ছন্দ/দিলীপকুমার রায়কে

দিলীপকুমার রায়কে লেখা

গীতাঞ্জলির কয়েকটি গানের ছন্দ সম্বন্ধে কৈফিয়ত চেয়েছ। গোড়াতেই বলে রাখা দরকার, গীতাঞ্জলিতে এমন অনেক কবিতা আছে যার ছন্দোরক্ষার বরাত দেওয়া হয়েছে গানের সুরের ’পরে।[] অতএব যে-পাঠকের ছন্দের কান আছে তিনি গানের খাতিরে এর মাত্রা কম-বেশি নিজেই দুরস্ত করে নিয়ে পড়তে পারেন, যাঁর নেই তাঁকে ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে।

 ১।‘নবনব রূপে এস প্রাণে’— এই গানের অন্তিম পদগুলির কেবল অন্তিম দুটি অক্ষরের দীর্ঘ স্বরের সম্মান স্বীকৃত হয়েছে। যথা ‘প্রাণে, গানে’ ইত্যাদি। একটিমাত্র পদে তার ব্যতিক্রম আছে। এস দুঃখে সুখে, এস মর্মে—এখানে ‘সুখে’র এ-কারকে অবাঙালি রীতিতে দীর্ঘ করা হয়েছে। ‘সৌখ্যে’ কথাটা দিলে বলবার কিছু থাকত না। তবু সেটাতে রাজি হইনি, মানুষ চাপা দেওয়ার চেয়ে মোটর ভাঙা ভালো।

 ২। ‘অমল ধবল পা- লে লেগেছে মন্দ-মধুর হাওয়া’—এ-গানে গানই মুখ্য, কাব্য গৌণ। অতএব তালকে সেলাম ঠুকে ছন্দকে পিছিয়ে থাকতে হল। যদি বল, পাঠকেরা তো শ্রোতা নয়, তারা মাপ করবে কেন। হয়তো করবে না— কবি জোড়হাত করে বলবে, ‘তালদ্বারা ছন্দ রাখিলাম, ত্রুটি মার্জনা করিবেন’।

 ৩। ৩৪ নম্বরটাও গান।[] তবুও এর সম্বন্ধে বিশেষ বক্তব্য হচ্ছে এই যে, যে-ছন্দগুলি বাংলার প্রাকৃত ছন্দ, অক্ষর গণনা করে তাদের মাত্রা নয়। বাঙালি সেটা বরাবর নিজের কানের[] সাহায্যে উচ্চারণ করে এসেছে। যথা—

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল- বা- ন,
শিবু ঠাকুরের বিয়ে- হবে- তিন কন্যে দা- ন।

আক্ষরিক মাত্রা গুনতি করে একে যদি সংশোধন করতে চাও তাহলে নিখুঁত পাঠান্তরটা দাঁড়াবে এই রকম:

বৃষ্টি পড়ছে টাপুর টুপুর নদেয় আসছে বন্যা,
শিবু ঠাকুরের বিবাহ হচ্‌ছে দান হবে তিন কন্যা।

রামপ্রসাদের একটি গান আছে:

মা আমার ঘুরাবি কত
যেন | চোখ-বাঁধা বলদের মতো।

এটাকে যদি সংশোধিত মাত্রায় কেতাদুরস্ত করে লিখতে চাও তাহলে তার নমুনা একটা দেওয়া যাক।

হে মাতা আমারে ঘুরাবি কতই
চক্ষু-বদ্ধ বৃষের মতোই।[]

 একটা কথা তোমাকে মনে রাখতে হবে, বাঙালি আবৃত্তিকার সাধুভাষাপ্রচলিত ছন্দেও নিজের উচ্চারণসম্মত মাত্রা রাখেনি বলে ছন্দের অনুরোধে হ্রস্বদীর্ঘের সহজ নিয়মের সঙ্গে রফানিষ্পত্তি করে চলেছে। যথা—

মহাভারতের কথা অমৃত সমান,
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান্।

