জননী/নয়
নয়
শ্যামার মনে আবার নিবিড় হইয়া আর্থিক দুর্ভাবনা ঘনাইয়া আসিয়াছে।
এবার আর কোনদিকে সে উপায় দেখিতে পায় না। আগে দুরবস্থায় পড়িয়া একটা ভরসা সে করিতে পারিত, বাড়িটা বিক্রয় করিয়া দিলে মোটা কিছু টাকা পাওয়া যাইবে। এখন সে ভরসাও নাই। বাড়ি বিক্রীর অতগুলি টাকা কেমন করিয়া নিঃশেষ হইয়া গেল? অপচয় করিয়াছে নাকি সে? হয়ত আরও হিসাব করিয়া খরচ করা উচিত ছিল। এক সঙ্গে অনেকগুলি টাকা হাতে পাইয়া নিজেকে হয় তো সে বড়লোক ঠাওরাইয়াই বসিয়াছিল।
তবে, একথা সত্য যে এ ক'বছর একটি পয়সাও ঘরে আসে নাই। ফোঁটা ফোঁটা করিয়া ঢালিলেও কলসীর জল একদিন শেষ হইয়া যায়। বিধানের পড়ার খরচও কি সহজ! বকুলের বিবাহেও ঢের টাকা লাগিয়াছে।
কিন্তু এখন উপায়?
শ্যামা এবার একটু মন দিয়া শীতলের ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করিতে লাগিল। খায় দায়, তামাক টানিয়া তাস পাশা খেলিয়া দিন কাটায়, হাঁটে একটু খোঁড়াইয়া, বদহজমে ভোগে, রাত্রে ভাল ঘুম হয় না। তবু কিছু কি শীতল করিতে পারে না? ঘরে বসিয়া থাকিয়াই হয়ত সে একেবারে সারিয়া উঠিতে পারিতেছে না, কাজে কর্মে মন দিলে হয়ত সুস্থ হইবে!
চুলে শীতলের পাক ধরিয়াছে। বিবর্ণ কপালের ঠিক উপরে একগোছা চুল একেবারে সাদা হইয়া গিয়াছে। না, বয়স শীতলের কম হয় নাই। বিবাহ সে বেশি বয়সেই করিয়াছিল, বয়স এখন ওর পঞ্চাশের কাছে গিয়াছে বৈকি। তবু, পঞ্চাশ বছর বয়সে পুরুষ মানুষ কি রোজগার করে না? হারান পঁয়ষট্টি বছর পর্যন্ত কতটাকা উপার্জন করিয়াছে, শীতল কি কিছু ঘরে আনিতে পারে না, যৎসামান্য? পঞ্চাশটা টাকা অন্তত? আর কিছু হোক বা না হোক, বিধানের পড়ার খরচ তো দিতে হইবে।
মৃদু মৃদু শীত পড়িয়াছে। কোঁচার খুঁট গায়ে জড়াইয়া বাহিরের অঙ্গনের জাম গাছটার গোড়ায় বেতের মোড়াতে বসিয়া শীতল তামাক টানে। বাড়ির পোষা কুকুরটা পায়ের কাছে মুখ গুঁজিয়া চুপচাপ শুইয়া থাকে। মাঝে মাঝে শীতলের পা চাটিয়া দেয়। কুকুরটার সঙ্গে শীতলের বড় ভাব। কুকুরটাও তার বড় বাধ্য। শ্যামা কাছে আসিয়া মানুষ ও পশুর চোখ-বোজা নিবিড় তৃপ্তির আলস্য চাহিয়া দ্যাখে।
কিন্তু উপায় কি? শ্যামার আর কে আছে, কে তার জন্য বাহির হইবে উপার্জন করিতে?
ধীরে ধীরে মিষ্টি করিয়াই কথাগুলি সে বলে, ভীত বিস্মিত চোখে তার মুখের দিকে চাহিয়া শীতল শুনিয়া যায়। কিন্তু, সে যেন বুঝিতে পারে না, সংসার, কর্তব্য, টাকার অভাব, খোকার পড়া সব জড়াইয়া শ্যামা যেন তাকে ভয়াবহ শাসনের ভয় দেখাইতেছে।
শীতল মাথা নাড়ে, সন্দিগ্ধভাবে। সে কি করিবে? কি করিবার ক্ষমতা তার আছে? শিশুর মত আহত কণ্ঠে সে বলে, আমার যে অসুখ গো?
অসুখ তা জানি, সেরে তো উঠেছ খানিকটা, ঠাকুরজামাইকে বলে কম খাটুনির একটা কাজ টাজ তুমি করতে পারবে। আমি আর কতকাল চালাব?
