ছিন্নপত্র (১৯১২)/৬৫
বোয়ালিয়া
১৮ই নবেম্বর,
১৮৯২।
ভাবছিলুম এতক্ষণে রেলগাড়ি না জানি কোথায় গিয়ে পৌঁছল। এই সময়টা সকালবেলায় নওয়াড়ির কাছে উঁচুনীচু প্রস্তরকঠিন তরুবিরল পৃথিবীর উপর সূর্য্যোদয় হয়। বোধ হয় নবীন রৌদ্রে এতক্ষণে চারিদিক উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, মাঝে মাঝে আকাশপটে নীল পর্ব্বতের আভাস দেখা যাচ্চে; শস্যক্ষেত্র বড় একটা নেই; দৈবাৎ দুই এক জায়গায় সেখানকার বুনো চাষারা মহিষ নিয়ে চাষ আরম্ভ করেছে; দুইধারে বিদীর্ণ পৃথিবী, কালো কালো পাথর, শুক্নো জলস্রোতের নুড়িছড়ানো পদচিহ্ন, ছোট ছোট অপরিণত শালগাছ, এবং টেলিগ্রাফের তারের উপর কালো লেজ ঝোলানো চঞ্চল ফিঙে পাখী। একটা যেন বৃহৎ বন্য প্রকৃতি পোষ মেনে একটি জ্যোতির্ম্ময় নবীন দেবশিশুর উজ্জ্বল কোমল করস্পর্শ সর্ব্বাঙ্গে অনুভব করে শান্ত স্থির ভাবে শুয়ে পড়ে আছে। কি রকম ছবিটা আমার মনে আসে বল্ব? কালিদাসের শকুন্তলায় আছে দুষ্যন্তের ছেলে শিশু ভরত একটা সিংহশাবক নিয়ে খেলা করত। সে যেন একদিন পশুবৎসলভাবে সিংহশাবকের বড় বড় রোঁয়ার মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে আপনার শুভ্র কোমল অঙ্গুলিগুলি চালনা করচে, আর বৃহৎ জন্তুটা স্থির হয়ে পড়ে আছে, এবং মাঝে মাঝে সস্নেহে একান্ত নির্ভরের ভাবে আপনার মানববন্ধুর প্রতি আড়চক্ষে চেয়ে দেখচে। আর ঐ যে শুক্নো স্রোতের নুড়িছড়ানো পথের কথা বল্লুম ওতে আমার কি মনে পড়ে বল্ব? বিলাতি রূপকথায় পড়া যায় বিমাতা যখন তার সতীনের ছেলেমেয়েকে ঘর থেকে তাড়িয়ে ছল করে একটা অচেনা অরণ্যের মধ্যে পাঠিয়ে দিলে তখন দুই ভাইবোনে বনের ভিতর চল্তে চল্তে বুদ্ধিপূর্ব্বক একটা একটা নুড়ি ফেলে আপনাদের পথ চিহ্নিত করে গিয়েছিল। ছোট ছোট স্রোতগুলি যেন সেইরকম ছোট ছোট ছেলেমেয়ে; তারা খুব তরুণ শৈশবে এই অচেনা বৃহৎ পৃথিবীর মধ্যে বেরিয়ে পড়ে; তাই চল্তে চল্তে আপনাদের ছোট ছোট পথের উপর নুড়ি ছড়িয়ে রেখে যায়—আবার যদি ফিরে আসে আপনার এই গৃহপথটি ফিরে পারে। কিন্তু ফিরে আসা আর ঘটবে না।