ছিন্নপত্র (১৯১২)/১৯

সাজাদপুরের অনতিদূরে,
 ১২ই মাঘ,
 ১৮৯১

 এখনো পথে আছি। ভোর থেকে আরম্ভ করে সন্ধ্যা সাতটা আটটা পর্য্যন্ত ক্রমাগতই ভেসে চলেছি। কেবলমাত্র গতির কেমন একটা আকর্ষণ আছে—দুধারের তটভূমি অবিশ্রাম চোখের উপর দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে—সমস্তদিন তাই চেয়ে আছি—কিছুতে তার থেকে চোখ ফেরাতে পারচিনে—পড়তে মন যার না, লিখ্‌তে মন যায় না, কোন কিছু কাজ নেই, কেবল চুপ করে চেয়ে বসে আছি। কেবল যে দৃশ্যের বৈচিত্র্যের জন্যে তা নয়— হয়ত দুধারে কিছুই নেই, কেবল তরুহীন তটের রেখামাত্র চলে গেছে—কিন্তু ক্রমাগতই চল্‌চে এই হচ্চে তার প্রধান আকর্ষণ। আমার নিজের কোন চেষ্টা নেই, পরিশ্রম নেই, অথচ বাইরের একটা অশ্রান্ত গতি মনটাকে বেশ মৃদু প্রশান্তভাবে ব্যাপৃত করে রাখে। মনের পরিশ্রমও নেই বিশ্রামও নেই এই রকমের একটা ভাব। চৌকিতে বসে বসে অলস অন্যমনস্কভাবে পা দোলানো যেরকম এও সেইরকম, শরীরটা মোটের উপর বিশ্রাম করচে, অথচ শরীরের যে অতিরিক্ত উদ্যমটুকু কোনকালে স্থির থাক্‌তে চায়না, তাকেও একটা একঘেয়ে রকম কাজ দিয়ে ভুলিয়ে রাখা হয়েচে। আমাদের কলিগ্রামের সেই মুমূর্ষুর নাড়ির মত অতি ক্ষীণস্রোত নদী কাল কোন্‌কালে ছাড়িয়ে এসেছি। সেই নদী থেকে ক্রমে একটা স্রোতস্বিনী নদীতে এসে পড়া গেল। সেটা বেয়ে ক্রমে এমন এক জায়গায় এসে পড়লুম যেখানে ডাঙায় জলে একাকার হয়ে গেছে। নদী এবং তীর উভয়ের আকারপ্রকারের ভেদ ক্রমশই ঘুচে গেছে—দুটি অল্পবয়সের ভাইবোনের মত। তীর এবং জল মাথায় মাথায় সমান—একটুও পাড় নেই। ক্রমে নদীর সেই ছিপ্‌ছিপে আকারটুকু আর থাকেনা—নানাদিকে নানারকমে ভাগ হয়ে ক্রমে চতুর্দ্দিকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল। এই খানিকটা সবুজ ঘাস এই খানিকটা স্বচ্ছ জল। দেখে পৃথিবীর শিশুকাল মনে পড়ে— অসীম জলরাশির মধ্যে যখন স্থল সবে একটুখানি মাথা তুলেছে— জলস্থলের অধিকার নির্দ্দিষ্ট হয়ে যায়নি। চারিদিকে জেলেদের বাঁশ পোতা—জেলেদের জাল থেকে মাছ ছোঁ মেরে নেবার জন্যে চিল উড়চে, পাঁকের উপরে নিরীহ বক দাঁড়িয়ে আছে—নানারকমের জলচর পাথী—জলে শ্যাওলা ভাস্‌চে—মাঝে মাঝে পাঁকের মধ্যে অযত্নসম্ভূত ধানের গাছ, স্থির জলের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে মশা উড়চে। ভোরের বেলা বোট ছেড়ে দিয়ে কাঁচিকাঠায় গিয়ে পড়া গেল। একটি বারো তেরো হাত সঙ্কীর্ণ খালের মত, ক্রমাগত এঁকে বেঁকে গেছে—সমস্ত বিলের জল তারি ভিতর দিয়ে প্রবল বেগে নিষ্ক্রান্ত হচ্চে—এর মধ্যে আমাদের এই প্রকাণ্ড বোট নিয়ে বিষম কাণ্ড—জলের স্রোত বিদ্যুতের মত বোটটাকে টেনে নিয়ে যাচ্চে, দাঁড়িরা লগি হাতে করে সাম্‌লাবার চেষ্টা করচে, পাছে ডাঙার উপর বোটটাকে আছ্‌ড়ে ফেলে। এদিকে হু হু করে বাদলার বাতাস দিচ্চে, ঘন মেঘ করে রয়েছে, মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্চে, শীতে সবাই কাঁপচে। ক্রমে খোলা নদীতে এসে পড়লুম। শীতকালে মেঘাচ্ছন্ন ভিজে দিন ভারি বিশ্রী লাগে। সকালবেলাটা তাই নিতান্ত নির্জ্জীবের মত ছিলুম। বেলা দুটোর সময় রোদ্ উঠল। তার পর থেকে চমৎকার। খুব উঁচু পাড়ে বরাবর দুই ধারে গাছপালা লোকালয় এমন শান্তিময়, এমন সুন্দর, এমন নিভৃত—দুই ধারে স্নেহসৌন্দর্য্য বিতরণ করে নদীটি বেঁকে বেঁকে চলে গেছে—আমাদের বাংলাদেশের একটি অপরিচিত অন্তঃপুরচারিণী নদী। কেবল স্নেহ এবং কোমলতা এবং মাধুর্য্যে পরিপূর্ণ। চাঞ্চল্য নেই, অথচ অবসরও নেই। গ্রামের যে মেয়েরা ঘাটে জল নিতে আসে, এবং জলের ধারে বসে বসে অতি যত্নে গামছা দিয়ে আপনার শরীরখানি মেজে তুল্‌তে চায় তাদের সঙ্গে এর যেন প্রতিদিন মনের কথা এবং ঘরকন্নার গল্প চলে।

 আজ সন্ধ্যাবেলায় নদীর বাঁকের মুখে ভারি একটি নিরালা জায়গায় বোট লাগিয়েছে। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, জলে একটিও নৌকা নেই—জ্যোৎস্না জলের উপর ঝিকঝিক করচে—পরিষ্কার রাত্রি—নির্জ্জন তীর—বহুদূরে ঘনবৃক্ষবেষ্টিত গ্রামটি সুষুপ্ত— কেবল ঝিঁ ঝিঁ ডাক্‌চে আর কোন শব্দ নেই।