উচ্চারণ-অনুসারে ‘মহাভারতের কথা’ লিখতে হয় ‘মহাভারতের্কথা’, তেমনি ‘কাশীরাম দাস কহে’ লেখা উচিত ‘কাশীরাম দাস্কহে’।[] কারণ হসন্ত শব্দ পরবর্তী স্বর বা ব্যঞ্জন শব্দের সঙ্গে মিলে যায়, মাঝখানে কোনো স্বরবর্ণ তাদের ঠোকাঠুকি নিবারণ করে না। কিন্তু বাঙালি বরাবর সহজেই ‘মহাভারতে- র্কথা’ পড়ে এসেছে, অর্থাৎ ‘তে’র এ-কারকে দীর্ঘ করে আপসে মীমাংসা করে দিয়েছে।[] তারপরে ‘পুণ্যবান্’ কথাটার ‘পুণ্যে’র মাত্রা কমিয়ে দিতে সংকোচ করেনি, অথচ ‘বান্’ কথাটার আক্ষরিক দুই মাত্রাকে টান এবং যতির সাহায্যে চার মাত্রা করেছে।[]

 ৪। ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’— এই গানের ছন্দ তুমি কী নিয়মে পড় আমি ঠিক বুঝতে পারছিনে। ‘দেবতা’ শব্দের পরে একটা দীর্ঘ যতি আছে সেটা কি রাখ না। যদি সেই যতিকে মান্য করে থাক তাহলে দেখবে, ‘দেবতা’ এবং ‘খোল দ্বার’ মাত্রায় অসমান হয়নি। এসব ধ্বনিগত তর্ক মোকাবিলায় মীমাংসা করাই সহজ। লিখিত বাক্যের দ্বারা এর শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব হবে কিনা জানিনে। ছাপাখানাশাসিত সাহিত্যে ছন্দোবিলাসী কবির এই এক মুশকিল—নিজের কণ্ঠ স্তব্ধ, পরের কণ্ঠের করুণার উপর নির্ভর। সেইজন্যেই আমাকে সম্প্রতি এমন কথা শুনতে হচ্ছে যে, আমি ছন্দ ভেঙে থাকি, তোমাদের স্তুতিবাক্যের কল্লোলে সেটা আমার কানে ওঠে না। তখন আকাশের দিকে চেয়ে বলি, ‘চতুরানন, কোন্ কানওয়ালাদের ’পরে এর বিচারের ভার’।

 ৫। ‘আজি গন্ধবিধুর সমীরণে’— কবিতাটি সহজ নিয়মেই পড়া উচিত। অবশ্য এর পঠিত ছন্দে ও গীত ছন্দে প্রভেদ আছে।

 ৬।‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানটায় যে মাত্রাধিক্যের কথা বলেছ সেটা অন্যায় বলনি। ঐ বাহুল্যের জন্যে ‘পঞ্জাব’ শব্দের প্রথম সিলেব্‌ল্‌টাকে দ্বিতীয় পদের গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখি—

পন্। জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা ইত্যাদি।

‘পঞ্জাব’কে ‘পঞ্জব’ করে নামটার আকার খর্ব করতে সাহস হয়নি, ওটা দীর্ঘকায়াদের দেশ। ছন্দের অতিরিক্ত অংশের জন্যে একটু তফাতে আসন পেতে দেওয়া রীতি বা গীতি বিরুদ্ধ নয়।[]  এই গেল আমার কৈফিয়তের পালা।  তোমার ছন্দের তর্কে আমাকে সালিস মেনেছ। ‘লীলানন্দে’র যে-লাইনটা নিয়ে তুমি অভিযুক্ত আমার মতে তার ছন্দঃপতন হয়নি। ছন্দ রেখে পড়তে গেলে কয়েকটি কথাকে অস্থানে খণ্ডিত করতে হয় বলেই বোধ হয় সমালোচক ছন্দঃপাত কল্পনা করেছেন।[] ভাগ করে দেখাই।

