ছিন্নপত্র (১৯১২)/৬০
২৯শে জুন,
১৮৯২।
কালকের চিঠিতে লিখেছিলুম আজ অপরাহ্ন সাতটার সময় কবি কালিদাসের সঙ্গে একটা এন্গেজ্মেণ্ট্, করা যাবে। বাতিটি জ্বলিয়ে টেবিলের কাছে কেদারাটি টেনে বইখানি হাতে যখন বেশ প্রস্তুত হয়ে বসেছি হেনকালে কবি কালিদাসের পরিবর্ত্তে, এখানকার পোষ্টমাষ্টার এসে উপস্থিত। মৃত কবির চেয়ে একজন জীবিত পোষ্টমাষ্টারের দাবী ঢের বেশি। আমি তাঁকে বল্তে পারলুম না— আপনি এখন যান, কালিদাসের সঙ্গে আমার একটু বিশেষ প্রয়োজন আছে—বল্লেও সে লোকটি ভাল বুঝতে পারতেন না। অতএব পোষ্টমাষ্টারকে চৌকিটি ছেড়ে দিয়ে কালিদাসকে আস্তে আস্তে বিদায় নিতে হল। এই লোকটির সঙ্গে আমার একটু বিশেষ যোগ আছে। যথন আমাদের এই কুঠিবাড়ির একতলাতেই পোষ্ট অপিস্ ছিল এবং আমি এঁকে প্রতিদিন দেখ্তে পেতুম তখনি আমি একদিন দুপুরবেলায় এই দোতালায় বসে সেই পোষ্টমাষ্টারের গল্পটি লিখেছিলুম এবং সে গল্পটি যখন হিতবাদীতে বেরল তখন আমাদের পোষ্টমাষ্টার বাবু তার উল্লেখ করে বিস্তর লজ্জামিশ্রিত হাস্য বিস্তার করেছিলেন। যাই হোক্ এই লোকটিকে আমার বেশ লাগে। বেশ নানারকম গল্প করে যান আমি চুপ করে বসে শুনি। ওরি মধ্যে ওঁর আবার বেশ একটু হাস্যরসও আছে।
পোষ্টমাষ্টার চলে গেলে সেই রাত্রে আবার রঘুবংশ নিয়ে পড়লুম। ইন্দুমতীর স্বয়ম্বর পড়ছিলুম। সভায় সিংহাসনের উপর সারিসারি সুসজ্জিত সুন্দর চেহারা রাজারা বসে গেছেন—এমন সময় শঙ্খ এবং তুরীধ্বনির মধ্যে বিবাহবেশ পরে সুনন্দার হাত ধরে ইন্দুমতী তাঁদের মাঝখানের সভাপথে এসে দাঁড়ালেন। ছবিটি মনে করতে এমনি সুন্দর লাগে! তার পরে সুনন্দা এক এক জনের পরিচয় করিয়ে দিচ্চে আর ইন্দুমতী অনুরাগহীন এক একটি প্রণাম করে চলে যাচ্চেন। এই প্রণাম করাটি কেমন সুন্দর! যাকে ত্যাগ করচেন তাকে যে নম্রভাবে সম্মান করে যাচ্চেন এতে কতটা মানিয়ে যাচ্চে! সকলেই রাজা, সকলেই তার চেয়ে বয়সে বড়, ইন্দুমতী একটি বালিকা, সে যে তাঁদের একে একে অতিক্রম করে যাচ্চে এই অবশ্যরূঢ়তাটুকু যদি একটি একটি সুন্দর সবিনয় প্রণাম দিয়ে না মুছে দিয়ে যেত তাহলে এই দৃশ্যের সৌন্দর্য্য থাক্ত না।