারের বিধান নিলে নিশ্চয়ই তিনি আমার সমর্থন করবেন। বাংলায় ধ্বনির এই নিয়ম স্বাভাবিক বলেই আধুনিক বাঙালি কবি ও ততোধিক আধুনিক বাঙালি ছন্দোবিৎ জন্মাবার বহু পূর্বেই বাংলা ছন্দে প্রাক্‌হসন্ত স্বরকে দুই মাত্রার পদবি দেওয়া হয়েছে। আজ পর্যন্ত কোনো বাঙালির কানে ঠেকেনি; এই প্রথম দেখা গেল নিয়মের ধাঁধায় পড়ে বাঙালি পাঠক কানকে অবিশ্বাস করলেন। কবিতা লেখা শুরু করবার বহুপূর্বে সবে যখন দাঁত উঠেছে তখন পড়েছি “জল পড়ে, পাতা নড়ে।” এখানে ‘জল’ যে ‘পাতা’র চেয়ে মাত্রাকৌলীন্যে কোনো অংশে কম এমন সংশয় কোনো বাঙালি শিশু বা তার পিতামাতার কানে বা মনেও উদয় হয়নি। এইজন্যে ঐ দুটো কথা অনায়াসে এক পংক্তিতে বসে গেছে, আইনের ঠেলা খায়নি। ইংরেজি মতে ‘জল’ সর্বত্রই এক সিলেব্‌ল্ ‘পাতা’ তার ডবল ভারি। কিন্তু জল শব্দটা ইংরেজি নয়। ‘কাশীরাম’ নামের ‘কাশী’ এবং ‘রাম’ যে একই ওজনের এ কথাটা কাশীরামের স্বজাতীয় সকলকেই মানতেই হয়েছে। ‘উদয়দিগন্তে ঐ শুভ্র শঙ্খ বাজে’ এই লাইনটা নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রবোধচন্দ্র ছাড়া আর কোনো পাঠকের কিছুমাত্র খটকা লেগেছে বলে আমি জানিনে, কেননা তারা সবাই কান পেতে পড়েছে নিয়ম পেতে নয়। যদি কর্তব্যবোধে নিতান্তই খটকা লাগা উচিত হয়, তাহলে সমস্ত বাংলাকাব্যের পনেরো আনা লাইনের এখনি প্রুফসংশোধন করতে বসতে হবে।

 লেখক আমার একটা মস্ত ফাঁকি ধরেছেন। তিনি বলেন, আমি ইচ্ছামতো কোথাও ‘ঐ’ লিখি কোথাও লিখি ‘ওই’, এই উপায়ে পাঠকের চোখ ভুলিয়ে অক্ষরের বাটখারার চাতুরীতে একই উচ্চারণকে জায়গা বুঝে দুই রকমের মূল্য দিয়েছি।

 তাহলে গোড়াকার ইতিহাসটা বলি। তখনকার দিনে বাংলা কবিতায় এক-একটি অক্ষর এক সিলেব্‌ল্ বলেই চলত। অথচ সেদিন কোনো কোনো ছন্দে যুগ্মধ্বনিকে দ্বৈমাত্রিক বলে গণ্য করার দরকার আছে বলে অনুভব করেছিলুম।

আকাশের ওই আলোর কাঁপন
নয়নেতে এই লাগে,
সেই মিলনের তড়িৎ-তাপন
নিখিলের রূপে জাগে।

আজকের দিনে এমন কথা অতি অর্বাচীনকেও বলা অনাবশ্যক যে, ঐ ত্রৈমাত্রিক ভূমিকার ছন্দকে নিচের মতো রূপান্তরিত করা অপরাধ—

ঐ যে তপনের রশ্মির কম্পন
এই মস্তিকেতে লাগে,
সেই সম্মিলনে বিদুৎ-ঝম্পন
বিশ্বমূর্তি হয়ে জাগে।

অথচ সেদিন ‘বৃত্রসংহারে’ এইজাতীয় ছন্দে হেমচন্দ্র ঐন্দ্রিলার রূপবর্ণনায় অসংকোচে লিখতে পেরেছিলেন

বদনমণ্ডলে ভাসিছে ব্রীড়া।

 বেশ মনে আছে সেদিন স্থানবিশেষে ‘ঐ’ শব্দের বানান নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়েছিল। প্রবোধচন্দ্র নিশ্চয় বলবেন, “ভেবে যা হয় একটা স্থির করে ফেলাই ভালো ছিল। কোথাও বা ‘ঐ’, কোথাও বা ‘ওই’ বানান কেন।” তার উত্তর এই বাংলার স্বরের হ্রস্বদীর্ঘতা সংস্কৃতের মতো বাঁধা নিয়ম মানে না, ওর মধ্যে অতি সহজেই বিকল্প চলে। “ও—ই দেখ, খোকা ফাউনটেন পেন মুখে পুরেছে”, এখানে দীর্ঘ ওকারে কেউ দোষ ধরবে না। আবার যদি বলি “ঐ দেখ, ফাউনটেন পেনটা খেয়ে ফেললে বুঝি”, তখন হ্রস্ব ঐকার নিয়ে বচসা করবার লোক মিলবে না। বাংলা উচ্চারণে স্বরের ধ্বনিকে টান দিয়ে অতি সহজেই বাড়ানো-কমানো যায় বলেই ছন্দে তার গৌরব বা লাঘব নিয়ে আজ পর্যন্ত দলাদলি হয়নি।  এ সব কথা দৃষ্টান্ত না দিলে স্পষ্ট হয় না, তাই দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হল।

মনে পড়ে দুইজনে জুঁই তুলে বাল্যে
নিরালায় বনছায় গেঁথেছিনু মাল্যে।
দোঁহার তরুণ প্রাণ বেঁধে দিল গন্ধে
আলোয় আঁধারে মেশা নিভৃত আনন্দে।

এখানে ‘দুই’ ‘জুঁই’ আপন আপন উকারকে দীর্ঘ করে দুই সিলেব্‌ল্এর টিকিট পেয়েছে, কান তাদের সাধুতায় সন্দেহ করলে না, দ্বার ছেড়ে দিলে। উলটো দৃষ্টান্ত দেখাই।

এই যে এল সেই আমারি স্বপ্নে দেখা রূপ,
কই দেউলে দেউটি দিলি, কই জ্বালালি ধূপ।
যায় যদি রে যাক না ফিরে চাইনে তারে রাখি,
সব গেলেও হায়রে তবু স্বপ্ন রবে বাকি।

এখানে ‘এই’ ‘সেই’ ‘কই’ ‘যায়’ ‘হায়’ প্রভৃতি শব্দ এক সিলেব্‌ল্‌এর বেশি মান দাবি করলে না। বাঙালি পাঠক সেটাকে অন্যায় না মনে করে সহজ ভাবেই নিলে।

কাঁধে মই, বলে, “কই ভুঁইচাপা গাছ।”
দইভাঁড়ে ছিপ ছাড়ে, খোঁজে কইমাছ।
ঘুঁটেছাই মেখে লাউ রাঁধে ঝাউপাতা,
কী খেতাব দেব তায় ঘুরে যায় মাথা।

এখানে ‘সই’ ‘কই’ ‘ভূঁই’ ‘দই’ ‘ছাই’ ‘লাউ’ প্রভৃতি সকলেরই সমান দৈর্ঘ্য, যেন গ্র্যানেডিয়ারের সৈন্যদল। যে-পাঠক এটা পড়ে দুঃখ পাননি সেই পাঠককেই অনুরোধ করি, তিনি পড়ে দেখুন—

দুইজনে জুঁই তুলতে যখন
গেলেম বনের ধারে,
সন্ধ্যা-আলোর মেঘের ঝালর
ঢাকল অন্ধকারে।
কুঞ্জে গোপন গন্ধ বাজায়
নিরুদ্দেশের বাঁশি,
দোঁহার নয়ন খুঁজে বেড়ায়
দোঁহার মুখের হাসি।

এখানে যুগ্মধ্বনিগুলো এক সিলেব ল এর চাকার গাড়িতে অনায়াসে ধেয়ে চলেছে। চণ্ডীদাসের গানে রাধিকা বলেছেন “কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো”। বাঁশিধ্বনির এই তো ঠিক পথ, নিয়মের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করলে মরমে পৌঁছত না। কবিরাও সেই কান লক্ষ্য করে চলেন, নিয়ম যদি চৌমাথার পাহারাওয়ালার মতো সিগ ন্যাল তোলে তবু তাঁদের রুখতে পারে না।

 আমার দুঃখ এই, তথাচ আইনবিৎ বলছেন যে, লিপিপদ্ধতির দোষে ‘অক্ষর গুনে ছন্দরচনার অন্ধ অভ্যাস’ আমাদের পেয়ে বসেছে। আমার বক্তব্য এই যে, ছন্দরচনার অভ্যাসটাই অন্ধ অভ্যাস। অন্ধের কান খুব সজাগ, ধ্বনির সংকেতে সে চলতে পারে, কবিরও সেই দশা। তা যদি না হত তাহলেই পায়ে পায়ে কবিকে চোখে চশমা এঁটে অক্ষর গনে গনে চলতে হত।

