ছবি/প্রথম পরিচ্ছেদ
ছবি।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
মাঘ মাস। দারুণ শীত। তাহার উপর সমস্ত দিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। উত্তরে বাতাস হু হু করিয়া প্রবাহিত হইতেছে। পথ জনশূন্য; নিতান্ত প্রয়োজন না হইলে কেহ রাস্তায় বাহির হইতেছে না।
আমার হাতে সেদিন বিশেষ কোন কাজ না থাকায়, বহুবাজারে আমার অফিসের একটা নির্জজন গৃহে বসিয়া সংবাদ-পত্র পাঠ করিতেছিলাম, এমন সময়ে আমার ভৃত্য একখানি পত্র আনিয়া আমার হতে দিল।
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে, গৃহে গৃহে অলোক প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে। মনে করিয়াছিলাম, এই দারুণ শীতে আর কোন কার্য্য করিব না; শীঘ্র বাড়ী গিয়া, আহারাদি সমাপন করিয়া, নিদ্রার আশ্রয় গ্রহণ করিব। কিন্তু মানুষের ইচ্ছায় কার্য্য হয় না। মানুষ মনে মনে অনেক আশা করে, কিন্তু সকল সময়েই তাহার আশা ফলবতী হয় না।
সে যাহা হউক, আশাভঙ্গ হওয়ায় মনটা কেমন খারাপ হইয়া গেল। চিঠিখানি খুলিলাম এবং দুই-তিনবার পাঠ করিলাম। পত্রখানি কোথা হইতে আসিয়াছে, তাহা জানিবার উপায় নাই, কারণ উহাতে পত্র-লেখকের স্বাক্ষর ছিল না। তিনি লিখিতেছেন:—
“আজ রাত্রি আট্টার সময় আপনার অফিসে থাকিবেন। কোন জমীদার-পুত্র ঐ সময়ে আপনার নিকট গমন করিয়া এক গুরুতর বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করিবেন। সম্প্রতি কোন জমীদারবাড়ীতে আপনি যে কার্য্য করিয়াছেন, তাহাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে, আপনিই জমীদার-পুত্রকে আসন্ন বিপদ হইতে রক্ষা করিতে পারিবেন। জমীদার-পুত্র স্বয়ং আপনার নিকটে না যাইতে পারেন। হয় ও তাঁহার কোন বন্ধুর উপরেই এই কার্য্যের ভার পড়িবে। কিন্তু আপনার নিকট আমার বিনীত অনুরােধ এই যে, আপনি তাঁহাকে কোনরূপ পরিচয় জিজ্ঞাসা করিবেন না। যদি ঈশ্বর দিন দেন, যদি আপনি জমীদার-পুত্রকে এই বিপদ হইতে রক্ষা করিতে পারেন, তাহা হইলে পরে সমস্তই জানিতে পারিবেন। আপনি চেষ্টা করিলে সকলই জানিতে পারিবেন বটে, কিন্তু আমার একান্ত অনুরােধ যে, আপাততঃ সেরূপ কোন চেষ্টা করিবেন না।
পত্রখানি তৃতীয়বার পাঠ করিলাম, কিন্তু কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। চিঠির কাগজখানি সাধারণ বাজারে কাগজ নহে, সাধারণ লােকে সে কাগজ ব্যবহার করা দূরে থাকুক, কখনও দেখিয়াছে কি না বলা যায় না। কাগজখানি আলােকের দিকে ধরিলাম; দেখিলাম, জলের অক্ষরে কি একটা কোম্পানীর নাম লেখা রহিয়াছে। সম্ভবত সেই কোম্পানিই ঐ প্রকারের চিঠির কাগজ প্রস্তুত করিয়া বিক্রয় করিয়া থাকে। কাগজখানি গোলাপের গন্ধে ভর্ভর করিতেছে। বুঝিলাম, পত্র-লেখক সামান্য ব্যক্তি ন’ন। খুব সম্ভব, তিনি স্বয়ংই জমীদার-পুত্র।
শীতকালের রাত্রি সহজে যায় না। বেলা পাঁচটার পরই সন্ধ্যার আলোক প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে। তাহার কিছু পরেই আমি পত্র পাইয়াছি। পত্রখানি এতবার পাঠ করিয়াছি, এতক্ষণ ধরিয়া পত্র-লেখকের নাম জানিবার জন্য চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু তখনও সাতটা বাজিল না।
পত্রখানি সম্মুখে রাখিয়া, একখানি আরাম চৌকিতে উপবেশন করিয়া, নানাপ্রকার চিন্তায় নিমগ্ন আছি, এমন সময়ে আমার গৃহদ্বারে করাঘাতের শব্দ শুনিতে পাইলাম।
হাতের শব্দ শুনিয়াই বুঝিতে পারিলাম, আমার বন্ধু বলাই ডাক্তার আসিয়াছেন। দরজা বন্ধ ছিল, কিন্তু হুড়কো দেওয়া ছিল না। আমি চৌকী হইতে না উঠিয়াই বলিলাম, “ভিতরে এস ডাক্তার। আমার এখানে ত মেয়ে-ছেলে নাই যে, তোমার আসিতে ভয় হইবে?”