বাড়ির টাকা পেলে, বাড়িটা কার?—শীতল বলে।
বটে। তাই তবে শীতল মনে করিয়াছে, তার বাড়ির টাকায় এতকাল চলিয়াছে, আর তাহার কিছু করিবার প্রয়োজন নাই। এতকাল সেই সংসার চালাইয়াছে এই কথা ভাবিয়া রাখিয়াছে শীতল? এবার তাই তাহার বসিয়া থাকার অধিকার জন্মিয়াছে।
এসব জ্ঞান তো টনটনে আছে দেখি বেশ—শ্যামা বলে।
কুকুরটা উঠিয়া যায়। শীতলের দৃষ্টি তাহাকে অনুসরণ করে। তারপর আবার কাতর কণ্ঠে সে বলে, আমার অসুখ যে গো!
একদিনে হাল ছাড়িবার পাত্রী শ্যামা নয়। বার বার শীতলকে সে তাহাদের অবস্থাটা বুঝাইবার চেষ্টা করে। কড়া কথা সে বলে না, লজ্জা দেয় না, অপমান করে না। আবার বাহির হইয়া ঘরে টাকা আনা শীতলের পক্ষে এখন কত কঠিন সে তা বোঝে পারুক না পারুক গা ঝাড়া দিয়া উঠিয়া শীতল একবার চেষ্টা করুক এইটুকু শুধু তার ইচ্ছা।
রাখালকে শ্যামা একদিন বলিয়াছিল, ঠাকুরজামাই, আবার তো আমি নিরুপায় হলাম?
কেন? অতটাকা কি করলে বৌঠান? বলেছিলাম টাকা তুমি রাখতে পারবে না—
ঠাকুরজামাই ছেলেকে আমার বি-এটা আপনি পাশ করিয়ে দিন।
পড়ার খরচ দেবার কথা বলছ বৌঠান?
হ্যাঁ, রাখাল এবাএ রাগ করিয়াছিল। সে কি রাজা না জমিদার? কতটাকা মাহিনা পায় সে শ্যামা জানে না? একি অন্যায় কথা যে শ্যামা ভুলিয়া যায় ক্ষমতার মানুষের একটা সীমা আছে। আজ কতবছর শ্যামা সকলকে লইয়া এখানে আছে, কত অসুবিধা হইয়াছে রাখালের। কত টানাটানি গিয়াছে তাহার কিন্তু কিছু সে বলে নাই। বলে নাই এই ভাবিয়া যে যতদিন তার দুমুঠো ভাত জুটিবে শ্যামার ছেলেমেয়েকে একমুঠা তাকে দিতে হইবে, সেটা তার কর্তব্য। তাই কি শ্যামা যথেষ্ট মনে করে না একটা ছাঁপোষা মানুষের পক্ষে?
ঠাকুরজামাই, এ'কবছর আমিও তো কিছু কিছু সংসার খরচ দিয়েছি?
বলিয়া শ্যামা সঙ্গে সঙ্গে অনুতাপ করে। অনুগ্রহ চাহিতে আসিয়া এমন কথা বলিতে আছে! মুখখানা তাহার শুকাইয়া যায়। রাখাল বলে, তা জানি বৌঠান, আজ বলে নয়, গোড়া থেকে জানি। কৃতজ্ঞতা বলে তোমার কিছু নেই। যাক, আমার কর্তব্য আমি করেছি, নিন্দা প্রশংসার কথা তো আর ভাবিনি, এখানে থাকতেও তোমাদের আমি বারণ করিনে, তার বেশি আমি কিছু পারব না বৌঠান, আমায় মাপ কর—এই হাত জোড় করলাম তোমার কাছে।
শীতলের একটা ব্যবস্থা? বিধানের পড়ার খরচ না দিক শীতলের জনা রাখাল কিছু করিতে পারে না?
শীতল? রাখাল অবাক হইয়া থাকে। শীতল চাকরী করিবে, ওই অসুস্থ আধপাগলা মানুষটা! কি বলছ বৌঠান তুমি, তোমার কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে?
আমার যে উপায় নেই ঠাকুরজামাই?
শেষে রাখাল বলে, আচ্ছা দেখি।
রাখাল সত্যই চেষ্টা করিল। শীতল বহুকাল কলিকাতার প্রেসে বড় চাকরি করিয়াছে, এই সব বলিয়া কহিয়া বোধ হয় স্থানীয় একটা ক্ষুদ্র ছাপাখানায় একটা কাজ সে যোগাড়ও করিয়া ফেলিল শীতলের জন্য। বেতন পনের টাকা। কাজ কর্ম দেখিবে, খাতা পত্র লিখিবে। মফস্বলের ছোট ছাপাখানা, কাজ সামান্যই হয়, শীতল পারিবে হয়ত।
খবর শুনিয়া শীতল বিবর্ণ হইয়া বলিল, অসুখ যে আমার, আমি পারব কেন? কলম ধরলে আমার যে হাত কাঁপে। আমি যে লিখতে পারিনে রাখাল?