নৃত্য। শুধু বি-। লানো লা-। বণ্য। ছন্দ

আসলে ‘বিলানো’ কথাটাকে দুভাগ করলে কানে খটকা লাগে।

নৃত্য শুধু লাবণ্য-বিলানো ছন্দ

লিখলে কোনোরকম আপত্তি মনে আসে না, অর্থ হিসাবেও স্পষ্টতর হয়। ঐ কবিতায় যে-লাইনে তোমার ছন্দের অপরাধ ঘটেছে সেটা এই

সংগীতসুধা নন্দনে(র) সে আলিম্পনে।

ভাগ করে দেখ

সংগী। ত সুধা। নন্দ। নের সে আ। লিম্পনে।

যদি লিখতে

সংগীতসুধা নন্দনেরি আলিম্পনে

তাহলে ছন্দের ত্রুটি হত না।

 যাক। তারপরে ‘ঐকান্তিকা’। ওটা প্রাকৃত ছন্দে লেখা। ছন্দের স্থিতিস্থাপকতা[১০] যথেষ্ট। মাত্রার ওজনের একটু-আধটু নড়চড় হলে ক্ষতি হয় না। তবুও নেহাত ঢিলেমি করা চলে না। বাঁধামাত্রার নিয়মের চেয়ে কানের নিয়ম সূক্ষ্ম, বুঝিয়ে বলা বড়ো শক্ত কেন ভালো লাগল বা লাগল না। ‘ঐকান্তিকা’র ছন্দটা বন্ধুর হয়েছে সে-কথা বলতেই হবে। অনেক জায়গায় দূরান্বয়ের জন্যে এবং ছন্দের বিভাগে বাক্য বিভক্ত হয়ে গেছে বলে অর্থ বুঝতে কষ্ট পেয়েছি। তন্ন তন্ন আলোচনা করতে হলে বিস্তর বাক্য ও কাল ব্যয় করতে হয়। তাই আমার কান ও বুদ্ধি অনুসরণ করে তোমার কবিতাকে কিছু কিছু বদল করেছি। তুমি গ্রহণ করবে এ আশা করে নয়, আমার অভিমতটা অনুমান করতে পারবে এই আশা করেই।

 ১৩৩৬ কার্তিক ১

 তুমি এমন করে সব প্রশ্ন ফাঁদ যে দুচার কথায় সেরে দেওয়া অসম্ভব হয়, তোমার সম্বন্ধে আমার এই নালিশ।

 ১। আবার এরা ঘিরেছে মোর মন'— এই পংক্তির ছন্দোমাত্রার সঙ্গে ‘দাহ আবার বেড়ে ওঠে ক্রমে’র মাত্রার অসাম্য ঘটেছে এই তোমার মত। ‘ক্রমে’ শব্দটার ‘ক্র’র উপর যদি যথোচিত ঝোঁক দাও তাহলে হিসাবের গোল থাকে না। ‘বেড়ে ওঠেক্‌রমে'— বস্তুত সংস্কৃত ছন্দের নিয়মে ‘ক্র’ পরে থাকাতে ‘ওঠে’র ‘এ’ স্বরবর্ণে মাত্রা বেড়ে ওঠা উচিত। তুমি বলতে পার আমরা সাধারণত শব্দের প্রথম বর্ণস্থিত র-ফলাকে দুই মাত্রা দিতে কৃপণতা করি। ‘আক্রমণ’ শব্দের ‘ক্র’কে তার প্রাপ্য মাত্র। দিই, কিন্তু ‘ওঠে ক্রমে’র ‘ক্র’ হ্রস্বমাত্রায় খর্ব করে থাকি। আমি সুযোগ বুঝে বিকল্পে দুইরকম নিয়মই চালাই।[১১]

 ২। ভক্‌ত | সেথায় | খোল দ্বা | • • র্ |— এইরকম ভাগে কোনো দোষ নেই। কিন্তু তুমি যে ভাগ করেছিলে | র • • | এটা চলে না.; যেহেতু ‘র’ হসন্ত বর্ণ, ওর পরে স্বরবর্ণ নেই, অতএব টানব কাকে।

