ছেলে-ভুল/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।


 সে রাত্রিতে আর কোনরূপ অনুসন্ধান হইল না। পরদিবস প্রত্যুষে আমি সেই বালকের অনুসন্ধান করিবার মানসে থানা হইতে বাহির হইতেছি, এমন সময় একখানি পত্র-সহ এক ব্যক্তি একখানি জুড়ি গাড়িতে আমার থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গাড়ি হইতে নামিয়াই তিনি আমার অনুসন্ধান করিলেন। সম্মুখে আমি উপস্থিত ছিলাম, একজন প্রহরী আমাকে দেখাইয়া দিল। আমাকে দেখিয়া তিনি আমার নিকট আগমন করিলেন, এবং পত্রখানি বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি পত্রখানি খুলিলাম; দেখিলাম, উহা আমার সেই সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর স্বহস্তলিখিত। লেখাও অধিক নহে, দুইটী ছত্র মাত্র। উহাতে লেখা ছিল,—“আপনি যে বালকের অনুসন্ধান করিতেছেন, এই পত্রবাহক সেই বালকের পিতা।”

 তাঁহার পোষাক-পরিচ্ছদ, গাড়ি-ঘোড়া দেখিয়া এবং তাঁহার কথাবার্ত্তা শুনিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম, তিনি একজন বড় মানুষ। পাশ্চাত্য-শিক্ষায় ইনি উত্তমরূপে শিক্ষিত। ইনি আসিয়া হঠাৎ উপস্থিত হওয়ায়, সেই সময় আর আমাকে বাহিরে যাইতে হইল না। তাঁহার সমভিব্যাহারে আমি আমার আফিস গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম, এবং সেই স্থানে নির্জ্জনে উভয়ে উপবেশন করিয়া আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনিই কি একখানি টেলিগ্রাম করিয়াছিলেন?”

 বড়লোক। হাঁ মহাশয়।

 আমি। দেখুন দেখি, এই টেলিগ্রাম কি না?

 বড়লোক। হাঁ মহাশয়। আমিই এই টেলিগ্রাম পাঠাইয়াছিলাম।

 আমি। এই টেলিগ্রামে যে বালকের কথা উল্লেখ আছে, সে কি আপনার পুত্র?

 বড়লোক। হাঁ, সেই শিশু আমার সন্তান। আপনার সাহেবের নিকট হইতে অবগত হইলাম, আপনিই সেই শিশুর অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছেন; ইহা কি প্রকৃত?

 আমি। উহার অনুসন্ধানের ভার আমারই উপর ন্যস্ত হইয়াছে।

 বড়লোক। উহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিয়াছেন কি?

 আমি। না, এ পর্য্যন্ত আমি উহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। আজ উহার সন্ধানে গমন করিতেছিলাম, এমন সময় আপনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 বড়লোক। উহার সন্ধান পাইবার কোনরূপ আশা আছে কি?

 আমি। আশা না থাকিলে কি কখনও এই জগতের অস্তিত্ব থাকিত? আশা নাই, এ কথা আমি বলিতে পারি না।

 বড়লোক। আপনি অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত গমন করিতেছিলেন; চলুন, আমিও আপনার সহিত গমন করি।

 আমি। আমার সহিত আপনার গমন করিবার প্রয়োজন এখন নাই। যখন প্রয়োজন হইবে, তখন আপনি আমার সহিত গমন করিবেন। এখন কতকগুলি কথা আপনার নিকট আমার জিজ্ঞাস্য আছে, সেইগুলির যথাযথ উত্তর প্রদান করুন; তাহা হইলে কিরূপ ভাবে কোথায় ইহার অনুসন্ধান করিতে হইবে, তাহা বুঝিতে পারিব।

 বড়লোক। আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?

 আমি। টেলিগ্রামে যে নাম আছে, সেই নামই বোধ হয়, আপনার নাম।

 বড়লোক। হাঁ উহাই আমার নাম।

 আমি। আপনার বাসস্থান কোথায়?