 ‘বৎসর’ ‘উৎসব’ প্রভৃতি খণ্ড ৎ-ওয়ালা কথাগুলোকে আমরা ছন্দের মাপে বাড়াই কমাই, এ রকম চাতুরী সম্ভব হয় যেহেতু খণ্ড ৎ-কে কখনো আমরা চোখে দেখার সাক্ষ্যে এক অক্ষর ধরি আবার কখনো কানে শোনার দোহাই দিয়ে তাকে আধ অক্ষর বলে চালাই, প্রবন্ধলেখক এই অপবাদ দিয়েছেন। অভিযোগকারীর বোঝা উচিত এটা একেবারেই অসম্ভব, কেননা ছন্দের কাজ চোখভোলানো নয়, কানকে খুশি করা, সেই কানের জিনিসে ইঞ্চিগজের মাপ চলেই না। ‘বৎসর’ প্রভৃতি শব্দ গেঞ্জিজামার মতো; মধুপুরের স্বাস্থ্যকর হাওয়ায় দেহ এক-আধ ইঞ্চি বাড়লেও চলে, আবার শহরে এসে এক-আধ ইঞ্চি কমলেও সহজে খাপ খেয়ে যায়। কান যদি সম্মতি না দিত তাহলে কোনো কবির সাধ্য ছিল না ছন্দ নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে।

বৎসরে বৎসরে হাঁকে কালের গোমায়ু,
যায় আয়ু, যায় আয়ু, যায় যায় আয়ু।

এখানে ‘বৎসর’ তিনমাত্রা। কিন্তু সেতারে মিড় লাগাবার মতো অল্প একটু টানলে বেসুর লাগে না। যথা—

সখা সনে উৎসবে বৎসর যায়
শেষে মরি বিরহের ক্ষুৎপিপাসায়।
ফাগুনের দিনশেষে মউমাছি ও যে
মধুহীন বনে বৃথা মাধবীরে খোঁজে।

টান কমিয়ে দেওয়া যাক।—

উৎসবের রাত্রিশেষে মৃৎপ্রদীপ হায়,
তারকার মৈত্রী ছেড়ে মৃত্তিকারে চায়।

দেখা যাচ্ছে এটুকু কমিবেশিতে মামলা চলে না, বাংলা ভাষার স্বভাবের মধ্যেই যথেষ্ট প্রশ্রয় আছে। যদি লেখা যেত

সখাসনে মহোৎসবে বৎসর যায়

তাহলে নিয়ম বাঁচত, কারণ পূর্ববর্তী ওকারের সঙ্গে খণ্ড ৎ মিলে একমাত্রা; কিন্তু কর্ণধার বলছে ঐখানটায় তরণী যেন একটু কাত হয়ে পড়ল। আমি এক জায়গায় লিখেছি ‘উদয়-দিক্‌প্রান্ত-তলে’। ওটাকে বদলে ‘উদয়ের দিক্‌প্রান্ত-তলে’ লিখলে কানে খারাপ শোনাত না একথা প্রবন্ধলেখক বলেছেন, সালিসির জন্যে কবিদের উপর বরাত দিলুম।

 অপরপক্ষে দেখা যাক চোখ ভুলিয়ে ছন্দের দাবিতে ফাঁকি চালানো যায় কিনা।

এখনই আসিলাম দ্বারে
অমনই ফিরে চলিলাম,
চোখও দেখেনি কভু তারে
কানই শুনিল তার নাম।

‘তোমারি’, ‘যখনি’ শব্দগুলির ইকারকে বাংলা বানানে অনেক সময় বিচ্ছিন্ন করে লেখা হয়, সেই সুযোগ অবলম্বন করে কোনো অলস কবি ওগুলোকে চারমাত্রার কোঠায় বসিয়ে ছন্দ ভরাট করেছেন কি না জানিনে, যদি করে থাকেন বাঙালি পাঠক তাঁকে শিরোপা দেবে না। ওদের উকিল তখন ‘বৎসর’ ‘উৎসব’ ‘দিক্‌প্রান্ত’ প্রভৃতি শব্দগুলির নজির দেখিয়ে তর্ক করবে। তার একমাত্র উত্তর এই যে, কান যেটাকে মেনে নিয়েছে কিংবা মেনে নেয়নি চোখের সাক্ষ্য নিয়ে কিংবা বাঁধানিয়মের দোহাই দিয়ে সেখানে তর্ক তোলা অগ্রাহ্য। যে-কোনো কবি উপরের ছড়াটাকে অনায়াসে বদল করে লিখতে পারে—

এখনি আসিনু তার দ্বারে
অমনি ফিরিয়া চলিলাম,
চোখেও দেখিনি কভু তারে
কানেই শুনেছি তার নাম।

‘বৎসর’ ‘উৎসব’ প্রভৃতি শব্দ যদি তিনমাত্রার কোঠা পেরোতে গেলেই স্বভাবতই খুঁড়িয়ে পড়ত তাহলে তার স্বাভাবিক ওজন বাঁচিয়ে ছন্দ চালানো এতই দুঃসাধ্য হত না যে, ধ্বনিকে এড়িয়ে অক্ষরগণনার আশ্রয়ে শেষে মানবাঁচানো আবশ্যক হত। ওটা চলে বলেই চালানো হয়েছে, দায়ে পড়ে না। কেবল অক্ষর সাজিয়ে অচল রীতিকে ছন্দে চালানো যদি সম্ভব হত তাহলে খোকাবাবুকে কেবল লম্বা টুপি পরিয়ে দাদামশায় বলে চালানো অসাধ্য হত না।...

 বিচিত্রা—১৩৩৮ পৌষ

 দিলীপকুমার আশ্বিনের ‘উত্তরা’য়[] ছন্দ সম্বন্ধে আমার দুই একটি চিঠির খণ্ড ছাপিয়েছেন। সর্বশেষে যে নোটটুকু দিয়েছেন তার থেকে বোঝা গেল আমি যে কথা বলতে চেয়েছি এখনো সেটা তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়নি।

 তিনি আমারই লেখার নজির তুলে দেখিয়েছেন যে, নিম্নলিখিত কবিতায় আমি ‘একেকটি’ শব্দটাকে চারমাত্রার ওজন দিয়েছি।

ইচ্ছা করে অবিরত আপনার মনোমত
গল্প লিখি একেকটি করে।

এদিকে নীরেনবাবুর[] রচনায়[] “একটি কথা এতবার হয় কলুষিত” পদটিতে ‘একটি’ শব্দটাকে দুই মাত্রায় গণ্য করতে আপত্তি করিনি বলে তিনি দ্বিধা বোধ করছেন। তর্ক না করে দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।

একটি কথার লাগি তিনটি রজনী জাগি,
একটুও নাহি মেলে সাড়া।
সখীরা যখন জোটে মুখে তব বন্যা ছোটে,
গোলমালে তোলপাড় পাড়া।

‘একটি’ ‘তিনটি’ ‘একটু’ শব্দগুলি হসন্তমধ্য, ‘গোলমাল’ ‘তোলপাড়’ ও সেই জাতের। অথচ হসন্তে ধ্বনিলাঘবতার অভিযোগে ওদের মাত্রা জরিমানা দিতে হয়নি। তিনমাত্রা ও চারমাত্রার গৌরবেই রয়ে গেল। কেউ কেউ বলেন কেবলমাত্র অক্ষরগণনার দোহাই দিয়েই এরা মান বাঁচিয়েছে, অর্থাৎ যদি যুক্ত অক্ষরের ছাঁদে লেখা যেত তাহলেই ছন্দে ধ্বনির কমতি ধরা পড়ত। আমার বক্তব্য এই যে, চোখ দিয়ে ছন্দ পড়া আর বাইসিক্‌ল্‌-এর চাকা দিয়ে হামাগুড়ি দেওয়া একই কথা, ওটা হবার জো নেই। বিরুদ্ধ দৃষ্টান্ত দিলে কথাটা বোঝা যাবে।

টোট্‌কা এই মুষ্টিযোগ লট্‌কানের ছাল,
সিট্‌কে মুখ খাবি, জ্বর আট্‌কে যাবে কাল।

বলে রাখা ভালে। এটা ভিষক্-ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নয়, সাহিত্যডাক্তারের বানানো ছড়া, ছন্দ সম্বন্ধে মতসংশয় নিবারণের উদ্দেশে; এর থেকে অন্য কোনো রোগের প্রতিকার কেউ যেন আশা না করেন। আরো একটা

এক্‌টি কথা শুনিবারে তিন্‌টে রাত্রি মাটি,
এর পরে ঝগ্‌ড়া হবে, শেষে দাঁত কপাটি।

অথবা

এক্‌টি কথা শোনো, মনে খট্‌কা নাহি রেখে,
টাট্‌কা মাছ জুট্‌ল না তো, শুঁট্‌কি দেখো চেখে।