 ৩। ‘জনগণ’ গান যখন লিখেছিলেম তখন ‘মারাঠা’ বানান করিনি। মরাঠিরাও প্রথমবর্ণে আকার দেয় না। আমার ছিল ‘মরাঠা’। তারপরে ধারা শোধন করেছেন তাঁরাই নিরাকারকে সাকার করে তুলেছেন, আমার চোখে পড়েনি।[১২]

 ৪। ‘জাগিয়ে’ ও ‘রটিয়ে’ শব্দের ‘গিয়ে’ ও ‘টিয়ে’ প্রাকৃত-বাংলার মতে একমাত্রাই। আমি যদি পরিবর্তন করে থাকি সেটাকে স্বীকার করবার প্রয়োজন নেই।

 ১৯২৯ নবেম্বর

 তুমি যে ‘ম্লান’ শব্দটিকে হসন্তভাবে উচ্চারণ কর এ আমার কাছে নতুন লাগল। আমি কখনই ‘ম্লান্‌’ বলিনে। প্রাকৃত-বাংলায় যে-সব শব্দ অতিপ্রচলিত তাদেরই উচ্চারণে এইরকম স্বরলুপ্তি সহ্য করা চলে। ‘ম্লান’ শব্দটা সে-জাতের নয় এবং ওটা অতি সুন্দর শব্দ, ওকে বিনা দোষে জরিমানা করে ওর স্বরহরণ কোরো না, তোমার কাছে এই আমার দরবার।[১৩]

 যতি বলতে বোঝায় বিরাম।[১৪] ছন্দ জিনিসটাই হচ্ছে আবৃত্তিকে বিরামের বিশেষ বিধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা।

ললিত ল। বঙ্গ ল। তা পরি। শীলন।[১৫]

প্রত্যেক চারমাত্রার পরে বিরাম।

বদসি যদি। কিঞ্চিদপি।[১৬]

পাঁচ পাঁচ মাত্রার শেষে বিরাম। তুমি যদি লেখ ‘বদসি যদ্যপি’ তাহলে এই ছন্দে যতির যে পঞ্চায়তী বিধান আছে তা রক্ষা হবে না। এখানে যতিভঙ্গ ছন্দোভঙ্গ একই কথা। প্রত্যেক পদক্ষেপের সমষ্টি নিয়ে নৃত্য, কিন্তু একটিমাত্র পদপাতে যদি চ্যুতি ঘটে তাহলে সে ত্রুটি পদবিক্ষেপের ত্রুটি, সুতরাং সমস্ত নৃত্যেরই ত্রুটি।

 ১৩৩৮ শ্রাবণ ৯

 ‘তোমারই’ কথাটাকে সাধুভাষার ছন্দেও আমরা ‘তোমারি’ বলে গণ্য করি।[১৭] এমন একদিন ছিল যখন করা হত না। আমিই প্রথমে এটা চালাই।‘এক্‌টি’ শব্দকে সাধুভাষায় তিনমাত্রার মর্যাদা যদি দেও তবে ওর হসন্ত হরণ করে অত্যাচারের দ্বারা সেটা সম্ভব হয়। যদি হসন্ত রাখ তবে দ্বৈমাত্রিক বলে ওকে ধরতেই হবে। যদি মাছের উপর কবিতা লেখার প্রয়োজন হয় তবে ‘কাৎলা’ মাছকে কা-ত-লা উচ্চারণের জোরে সাধুত্বে উত্তীর্ণ করা আর্যসমাজি শুদ্ধিতেও বাধবে। তুমি কি লিখতে চাও