ডাক্তারকে আর কিছু বলিতে হইল না। তিনি হাসিতে হাসিতে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন, এবং আমার নিকটস্থ একখানি চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেমন আছ ডাক্তার? এদিকে আর এস না কেন?”
ডা। তুমিই যত নষ্টের মূল।
আ। সে কি! আমার অপরাধ কি?
ডা। তোমার কথাতেই বিবাহ করি। এখন আমায় ঘোর সংসারী হতে হয়েছে।
আ। ভালই ত ডাক্তার! সকলেই যদি বিবাহ না করে, তাহা হইলে ঈশ্বরের সৃষ্টি লোপ হবে যে!
ডা। তাই বুঝি আমার ঘাড়ে সংসার চাপিয়ে দিলে?
আ। কেন ভাই, তোমার অসুখ কিসে? অমন স্ত্রী কার ভাগ্যে আছে?
ডা। সে কথা আমি স্বীকার করি। সে সকল কষ্ট নাই, তবে অর্থের অভাব।
আ। কেন? এখন তোমার কাজ কর্ম্ম ত বেশ লিতেছে।
ডা। সে কথা তোমায় কে বলিল?
আ। কেহই নয়। যদি তোমার অবসর থাকিত, তাহা হইলে কি এতদিনের মধ্যে একটীবারও দেখা করতে পারিতে না? আর এককথা, সম্প্রতি তুমি একদিন ভয়ানক বৃষ্টিতে ভিজিয়াছিলে, কেমন? আমার অনুমান সত্য কি না?
ডা। সত্য। গত মঙ্গলবার রোগী দেখিয়া বাড়ী ফিরিবার সময় পথে ভয়ানক বৃষ্টি আ’সে, বাড়ীর নিকটে ছিলাম বলিয়া, কোথাও না দাঁড়াইয়া, ভিজিতে ভিজিতে বাড়ী যাই। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তাহার পর প্রায় চারিদিন কাটিয়া গিয়াছে অথচ তুমি সে কথা বলিলে কিরূপে?
আ। আরও একটা কথা আছে, তোমার চাকর বড় দুষ্ট, সকল সময়ে সে তোমার কথানুযায়ী কাজ করে না।
ডা। যথার্থ বলিয়াছ। বেটাকে লইয়া আমি কি করিব স্থির করিতে পারিতেছি না। কিন্তু সে কথা যাউক, তুমি এ সকল কথা জানিলে কিরূপে?
আ। ডাক্তার! তোমার জুতার অবস্থা ভাল করিয়া দেখ দেখি, তুমি নিজেই বলিতে পারিবে। জুতার উপরের কাদা দেখিয়া ঐ দুইটী মীমাংসা করিয়াছি। যদি তোমার চাকর ভাল করিয়া জুতা পরিষ্কার করিত, তাহা হইলে আমি এই দুইটা কথা বলিতে পারিতাম না। এখন বুঝিলে? বৃষ্টি আরম্ভের পর ভিজিয়া রাস্তায় চলিলে জুতায় ঐরূপ কাদা ও ময়লা জমে।
ডা। বেশ বুঝিয়াছি; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, যদিও তোমার সহিত এতকাল বাস করিতেছি, তথাপি তুমি না বুঝাইয়া দিলে, আমি কিছুই বুঝিতে পারি না।