শেষের তিনটি ছড়ায় অক্ষর গুনতি করতে গেলে দৃশ্যত পয়ারের সীমা ছাড়িয়ে যায়, কিন্তু তাই বলেই যে পয়ার ছন্দের নির্দিষ্ট ধ্বনি বেড়ে গেল তা নয়। আপাতত মনে হয় এটা যথেচ্ছাচার। কিন্তু হিসাব করে দেখলেই দেখা যাবে ছন্দের নীতি নষ্ট করা হয়নি। কেননা, তার জো নেই। এ তো রাজত্ব করা নয় কবিত্ব করা, এখানে লক্ষ্য হল মনোরঞ্জন; খামকা একটা জবরদস্তির আইন জারি করে তারপরে পাহারাওয়ালা লাগিয়ে দেওয়া, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। ধ্বনির রাজ্যে গোঁয়ারতমি করে কেউ জিতে যাবে এমন সাধ্য আছে কার। চব্বিশ ঘণ্টা কান রয়েছে সতর্ক।

 আমি এই কথাটি বোঝাতে চেষ্টা করছি যে, আক্ষরিক ছন্দ বলে কোনো অদ্ভুত পদার্থ বাংলায় কিংবা অন্য কোনো ভাষাতেই নেই। অক্ষর ধ্বনির চিহ্নমাত্র। যেমন ‘জল’ শব্দটাকে দিয়ে ‘জল’ পদার্থটার প্রতিবাদ চলে না, অক্ষরকে ধ্বনির প্রতিপক্ষ দাঁড় করানো তেমনি বিড়ম্বনা।

 প্রশ্ন উঠবে, তাই যদি হয় তাহলে খোঁড়া হসন্তবর্ণকে কখনো আধমাত্রা কখনো পুরোমাত্রার পদবিতে বসানো হয় কেন। উত্তরে আমার বক্তব্য এই যে, স্বয়ং ভাষা যদি নিজেই আসন পেতে দেয় তবে তার উপরে অন্য কোনো আইন চলে না। ভাষাও বর্ণভেদে পংক্তির ব্যবস্থা নিজের ধ্বনির নিয়ম বাঁচিয়ে তবে করতে পারে। বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণের ধ্বনিমাত্রা বিকল্পে দীর্ঘ ও হ্রস্ব হয়ে থাকে, ধনুকের ছিলের মতো, টানলে বাড়ে, টান ছেড়ে দিলে কমে। সেটাকে গুণ বলেই গণ্য করি। তাতে ধ্বনিরসের বৈচিত্র্য হয়। আমরা দ্রুত লয়ে বলতে পারি ‘এইরে’, আবার তাকে টানলে ডবল করে বলতে পারি ‘এ-ইরে’। তার কারণ আমাদের স্বরবর্ণগুলো জীবধর্মী, ব্যবহারের প্রয়োজনে একটা সীমার মধ্যে তাদের সংকোচন-প্রসারণ চলে। চারটে পাথরের মূর্তি ধরাবার মতো জায়গায় পাঁচটা ধরাতে গেলে মুশকিল বাধে; কিন্তু চারজন প্যাসেঞ্জার বসবার বেঞ্চিতে পাঁচজন মানুষ বসালে দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই যদি তারা পরস্পর রাজি থাকে। বাংলা ভাষার স্বরবর্ণগুলিও পাথুরে নয়, নিজের স্থিতিস্থাপকতার গুণে তারা প্রতিবেশীর জন্যে একটু-আধটু জায়গার ব্যবস্থা করতে সহজেই রাজি থাকে। এইজন্যেই অক্ষরের সংখ্যা গণনা করে ছন্দের ধ্বনিমাত্রা গণনা বাংলায় চলে না। এটা বাঙালির আত্মীয়সভার মতন। সেখানে যতগুলো চৌকি তার চেয়ে মানুষ বেশি থাকা কিছুই অসম্ভব নয়, অথবা পাশে ফাঁক পেলে দুইজনের জায়গা একজনে হাত পা মেলে আরামে দখল করাও এই জনতার অভ্যস্ত। বাংলার প্রাকৃতছন্দ ধরে তার প্রমাণ দেওয়া যাক।

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান,
শিবঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান।

এটা তিন মাত্রার ছন্দ। অর্থাৎ চার পোয়ায় সেরওয়ালা এর ওজন নয়, তিন পোয়ায় এর সের। এর প্রত্যেক পা-ফেলার লয় হচ্ছে তিনের।

বৃষ্‌টি। পড়ে-। টাপুর। টুপুর। নদেয়। এল-। বা-ন।
শিবঠা। কুরের। বিয়ে-। হবে। তিন্‌ক। ন্‌নে-। দা-ন।

দেখা যাচ্ছে, তিন গণনায় যেখানে যেখানে ফাঁক, পার্শ্ববর্তী স্বরবর্ণগুলি সহজেই ধ্বনি প্রসারিত করে সেই পোড়ো জায়গা দখল করে নিয়েছে। এত সহজে যে, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে এই ছড়া আউড়েছে, তবু ছন্দের কোনো গর্তে তাদের কারো কণ্ঠ স্খলিত হয়নি। ফাঁকগুলো যদি ঠেসে ভরাতে কেউ ইচ্ছা করেন— দোহাই দিচ্ছি না করেন যেন—তবে এই রকম দাঁড়াবে।

বৃষ্টি পড়ছে টাপুর টুপুর নদেয় আসছে বন্যা,
শিবঠাকুরের বিয়ের বাসরে দান হবে তিন কন্যা।

রামপ্রসাদের একটি গান আছে।—

মা আমায় ঘুরাবি কত
চোখবাঁধা বলদের মতো।

এটাও তিনমাত্রা লয়ের ছন্দ।

মা-আ। মায় ঘু। রাবি-। কত-।

ফাঁক ভরাট করতে হলে হবে এই চেহারা।

হে মাতা আমারে ঘুরাবি কতই
চক্ষুবদ্ধ বৃষের মতোই।

যাঁরা অক্ষর গণনা করে নিয়ম বাঁধেন তাঁদের জানিয়ে রাখা ভালো যে, স্বরবর্ণে টান দিয়ে মিড় দেবার জন্যেই প্রাকৃত-বাংলা ছন্দে কবিরা বিনা দ্বিধায় ফাঁক রেখে দেন; সেই ফাঁকগুলো ছন্দেরই অঙ্গ, সে সব জায়গায় ধ্বনির রেশ কিছু কাজ করবার অবকাশ পায়।

হারিয়ে ফেলা বাঁশি আমার পালিয়েছিল বুঝি
লুকোচুরির ছলে।

এর মধ্যে প্রায় প্রত্যেক যতিতে ফাঁক আছে।

   
হারিয়ে ফেলা-। বাঁশি আমা-র। পালিয়েছিল। বুঝি—।
 
লুকোচুরি-র। ছলে-।

কিছু বৈচিত্র্যও দেখছি। প্রথম দুটি বিভাগে সমান্তরাল ফাঁক। কিন্তু ভাগে ফাঁক বাদ গিয়ে একেবারে চতুর্থ ভাগের শেষে দীর্ঘ ফাঁক পড়েছে। পাঠক ‘হারিয়ে ফেলা’র পরেও ফাঁক না দিয়ে একেবারে দ্বিতীয় ভাগের শেষে যদি সেটা পূরণ করে দেন তবে ভালোই শুনতে হবে। কিন্তু যদি বেফাঁক টাসবুনানির বিশেষ ফরমাশ থাকে তাহলে সেটাও চেষ্টা করলে মন্দ হবে না।

স্বপ্ন আমার বন্ধনহীন সন্ধ্যাতারার সঙ্গী
মরণযাত্রীদলে,
স্বর্ণবরন কুজ্ঝটিকায় অস্তশিখর লঙ্ঘি’
লুকায় মৌনতলে।

 এই কথাটা লক্ষ্য করবার বিষয় যে, হসন্তবর্ণের হ্রস্ব বা দীর্ঘ যে মাত্রাই থাক পাঠ করতে বাঙালি পাঠকের একটুও বাধে না, ছন্দের ঝোঁক আপনিই অবিলম্বে তাকে ঠিকমতো চালনা করে।

পাৎলা করিয়া কাট কাৎলা মাছেরে,
উৎসুক নাৎনি যে চাহিয়া আছেরে।

এই ছড়াটা পড়তে গেলে বাঙালি নিঃসংশয়ে স্বতই খণ্ড ৎ-এর পূর্ববর্তী স্বরবর্ণকে দীর্ঘ করে পড়বে। আবার যেমনি নিম্নের ছড়াটি সামনে ধর

পাৎলা করি কাট প্রিয়ে কাৎলা মাছটিরে
টাট্‌কা তেলে ফেলে দাও সরষে আর জিরে,
ভেট্‌কি যদি জোটে তাহে মাখ লঙ্কাবাঁটা,
যত্ন করে বেছে ফেল টুকরো যত কাঁটা।

