শিলাইদহ,
২৪শে জুন, ১৮৯৪।

 সবে দিন চারেক হল এখানে এসেছি কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কতদিন আছি তার ঠিক নেই—মনে হচ্চে আজই যদি কলকাতায় যাই তাহলে যেন অনেক বিষয়ে অনেক পরিবর্ত্তন দেখ্‌তে পাব।

 আমিই কেবল সময়স্রোতের বাইরে একটি জায়গায় স্থির হয়ে আছি, আর সমস্ত জগৎ আমার অজ্ঞাতে একটু একটু করে ঠাঁই বদল করচে। আসলে, কলকাতা থেকে এখানে এলে সময়টা চতুর্গুণ দীর্ঘ হয়ে আসে, কেবল আপনার মনোরাজ্যে বাস করতে হয়, সেখানে ঘড়ি ঠিক চলে না। ভাবের তীব্রতা অনুসারে মানসিক সময়ের পরিমাপ হয়—কোন কোন ক্ষণিক সুখ দুঃখ মনে হয় যেন অনেকক্ষণ ধরে ভোগ করচি। যেখানে বাইরের লোকপ্রবাহ এবং বাইরের ঘটনা এবং দৈনিক কার্য্যপরম্পরা আমাদের সর্ব্বদা সময়গণনায় নিযুক্ত না রাখে সেখানে, স্বপ্নের মত, ছোট মুহূর্ত্ত দীর্ঘকালে এবং দীর্ঘকাল ছোটমুহূর্ত্তে সর্ব্বদাই পরিবর্ত্তিত হতে থাকে। তাই আমার মনে হয় খণ্ড কাল এবং খণ্ড আকাশ আমাদের মনের ভ্রম। প্রত্যেক পরমাণু অসীম এবং প্রত্যেক মুহূর্ত্তই অনন্ত। এ সম্বন্ধে পারস্য উপন্যাসে খুব ছেলেবেলায় একটা গল্প পড়েছিলুম সেটা আমার ভারি ভাল লেগেছিল—এবং তখন যদিও খুব ছোট ছিলুম তবুও তার ভিতরকার ভাবটা একরকম করে বুঝ্‌তে পেরেছিলুম। কালের পরিমাণটা যে কিছুই নয় সেইটে দেখাবার জন্যে একজন ফকির একটা টবের মধ্যে মন্ত্রঃপূত জল রেখে বাদশাকে বল্লে তুমি এর মধ্যে ডুব দিয়া স্নান কর। বাদশা ডুব দেবামাত্র দেখ্‌লে সে এক সমুদ্রের ধারে নতুন দেশে উপস্থিত—সেখানে সে দীর্ঘ জীবন ধরে নানা ঘটনা নানা অবস্থার মধ্যে দিয়ে নানা সুখ দুঃখ অতিবাহন করলে। তার বিয়ে হল, তার একে একে অনেকগুলি ছেলে হল, ছেলেরা মরে গেল, স্ত্রী মরে গেল, টাকাকড়ি সব নষ্ট হয়ে গেল এবং সেই শোকে যখন সে একেবারে অধীর হয়ে পড়েছে এমন সময় হঠাৎ দেখ্‌লে সে আপন রাজসভার জলের টবের মধ্যে। ফকিরের উপর খুব ক্রোধ প্রকাশ করাতে সভাসদ্‌রা সকলেই বল্লে, মহারাজ, আপনি কেবলমাত্র জলে ডুব দিয়েই মাথা তুলেছেন। আমাদের সমস্ত জীবনটা এবং জীবনের সমস্ত সুখ দুঃখ এই রকম এক মুহূর্ত্তের মধ্যে বন্ধ; আমরা সেটাকে যতই সুদীর্ঘ এবং যতই সুতীব্র মনে করি যেমনি সংসারের টব থেকে মাথা তুল্‌ব অমনি সমস্তটা মুহূর্ত্তকালের স্বপ্নের মত ক্ষুদ্র হয়ে যাবে। কালের ছোট বড় কিছুই নেই—আমরাই ছোট বড়।

 কাল দিনের বেলাটা বেশ ছিল। আমার এই নদীর জলরেখা, বালির চর এবং ওপারের বনদৃশ্যের উপরে মেঘ এবং রৌদ্রের মুহূর্মুহু নতুন খেলা চলছিল—খোলা জানলার ভিতর দিয়ে যে দিকেই চোখ পড়ছিল এমন সুন্দর দেখাচ্ছিল। কোনো সুন্দর জিনিষকে “স্বপ্নের মত” কেন বলে ঠিক জানিনে, বোধ হয় নিছক সৌন্দর্য্যটা প্রকাশ করবার জন্যে। অর্থাৎ ওর মধ্যে যেন Realityর ভাবটুকু মাত্র নেই—অর্থাৎ এই শস্যক্ষেত্র থেকে যে আহার সংগ্রহ করতে হয়, এই নদী দিয়ে যে পাটের নৌকো যাবার রাস্তা, এই চর যে জমিদারের সঙ্গে খাজনা দিয়ে বন্দোবস্ত করে নিতে হয় ইত্যাদি শত সহস্র কথা মন থেকে দূর করে দিয়ে কেবলমাত্র হিসাবহীন বিশুদ্ধ আনন্দময় সৌন্দর্য্যের ছবি যখন অমরা উপভোগ করি তখন আমরা সেটাকে স্বপ্নের মত বলি। অন্য সময়ে আমরা জগৎকে প্রধানতঃ সত্য বলে দেখি তারপরে তাকে আমরা সুন্দর অথবা অন্যরূপে জানি—কিন্তু যে সময়ে তাকে আমরা প্রধানতঃ সুন্দর হিসাবে দেখি, তারপরে সত্যহোক্ না হোক্‌ লক্ষ্য করিনে তখন আমরা তাকে বলি স্বপ্নের মত।