 বড়লোক। এই শহরেই আমার বাসস্থান।

 আমি। আপনি যে কলিকাতাবাসী, তাহা আমি পূর্ব্বেই বুঝিতে পারিয়াছি; কিন্তু কলিকাতার কোন্ স্থানে আপনার বাসস্থান, তাহা আমাকে বলিয়া দিবেন কি? কারণ, যখন আপনাকে আবশ্যক হইবে, তখন আমি আপনাকে কোথায় পাইব?

 আমার কথার উত্তরে তিনি তাঁহার প্রকৃত পরিচয় আমাকে প্রদান করিলেন, এবং যে স্থানে তাঁহার বাসস্থান তাহাও আমাকে বলিলেন। আমি কিন্তু তাঁহার নাম ও পরিচয় পাঠকগণের নিকট সবিশেষ কোন কারণ বশতঃ প্রকাশ করিতে পারিলাম না।

 আমি। কিরূপ অবস্থায় আপনি আপনার শিশুসন্তানটীকে হারাইয়াছেন, তাহার আদ্যোপান্ত বৃত্তান্ত আমার নিকট সবিশেষ করিয়া বলুন দেখি।

 বড়লোক। আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আমার বাসস্থান এই কলিকাতায়; কিন্তু আমার শ্বশুরালয় কলিকাতায় নহে। মেদিনীপুর জেলার মধ্যে একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে আমার শ্বশুরালয়। সেই স্থানে গমন করিতে হইলে, ষ্টীমারে তমলুক পর্য্যন্ত গমন করিতে হয়। তমলুক হইতে আমার শ্বশুরালয় কয়েকখানি গ্রাম ব্যবধান। তমলুক হইতে সেই স্থানে গমন করিতে হইলে পাল্কী বা শকট ভিন্ন গমন করিবার আর কোন উপায় নাই। আমার বিবাহের পর আমার স্ত্রী কেবলমাত্র একবার তাহার পিত্রালয়ে গমন করিয়াছিলেন; তাহা বহুদিবসের কথা। আমার শ্বশুরের অবস্থা ভাল নহে বলিয়া, আমি আমার স্ত্রীকে সেই স্থানে যাইতে দেই না। আমার শ্বশুর মহাশয় আসিয়া মধ্যে মধে তাঁহার কন্যাকে দেখিয়া যান; কিন্তু পাড়াগাঁয়ের নিয়ম-অনুসারে আমার শ্বাশুড়ী ঠাকুরাণী আমাদিগের বাটীতে আসিতে পারেন না। সুতরাং তাঁহার কন্যার সহিত প্রায় একরূপ দেখা-সাক্ষাৎ নাই। আমার স্ত্রী বহুদিবস হইতে তাহার মাতাকে দেখিতে না পাইয়া, দুঃখিতা থাকিতেন, এবং সেই স্থানে গমন করিয়া একবার তাহার মাতায় সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসিবেন, এই ইচ্ছা মধ্যে মধ্যে প্রকাশ করিতেন। সুযোগ মত আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া তাহার মাতার সহিত সাক্ষাৎ করাইয়া আনিব, এই কথা মধ্যে মধ্যে বলিয়া তাহাকে সান্ত্বনা করিতাম।