অমনি প্রাক্‌হসন্ত স্বরগুলিকে ঠেসে দিতে এক মুহূর্তও দেরি হবে না। এই যে বাংলা স্বরবর্ণের সজীবতা, একে কোনো কড়া নিয়মের চাপে আড়ষ্ট করে তাকে সর্বত্র সমানভাবে ব্যবহারযোগ্য করা উচিত—এ মত চালালে বাংলাভাষাকে ফাঁকি দেওয়া হবে। শুকনো আমসত্ত্বের মধ্যেই সাম্য, কি সরস আমের মধ্যে বৈচিত্র্য, ভোজে কোন্‌টার দাম বেশি তা নিয়ে তর্ক অনাবশ্যক।

 বাংলা-প্রাকৃত ভাষার কাব্যে স্বরধ্বনির যে প্রাণবান্ স্বচ্ছন্দতা আছে সংস্কৃত-বাংলা ভাষা, যাকে আমরা সাধুভাষা বলি, তার মধ্যে পড়ে সে কেন জেনানা মেয়ের মতো দেয়ালে আটকা পড়ে গেল। তার কারণ সংস্কৃত-বাংলা কৃত্রিম ভাষা, ওখানে বাইরের নিয়মের প্রাধান্য, তার আপন নিয়ম অনেক জায়গায় কুণ্ঠিত। সভাস্থলে একটি আসনে একটি মানুষের স্থান নির্দিষ্ট, কারো বা দেহ ক্ষীণ, আসনে ফাঁক থেকে যায়, কারো বা স্থূল দেহ, আসনে ঠেসে বসতে হয়; কিন্তু গোনাগনতি চৌকি, সীমা নির্দিষ্ট। যদি ফরাশে বসতে হত তাহলে কলেবরের তারতম্য ধরে পরস্পরের আসনের সীমানায় কমিবেশি স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটত। কিন্তু সভ্যতার মর্যাদার দিকে দৃষ্টি রেখে স্বভাবের নিয়মকে বাঁধা নিয়মে পাকা করে দিতে হয়। তাতে কিছু পীড়ন ঘটলেও গাম্ভীর্যের পক্ষে তার একটা সার্থকতা আছে। সেইজন্যেই সভার রীতি ও ঘরের রীতিতে কিছু ভেদ থাকেই। শকুন্তলার বাকল দেখে দুষ্যন্ত বলেছিলেন, কিমিব হি মধুরাণাং মণ্ডনং নাকৃতীনাম্; কিন্তু যখন তাঁকে রাজান্তঃপুরে নিয়েছিলেন তখন তাঁকে নিশ্চয়ই বাকল পরাননি। তখন শকুন্তলার স্বাভাবিক শোভাকে অলংকৃত করেছিলেন, সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে নয়, মর্যাদারক্ষার জন্যে। রাজরানীর সৌন্দর্য ব্যক্তিবিশেষে বিচিত্র, কিন্তু তাঁর মর্যাদার আদর্শ সকল রাজরানীর মধ্যে এক। ওটা প্রকৃতির হাতে তৈরি নয়, রাজসমাজের দ্বারা নির্দিষ্ট। অর্থাৎ ওটা প্রাকৃত নয়, সংস্কৃত। তাই দুষ্যন্ত স্বীকার করেছিলেন বটে বনলতার দ্বারা উদ্যানলতা পরাভূত, তবু উদ্যানকে বনের আদর্শে রমণীয় করে তুলতে নিশ্চয় তাঁর সাহস হয়নি। তাই আমি নিজে আকন্দফুল ভালোবাসি, কিন্তু আমার সাধুসমাজের মালি ঐ গাছের অঙ্কুর দেখবামাত্র উপড়ে ফেলে। সে যদি কবি হত, সাধুভাষায় ছাড়া কবিতা লিখত না। সাধুভাষার ছন্দের বাঁধারীতি যে-জাতীয় ছন্দে চলে এবং শোভা পায় সে হচ্ছে পয়ারজাতীয় ছন্দ। এখানে ফাঁক-ফাঁক নির্দিষ্ট আসনের উপর নানা ওজনেরই ধ্বনিকে চড়ানো নিরাপদ্। এখানে ঠিক চোদ্দটা অক্ষরকে বাহন করে যুগ্ম-অযুগ্ম নানারকমের ধ্বনিই একত্র সভা জমাতে পারে।

 কাব্যলীলা একদিন যখন শুরু করেছিলেম তখন বাংলাসাহিত্যে সাধুভাষারই ছিল একাধিপত্য। অর্থাৎ তখন ছিল কাটা-কাটা পিঁড়িতে ভাগকরা ছন্দ। এই আইনের অধীনে যতক্ষণ পয়ারের এলাকায় থাকি ততক্ষণ আসনপীড়া ঘটে না। কিন্তু তিনমাত্রামূলক ছন্দের দিকে আমার কলমের একটা স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল। ঐ ছন্দে প্রত্যেক অক্ষরে স্বতন্ত্র- আরূঢ় সকল ওজনের ধ্বনিকেই সমানদরের একক বলে ধরে নিতে বারংবার কানে বাজত। সেইজন্যে যুক্ত-অক্ষর অর্থাৎ যুগ্মধ্বনি বর্জন করবার একটা দুর্বল অভ্যাস আমাকে ক্রমেই পেয়ে বসছিল। ঠোকর খাবার ভয়ে পদগুলোকে একেবারে সমতল করে যাচ্ছিলুম। সব জায়গায় পেরে উঠিনি, কিন্তু মোটের উপর চেষ্টা ছিল। ‘ছবি ও গান’এ ‘রাহুর প্রেম’ কবিতা পড়লে দেখা যাবে, যুক্ত-অক্ষর ঝেঁটিয়ে দেবার প্রয়াস আছে তবু তারা পাথরের টুকরোর মতো রাস্তার মাঝে মাঝে উঁচু হয়ে রইল। তাই যখন লিখেছিলুম

কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া
চিরকাল তোরে রব আঁকড়িয়া
লৌহশৃঙ্খলের ডোর।

মনে খটকা লেগেছিল, কান প্রসন্ন হয়নি। কিন্তু তখন কলম ছিল অপটু এবং অলস মন ছিল অসতর্ক। কেননা পাঠকদের তরফ থেকে বিপদের আশঙ্কা ছিল না। তখন ছন্দের সদর রাস্তাও গ্রাম্যরাস্তার মতো এবড়ো-খেবড়ো থাকত, অভ্যাসের গতিকে কেউ সেটাকে নিন্দনীয় বলে মনেও করেনি।

 অক্ষরের দাসত্বে বন্দী বলে প্রবোধচন্দ্র বাঙালি কবিদেরকে যে দোষ দিয়েছেন[] সেটা এই সময়কার পক্ষে কিছু অংশে খাটে। অর্থাৎ অক্ষরের মাপ সমান রেখে ধ্বনির মাপে ইতরবিশেষ করা তখনকার শৈথিল্যের দিনে চলত, এখন চলে না। তখন পয়ারের রীতি সকল ছন্দেরই সাধারণ রীতি বলে সাহিত্যসমাজে চলে গিয়েছিল। তার প্রধান কারণ পয়ারজাতীয় ছন্দই তখন প্রধান, অন্যজাতীয় অর্থাৎ ত্রৈমাত্রিক ছন্দের ব্যবহার তখন অতি অল্পই। তাই এই মাইনরিটির স্বতন্ত্র দাবি সেদিন বিধিবদ্ধ হয়নি।

 তারপরে ‘মানসী’ লেখার সময় এল। তখন ছন্দের কান আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। একথা তখন নিশ্চিত বুঝেছি যে, ছন্দের প্রধান সম্পদ্ যুগ্মধ্বনি, অথচ এটাও জানছি যে পয়ারসম্প্রদায়ের বাইরে নির্বিচারে যুগ্মধ্বনির পরিবেশন চলে না।

রয়েছি পড়িয়া শৃঙ্খলে বাঁধা

এ লাইন-বেচারাকে পয়ারের বাঁধাপ্রথাটা শৃঙ্খল হয়েই বেঁধেছে, তিনমাত্রার স্কন্ধকে চারমাত্রার বোঝা বইতে হচ্ছে।[] সেই ‘মানসী’ লেখবার বয়সে আমি যুগ্মধ্বনিকে দুইমাত্রার মূল্য দিয়ে ছন্দ রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি। প্রথম প্রথম পয়ারেও সেই নিয়ম প্রয়োগ করেছিলুম।[] অনতিকাল পরেই দেখা গেল তার প্রয়োজন নেই।[] পয়ারে যুগ্মধ্বনির উপযুক্ত ফাঁক যথেষ্ট আছে। এই প্রবন্ধে আমি ত্রিপদী প্রভৃতি পয়ারজাতীয় সমস্ত দ্বৈমাত্রিক ছন্দকেই ‘পয়ার’ নাম দিচ্ছি।

 পয়ারে ধ্বনিবিন্যাসের এই যে স্বচ্ছন্দতা, দুই মাত্রার লয় তার একমাত্র কারণ নয়। পয়ারের পদগুলিতে তার ধ্বনিভাগের বৈচিত্র্য একটা মস্ত কথা। সাধারণ ভাগ হচ্ছে ৩+৩+২+৩+৩। যথা—