পাতলা করিয়া কাটো কাতলা মাছেরে,
উৎসুক নাতনী যে চাহিয়া আছে রে।

আর আমি যদি লিখি

পাৎলা করি কাটো প্রিয়ে কাৎলা মাছটিরে
টাট্‌কা করি দাও ঢেলে সর্‌ষে আর জিরে,
ভেট্‌কি যদি জোটে তাহে মাখো লঙ্কাবাঁটা,
যত্ন করে রেছে ফেলো টুকরো যত কাঁটা।

আপত্তি করবে কি। ‘উষ্ট্র’ যদি দুইমাত্রায় পদক্ষেপ করতে পারে তবে ‘এক্‌টি’ কী দোষ করেছে।[১৮]

 ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ সংস্কৃত ছন্দে বাংলায় আমদানি।

 ১৩৩৮ ভাদ্র ৭

 ছন্দ সম্বন্ধে তুমি অতিমাত্র সচেতন হয়ে উঠেছ। শুধু তাই নয়, কোনো মতো নতুন ছন্দ তৈরি করাকে তুমি বিশেষ সার্থকতা বলে কল্পনা কর। আশা করি এই অবস্থা একদিন তুমি কাটিয়ে উঠবে এবং ছন্দ সম্বন্ধে একেবারেই সহজ হবে তোমার মন। আজ তুমি ভাগবিভাগ করে ছন্দ যাচাই করছ, প্রাণের পরীক্ষা চলছে দেহব্যবচ্ছেদ করে। যারা ছান্দসিক তাদের উপর এই কাটাঁছেড়ার ভার দাও, তুমি যদি ছন্দরসিক হও তবে ছুরিকাঁচি ফেলে দিয়ে কানের পথ খোলসা রাখ যেখান দিয়ে বাঁশি মরমে প্রবেশ করে।[১৯]

 গীতার একটা শ্লোকের আরম্ভ এই

অপরং ভবতো জন্ম,

ঠিক তার পরবর্তী শ্লোক

বহূনি মে ব্যতীতানি।[২০]

দ্বিতীয়টির সমান ওজনে প্রথমটি যদি লিখতে হয় তাহলে লেখা উচিত ‘অপারং ভাবতো জন্ম’। কিন্তু যাঁরা এই ছন্দ[২১] বানিয়েছিলেন তাঁরা ছান্দসিকের হাটে গিয়ে নিক্তি নিয়ে বসেননি। আমি যখন ‘পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা’ লিখেছিলুম তখন জানতুম কোনো কবির কানে খটকা লাগবে না, ছান্দসিকের কথা মনে ছিল না।

 ১০৩৯ মাঘ ১৩

 ছন্দ‌ নিয়ে যে-কথাটা তুলেছ সে সম্বন্ধে আমার বক্তব্যটা বলি। বাংলার উচ্চারণে হ্রস্বদীর্ঘ উচ্চারণভেদ নেই, সেইজন্যে বাংলাছন্দে সেটা চালাতে গেলে কৃত্রিমতা আসেই।[২২]

| | | | | |
হেসে হেসে হল যে অস্থির,
| | | | |
মেয়েটা বুঝি ব্রাহ্মণ-বস্তির।

এটা জবরদস্তি। কিন্তু

হেসে কুটিকুটি এ কী দশা এর,
এ মেয়েটি বুঝি রায়মশায়ের।

এর মধ্যে কোনো অত্যাচার, নেই। রায়মশায়ের চঞ্চল মেয়েটিক কাহিনী যদি বলে যাই লোকের মিষ্টি লাগবে, কিন্তু দীর্ঘে হ্রস্বে পা ফেলে চলেন যিনি তাঁর সঙ্গে বেশিক্ষণ আলাপ চলে না। যেটা একেবারে প্রকৃতিবিরুদ্ধ তার নৈপুণ্যে কিছুক্ষণ বাহবা দেওয়া চলে, তার সঙ্গে ঘর করা চলে না।

