শিলাইদহ, 
মে, ১৮৯৩। 

 এখন আমি বোটে। এই যেন আমার নিজের বাড়ি। এখানে আমিই একমাত্র কর্ত্তা। এখানে আমার উপরে আমার সময়ের উপরে আর কারো কোনো অধিকার নেই। এই বোটটি আমার পুরোণো ড্রেসিং গাউনের মত—এর মধ্যে প্রবেশ করলে খুব একটি ঢিলে অবসরের মধ্যে প্রবেশ করা যায়। যেমন ইচ্ছা ভাবি, যেমন ইচ্ছা কল্পনা করি, যত খুসি পড়ি, যত খুসি লিখি, এবং যত খুসি নদীর দিকে চেয়ে টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে আপন মনে এই আকাশপূর্ণ, আলোকপূর্ণ, আলস্যপূর্ণ দিনের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে থাকি।

 এখন প্রথম দিনকতক আমার এই পূর্ব্বপরিচিতের সঙ্গে পুনর্ম্মিলনের নতুন বাধো বাধো ভাবটা কাটাতেই যাবে। তার পরে নিয়মিত লিখ্‌তে পড়তে নদীর ধারে বেড়াতে বেড়াতে আমাদের পুরাতন সখ্য আবার বেশ সহজ হয়ে আস্‌বে। বাস্তবিক, পদ্মাকে আমি বড় ভালবাসি। ইন্দ্রের যেমন ঐরাবত আমার তেমনি পদ্মা আমার যথার্থ বাহন—খুব বেশি পোষমানা নয়, কিছু বুনোরকম;—কিন্তু ওর পিঠে এবং কাঁধে হাত বুলিয়ে ওকে আমার আদর করতে ইচ্ছে করে। এখন পদ্মার জল অনেক কমে গেছে—বেশ স্বচ্ছ কৃশকায় হয়ে এসেছে—একটি পাণ্ডুবর্ণ ছিপ্‌ ছিপে মেয়ের মত, নরম শাড়িটি গায়ের সঙ্গে বেশ সংলগ্ন। সুন্দর ভঙ্গীতে চলে যাচ্চে আর শাড়িটি বেশ গায়ের গতির সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে যাচ্চে। আমি যখন শিলাইদহে বোটে থাকি, তখন পদ্মা আমার পক্ষে সত্যিকার একটি স্বতন্ত্র মানুষের মত,—অতএব তার কথা যদি কিছু বাহুল্য করে লিখি তবে সে কথাগুলো চিঠিতে লেখ্‌বার অযোগ্য মনে করা উচিত হবেনা। সেগুলো হচ্চে এখানকার পার্সোনাল খবরের মধ্যে। একদিনেই কলকাতার সঙ্গে ভাবের কত তফাৎ হয়ে যায়। কাল বিকেলে সেখানে ছাতে বসেছিলুম সে একরকম, আর আজ এখানে দুপুরবেলায় বোটে বসে আছি এ একরকম। কলকাতার পক্ষে যা সেণ্টিমেণ্টাল, পোয়েটিকাল, এখানকার পক্ষে তা কতখানি সত্যিকার সত্যি। পাব্লিক নামক গ্যাসালোকজালা ষ্টেজের উপর আর নাচতে ইচ্ছে করেনা—এখানকার এই স্বচ্ছ দিবালোক এবং নিভৃত অবসরের মধ্যে গোপনে আপনার কাজ করে যেতে ইচ্ছে করে। নেপথ্যে এসে রংচংগুলো ধুয়ে মুছে না ফেল্লে মনের অশান্তি আর যায়না। সাধনা চালানো, সাধারণের উপকার করা এবং হাঁস্‌ফাঁস্‌ করে মরাটা অনেকটা অনাবশ্যক বলে মনে হয়—তার ভিতরে অনেক জিনিষ থাকে যা খাঁটি সোনা নয় যা খাদ—আর, এই প্রসারিত আকাশ আর সুবিস্তীর্ণ শান্তির মধ্যে যদি কারো প্রতি দৃক্‌পাত না করে আপনার গভীর আনন্দে আপনার কাজ করে যাই তাহলেই যথার্থ কাজ হয়।