 “ক্রমে আমার সেই পুত্রটী জন্মগ্রহণ করিল। সেই পুত্র জন্মাইবার পর হইতে আমার স্ত্রী তাঁহার পিত্রালয়ে অভাবপক্ষে দুই একদিবসের নিমিত্তও গমন করিবার জন্য আমাকে সবিশেষরূপে অনুরোধ করিতে লাগিল। আমি প্রথমতঃ তাহার প্রস্তাবে অসম্মত হইলাম; কিন্তু কোনরূপেই তাহাকে শান্ত করিতে পারিলাম না। অনন্যোপায় হইয়া ক্রমে তাহার মতে আমাকে মত দিতে হইল, এবং শ্বশুরালয়ে গমন করিবার দিন স্থির করিয়া শ্বশুর মহাশয়কে পত্র লিখিলাম। সেই স্থানে গমন করিতে হইলে, যে স্থানে যেরূপ করিবার প্রয়োজন, তাহার সমস্তই ঠিক হইল। প্রায় এক সপ্তাহ হইল, আমি আমার স্ত্রী ও পুত্রের সহিত আমার শ্বশুর বাড়ী গমন করিবার নিমিত্ত কলিকাতা পরিত্যাগ করিলাম। আমাদিগের সঙ্গে আমার দুইজন বন্ধু, একজন পাচক ব্রাহ্মণ, দুইটী দ্বারবান্‌, চারিজন পরিচারক এবং দুইজন পরিচারিকামাত্র গমন করিল। আমার শ্বশুরের অবস্থা ভাল নহে, একথা আমি পুর্ব্বেই বলিয়াছি। সুতরাং সেই স্থানে গমন করিয়া, সেই স্থানে অবস্থিতি করিবার ও সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিবার জন্য যে সকল ব্যয় এবং যেরূপ বন্দোবস্তের প্রয়োজন, তাহা সমস্ত আমিই নির্ব্বাহ করিলাম।

 “কলিকায় আরমানিঘাট হইতে জাহাজে আরোহণ করিয়া আমরা তমলুকে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে পাল্কীর বন্দোবস্ত ছিল। সুতরাং শ্বশুরবাড়ী পৌঁছিতে আমার বা আমার সমভিব্যাহারী সমস্ত লোকের কোনরূপ কষ্ট হইল না। সেই স্থানে কয়েকদিবসকাল অতিবাহিত করিয়া গত পরশ্ব তারিখে আমরা তমলুকে আসিয়া উপস্থিত হই। সেই স্থানে রাত্রিযাপন করিয়া, পরদিবস জাহাজে আরোহণ করি। আমাদিগের ইচ্ছা ছিল, তমলুক হইতে আমরা একবারে কলিকাতায় আগমন করিব না; উলুবেড়িয়ার কয়েকখানি গ্রাম ব্যবধানে আমার স্ত্রীর এক ভগিনীর শ্বশুরবাড়ী আছে। ইচ্ছা ছিল, উলুবেড়িয়ায় নামিয়া, আমরা সেই স্থানে গমন করিব; সেই স্থানে দুই একদিবস থাকিয়া, আমরা কলিকাতায় প্রত্যাবর্ত্তন করিব। মনে মনে আমরা যেরূপ স্থির করিয়াছিলাম, কার্য্যেও আমরা সেইরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছিলাম। সেই স্থানে গমন করিবার সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক ছিল, জাহাজ উলুবেড়িয়ায় আসিয়া উপস্থিত হইলে, আমরা সকলে সেই স্থানে অবতরণ করিলাম। জাহাজ জেটিতে থাকিয়া নিয়মিত সময়ে কলিকাতা অভিমুখে প্রস্থান করিল।

 “জাহাজ ছাড়িয়া যাইবার পর দেখিলাম, আমার সমভিব্যাহারী লোজন ও দ্রব্যসামগ্রী সমস্তই জাহাজ হইতে নামাইয়া আনা হইয়াছে, কেবল আমার শিশুসন্তানটীকে দেখিতে পাইলাম না। তাহাকে দেখিতে না পাইয়া, প্রথমতঃ আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলাম; তিনি কহিলেন, “আমার নিকটে আমার সন্তান নাই, কোন না কোন চাকর-চাকরাণীর কাছ থাকিবে।” তখন এক এক করিয়া চাকর-চাকরাণী, দ্বারবান্‌, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি যে সকল ব্যক্তি আমাদিগের সঙ্গে ছিল; তাহাদিগের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করিলাম। সকলেই কহিল, তাহারা কেহই জাহাজ হইতে বালককে নামাইয়া আনে নাই। অধিকন্তু প্রত্যেকে প্রত্যেকের সহিত বিবাদ আরম্ভ করিল, পরিচারিকাদ্বয়ের মধ্যে মহাগোলযোগ উপস্থিত হইল।