 ‘জনগণমনঅধিনায়ক’— ওটা যে গান। দ্বিতীয়ত সকল প্রদেশের কাছে যথাসম্ভব সুগম করবার জন্যে যথাসাধ্য সংস্কৃত শব্দ লাগিয়ে ওটাকে আমাদের পাড়া থেকে জয়দেবীয় পল্লীতে চালান করে দেওয়া হয়েছে। বাংলা শব্দে এক্‌সেন্‌ট্ দিয়ে বা ইংরেজি শব্দে না দিয়ে কিংবা সংস্কৃত কাব্যে দীর্ঘহ্রস্বকে বাংলার মতো সমভূম করে যদি রচনা করা যায় তকে কেবলমাত্র ছন্দকৌশলের খাতিরে সাহিত্যসমাজে তার নতুন মেলবন্ধন করা চলবে না। বিশেষত চিহ্ন উঁচিয়ে চোখে খোঁচা দিয়ে পড়াতে চেষ্টা করলে পাঠকদের প্রতি অসৌজন্য করা হয়।

| | |
Autumn flaunteth in his bushy bowers

এতে একটা ছন্দের সূচনা থাকতে পারে, কিন্তু সেইটেই কি যথেষ্ট। অথবা

| | | |
সম্মুখ সময়ে পড়ি বীর চূড়ামণি বীরবাহু।

এক্‌সেন্‌ট্‌এর তাড়ায় ধাক্কা মেরে চালালে এইরকম লাইনের আলস্য ভেঙে দেওয়া যায় যদি মানি, তবু আর কিছু মানবার নেই কি।

 ১৯৩৬ জুলাই ৬।

 দীর্ঘহ্রস্ব ছন্দ সম্বন্ধে আর-একবার বলি। ও এক বিশেষ ধরনের লেখায় বিশেষ ভাষারীতিতেই চলতে পারে। আকবর বাদশার যোধপুরী মহিষীর জন্যে তিনি মহল বানিয়েছিলেন স্বতন্ত্র, সমগ্র প্রাসাদের মধ্যে সে আপন জাত বাঁচিয়ে নির্লিপ্ত ছিল। বাংলার উচ্চারণরীতিকে মেনে চলে যে ছন্দ, তার চলাফেরা সাহিত্যের সর্বত্র, কোনো গণ্ডির মধ্যে নয়। তা পণ্ডিত-অপণ্ডিত সকল পাঠকের পক্ষেই সুগম। তুমি বলতে পার সকল কবিতাই সকলের পক্ষে সুগম হবেই এমনতরো কবুলতিনামায় লেখককে সই দিতে বাধ্য করতে পারিনে। সে তর্ক খাটে ভাবের দিক্ থেকে চিন্তার দিক্ থেকে, কিন্তু ভাষার সর্বজনীন উচ্চারণরীতির দিক্ থেকে নয়। তুমি বেলের শরবতই কর দইএর শরবতই কর মূল উপাদান জলটা সাধারণ জল, ভাষার উচ্চারণটাও সেইরকম। My heart aches—কোনো ধ্বনিসৌষ্ঠবের খাতিরেই বা বাঙালির অভ্যাসের অনুরোধে heartএর আ এবং achesএর এ-কে হ্রস্ব করা চলবে না। এই কারণে বাংলায় বিশুদ্ধ সংস্কৃত ছন্দ চালাতে গেলে দীর্ঘ স্বরধ্বনির জায়গায় যুক্তবর্ণের ধ্বনি দিতে হয়। সেটার জন্যে বাংলাভাষা ও পাঠককে সর্বদা ঠেলা মারতে হয় না। অথবা দীর্ঘস্বরকে দুই মাত্রার মূল্য দিলেও চলে।[২৩] যদি লিখতে

হে অমল চন্দনগঞ্জিত, তনু রঞ্জিত
হিমানীতে সিঞ্চিত স্বর্ণ,

[২৪]

