ছবি ও গান/মধ্যাহ্নে
মধ্যাহ্নে
হের ওই বাড়িতেছে বেলা,
বসে আমি রয়েছি একেলা।
ওই হোথা যায় দেখা, সুদূরে বনের রেখা
মিশেছে আকাশ নীলিমায়।
দিক হতে দিগন্তরে মাঠ শুধু ধূধূ করে,
বায়ু কোথা ব’হে চলে যায়।
সুদূর মাঠের পারে গ্রামখানি এক ধারে
গাছ দিয়ে ছায়া দিয়ে ঘেরা’,
কাননের গায়ে বেন ছায়াখানি বুলাইয়া
ভেসে চলে কোথায় মেঘেরা!
মধুব উদাস প্রাণে চাই চারিদিক্ পানে,
স্তব্ধ সব ছবির মতন,
সব যেন চারিধারে অবশ অলস ভারে
স্বর্ণময় মায়ায় মগন।
গ্রাম খানি, মাঠ পাখি, উঁচুনিচু পথখানি,
দুয়েকটি গাছ মাঝে মাঝে,
আকাশ সমুদ্রে ঘেরা সুবর্ণ দ্বীপের পারা
কোথা যেন সুদুরে বিরাজে।
কনক-লাবণ্য ল’য়ে যেন অভিভূত হয়ে
আপনাতে আপনি ঘুমায়,
নিঝুম পাদপ লতা, শ্রান্তকায় নীরবতা
শুয়ে আছে গাছের ছায়ায়।
শুধু অতি মৃদু স্বরে গুন্ গুন্ গান করে
যেন সব ঘুমন্ত ভ্রমর,
যেন মধু খেতে খেতে ঘুমিয়েছে কুসুমেতে
মরিয়া এসেছে কণ্ঠস্বর।
নীল শূন্যে ছবি আঁকা রবির কিরণ মাখা,
সেথা যেন বাস করিতেছি,
জীবনের আধখানি যেন ভুলে গেছি আমি
কোথা যেন কেলিয়ে এসেছি।
আনমনে ধরি ধরি বেড়াতেছি ফিরি ফিরি
ঘুমঘোর ছায়ায় ছায়ায়,
কোথা যাব কোথা যাই সে কথা যে মনে নাই,
ভুলে আছি মধুর মায়ায়।
মধুর বাতাসে আজি যেন রে উঠিছে বাজি
পরাণের ঘুমন্ত বীণাটি,
ভালবাসা আজি কেন সঙ্গীহারা পাখী যেন
বসিয়া গাহিছে একেলাটি।
কে জানে কাহাৱে চায়, প্রাণ যেন উভরায়
ডাকে কারে “এস এস” ব’লে,
কাছে কারে পেতে চায়, সব তারে দিতে চায়,
মাথাটি রাখিতে চায় কোলে।
স্তব্ধ তরুতলে গিয়া পা-দুখানি ছড়াইয়া
নিমগন মধুময় মোহে,
আনমনে গান গেয়ে দূর শূন্য পানে চেয়ে
ঘুমায়ে পড়িতে চায় দোঁহে।
দূব মরীচিকাসম ওই বন উপবন,
ওরি মাঝে পরাণ উদাসী,
বিজন বকুলতলে পল্লবের মরমরে,
নাম ধ’রে বাজাইছে বাঁশি।
সে যেন কোথায় আছে, সুদূর বনের পাছে,
কত নদী সমুদ্রের পারে,
নিভৃত নির্ঝর তীরে লতায় পাতায় ঘিরে
বসে আছে নিকুঞ্জ আঁধারে।
সাধ যায় বাশি করে বন হতে বনান্তরে
চলে যাই আপনার মনে,
কুসুমিত নদী তীরে বেড়াইব ফিরে ফিরে
কে জানে কাহার অন্বেষণে।
সহসা দেখিব তারে, নিমেষেই একেবারে
প্রাণে প্রাণে হইবে মিলন,
এই মরীচিকা দেশে দুজনে বাসর বেশে
ছায়ারাজ্যে করিব ভ্রমণ।
বাঁধিবে সে বাহুপাশে চোখে তার স্বপ্ন ভাসে
মুখে তার হাসির মুকুল,
কে জানে বুকের কাছে আঁচল আছে না আছে
পিঠেতে পড়েছে এলোচুল।
মুখে আধখানি কথা চোখে আধখানি কথা
আধখানি হাসিতে জড়ান’,
দুজনেতে চলে যাই কে জানে কোথায় চাই
পদতলে কুসুম ছড়ান’।
বুঝিরে এমনি বেলা ছায়ায় করিত খেলা
তপোবনে ঋষি-বালিকারা,
পরিয়া বাকল বাস, মুখেতে বিমল হাস
বনে বনে বেড়াইত তারা।
হরিণ-শিশুরা এসে কাছেতে বসিত ঘেঁসে
মালিনী বহিত পদতলে,
দু-চারি সখীতে মেলি কথা কয় হাসি খেলি
তরুতলে বসি কুতূহলে।
কারো কোলে কারো মাথা, সরল প্রাণের কথা
নিরালায় কহে প্রাণ খুলি,
নুকিয়ে গাছের আড়ে সাধ যায় শুনিয়ে
কি কথা কহিছে মেয়েগুলি।
লতার পাতার মাঝে, ঘাসের ফুলের মাঝে
হরিণ-শিশুর সাথে মিলি,
অঙ্গে আভরণ নাই বাকল বসন পরি
রূপগুলি বেড়াইছে খেলি।
ওই দূর বনছায়া ও যে কি জানেরে মায়া,
ও যেনরে রেখেছে লুকায়ে,
সেই স্নিগ্ধ তপোবন চিরফুল্ল তরুগণ,
হরিণশাবক তরু-ছয়ে।
হেথায় মালিনী নদী বহে যেন নিরবধি,
ঋষিকন্যা কুটীরের মাঝে,
কভু বসি তরুতলে মেহে তারে ভাই বলে,
ফুলটি ঝরিলে ব্যথা বাজে।
কত ছবি মনে আসে, পরাণের আশেপাশে
কল্পনা কত যে করে খেলা,
বাতাস লাগায়ে গায়ে বসিয়া তরুর ছায়ে
কেমনে কাটিয়া যায় বেলা।