পতিসর,
২২শে মার্চ্চ, ১৮৯৪।

 “পশুপ্রীতি” বলে ব—একটা প্রবন্ধ লিখে পাঠিয়েছে—আজ সমস্ত সকালবেলায় সেইটে নিয়ে পড়েছিলুম। কাল আমি বোটে বসে জানলার বাইরে নদীর দিকে চেয়ে আছি এমন সময় হঠাৎ দেখি—একটা কি পাখী সাঁতরে তাড়াতাড়ি ওপারের দিকে চলে যাচ্চে আর তার পিছনে মহা ধর্ ধর্ মার মার রব উঠেছে। শেষকালে দেখি একটি মুরগী—তার আসন্ন মৃত্যুকালে বাবুর্চ্চিখানার নৌকো থেকে হঠাৎ কিরকমে ছাড়া পেরে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল, ঠিক্ যেই তীরের কাছে গিয়ে পৌঁচেছে অমনি যমদূত মানুষ ক্যাঁক্ করে তার গলা টিপে ধরে আবার নৌকো করে ফিরিয়ে নিয়ে এল। আমি ফটিককে ডেকে বল্লুম আমার জন্যে আজ মাংস হবে না। এমন সময় ব—র পশুপ্রীতি লেখাটা এসে পৌঁছল—আমি পেয়ে কিছু আশ্চর্য্য হলুম। আমারত আর মাংস খেতে রুচি হয় না। আমরা যে কি অন্যায় এবং নিষ্ঠুর কাজ করি তা ভেবে দেখিনে বলে মাংস গলাধঃকরণ করতে পারি। পৃথিবীতে অনেক কাজ আছে যার দূষণীয়তা মানুষের স্বহস্তে গড়া—যার ভালমন্দ, অভ্যাসপ্রথা দেশাচার সমাজনিয়মের উপর নির্ভর করে কিন্তু নিষ্ঠুরতা সেরকম নয়, এটা একেবারে আদিম দোষ, এর মধ্যে কোনো তর্ক নেই, কোনো দ্বিধা নেই, হৃদয় যদি আমাদের অসাড় না হয়, হৃদয়কে যদি চোখ বেঁধে অন্ধ করে না রেখে দিই তাহলে নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে নিষেধ একেবারে স্পষ্ট শুন্‌তে পাই—অথচ ওটা আমরা হেসেখেলে সকলে মিলে খুব অনায়াসে আনন্দসহকারে করে থাকি, এমন কি, যে না করে তাকে কিছু অদ্ভুত বলে মনে হয়। পাপপুণ্যসম্বন্ধে মানুষের এমনি একটা কৃত্রিম অপূর্ব্ব ধারণা। আমার বোধ হয় সকল ধর্ম্মের শ্রেষ্ঠধর্ম সর্ব্ব জীবে দয়া। প্রেম হচ্চে সমস্ত ধর্ম্মের মুল ভিত্তি। সেদিন একটা ইংরিজি কাগজে পড়লুম, পঞ্চাশহাজার পৌণ্ড মাংস ইংলণ্ড থেকে আফ্রিকার কোনো এক সেনানিবাসে পাঠান হয়েছিল—মাংসটা খারাপ হওয়াতে তারা ফিরে পাঠিয়ে দেয়; তার পরে সেই মাংস পোর্ট্‌স্‌মথে পাঁচ ছশ টাকায় নিলেম হয়ে যায়—ভেবে দেখ দেখি—জীবের জীবনের কি ভয়ানক অপব্যয় এবং কি অল্প মূল্য! আমরা যখন একটা খানা দিই তখন কত প্রাণী কেবলমাত্র ডিশ পূরণের জন্যে আত্মবিসর্জ্জন দেয়, হয়ত কেবল ফিরে ফিরে যার কেউ পাতে নেয়না। যতক্ষণ তামরা অচেতনভাবে থাকি এবং অচেতনভাবে হিংসা করি ততক্ষণ আমাদের কেউ দোষ দিতে পারেনা। কিন্তু যখন মনে দয়া উদ্রেক হয় তখন যদি সেই দয়াটাকে গলা টিপে মেরে দশজনের সঙ্গে মিশে হিংস্রভাবে কাজ করে যাই তাহলেই যথার্থ আপনার সমস্ত সাধুপ্রকৃতিকে অপমান করা হয়। আমিত মনে করেছি—আরো একবার নিরামিষ খাওয়া ধরে দেখ্‌ব।

 আমার একটি নির্জ্জনের প্রিয়বন্ধু জুটেছে—আমি লোকেনের ওখান থেকে তার একখানা Amiel’s Journal ধার করে এনেছি—যখনি সময় পাই সেই বইটা উল্টে পাল্টে দেখি—ঠিক মনে হয় তার সঙ্গে মুখোমুখী হয়ে কথা কচ্চি—এমন অন্তরঙ্গ বন্ধু আর খুব অল্প ছাপার বইয়ে পেয়েছি। অনেক বই এর চেয়ে ভাল লেখা আছে এবং এই বইয়ের অনেক দোষ থাক্‌তে পারে কিন্তু এই বইটি আমার মনের মত। অনেক সময় আসে যখন সব বই ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফেলে দিতে হয় কোনোটা ঠিক আরামের বোধ হয় না—যেমন রোগের সময় অনেক সময় বিছানায় ঠিক আরামের অবস্থাটি পাওয়া যায় না, নানারকমে পাশ ফিরে দেখ্‌তে ইচ্ছে করে, কখনো বালিশের উপর বালিশ চাপাই, কখনো বালিশ ফেলে দিই, সেইরকম মানসিক অবস্থায় আমিয়েলের যেখানেই খুলি সেখানেই মাথাটি ঠিক গিয়ে পড়ে শরীরটা ঠিক বিশ্রাম পায়। আমার সেই অন্তরঙ্গ বন্ধু আমিয়েল পশুদের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে এক জায়গায় লিখেছে—ব—র লেখায় আমি সেইটে সমস্তটা নোট বসিয়ে দিয়েছি। কাদম্বরীর সেই মৃগয়া বর্ণনা থেকে অনেকটা আমি ব—কে তর্জ্জমা করতে বলে দিয়েছি। পাখীরাও যে কতকটা আমাদেরি মত—একটা জায়গার আছে যেখানে তাতে আমাতে প্রভেদ নেই—এইটে বাণভট্ট আপন করুণ কল্পনাশক্তির দ্বারা অনুভব ও প্রকাশ করেছেন।