তাহলে চতুষ্পাঠীর বহির্বর্তী পাঠকের দুশ্চিন্তা ঘটাত না।

 ১৯৩৬ জুলাই ৮

 বাংলায় প্রাক্‌হসন্ত স্বর দীর্ঘায়ত হয় একথা বলেছি। জল এবং জলা, এই দুটো শব্দের মাত্রাসংখ্যা সমান নয়।[২৫] এইজন্যেই ‘টুমুস্ টুমুস্ বাদ্যি বাজে’ পদটাকে ত্রৈমাত্রিক বলেছি। টু-মু দুই সিলেব্‌ল্, পরবর্তী হসন্ত স্-ও এক সিলেব্‌ল্‌এর মাত্রা নিয়েছে পূর্ববর্তী উ স্বরকে সহজেই দীর্ঘ করে। ‘টুমু টুমু বাজা বাজে’ এবং ‘টুমুস্ টুমুস বাদ্যি বাজে’ এক ছন্দ নয়। ‘রণিয়া রণিয়া বাজিছে বাজনা’ এবং ‘টুমুস্‌ টুমুস্‌ বাদ্যি বাজে’ এক ওজনের ছন্দ। দুটোই ত্রৈমাত্রিক। আমি প্রচলিত ছড়ার দৃষ্টান্তও দেখিয়েছি।[২৬]

 ১৯৩৬ জুলাই ২০

  1. তুলনীয়: “প্রবাহিণীতে যে-সমস্ত রচনা প্রকাশ করা হইল তাহার সবগুলিই গান, সুরে বসানো। এই কারণে কোনো কোনো পদে ছন্দের বাঁধন নেই। তৎসত্ত্বেও এগুলিকে গীতিকাব্যরূপে পড়া যাইতে পারে বলিয়া আমার বিশ্বাস।” প্রবাহিণী (১৩৩২), ভূমিকা।
  2. ‘আমার মিলন লাগি তুমি আসছ কবে থেকে’ ইত্যাদি।
  3. দ্রষ্টব্য পৃ ১৯০ পাদটীকা ২।
  4. বাংলা প্রাকৃত ছন্দের এই উচ্চারণ-বৈশিষ্টোর বিষয় এইসব দৃষ্টান্তযোগেই ৬২-৬৩ পৃষ্ঠার বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। অন্যত্রও এ-প্রসঙ্গের আলোচনা আছে: পৃ ১৪৩।
  5. দ্রষ্টব্য পৃ ১৭১ পাদটীকা ৩।
  6. এ-প্রসঙ্গে ‘সতত হে নদ...’ রচনাটির ছন্দোবিশ্লেষণপ্রণালী (পৃ ১৪২-৪৩) তুলনীয়।
  7. টান এবং যতির সাহায্যে ‘বান্’ কিভাবে চার মাত্রার স্থান অধিকার করে তা ১০, ৯৫-৯৬ ও ১২০ পৃষ্ঠায় দেখানো হয়েছে।
  8. পৃ ১৭১ পাদটীকা ১ এবং সঞ্চয়িতা (চতুর্থ সং) গ্রন্থপরিচয় অংশে এই গানটির ছন্দোবিশ্লেষণ দ্রষ্টব্য।
  9. তুলনীয়: বোধ হয় অর্থও শব্দকে...কৃত্রিম ঠেকেছে পৃ ১০৪। শব্দমধ্যবর্তী ঝোঁকের ঠিক পূর্বেই হচ্ছে ছেদস্থাপন করার স্বাভাবিক স্থান, অন্যত্র করলেই সেটা হয় ‘অস্থান’। শব্দকে অস্থানে খণ্ডিত করলেই কানে খটকা লাগে, যথাস্থানে করলে লাগে না। পরবর্তী ‘বিলানো’ ও ‘লাবণ্য’ শব্দের ছেদগত পার্থক্য লক্ষণীয়।
  10. দ্রষ্টব্য পৃ ১৯২ পাদটীকা ২। এ-প্রসঙ্গে সাধুছন্দের ‘স্থিতিস্থাপকতা’র আলোচনাও লক্ষিতব্য পৃ ১২০-২১।
  11. দ্রষ্টব্য পৃ ১৮১ পাদটীকা ২। সংস্কৃত ছন্দে কোনো শব্দের আরম্ভে যুক্তাক্ষর থাকলে পূর্ববর্তী শব্দের শেষ স্বরটি গুরু বলে গণ্য হয়। বাংলায় সাধারণত তা হয় না। তবে সুযোগ বুঝে বৈকল্পিক নিয়ম চালানো যায়। যথা—