 “একজন কহিল, ‘বালক তোর জিম্মায় ছিল, তুই আনিস্ নাই কেন?’ অপর আর একজন কহিল, ‘জাহাজের ভিতর তুই বালককে ক্রোড়ে করিয়া রাখিয়াছিলি, তোরই নিকট সেই বালক ছিল, তুই তাহাকে কিরূপে পরিত্যাগ করিয়া আসিলি।’ চাকরগণের মধ্যে পরস্পর হাতাহাতি আরম্ভ হইল। একজন কহিল, ‘তোর দোষ।’ আর একজন কহিল, ‘তোর দোষ।’ একজন কহিল, ‘জাহাজ হইতে নামিবার সময় তোকে বলিয়াছিলাম, কোন দ্রব্য ভুল ক্রমে ফেলিয়া আসিয়াছি কি না, দেখিয়া আয়।’ অপর ব্যক্তি কহিল, ‘এ কার্য্যের ভার তোর উপর ছিল, তুই আপন কার্য্য করিস্‌ নাই বলিয়াই ত এই সর্ব্বনাশ ঘটিল।’ আমার সমভিব্যাহারে অপর যাঁহারা ছিলেন, তাঁহারা চুপ করিয়া এদিক ওদিক অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, আমার স্ত্রী উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে আরম্ভ করিল। এই সকল ব্যাপার দেখিয়া আমি যে কি করিব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। ওদিকে দেখিলাম, জাহাজখানি আর ঘাটে নাই, কলিকাতা অভিমুখে প্রস্থান করিতেছে; আর এত দূরবর্ত্তী হইয়া পড়িয়াছে যে, জাহাজের কোন লোক আমাদিগের উচ্চরবও শুনিতে পায় না।

 “তখন অনন্যোপায় হইয়া, কি করি, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আপনাদিগের সাহেবের নিকট টেলিগ্রাম করিলাম, এবং অপর যে সকল স্থানে সেই জাহাজ দাঁড়াইবার সম্ভাবনা আছে, সেই সকল স্থানে অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত লোকজন সমভিব্যাহারে আমি নিজেই রওনা হইলাম। স্থানীয় পুলিসকেও সেই সময় সংবাদ দেওয়া হইয়াছিল, তাঁহারাও আমাদিগকে সবিশেষরূপ সাহায্য করিলেন; কিন্তু কোন স্থানেই তাহার কোনরূপ সন্ধান করিতে পারিলাম না।

 আমি। যখন আপনারা তমলুক হইতে জাহাজে আরোহণ করেন, সেই সময় বালকটীকে জাহাজে আনা হইয়াছিল ত?

 বড়লোক। সে সময় ভুল হয় নাই।

 আমি। জাহাজের উপর আপনি আপনার পুত্রটীকে নিজ চক্ষে দেখিয়াছিলেন কি?

 বড়লোক। জাহাজের মধ্যে আমি যে তাহাকে নিজ চক্ষে দেখিয়াছি ইহা কিন্তু আমার ঠিক স্মরণ হয় না; কিন্তু বালকটীকে যে জাহাজে আনা হইয়াছিল, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

 আমি। আপনি কিরূপে বলিতেছেন যে, জাহাজে তাহাকে আনা হইয়াছিল? কারণ, আপনি নিজে ত তাহাকে দেখেন নাই।

 বড়লোক। আমি নিজে দেখি নাই সত্য। কিন্তু পরিশেষে এ বিষয়ে আমি অনুসন্ধান করিয়াছিলাম। যে চাকরাণী ক্রোড়ে করিয়া তাহাকে জাহাজে উঠাইয়াছিল, সে-ই আমাকে বলিয়াছে। তদ্ব্যতীত আমার স্ত্রীও তাহাকে জাহাজের ভিতর দেখিয়াছেন।

 আমি। যে সময় উলুবেড়িয়ায় আপনারা সকলে জাহাজ হইতে অবতরণ করেন, সেই সময় সেই বালক কার নিকট ছিল, তাহার কিছু অনুসন্ধান করিয়াছেন কি?

