কলিকাতা,
৫ই অক্টোবর, ১৮৯৪।

 আজ সকালের বাতাসে অতি ঈষৎ শীতের সঞ্চার হয়েছে, একটুখানি শিউরে ওঠার মত। কাল দুর্গোৎসব; আজ তার সুন্দর সূচনা। ঘরে ঘরে দেশের লোকের মনে যখন একটা আনন্দ প্রবাহিত হচ্চে তখন তাদের সঙ্গে আমার ধর্ম্মসংস্কারের বিচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও সে আনন্দ মনকে স্পর্শ করে। পর্শুদিন স-র বাড়ি যাবার সময় দেখেছিলুম রাস্তার দুধারে প্রায় বড় বড় বাড়ির দালানমাত্রেই প্রতিমা তৈরি হচ্চে। দেখে আমার মনে হল, দেশের ছেলেবুড়ো সকলেই হঠাৎ দিনকয়েকের জন্যে ছেলেমানুষ হয়ে উঠে একটা বড় গোছের খেলায় লেগে গেছে। ভেবে দেখ্‌তে গেলে আনন্দের আয়োজনমাত্রই পুতুলখেলা—অর্থাৎ তাতে আনন্দ ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য নেই, লাভ নেই—বাইরে থেকে দেখে মনে হয় সময় নষ্ট। কিন্তু সমস্ত দেশের লোকের মনে যাতে একটা ভাবের আন্দোলন এনে দেয় তা কি কখনো নিষ্ফল হতে পারে? সমাজের মধ্যে কত লোক আছে যারা নীরস বিষয়ীলোক—এই উৎসবে তাদেরও মন একটা সর্ব্বব্যাপী ভাবের টানে বিচলিত হয়ে সকলের সঙ্গে মিলে যায়। এমনি করে প্রতিবৎসর কিছুকালের জন্য মনের এমন একটি অনুকূল আর্দ্র অবস্থা আসে যাতে স্নেহ প্রীতি দয়া সহজে অঙ্কুরিত হতে পারে; আগমনী বিজয়ার গান, প্রিয়সম্মিলন, নহবতের সুর, শরতের রৌদ্র এবং আকাশের স্বচ্ছতা সমস্তটা মিলে মনের মধ্যে আনন্দকাব্য রচনা করে। ছেলেদের যে আনন্দ সেইটেই বিশুদ্ধ আনন্দের আদর্শ। তারা তুচ্ছ উপলক্ষ্যকে নিয়ে নিজের মন দিয়ে ভরে তোলে, সামান্য কদাকার পুতুল নিয়ে তাকে নিজের ভাব দিয়ে সুন্দর ও প্রাণ দিয়ে সজীব করে তোলে। এই ক্ষমতাটা যে লোক বড় বয়স পর্য্যন্ত রাখ্‌তে পারে সেইত ভাবুক। তার কাছে চারিদিকের বস্তু কেবল বস্তু নয়—কেবল দৃষ্টিগোচর বা শ্রুতিগোচর নয় কিন্তু ভাবগোচর—তার সমস্ত সঙ্কীর্ণতা এবং অসম্পূর্ণতা সে একটি সঙ্গীতের দ্বারা পূর্ণ করে নেয়। দেশের সমস্ত লোক ভাবুক হতেই পারে না কিন্তু এই রকম উৎসবের সময় ভাবস্রোত অধিকাংশ লোকের মনকে অধিকার করে। তখন, যেটাকে দূরে থেকে সামান্য পুতুল বলে মনে হয়, কল্পনায় মণ্ডিত হয়ে তার সে মূর্ত্তি থাকে না।