নিখিল আকাশভরা আলোর মহিমা
তৃণের শিশির মাঝে লভিল প্রতিমা।

অন্য রকম। যথা—

তপনের পানে চেয়ে সাগরের ঢেউ
বলে ওই পুতলিরে এনে দে-না কেউ।

অথবা

রাখি যাহা তার বোঝা কাঁধে চেপে রহে,
দিই যাহা তার ভার চরাচর বহে।

অথবা

সারা দিবসের হায় যত কিছু আশা
রজনীর কারাগারে হারাবে কি ভাষা।

অমিত্রাক্ষর ছন্দে পয়ারের প্রবর্তন হয়েছে এই কারণেই সে কোনো কোনো আদিম জীবের মতো বহুগ্রন্থিল, তাকে নষ্ট না করেও যেখানে-সেখানে ছিন্ন করা যায়।[১০] এই ছেদের বৈচিত্র্য থাকাতেই প্রয়োজন হলে সে পদ্য হলেও গদ্যের অবন্ধ গতি অনেকটা অনুকরণ করতে পারে। সে গ্রামের মেয়ের মতো; যদিও থাকে অন্তঃপুরে, তবুও হাটে-ঘাটে তার চলাফেরায় বাধা নেই।

 উপরের দৃষ্টান্তগুলিতে ধ্বনির বোঝা হালকা। যুগ্মবর্ণের ভার চাপানো যাক।

সুরাঙ্গনা নন্দনের নিকুঞ্জ প্রাঙ্গণে
মন্দারমঞ্জরি তোলে চঞ্চলকঙ্কণে।
বেণীবন্ধ তরঙ্গিত কোন্ ছন্দ নিয়া,
স্বর্গবীণা গুঞ্জরিছে তাই সন্ধানিয়া।

 আধুনিক বাংলা ছন্দে সবচেয়ে দীর্ঘ পয়ার আঠার অক্ষরে গাঁথা। তার প্রথম যতি পদের মাঝখানে আট অক্ষরের পরে, শেষ যতি দশ অক্ষরের পরে পদের শেষে। এতেও নানাপ্রকারের ভাগ চলে। তাই অমিত্রাক্ষরের লাইনডিঙানো চালে এর ধ্বনিশ্রেণীকে নানারকমে কুচকাওয়াজ করানো যায়।

হিমাদ্রির ধ্যানে যাহা | স্তব্ধ হয়ে ছিল রাত্রিদিন
সপ্তর্ষির দৃষ্টিতলে | বাক্যহীন স্তব্ধতায় লীন,
সেই নির্ঝরিণী-ধারা | রবিকরস্পর্শে উচ্ছ্বসিতা
দিগ্‌দিগন্তে প্রচারিছে | অন্তহীন আনন্দের গীতা।

বাংলায় এই আরেকটি গুরুভারবহ ছন্দ। এরা সবাই মহাকাব্য বা আখ্যান বা চিন্তাগর্ভ বড়ো বড়ো কথার বাহন। ছোটো পয়ার আর এই বড়ো পয়ার, বাংলা কাব্যে এরা যেন ইন্দ্রের উচ্চেঃশ্রবা আর ঐরাবত। অন্তত এই বড়ো পয়ারকে গীতিকাব্যের কাজে খাটাতে গেলে বেমানান হয়। এর নিজের গড়নের মধ্যেই একটা সমারোহ আছে, সেইজন্যে এর প্রয়োজন সমারোহসূচক ব্যাপারে।

 ছোটো পয়ারকে চেঁচে ছুলে হালকা কাজে লাগানো যায়, যেমন বাঁশের কঞ্চিকে ছিপ করা চলে। পয়ারের দেহসংস্থানেই গুরুর সঙ্গে লঘুর যোগ আছে। তার প্রথম অংশে আট, দ্বিতীয় অংশে ছয়; অর্থাৎ হালের দিকে সে চওড়া কিন্তু দাঁড়ের দিকে সরু; তাকে নিয়ে মালবওয়ানোও যায়, বাচ-খেলানোও চলে। বড়ো পয়ারের দেহসংস্থান এর উলটো; তার প্রথমভাগে আট, শেষভাগে দশ; তার গৌরবটা ক্রমেই প্রশস্ত হয়ে উঠেছে। ছোটো পয়ারের ছিবলেমির একটা পরিচয় দেওয়া যাক।

খুব তার বোলচাল, সাজ ফিটফাট,
তকরার হলে আর নাই মিটমাট।
চশমায় চমকায় আড়ে চায় চোখ,
কোনো ঠাঁই ঠেকে নাই কোনো বড়ো লোক।

এর ভাগগুলোকে কাটা-কাটা ছোটো ছোটো করে হ্রস্বস্বরে হসন্তবর্ণে ঘনঘন ঝোঁক দিয়ে এর চটুলতা বাড়িয়ে দেওয়া গেছে। এখানে এটা পাতলা কিরিচের মতো। একেই আবার যুগ্মধ্বনির যোগে মজবুত করে খাড়া করে তোলা যায়।

বাক্য তার অনর্গল মল্লসজ্জাশালী,
তর্কযুদ্ধে উগ্র তেজ, শেষ যুক্তি গালি।
ভ্রূকুটিপ্রচ্ছন্ন চক্ষু কটাক্ষিয়া চায়,
কুত্রাপিও মহত্ত্বের চিহ্ন নাহি পায়।

যেখানে-সেখানে নানা প্রকার অসমান ভার নিয়েও পয়ারের পদস্খলন হয় না, এই তত্ত্বটির মধ্যে অসামান্যতা আছে। অন্য কোনো ভাষার কোনো ছন্দে এ-রকম স্বচ্ছন্দতা এতটা পরিমাণে আছে বলে আমি তো জানিনে।

 এর কৌশলটা কোন্‌খানে যখন ভেবে দেখা যায়, তখন দেখি পয়ারে প্রত্যেক পদের মাঝখানে ও শেষে যে দুটো হাঁফ ছাড়বার যতি আছে সেইখানেই তার ভারসামঞ্জস্য হয়ে থাকে।

নিঃস্বতা-সংকোচে দিন | অবসন্ন হলে
নিভৃতে নিঃশব্দ সন্ধ্যা | নেয় তারে কোলে।

গণনা করে দেখলে ধরা পড়ে এই পয়ারের দুই লাইনে ধ্বনিভারের সাম্য নেই। তবু যে টলমল করতে করতে ছন্দটা কাত হয়ে পড়ে না, তার কারণ ডাইনে-বাঁয়ে যতির লগির ঠেকা দিয়ে দিয়ে তাকে চালিয়ে নেওয়া হয়। চতুষ্পদ জন্তু যেমন তার ভারী দেহটাকে দুইজোড়া পায়ের দ্বারা দুই দিকে ঠেকাতে ঠেকাতে চলে সেই রকম। পয়ারের প্রকৃতরূপ চোদ্দটা অক্ষরে নয়, সেটা প্রথম অংশের আট অক্ষর ও দ্বিতীয় অংশের ছয় অক্ষরের পরবর্তী দুই যতিতে। অজগর সমস্ত দেহটা নিয়ে চলে। তার দেহে মুণ্ড এবং ধড়ের মধ্যে ভাগ নেই। ঘোড়ার দেহে সেই ভাগ আছে। তার মুণ্ডটার পরে যেখানে গলা সেখানে একটা যতি, ধড়ের শেষভাগে যেখানে ক্ষীণকটি সেখানেও আর একটা। এই বিভক্তভারের দেহকে সামলিয়ে নিয়ে সে চার পা ফেলে চলে। পয়ারেরও সেইরকম বিশেষভাবে বিভক্ত দেহ এবং চার পা ফেলতে ফেলতে চলা। চতুষ্পদ জন্তুর দুই পায়ের সমান বিন্যাস। যদি এমন হত যে, কোনো জানোয়ারের পা দুটো বাঁয়ের চেয়ে ডাইনে এক ফুট বেশি লম্বা তাহলে তার চলনে স্থিতির চেয়ে অস্থিতিই বেশি হত; সুতরাং তার পিঠে সওয়ার চাপালে কোনো পক্ষেই আরাম থাকত না। ছন্দে তার একটা দৃষ্টান্ত দিই।

তরণী বেয়ে শেষে | এসেছি ভাঙা ঘাটে,
স্থলে না মেলে ঠাঁই | জলে না দিন কাটে।

এ ছড়ায় প্রত্যেক লাইনে চোদ্দ অক্ষর এবং মাঝে আর শেষে দুই যতিও আছে। তবু ওকে পয়ার বলবার জো নেই। ওর পা-ফেলার ভাগ অসমান।

তরণী। বেয়ে শেষে। এসেছি। ভাঙা ঘাটে।

এক পায়ে তিন মাত্রা আর এক পায়ে চার। সাত মাত্রার পরে একটা করে যতি আছে, কিন্তু বিজোড় অঙ্কের অসাম্য ঐ যতিতে পুরো বিরাম পায় না। সেইজন্যে সমস্ত পদটার মধ্যে নিয়তই একটা অস্থিরতা থাকে, যে পর্যন্ত না পদের শেষে এসে একটা সম্পূর্ণ স্থিতি ঘটে। এই অস্থিরতাই এরকম ছন্দের স্বভাব, অর্থাৎ পয়ারের ঠিক বিপরীত। এই অস্থিরতার সৌন্দর্যকে ব্যবহার করবার জন্যেই এই রকম ছন্দের রচনা। এর পিঠের উপর যেমন-তেমন করে যুগ্মধ্বনির সওয়ার চাপালে অস্বস্তি ঘটে। যদি লেখা যায়

