ছেলেবেলা/১২
১২
এইবার তেতলাঘরের আর-এক পালা আরম্ভ হল আমার সংসার নিয়ে।
একদিন গােলাবাড়ি পাল্কি আর তেতলার ছাদের খালি ঘরে আমার ছিল যেন বেদের বাসা, কখনাে এখানে, কখনাে ওখানে। বউঠাকরুন এলেন, ছাদের ঘরে বাগান দিল দেখা। উপরের ঘরে এল পিয়ানাে, নতুন নতুন সুরের ফোয়ারা ছুটল।
পূর্বদিকের চিলেকোঠার ছায়ায় জ্যোতিদাদার কফি খাওয়ার সরঞ্জাম হ’ত সকালে। সেই সময়ে পড়ে শােনাতেন তাঁর কোনােএকটা নতুন নাটকের প্রথম খসড়া। তার মধ্যে কখনাে কখনাে কিছু জুড়ে দেবার জন্যে আমাকেও ডাক পড়ত আমার অত্যন্ত কাঁচা হাতের লাইনের জন্যে। ক্রমে রােদ এগিয়ে আসত— কাকগুলাে ডাকাডাকি করত উপরের ছাদে বসে রুটির টুকরাের ’পরে লক্ষ করে। দশটা বাজলে ছায়া যেত ক্ষ’য়ে, ছাতটা উঠত তেতে।
দুপুরবেলায় জ্যোতিদাদা যেতেন নীচের তলায় কাছারিতে। বউঠাকরুন ফলের খােসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে যত্ন ক’রে রুপাের রেকাবিতে সাজিয়ে দিতেন। নিজের হাতের মিষ্টান্ন কিছু কিছু থাকত তার সঙ্গে, আর তার উপরে ছড়ানো হ’ত গোলাপের পাপড়ি। গেলাসে থাকত ডাবের জল কিংবা ফলের রস কিংবা কচি তালশাঁস বরফে-ঠাণ্ডা-করা। সমস্তটার উপর একটা ফুলকাটা রেশমের রুমাল ঢেকে মোরাদাবাদি খুঞ্চেতে করে জলখাবার বেলা একটা-দুটোর সময় রওনা করে দিতেন কাছারিতে।
তখন ‘বঙ্গদর্শন’এর ধুম লেগেছে— সূর্যমুখী আর কুন্দনন্দিনী আপন লোকের মতো আনাগোনা করছে ঘরে ঘরে। কী হল, কী হবে, দেশসুদ্ধ সবার এই ভাবনা।
‘বঙ্গদর্শন’ এলে পাড়ায় দুপুরবেলায় কারো ঘুম থাকত না। আমার সুবিধে ছিল, কাড়াকাড়ি করবার দরকার হ’ত না; কেননা, আমার একটা গুণ ছিল— আমি ভালো পড়ে শোনাতে পারতুম। আপন মনে পড়ার চেয়ে আমার পড়া শুনতে বউঠাকরুন ভালোবাসতেন। তখন বিজ্লিপাখা ছিল না, পড়তে পড়তে বউঠাকরুনের হাতপাখার হাওয়ার একটা ভাগ আমি আদায় করে নিতুম।