ছিন্নপত্র (১৯১২)/১১৪
শিলাইদা
১০ই আগষ্ট, ১৮৯৪।
কাল খানিকরাত্রে জলের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। নদীর মধ্যে হঠাৎ একটা তুমুল কল্লোল এবং প্রবল চঞ্চলতা উপস্থিত হয়েছে। বোধ হয় অকস্মাৎ একটা নতুন জলের স্রোত এসে পড়েছে। রোজই প্রায় এই রকম ব্যাপার ঘটচে। বসে আছি-আছি, হঠাৎ দেখতে পাই নদী ছল্ছল্ কল্কল্ করে জেগে উঠেছে, আর সবসুদ্ধ খুব একটা ধুমধাম পড়ে গেছে। বোটের তক্তার উপর পা রাখলে বেশ স্পষ্ট বোঝা যায় তার নীচে দিয়ে কতরকমের বিচিত্রশক্তি অবিশ্রাম চল্চে; খানিকটা কাঁপচে, খানিকটা টল্চে, খানিকটা ফুল্চে, খানিকটা আছাড় খেয়ে পড়চে—ঠিক যেন আমি সমস্ত নদীর নাড়ির স্পন্দন অনুভব করচি। কাল অর্দ্ধেক রাত্রে হঠাৎ একটা চঞ্চল উচ্ছ্বাস এসে নাড়ির নৃত্য অত্যন্ত বেড়ে উঠেছিল। আমি অনেকক্ষণ জানলার ধারে বেঞ্চের উপর বসে রইলুম। খুব একরকম ঝাপ্সা আলো ছিল—তাতে করে সমস্ত উতলা নদীকে আরো যেন পাগলের মত দেখাচ্ছিল। আকাশে মাঝে মাঝে মেঘ। একটা খুব জ্বল্জ্বলে মস্ত তারার ছায়া দীর্ঘতর হয়ে জলের মধ্যে অনেকদূর পর্য্যন্ত একটা জ্বালাময় বিদ্ধ বেদনার মত থরথর করে কাঁপছিল। নদীর দুইতীর অস্পষ্ট আলোকে এবং গাঢ় নিদ্রায় আচ্ছন্ন অচেতন। মাঝখান দিয়ে একটা নিদ্রাহীন উন্মত্ত অধীরতা ভরপূরবেগে একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে চলেছে। অর্দ্ধেক রাত্রে ঐরকম দৃশ্যের মধ্যে জেগে উঠে বসে থাক্লে আপনাকে এবং জগৎকে কি এক নতুন রকমের মনে হয়—দিনের বেলাকার লোকসংসর্গের জগৎটা মিথ্যা হয়ে যায়। আবার আজ সকালে উঠে আমার সেই গভীর রাত্রের জগৎ স্বপ্নের মত কত দূরবর্ত্তী এবং লঘু হয়ে গেছে। মানুষের পক্ষে দুটোই সত্য অথচ দুটোই বিষম স্বতন্ত্র। আমার মনে হয় দিনের জগৎটা য়ুরোপীয় সঙ্গীত—সুরে বেসুরে খণ্ডে অংশে মিলে একটা গতিশীল প্রকাণ্ড হার্ম্মনির জটলা। আর রাত্রের জগৎটা আমাদের ভারতবর্ষীয় সঙ্গীত—একটি বিশুদ্ধ করুণ গম্ভীর অমিশ্ররাগিণী। দুটোই আমাদের বিচলিত করে অথচ দুটোই পরম্পর বিরোধী। কি করা যাবে! প্রকৃতির গোড়ায় একটা দ্বিধা একটা বিরোধ আছে;—রাজা এবং রাণীর মধ্যে সমস্ত বিভক্ত। দিন এবং রাত্রি, বিচিত্র এবং অখণ্ড, পরিব্যক্ত এবং অনাদি। আমরা ভারতবর্ষীয়েরা সেই রাত্রির রাজত্বে থাকি—আমরা অখণ্ড অনাদির দ্বারা অভিভূত। আমাদের নির্জ্জন এককের গান, য়ুরোপের সজন লোকালয়ের সঙ্গীত। আমাদের গানে শ্রোতাকে মনুষ্যের প্রতিদিনের সুখদুঃখের সীমা থেকে বের করে নিয়ে নিখিলের মূলে যে একটি সঙ্গীহীন বৈরাগ্যের দেশ আছে সেইখানে নিয়ে যায়—আর য়ুরোপের সঙ্গীত মমুষ্যের সুখদুঃখের অনন্ত উত্থানপতনের মধ্যে বিচিত্রভাবে নৃত্য করিয়ে নিয়ে চলে।