সায়াহ্ন-অন্ধকারে এসেছি ভগ্ন ঘাটে

তাহলে ছন্দটার কোমর ভেঙে যাবে। তবুও যদি যুগ্মবর্ণ দেওয়াই মত হয় তাহলে তার জন্যে বিশেষভাবে জায়গা করে দিতে হবে। পয়ারের মতো উদারভাবে যেমন খুশি ভার চাপিয়ে দিলেই হল না।

অন্ধরাতে যবে | বন্ধ হল দ্বার,
ঝঞ্ঝাবাতে ওঠে | উচ্চ হাহাকার।

মনে রাখা দরকার এই শ্লোক অবিকৃত রেখেও এর ভাগের যদি পরিবর্তন করে পড়া যায়, দুই ভাগের বদলে প্রত্যেক লাইনে যদি তিন ভাগ বসানো যায়, তাহলে এটা আরেক ছন্দ হয়ে যাবে। একে নিম্নলিখিত রকম ভাগ করে পড়া যাক।

অন্ধরাতে | যবে বন্ধ | হল দ্বার
ঝঞ্ঝাবাতে | ওঠে উচ্চ | হাহাকার।

 পশুপক্ষীদের চলন সমান মাত্রার দুই বা চার পায়ের উপর। এই পা-কে কেবল যে চলতে হয় তা নয়, দেহভার বইতে হয়। পদক্ষেপের সঙ্গেসঙ্গেই বিরাম আছে বলে বোঝা সামলিয়ে চলা সম্ভব। আজ পর্যন্ত জীবলোকে জুড়িওয়ালা পায়ের পরিবর্তে চাকার উদ্ভব কোথাও হল না। কেননা চাকা না থেমে গড়িয়ে চলে, চলার সঙ্গে থামার সামঞ্জস্য তার মধ্যে নেই। দুইমূলক সমমাত্রায় দুই পায়ের চাল, তিনমূলক অসমমাত্রায় চাকার চাল। দুইপা-ওয়ালা জীব উঁচুনিচু পথের বাধা ডিঙিয়ে চলে যায়। পয়ারের সেই শক্তি। চাকা বাধায় ঠেকলে ধাক্কা খায়, ত্রৈমাত্রিক ছন্দের সেই দশা। তার পথে যুগ্মস্বর[১১] যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সেই চেষ্টা করতে হবে।

অধীর বাতাস এল সকালে
বনেরে বৃথাই শুধু বকালে।
দিনশেষে দেখি চেয়ে
ঝরা ফুলে মাটি ছেয়ে
লতারে কাঙাল করে ঠকালে।

এ ছন্দ পয়ারজাতীয়, টেনিস খেলোয়াড়ের আধা-পায়জামার মতো বহরটা নিচের দিকে ছাঁটা। এ ছন্দে তাই যুগ্মস্বর যেমন খুশি চলে।

নবারুণ চন্দনের তিলকে
দিক্‌ললাট এঁকে আজি দিল কে।
বরণের পাত্র হাতে
ঊষা এল সুপ্রভাতে,
জয়শঙ্খ বেজে ওঠে ত্রিলোকে।

কিন্তু

শরতে শিশির বাতাস লেগে
জল ভরে আসে উদাসী মেঘে।
বরষন তবু হয় না কেন,
ব্যথা নিয়ে চেয়ে রয়েছে যেন।

এখানে তিনমাত্রার ছন্দ গড়িয়ে চলেছে। চাকার চাল, পা ফেলার চাল নয়; তাই যুগ্মবর্ণের স্বেচ্ছাচারিতা এর সইবে না।

চাষের সময়ে যদিও করিনি হেলা,
ভুলিয়া ছিলাম ফসল-কাটার বেলা।

পয়ারের মতোই চোদ্দটা অক্ষরে পদ, কিন্তু জাত আলাদা। তিনমাত্রার চাকায় চলেছে। পদাতিকের সঙ্গে চক্রীর মেলে না।

শ্যামল ঘন | বকুলবন | ছায়ে ছায়ে
যেন কী সুর | বাজে মধুর | পায়ে পায়ে।

এখানেও চোদ্দ অক্ষর। কিন্তু এর চালে পয়ারের মতো সমমাত্রার পদচারণের শান্তি নেই বলে বিষমমাত্রার ভাগগুলি যতির মধ্যেও গতির ঝোঁক রেখে দেয়। খোঁড়া মানুষের চলার মতো, যতক্ষণ না লক্ষ্য স্থানে গিয়ে বসে পড়ে থেমেও ভালো করে থামতে পারে না।

 বাংলা চলতি ভাষায় মূল সংস্কৃত শব্দের অনেকগুলি বর্ণ ই কোনোটা আধখানা কোনোটা পুরোপুরি ক্ষয়ে যাওয়াতে ব্যঞ্জনগুলো তাল পাকিয়ে অত্যন্ত পরস্পরের গায়ে-পড়া হয়ে গেছে। স্বরের ধ্বনিই ব্যঞ্জনের ধ্বনিকে অবকাশ দেয়, তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে; সেগুলো সরে গেলেই ব্যঞ্জনধ্বনি পিণ্ডীভূত হয়ে পড়ে। চলিত এবং চল্‌তি, ঘৃণা এবং ঘেন্না, বসতি এবং বস্‌তি, শব্দগুলো তুলনা করে দেখলেই বোঝা যাবে। সংস্কৃত ভাষায় স্বরধ্বনির দাক্ষিণ্য, আর প্রাকৃত-বাংলায় তার কার্পণ্য, এইটেই হল দুটো ভাষার ধ্বনিগত মূল পার্থক্য। স্বরবর্ণবহুল ধ্বনিসংগীত এবং স্বরবর্ণবিরল ধ্বনিসংগীতে প্রভূত প্রভেদ। এই দুইয়েরই বিশেষ মূল্য আছে। বাঙালি কবি তাঁদের কাব্যে যথাস্থানে দুটোরই সুযোগ নিতে চান। তাঁরা ধ্বনিরসিক বলেই কোনোটাকেই বাদ দিতে ইচ্ছা করেন না।

 প্রাকৃত-বাংলার ধ্বনির বিশেষত্ববশত দেখতে পাই তার ছন্দ তিনমাত্রার দিকেই বেশি ঝুঁকেছে। অর্থাৎ তার তালটা স্বভাবতই একতালাজাতীয়, কাওয়ালিজাতীয় নয়। সংস্কৃত ভাষায় এই ‘তাল’ শব্দটা দুই সিলেব্‌ল্‌এর; বাংলায় ল আপন অন্তিম অকার খসিয়ে ফেলেছে, তার জায়গায় টি বা টা যোগ করে শব্দটাকে পুষ্ট করবার দিকে তার ঝোঁক। টি টা-এর ব্যবধান যদি না থাকে তবে ঐ নিঃস্বর ধ্বনিটি প্রতিবেশী যে-কোনো ব্যঞ্জন বা স্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পূর্ণতা পেতে চায়।

রূপসাগরের তলে ডুব দিনু আমি

এটা সংস্কৃত-বাংলার ছাঁদে লেখা। এখানে শব্দগুলো পরস্পর গা-ঘেঁষা নয়। বাংলা-প্রাকৃতের অনিবার্য নিয়মে এই পদের যে শব্দগুলি হসন্ত, তারা আপনারই স্বরধ্বনিকে প্রসারিত করে ফাঁক ভরতি করে নিয়েছে। ‘রূপ’ এবং ‘ডুব’ আপন উকারধ্বনিকে টেনে বাড়িয়ে দিলে। ‘সাগরের’ শব্দ আপন একারকে পরবর্তী হসন্ত র-এর পঙ্গুতা চাপা দিতে লাগিয়েছে। এই উপায়ে ঐ পদটার প্রত্যেক শব্দ নিজের মধ্যেই নিজের মর্যাদা বাঁচিয়ে চলেছে। অর্থাৎ এ-ছন্দে ডিমক্রেসির প্রভাব নেই। এই রকমের ছন্দে দুই মাত্রার ধ্বনি আপন পদক্ষেপের প্রত্যেক পর্যায়ে যে অবকাশ পায় তা নিয়ে তার গৌরব। বস্তুত এই অবকাশের সুযোগ গ্রহণ করে তার ধ্বনিসমারোহ বাড়িয়ে তুললে এ ছন্দের সার্থকতা। যথা—