 বড়লোক। করিয়াছি, সেই সময় সেই বালক কাহারও ক্রোড়ে ছিল না। জাহাজ হইতে অবতরণ করিবার কিছু পূর্ব্বেই সে নিদ্রিত হইয়া পড়ে, কামরার মধ্যে একখানি বেঞ্চের উপর তাহাকে শোয়াইয়া রাখা হয়। পরিশেষে নামিবার সময় ভুল-ক্রমে আর কেহই তাহাকে লইয়া নাবেন নাই। নিদ্রিত অবস্থায় বালক আমার সেই স্থানেই রহিয়া যায়।

 আমি। আমি বিস্তর বিস্তর ভুল দেখিয়াছি; কিন্তু এরূপ মহাভুল আমি কখনও দেখি নাই; দেখা ত দূরের কথা, কখনও শুনি নাই।

 বড়লোক। নিদ্রিত অবস্থায় বালক আমার এই কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হয় নাই ত?

 আমি। জাহাজ ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই আমি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম। আমার সম্মুখেই জাহাজ আসিয়া ঘাটে উপস্থিত হয়। জাহাজের ভিতর ও আরোহীগণের মধ্যে আমি নিজে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছি। বালক কলিকাতা পর্য্যন্ত আসিয়া উপস্থিত হয় নাই।

 বড়লোক। জাহাজের কোন লোক সেই বালক সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে পারে নাই?

 আমি। তাহাও আমি প্রায় প্রত্যেকেকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি; কিন্তু সেই বালক যে কোথায় গেল, বা কে তাহাকে লইয়া গেল, এ সংবাদ আমাকে কেহই প্রদান করিতে পারিল না। কেবল জাহাজের খালাসিগণের নিকট হইতে এইমাত্র অবগত হইতে পারিলাম যে, আপনারা তমলুকে উঠিয়াছিলেন, এবং উলুবেড়িয়ায় নামিয়া গিয়াছেন।

 বড়লােক। মহাশয়! এখন উপায় কি বলুন দেখি?

 আমি। উপায় ঈশ্বরের হস্ত। আমরা বালকের সন্ধান করিবার নিমিত্ত সাধ্যমত চেষ্টা করিবমাত্র। সেই বালকের অঙ্গে কি কি অলঙ্কার ছিল বলিতে পারেন কি?

 বড়লােক। কি কি অলঙ্কার ছিল, ঠিক তাহা আমি বলিতে পারি না। কেবল এইমাত্র বলিতে পারি যে, বালকের অঙ্গে সােণার যে সকল অলঙ্কার থাকিতে পারে, তাহার সমস্তই ছিল। আবশ্যক হয়, তাহার একটী বিস্তারিত তালিকা আমি পরে পাঠাইয়া দিব।

 আমি। আমি একটী কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি,—যে সকল চাকর-চাকরাণী বা লােকজন আপনার সহিত ছিল, তাহাদিগের মধ্যে কাহাকেও কোনরূপে আপনার সন্দেহ হয় কি?

 বড়লােক। সকলেই পুরাতন চাকর। তাহাদিগের কাহারও দ্বারা যে কোনরূপ অনিষ্ট হইবে, তাহা কিন্তু আমার মনে স্থান পায় না; তবে বলিতে পারি না। কিন্তু তাহারা সকলেই ত আমাদিগের সহিত ছিল, কাহাকেই সেই সময় অনুপস্থিত পাই নাই।

 আমি। অলঙ্কারের লােভ, ভয়ানক লােভ। এ লােভ সম্বরণ করা সামান্য লােকের পক্ষে বড়ই কঠিন।

 বড়লােক। উহাদিগের মধ্যে কেহ যদি অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিত, তাহা হইলে অলঙ্কার-শূন্য বালকটীকে ত কোন প্রকারে পাওয়া যাইত?

 আমি। পাওয়া ত উচিত ছিল; কিন্তু যদি অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়া বালককে গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করিয়া থাকে, তাহা হইলে কিরূপে বালককে পাওয়া যাইতে পারে?

