শিলাইদহ,
৩রা জুলাই, ১৮৯৩।

 কাল সমস্ত রাত তীব্র বাতাস পথের কুকুরের মত হূহু করে কেঁদেছিল— আর বৃষ্টিও অবিশ্রাম চল্‌চে। মাঠের জল ছোট ছোট নির্ঝরের মত নানাদিক থেকে কল্‌কল্ করে নদীতে এসে পড়চে—চাষারা ওপারের চর থেকে ধান কেটে আনবার জন্যে কেউবা টোগা মাথায় কেউবা একখানা কচুপাতা মাথার উপর ধরে ভিজ্‌তে ভিজ্‌তে খেয়া নৌকায় পার হচ্চে—বড় বড় বোঝাই নৌকোর মাথার উপর মাঝি হাল ধরে বসে বসে ভিজ্‌চে, আর মাল্লারা গুণ কাঁধে করে ডাঙার উপর ভিজ্‌তে ভিজ্‌তে চলেচে— এমন দুর্য্যোগ তবু পৃথিবীর কাজকর্ম বন্ধ থাকবার যো নেই। পাখীরা বিমর্ষ মনে তাদের নীড়ের মধ্যে বসে আছে কিন্তু মানুষের ছেলেরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। আমার বোটের সাম্‌নে দুটি রাখালবালক একপাল গরু নিয়ে এসে চরাচ্চে; গরুগুলি কচর্‌মচর্‌ শব্দ করে’ এই বর্ষাসতেজ সরসশ্যামল সিক্ত ঘাসগুলির মধ্যে মুখ ভরে দিয়ে ল্যাজ নেড়ে পিঠের মাছি তাড়াতে তাড়াতে স্নিগ্ধ শান্ত নেত্রে আহার করে করে বেড়াচ্চে-তাদের পিঠের উপর বৃষ্টি এবং রাখালবালকের যষ্টি অবিশ্রাম পড়চে, দুইই তাদের পক্ষে সমান অকারণ, অন্যায় এবং অনাবশ্যক, এবং দুই তারা সহিষ্ণুভাবে বিনা-সমালোচনায় সয়ে যাচ্চে এবং কচরমচর করে ঘাস খাচ্চে। এই গরুগুলির চোখের দৃষ্টি কেমন বিষণ্ণ শান্ত সুগম্ভীর স্নেহময়—মাঝের থেকে মানুষের কর্ম্মের বোঝা এই বড় বড় জন্তুগুলোর ঘাড়ের উপর কেন পড়ল? নদীর জল প্রতিদিনই বেড়ে উঠ্‌চে। পর্শু দিন বোটের ছাতের উপর থেকে যতখানি দেখা যেত, আজ, বোটের জানলায় বসে প্রায় ততটা দেখা যাচ্ছে—প্রতিদিন সকালে উঠে দেখি তটদৃশ্য অল্প অল্প করে প্রসারিত হয়ে যাচ্চে। এতদিন সাম্‌নে ঐ দূর গ্রামের গাছপালার মাথাটা সবুজ পল্লবের মেঘের মত দেখা যেত—আজ সমস্ত বনটা আগাগোড়া আমার সম্মুখে এসে উপস্থিত হয়েছে। ডাঙা এবং জল দুই লাজুক প্রণয়ীর মত অল্প অল্প করে পরস্পরের কাছে অগ্রসর হচ্চে। লজ্জার সীমা উপ্‌চে এল বলে—প্রায় গলাগলি হয়ে এসেছে। এই ভরা বাদরে ভরা নদীর মধ্যে দিয়ে নৌকো করে যেতে বেশ লাগ্‌বে—বাঁধা বোট ছেড়ে দেবার জন্যে মনটা অধীর হয়ে আছে।