চৈতন্য নিমগ্ন হল রূপসিন্ধুতলে।

প্রাকৃত-বাংলা দেখা যাক।

রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করি

‘এখানে ‘রূপ’ আপন হসন্ত প-এর ঝোঁকে ‘সাগরে’র সা-টাকে টেনে আপন করে নিয়েছে, মাঝে ব্যবধান থাকতে দেয়নি। 'রূপ-সা' তাই আপনিই তিনমাত্রা হয়ে গেল। ‘সাগরে’র বাকি টুকরো রইল ‘গরে’। সে আপন ওজন বাঁচাবার জন্যে রে-টাকে দিলে লম্বা করে, তিনমাত্রা পুরল। ‘ডুব’ আপনার হসন্তর টানে ‘দিয়েছি’র দি-টাকে করলে আত্মসাৎ। এমনি করে আগাগোড়া তিনমাত্রা জমে উঠল। হসন্তপ্রধান ভাষা সহজেই তিনমাত্রার দানা পাকায়, এটা দেখেছি। এমন কি, যেখানে হসন্তের ভিড় নেই সেখানেও তার ঐ একই চাল। এটা যেন তার অভ্যস্ত হয়ে মজ্জাগত হয়ে গেছে। যেমন—

অচে- | তনে-| ছিলেম | ভালো-।
আমায় | চেতন। করলি | কেনে-।

প্রাকৃত-বাংলার এই তিনমাত্রার ভঙ্গি চণ্ডীদাস জ্ঞানদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিরা সাধুভাষাতেও গ্রহণ করেছেন। যেমন—

হাসিয়া হাসিয়া মুখ নিরখিয়া
মধুর কথাটি কয়।
ছায়ার সহিতে ছায়া মিশাইতে
পথের নিকটে রয়।

কিন্তু প্রাকৃত-বাংলার ক্রিয়াপদ নিয়ে একটু ভাববার বিষয় আছে।

মত্তরোষে বীরভদ্র ছুট্‌ল ঊর্ধ্বশ্বাসে,
ঘূর্ণিবেগে উড়্‌ল ধুলো রক্ত সন্ধ্যাকাশে।

কিংবা

ছুট্‌ল কেন মহেন্দ্রের আনন্দের ঘোর,
টুট্‌ল কেন উর্বশীর মঞ্জীরের ডোর।
বৈকালে বৈশাখী এল আকাশলুণ্ঠনে,
শুক্লরাতি ঢাক্‌ল মুখ মেঘাবগুণ্ঠনে।

এদের সম্বন্ধে কী বলা যাবে। প্রধানত ক্রিয়াপদেরই বিশেষ রূপটাতে প্রাকৃত-বাংলার চেহারা ধরা পড়ে। উপরের ছড়াগুলিতে ‘উড়্‌ল' ‘ছুট্‌ল’ ‘টুট্‌ল’ ‘ঢাক্‌ল’ প্রভৃতি প্রয়োগ নিয়ে তর্কটা ছন্দের তর্ক নয়, ভাষারীতির। এই রকম ক্রিয়াপদ যদি ব্যবহার করি তবে ধরে নিতে হবে ঐ ছড়াগুলি প্রাকৃত-বাংলাতেই লেখা হচ্ছে। আমি যে প্রবন্ধ লিখছি এও প্রাকৃত-বাংলার ঠাটে। যদি আমাকে কারো সঙ্গে মুখে মুখে আলোচনা করতে হত তাহলে এই লেখার সঙ্গে আমার মুখের কথার কোনো তফাত থাকত না। মাঝে মাঝে অভ্যাসদোষে হয়তো ইংরেজি শব্দ মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেত, কিন্তু কখনোই ‘করিয়াছিল’ ‘গিয়াছে’ ধরনের ক্রিয়াপদ ভুলেও ব্যবহার করতে পারতুম না। আবার প্রাকৃত-বাংলার ক্রিয়াপদ সংস্কৃত-বাংলায় ব্যবহার করাও চলে না। প্রবোধচন্দ্র ‘বিচিত্রা’য়[১২] লিখেছেন যে, বাঙালি কবিরা সাহস করে কবিতায় ‘করিব’ ‘চলিব’ প্রভৃতি প্রয়োগ না করে কেন ‘করব’ ‘চলব’ প্রয়োগ না করেন। যদি প্রশ্নটার অর্থ এই হয় যে, অযথাস্থানে কেন করিনে তবে তার উত্তর দেওয়া অনাবশ্যক। যদি বলেন যথাস্থানেও কেন করিনে তবে তার উত্তরে বলব, যথাস্থানে করে থাকি।

 যে তর্ক নিয়ে লেখা শুরু করেছিলেম সেটাতে ফিরে আসা যাক। বাংলায় হসন্তমধ্য শব্দগুলোয় কয় মাত্রা গণনা করা হবে তাই নিয়ে সংশয় উঠেছে।

 [সংস্কৃত ভাষায় শব্দের মাঝখানে হসন্তবর্ণ যুক্তবর্ণের রূপ ধরে সাধুভাষায় অনায়াসেই আপন স্থান পেয়েছে। একমাত্র খণ্ড-ৎ অক্ষরমহলে আপন অনুবর্তী জুড়ির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। প্রাকৃত-বাংলায় শব্দমধ্যবর্তী হসন্তবর্ণ আপন বিচ্ছিন্ন অক্ষররূপ রক্ষা করে রয়ে গেছে। তার অধিকাংশই ক্রিয়াপদ।]

 যেগুলি ক্রিয়াপদ নয় সে সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এ-প্রবন্ধের গোড়াতেই আলোচনা করেছি। বলেছি নিয়মের বিকল্প চলে; কেননা বাঙালির কান সাধারণ ব্যবহারে সেই বিকল্প মঞ্জুর করেছে। এ-ক্ষেত্রে হিসাবে একটা মাত্রার কমিবেশি নিয়ে তর্ক ওঠে না।

চিমনি ভেঙে গেছে দেখে গিন্নি রেগে খুন,
ঝি বলে আমার দোষ নেই ঠাকরুন।

অন্তত ‘চিমনি’কে দুই মাত্রা করায় কবির দোষ হয়নি। আবার

চিমনি ফেটেছে দেখে গৃহিণী সরোষ,
ঝি বলে ঠাকরুন মোর নাই কোনো দোষ।

এ রকম বিপর্যয়ও চলে। একই ছড়ায় ‘চিমনি’কে একমাত্রা গ্রেসমার্কা দেওয়া হয়েছে, অথচ ‘ঠাকরুন’কে খর্ব করে তিনমাত্রায় নামানো গেল। অপরাধ ঘটেছে বলে মনে করিনি।

কুস্তির আখড়ায় ভিস্তিকে ধরে
জল ছিটাইয়া দাও, ধুলা যাক মরে।

অপর পক্ষে

রাস্তা দিয়ে কুস্তিগির চলে ঘেঁষাঘেষি,
একটা নয় দুটো নয় একশোর বেশি।

প্রয়োজনমতো এটাও চলে, ওটাও চলে। নিখতির মাপে বিচার করতে গেলে বিশুদ্ধ ওজনের পয়ার হচ্ছে

পালোয়ানে পালোয়ানে চলে ঘেঁষাঘেষি।

তাতে প্রত্যেক অক্ষর নিখুঁত একমাত্রা, সবসুদ্ধ চোদ্দটা। ‘রাস্তা’ ‘কুস্তি’ প্রভৃতি শব্দে ওজন বেড়ে যায়, তবুও বহুসহিষ্ণু পয়ারকে কাবু করতে পারে না।

 প্রাকৃত-বাংলার ক্রিয়াপদ নিয়ে কথা হচ্ছিল। ক্রিয়াপদেই তার আপন চেহারা। ঐটুকু ছাড়া তার আর কোনো উপসর্গ নেই বললেই চলে। বাংলা-সংস্কৃত ভাষার মতো সে শুচিবায়ুগ্রস্ত নয়। ভোজে বসে গেছে ব্রাহ্মণ, তাকে পরিবেশনকর্তা জিজ্ঞাসা করলে, নিরামিষ না আমিষ। সে বললে, দ্বৌ কর্তব্যৌ। তেমনি শব্দবাছাই নিয়ে যদি প্রাকৃত-বাংলাকে প্রশ্ন করা যায়, ‘কী চাই, প্রাকৃত শব্দ না সংস্কৃত শব্দ’ সে বলবে, দ্বৌ কর্তব্যৌ। তার জাতবিচার নেই বললেই হয়। পছন্দ হবামাত্র ইংরেজি পারসি সব শব্দই সে আত্মসাৎ করে। আবার অমরকোষবিহারী বড়ো বড়ো বহরওয়ালা সংস্কৃত শব্দকে ওদেরি ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে নেয়। সংস্কৃত ভাষার প্রতি সম্ভ্রমবশত তার মুখে বাধবে না—

রূপযৌবন উপঢৌকন
দেবেন কন্যা তাহারে,
তাই পরেছেন চীনাংশুকের
পট্টবসন বাহারে।

নন-কো-অপরেশনের দিনেও ইংরেজি শব্দ চালিয়ে দিতে পিকেটিঙের ভয় নেই। যথা—

আইডিয়াল নিয়ে থাকে, নাহি চড়ে হাঁড়ি,
প্র্যাকটিক্যাল লোকে বলে, এ যে বাড়াবাড়ি।
শিবনেত্র হল বুঝি, এইবার মোলো,
অকসিজেন নাকে দিয়ে চাঙ্গা করে তোলো।