 বড়লোক। যখন আমরা সকলেই সেই স্থানে উপস্থিত, তখন চাকর-চাকরাণীগণের মধ্যে কাহারও কি এতদূর সাধ হইতে পারে? যদি তাহাই হইয়া থাকে, তাহা হইলে আপনার বিবেচনায় বালককে কি হত্যা করিয়া তাহার অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়াছে বলিয়া, আপনার অনুমান হয়?

 আমি। অনুমান হয় না। চাকর-চাকরাণীগণ কর্ত্তৃক শিশু হত্যা না হইবারই খুব সম্ভাবনা। এ কথা আমি তর্কচ্ছলে বলিতেছি মাত্র। আমি আপনাকে আরও দুই একটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।

 বড়লোক। কি?

 আমি। যে কামরার ভিতর আপনার স্ত্রী ও আপনার শিশুসন্তান ছিল, আপনিও কি সেই কামরার ভিতর ছিলেন?

 বড়লোক। না মহাশয়। আমি সেই স্থানে ছিলাম না, অপর স্থানে ছিলাম।

 আমি। সেই কামরার ভিতর আপনার স্ত্রী ব্যতীত অপর আর কে ছিল?

 বড়লোক। দুইজন পরিচারিকা ছিল।

 আমি। তাহারা এখন কোথায়?

 বড়লোক। তাহারা এখন আমার বাড়ীতেই আছে।

 আমি। আমি তাহাদিগকে দুই চারিটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।

 বড়লোক। উত্তম, আপনি আমার সহিত আমাদিগের বাড়ীতে চলুন। সেই স্থানে চাকর-চাকরাণীগণ যাহারা আমাদিগের সহিত ছিল, সকলেই উপস্থিত আছে, আপনি যাহাকে যাহা ইচ্ছা হয়, তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া লইতে পারেন।

 আমি। সে-ই ভাল, চলুন আমি আপনার সহিত গমন করিতেছি। আপনাকে আরও একটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।

 বড়লোক। কি?

 আমি। আপনার অবস্থা দেখিয়া ও আপনার কথাবার্ত্তা শুনিয়া আমার বেশ অনুমান হইতেছে, আপনি বড়লোক, এবং আপনার বিষয়-আশয় যথেষ্ট আছে।

 বড়লোক। আপনি যাহা বলিতেছেন, সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার এই মহৎ কার্য্য যদি আপনার দ্বারা সাধিত হয়, তাহা হইলে আপনার খরচপত্র ত দূরের কথা, যাহাতে আপনি সন্তুষ্ট হন, এরূপ পুরষ্কার আমি আপনাকে প্রদান করিব।

 আমি। আমি পুরষ্কার বা খরচপত্রের কথা বলিতেছি না। আমি যাহা বলিতেছি, তাহা অগ্রে শুনিয়া তাহার উত্তর প্রদান করুন, আমি যাহা অনুমান করিতেছি, তাহা ত প্রকৃত? আপনার যথেষ্ট বিষয় আছে কি? আমার এ জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য, আপনাকে পরে বলিতেছি।

 বড়লোক। হাঁ, কিছু আছে।

 আমি। আপনার পুত্রের জীবনের উপর আপনার বিষয় উপলক্ষে কাহারও শুভাশুভ কিছু নির্ভর করে কি?

 বড়লোক। আমি আপনার এ কথার ঠিক প্রকৃত অর্থ বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।

 আমি। আপনার যদি সেই পুত্র জন্মগ্রহণ না করিত, বা সেই পুত্রের কোনরূপে যদি মৃত্যু হয়, তাহা হইলে আপনার মৃত্যুর পর আপনার অগাধ বিষয়ের স্বত্বাধিকারী অপর কেহ হইতে পারে কি?

 বড়লোক। না, আমি সেরূপ দেখিতেছি না। আমার এই পুত্রের মৃত্যুতে আমার এই বিষয়ের কোনরূপ ক্ষতি-বৃদ্ধি হইবে না। কারণ, এই বিষয় এখন আমার নহে, আমার পিতার। তিনি এখনও বর্ত্তমান; তদ্ব্যতীত আমিই কেবল তাঁহার একমাত্র পুত্র নহি।