    গুরু গুরু গুরু নাচের
    ডমরু বাজিল ক্ষণে ক্ষণে।
    —বর্ষামঙ্গল, নটরাজ (বনবাণী)

     এখানে ‘ক্ষণে ক্ষণে’র উচ্চারণরূপ হচ্ছে ‘ক্ষণেক্‌ক্ষণে’। কিন্তু

    ক্ষণে ক্ষণে আসি তব দুয়ারে
    অকারণে গান গাই গো।
    —অহৈতুক, নটরাজ (বনবাগী)

     এখানে ‘ক্ষণে ক্ষণে'র উচ্চারণরূপ ‘ক্ষণে-ক্ষণে’। এ-প্রসঙ্গে “বাংলাছন্দে ধ্বনিপ্রয়োগ” প্রবন্ধ (বৈশাখী ১৩৫১ পৃ ১৩—২০) দ্রষ্টব্য।

  12. এই গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় (১৮৩৩ শক, মাঘ)। সেখানে ‘মারাঠা’ই আছে। সম্ভবত পাণ্ডুলিপিতে ছিল ‘মরাঠা’।
  13. মিল বা ছন্দের খাতিরে ‘ম্লান’ শব্দটিকে কখনও কখনও ‘ম্লান্’-রূপে উচ্চারণ করার প্রয়োজন হয়। যথা—

    দেবী,  আজি আসিয়াছে অনেক যন্ত্রী শুনাতে গান
    অনেক যন্ত্র আনি।
    আমি আনিয়াছি ছিন্নতন্ত্রী নীরব স্নান
    এই দীন বীণাখানি।
    —চিত্রা সাধনা

  14. বতির্জিহ্বেষ্টবিভ্রামস্থানম্, ছন্দোমঞ্জরী ১।১৯; যতির্বিচ্ছেদঃ, পিঙ্গলচ্ছন্দঃসুত্রম্ ৬।১।
  15. গীতগোবিন্দ, প্রথম সর্গ, তৃতীয় গীত।
  16. গীতগোবিন্দ, দশম সর্গ, প্রথম গীত। দ্রষ্টব্য পৃ ১২৬।
  17. দ্রষ্টব্য পৃ ৫৮-৫৯।
  18. দ্রষ্টব্য ‘ছন্দের হসন্ত-হলন্ত’ প্রবন্ধের দ্বিতীয় পর্যায় পৃ ৫৯-৬১, ৬৪।
  19. তুলনীয়: চণ্ডীদাসের গানে...মরমে পৌঁছত না পৃ ৫৬।
  20. চতুর্থ অধ্যায়, চতুর্থ-পঞ্চম শ্লোক।
  21. অনুষ্টুপ্ বক্ত্র ছন্দ। ‘সংজ্ঞাপরিচয়’ দ্রষ্টব্য।
  22. তুলনীয়: বাংলার এ-জিনিস...সুব্যক্ত নহে পৃ ৫, সংস্কৃতের অনুকরণে...এই কৃত্রিমতা বেশিক্ষণ সয় না পৃ ১২২।
  23. তুলনীয়: বাংলার সেই ...দাঁড় করানো যেতে পারে পৃ ৯৩।
  24. এ-ছন্দটি জয়দেবের

    দিনমণিমণ্ডলমণ্ডন ভবখণ্ডন
    মুনিজনমানসহংস

    ইত্যাদি গানটির (গীতগোবিন্দ, প্রথম সর্গ, দ্বিতীয় গীত) অনুসরণে রচিত।

  25. দ্রষ্টব্য পৃ ১৮৬ পাদটীকা ১।
  26. দ্রষ্টব্য পৃ ১২৭