কিন্তু সংস্কৃত-বাংলায় বাছবিচার খুব কড়া। আধুনিকদের হাতে পড়ে ম্লেচ্ছপনা কিছুকিছু সয়ে গেছে; কিন্তু সেটুকু বড়োজোর বাইরের রোয়াকে, ভিতরমহলে রীতরক্ষা সম্বন্ধে কষাকষি।

কর্ণে দিলা ঝুমকাফুল, নাসিকায় নথ,
অঙ্গসজ্জা-সমাধানে ভূরি মেহম্নত।

এটাকে প্রহসন বলে পাঠক হয়তো মাপ করতে পারেন, কিন্তু প্রাকৃতবাংলায় এই রকম ভিন্নপর্যায়ের শব্দগুলো যখন কাছাকাছি বসানো যায় তাদের আওয়াজের মধ্যে অত্যন্ত বেশি বেমিল হয় না। আমার এই গদ্য প্রবন্ধ পড়ে দেখলে পাঠকেরা সেটা লক্ষ্য করতে পারবেন। কিন্তু এটাও দেখে থাকবেন এটার মধ্যে ‘করিব’ ‘করিয়াছে’ ‘করিয়াছিল’ প্রভৃতি ক্রিয়ারূপ কলমের কোনো ভুলে ঢুকে পড়বার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেইজন্যে আমরা বাংলায় সংস্কৃতে ও প্রাকৃতে দুই ভিন্ন নিয়মেই চলি, তার অন্যথা করা অসম্ভব। তাই বাংলাকাব্যে এই দুই ভাষার ধারায় ছন্দের রীতি যদি দুই ভিন্ন পথ নিয়ে থাকে তবে সেই আপত্তিতে শুদ্ধির গোময়লেপনে সমস্ত একাকার করবার পক্ষপাতী আমি নই। আমি বলি, দ্বৌ কর্তব্যৌ। কারণ ছন্দের এই দ্বিবিধরসেই আমার রসনার লোভ।

 পরিচয়—১৩৩৮ মাঘ

...তব চিত্তগগনের দূর দিক্‌সীমা
বেদনার রাঙা মেঘে পেয়েছে মহিমা।

এখানে ‘দিক্‌’ শব্দের ক্ হসন্ত হওয়া সত্ত্বেও তাকে একমাত্রার পদবি দেওয় গেল। নিশ্চিত জানি পাঠক সেই পদবির সম্মান স্বতই রক্ষা করে চলবেন।

মনের আকাশে তার দিক্‌সীমানা বেয়ে
বিবাগী স্বপনপাখি চলিয়াছে ধেয়ে।

অথবা

দিগ্‌বলয়ে নবশশিলেখা
টুক্‌রো যেন মানিকের রেখা।

এতেও কানের সম্মতি আছে।

দিক্‌প্রান্তে ওই চাঁদ বুঝি
দিক্-ভ্রান্ত মরে পথ খুঁজি।

আপত্তির বিশেষ কারণ নেই।

দিক্‌প্রান্তের ধূমকেতু উন্মত্তের প্রলাপের মতো
নক্ষত্রের আঙিনায় টলিয়া পড়িল অসংগত।

এও চলে। একের নজিরে অন্যের প্রামাণ্য ঘোচে না।

 কিন্তু যাঁরা এ নিয়ে আলোচনা করছেন তাঁরা একটা কথা বোধ হয় সম্পূর্ণ মনে রাখছেন না যে, সব দৃষ্টান্তগুলিই পয়ারজাতীয় ছন্দের। আর এ-কথা বলাই বাহুল্য যে, এই ছন্দ যুক্তধ্বনি ও অযুক্তধ্বনি উভয়কেই বিনা পক্ষপাতে একমাত্রারূপে ব্যবহার করবার সনাতন অধিকার পেয়েছে। আবার যুক্তধ্বনিকে দুইভাগে বিশ্লিষ্ট করে তাকে দুইমাত্রায় ব্যবহার করার স্বাধীনতা সে যে দাবি করতে পারে না তাও নয়।

 যাকে আমি অসম বা বিষমমাত্রার ছন্দ বলি যুক্তধ্বনির বাছবিচার তাদেরই এলাকায়।

হৃৎ-ঘটে সুধারস ভরি

কিংবা

হৃৎ-ঘটে অমৃতরস ভরি
তৃষা মোর হরিলে সুন্দরী।

এ ছন্দে দুইই চলবে। কিন্তু

অমৃতনির্ঝরে হৃৎপাত্রটি ভরি
কারে সমর্পণ করিলে সুন্দরী।

অগ্রাহ্য, অন্তত আধুনিক কালের কানে। অসমমাত্রার ছন্দে এরকম যুক্তধ্বনির বন্ধুরতা আবার একদিন ফিরে আসতেও পারে, কিন্তু আজ এটার চল নেই।

 এই উপলক্ষ্যে একটা কথা বলে রাখি, সেটা আইনের কথা নয়, কানের অভিরুচির কথা।

হৃৎপটে আঁকা ছবিখানি

ব্যবহার করা আমার পক্ষে সহজ, কিন্তু

হৃৎপত্রে আঁকা ছবিখানি

অল্প একটু বাধে। তার কারণ খণ্ড ৎ-কে পূর্ণ ত-এর জাতে তুলতে হলে তার পূর্ববর্তী স্বরবর্ণকে দীর্ঘ করতে হয়; এই চুরিটুকুতে পীড়াবোধ হয় না যদি পরবর্তী স্বরটা হ্রস্ব থাকে। কিন্তু পরবর্তী স্বরটাও যদি দীর্ঘ হয় তাহলে শব্দটার পায়াভারি হয়ে পড়ে।

হৃৎপত্রে এঁকেছি ছবিখানি

আমি সহজে মঞ্জুর করি, কারণ এখানে ‘হৃৎ’ শব্দের স্বরটি ছোটো ও ‘পত্র’ শব্দের স্বরটি বড়ো। রসনা ‘হৃৎ’ শব্দ দ্রুত পেরিয়ে ‘পত্র’ শব্দে পুরো ঝোঁক দিতে পারে। এই কারণেই ‘দিক্‌সীমা’ শব্দকে চারমাত্রার আসন দিতে কুণ্ঠিত হইনে, কিন্তু ‘দিক্‌প্রান্ত’ শব্দের বেলা ঈষৎ-একটু দ্বিধা হয়। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, দরিদ্রান্ ভর কৌন্তেয়; ‘দিক্‌সীমা’ কথাটি দরিদ্র, ‘দিক্‌প্রান্ত’ কথাটি পরিপুষ্ট।

এ অসীম গগনের তীরে
মৃৎকণা জানি ধরণীরে।

‘মৃৎকণা’ না বলে যদি ‘মৃৎপিণ্ড’ বলা যায় তবে তাকে চালিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু একটু যেন ঠেলতে হয় তবেই চলে।

মৃৎ-ভবনে এ কী সুধা
রাখিয়াছ হে বসুধা।

কানে বাধে না। কিন্তু

মৃৎ-ভাণ্ডেতে এ কী সুধা
ভরিয়াছ হে বসুধা।

কিছু পীড়া দেয় না যে তা বলতে পারিনে। কিন্তু অক্ষর গনতি করে যদি বল ওটা ইন্‌ভীডিয়স্ ডিস্‌টিঙ্ক্‌শন, তাহলে চুপ করে যাব। কারণ কান-বেচারা প্রিমিটিভ্ ইন্দ্রিয়, তর্কবিদ্যায় অপটু।...

 পরিচয়—১৩৩৯ কার্তিক
  1. ৪৯ পৃষ্ঠায় পাদটীকা ১ দ্রষ্টব্য।
  2. বিচিত্রা—১৩৩৮ অগ্রহায়ণ: বাংলা অক্ষবৃত্ত ছন্দের স্বরূপ।
  3. উত্তরা—১৩৩৮ আশ্বিন: পত্রধারা।
  4. নীরেন্দ্রনাথ রায়।
  5. পরিচয়—১৩৩৮ কার্তিক: অনুবাদ।
  6. ৫২ পৃষ্ঠায় পাদটীকা ২ দ্রষ্টব্য।
  7. ‘শৃঙ্খলে’ শব্দে চার মাত্রা না ধরে তিন মাত্রা ধরা হয়েছে। পরবর্তী ‘গদ্যছন্দ’ প্রবন্ধের প্রথম উদ্ধৃতি দ্রষ্টব্য।
  8. ‘মানসী’র প্রথম সংস্করণের ভূমিকা দ্রষ্টব্য।
  9. গ্রন্থপরিচয় দ্রষ্টব্য।
  10. দৃষ্টান্ত ৪৪ পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য।
  11. যুগ্মধ্বনি। পরবর্তী ‘যুগ্মস্বর’ ও ‘যুগ্মবর্ণ’ লক্ষিতব্য।
  12. ১৩৩৮ অগ্রহায়ণ, পৃ ৫৭৪-৭৫।