ছিন্নপত্র (১৯১২)/১৩৫
শিলাইদহ
১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৪।
অদৃষ্টের পরিহাসবশতঃ, ফাল্গুনের এক মধ্যাহ্ণে এই নির্জ্জন অবসরে এই নিস্তরঙ্গ পদ্মার উপরে এই নিভৃত নৌকার মধ্যে বসে, সমুখে সোনার রৌদ্র এবং সুনীল আকাশ নিয়ে আমাকে একখানা বই সমালোচনায় প্রবৃত্ত হতে হচ্চে। সে বইও কেউ পড়বে না সে সমালোচনাও কেউ মনে রাখ্বে না মাঝের থেকে এমন দিনটা মাটি করতে হবে। জীবনে এমন দিন কটাই বা আসে! অধিকাংশ দিনই ভাঙাচোরা জোড়াতাড়া; আজকের দিনটি যেন নদীর উপরে সোনার পদ্মফুলের মত ফুটে উঠেচে, আমার মনটিকে তার মর্ম্মকোষের মধ্যে টেনে নিচ্চে। আবার হয়েচে কি, একটা হল্দে-কোমরবন্ধ্ পরা স্নিগ্ধ বেগুনিরঙের মস্ত ভ্রমর আমার বোটের চারদিকে গুঞ্জনসহকারে চঞ্চল হয়ে বেড়াচ্চে। বসন্তকালে ভ্রমরগুঞ্জনে বিরহিণীর বিরহ বেদনা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে এ কথাটাকে আমি বরাবর পরিহাস করে এসেছি, কিন্তু ভ্রমরগুঞ্জনের মর্ম্মটা আমি একদিন দুপরবেলা বোলপুরে প্রথম আবিষ্কার করেছিলুম। সেদিন নিষ্কর্ম্মার মত দক্ষিণের বারান্দায় বেড়াচ্ছিলুম—মধ্যাহ্নটা মাঠের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল, গাছের নিবিড় পল্লবগুলির মধ্যে স্তব্ধতা যেন রাশীকৃত হয়ে উঠেছিল। সেই সময়টায় বারান্দার নিকটবর্ত্তী একটা মুকুলিত নিমগাছের কাছে ভ্রমরের অলসগুঞ্জন সমস্ত উদাস মধ্যাহ্নের একটা সুর বেঁধে দিচ্ছিল। সেইদিন বেশ বোঝা গেল মধ্যাহ্নের সমস্ত পাঁচমিশালি শ্রান্তসুরের মূল সুরটা হচ্চে ঐ ভ্রমরের গুঞ্জন—তাতে বিরহিণীর মনটা যে হঠাৎ হাহা করে উঠ্বে তাতে আশ্চর্য্য কিছুই নেই। আসল কথাটা হচ্চে, ঘরের মধ্যে যদি খামখা একটা ভ্রমর এসে পড়েই ভোঁভোঁ করতে সুরু করে এবং ক্ষণে ক্ষণে শার্সির কাঁচে মাথা ঠুক্তে থাকে তবে তাতে করে তার নিজের ছাড়া আর কারো কোনো প্রকার ব্যথা লাগ্বার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ঠিক জায়গাটিতে সে ঠিক সুরই দেয়। আজকের আমার এই সোনার মেখলাপরা ভ্রমরটিও ঠিক সুরটি লাগিয়েছে। নিশ্চয়ই বোধ হচ্চে কোনো গ্রন্থের সমালোচনা করচে না—কিন্তু কেন যে আমার নৌকার চারপাশে ঘুরঘুর করে মরচে আমি ত বুঝতে পারচিনে—নিরপেক্ষ বিচারকমাত্রইত বলবে আমি শকুন্তলা বা সে জাতীয় কেউ নই।