শিলাইদা
৩০শে জুন ১৮৯৪

 আমার এই ক্ষুদ্র নির্জ্জনতাটি আমার মনের কারখানা ঘরের মত; তার নানাবিধ অদৃশ্য যন্ত্রতন্ত্র এবং সমাপ্ত ও অসমাপ্ত কাজ চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে, কেউ যখন বাইরে থেকে আসেন তখন সেগুলি তাঁর চোখে পড়েনা—কখন কোথায় পা ফেলেন তার ঠিক নেই দিব্য অজ্ঞানে হাস্যমুখে বিশ্বসংসারের খবর আলোচনা করতে করতে আমার অবসরের তাঁতে চড়ানো অনেক সাধনার সূক্ষ্ম সূত্রগুলি পট্‌পট্ করে ছিঁড়তে থাকেন। যখন ষ্টেশনে তাঁকে পৌঁছে দিয়ে আবার একাকী আমার কর্ম্মশালায় ফিরে আসি তখন দেখ্‌তে পাই আমার কত লোকসান হয়েছে। অনেক কথা, অনেক কাজ, অনেক আলোচনা আছে যা অন্যের পক্ষে সামান্য এবং জনতার মধ্যে স্বাভাবিক, কিন্তু নির্জ্জন জীবনের পক্ষে আঘাতজনক। কেননা নির্জ্জনে আমাদের সমস্ত গোপন অংশ গভীর অংশ বাহির হয়ে আসে সুতরাং সেই সময়ে মানুষ বড় বেশি নিজেরই মত অর্থাৎ কিছু সৃষ্টিছাড়া গোচের হয়—সে অবস্থার সে লোকসঙ্ঘের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। বাহ্য প্রকৃতির একটা গুণ এই যে সে অগ্রসর হয়ে মনের সঙ্গে কোনো বিরোধ করে না; তার নিজের মন বলে কোনো বালাই না থাকাতে মানুষের মনকে সে আপনার সমস্ত জায়গাটি ছেড়ে দিতে রাজি হয়; সে নিয়ত সঙ্গদান করে তবু সঙ্গ আদায় করেনা, সে অনন্ত আকাশ অধিকার করে থাকে তবু সে আমার একতিল জায়গা জোড়ে না;—নির্ব্বোধের মত বকে না, সুবুদ্ধির মত তর্ক করে না,—আমার শিশু কন্যাটির মত আকাশের কোলে শুয়ে থাকে,—যখন শান্তভাবে থাকে সেও মিষ্টি লাগে; যখন গর্জ্জন করে হাত পা ছুঁড়তে থাকে সেও মিষ্টিলাগে; বিশেষত যখন তার স্নান পান বেশ পরিবর্ত্তনের বন্দোবস্ত ভার আমার উপর কিছুমাত্র নেই—তখন এই ভাষাহীন মনোহীন বিরাটসুন্দর শিশুটি আমার নির্জ্জনের পক্ষে বেশ। ভাষায় অত্যন্ত পরিপূর্ণ বুদ্ধিমান বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষ লোকালয়ের পক্ষেই উপাদেয়।