ছিন্নপত্র (১৯১২)/১১৬
শিলাইদা
১৬ই আগষ্ট ১৮৯৪।
এখন শুক্লপক্ষ কিনা—বেড়াবার সময় চমৎকার জ্যোৎস্না পাই। আমার দক্ষিণে সুবিস্তীর্ণ মাঠ, মাঝে মাঝে আউষ ধান, একপ্রান্ত দিয়ে একটি সঙ্কীর্ণ মেঠো রাস্তা, সম্মুখে পূর্ব্বদিকে হাটের গোলাঘর, সামনে স্তূপাকার খড় জমা রয়েছে—জ্যোৎস্নায় সমস্ত ছবির মত দেখাচ্চে। সন্ধ্যাবেলাটি আমার মাথার উপর, আমার চোখের সামনে, আমার পায়ের তলায়, আমার চতুর্দ্দিকে এমন সুন্দর, এমন শান্তিময়, এমন মানুষটির মত নিবিড়ভাবে আমার নিকটবর্ত্তী হয়ে আসে যে, আকাশের নক্ষত্রলোক থেকে আর পদ্মার সুদূর ছায়াময় তীররেখা পর্য্যন্ত সমস্তটি একটি নিভৃত গোপন গৃহের মত ছোট হয়ে ঘিরে দাঁড়ার—আমার মধ্যে যে দুটি প্রাণী আছে, বাইরের আমি, এবং আমার অন্তঃপুরবাসী আত্মা এই দুটিতে মিলে সমস্ত ঘরটি দখল করে বসে থাকি—এই দৃশ্যের মধ্যগত সমস্ত পশুপক্ষী প্রাণী আনাদের অন্তর্গত হয়ে যায়—কানে জলের কলশব্দ আস্তে থাকে, মুখের উপর মাথার উপর জ্যোৎস্নার শুভ্র হস্ত আদরের স্পর্শ করতে থাকে, আকাশে চকোর পাখী ডেকে চলে যায়, জেলের নৌকো পদ্মার মাঝখানে খরস্রোতের উপর দিয়ে বিনা চেষ্টায় অনায়াসে পিছ্লে বহে যেতে থাকে, আকাশব্যাপী স্নিগ্ধরাত্রি আমার রোমে রোমে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে উত্তাপ জুড়িয়ে দেয়—চোখ বুজে কান পেতে দেহ প্রসারিত করে প্রকৃতির একমাত্র যত্নের জিনিষের মত পড়ে থাকি, তার সহস্র সহচরী আমার সেবা করে। মনের কল্পনাও তার দুটি হস্তে থালা সাজিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়—মৃদুমন্দ বাতাসের সঙ্গে তার কোমল অঙ্গুলির স্পর্শ আমার চুলের মধ্যে অনুভব করি।