শ্যামা বলিল, আগে থেকে ভড়কাচ্ছ কেন বলত? গিয়েই দ্যাখো না পার কিনা, দুদিন যেতে আরম্ভ করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
কোথায় পঞ্চাশ, কোথায় পনের। পঞ্চাশই বা কেন? ছাপাখানায় কাজ করিয়া তিনশ' টাকাও তো শীতল একদিন মাসে মাসে ঘরে আনিয়াছে। তবে আজ সে কথা ভাবা মিছে। সেদিন আর ফিরিবে না, সে শীতল নাই, সে শ্যামাও নাই। পঞ্চাশ টাকার আশা করিয়া পনের টাকাতেই শ্যামা এখন খুসি হইতে জানে।
শীতল আপিসে যায়। ছাপাখানা প্রায় আধ মাইল দূরে। স্নান করিয়া খাইয়া শীতল ছেঁড়া কোটটি গায়ে চাপায়, বিষণ্ণ সকাতর মুখে হুঁকায় কয়েকটা শেষটান দিয়া মোটা লাঠিটা বাগাইয়া ধরে। বড় দুর্বল পা দুটি শীতলের, লাঠিতে ভর দিয়া সে গুটিগুটি হাঁটিতে আরম্ভ করে। পোষা কুকুরটি তখন উঠিয়া দাঁড়ায়, লেজ নাড়িতে নাড়িতে সে শীতলের সঙ্গে যায়। পুকুর ঘুরিয়া গলি পথ পার হইয়া বড় সদর রাস্তা পর্যন্ত শীতলকে আগাইয়া দিয়া আসে।
বকুল চিঠি লিখিয়াছে, সে ভাল আছে। বিধান চিঠি লিখিয়াছে সেও ভাল আছে। সকলে ভাল আছে।
শরীরটা শ্যামারও বহুকাল ভালই আছে। দু'বেলা রাঁধে, সংসারের কাজকর্ম করে, অবিশ্রাম খাটুনি শ্যামার, শক্ত সবল দেহ না থাকিলে কবে শ্যামা ক্ষয় হইয়া যাইত। এত খাটিতে হয় কেন শ্যামাকে? আশ্রিতার সমস্ত অবসর মুহূর্তগুলি কেমন করিয়া কর্তব্যে ভরিয়া ওঠে কেহ টেরও পায় না। একদিন দেখা যায় ভোর পাঁচটা হইতে রাত এগারোটা অবধি যত কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব সব সে করিতেছে একা।
কস্তাপাড় মোটা একখানা সাড়ি পরিয়া শ্যামা কাজ করে, দেখিয়া কে বলিবে সে এ বাড়ির দাসী নয়। হাতের চামড়া তাহার কর্কশ হইয়াছে, থাবা হইযাছে বড়, আধমণ জলের বালতি সে অবলীলাক্রমে তুলিয়া নেয়, গায়ে এত জোর। ছেলেমেয়েরা বড় হইয়াছে, রাত্রে তাহাকে বারবার উঠিতে হয় না, বিধানও এখানে নাই যে জাগিয়া বসিয়া সে তাহার পাঠরত পত্রের দিকে চাহিয়া আকাশ পাতাল ভাবিবে, কাজকর্ম শেষ করিয়া শোয়া মাত্র শ্যামা ঘুমাইয়া পড়ে, কোথা দিয়া রাত কাটিয়া যায় সে টেরও পায় না। টাকার চিন্তা করে না শ্যামা? শীতলের পনের টাকার চাকরিতেই সে নির্ভাবনা হইয়া গিয়াছে নাকি! চিন্তার তাহার শেষ নাই। তবে রাত জাগিয়া কোন ভাবনাই সে ভাবিতে পারে না। সারাদিন সহস্র কাজের সঙ্গে ভাবনার কাজটাও সে করিয়া যায়, অনেকটা কলের মত, পাঠাভ্যাসের মত। এমনি হইয়াছে আজকাল। আজীবন শ্যামা যে একা, কারো সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া ভাবিবার সংযোগ সে যে কোনদিন পায় নাই, অতীতের স্মৃতিতে, বর্তমানের সম্পদে বিপদে, ভবিষ্যতের জল্পনা-কল্পনায় চিত্ত তাহার নিঃসঙ্গ, নির্ভরহীন।
ফণী একবার নিউমোনিয়ায় মরমর হইয়া বাঁচিয়া উঠিল, মন্দার যমজ ছেলে দুটির একজন, সে কালু, মরিল জ্বর-বিকারে। পড়াশোনা ভাই দু'টি বেশি দূর করে নাই, পাটের ব্যবসা আরম্ভ করিয়াছিল। গত বছর একদিনে এক লগ্নে দু'ভাইএর বিবাহ দিয়া মন্দা আনিয়াছিল দু'টি বৌ! শ্যামার জীবনে ওদের বিশেষ কোন স্থান ছিল না, কালুর মরণ শ্যামার কাছে বিশেষ কিছু শোচনীয় ব্যাপার নয়, তবু সেও যেন গভীর শোক পাইল। মন খারাপ হইয়া যাওয়া আশ্চর্য ছিল না। মামী বলিয়া কোনদিন খাতির না করুক, আশ্রিতা বলিয়া মাঝে মাঝে অপমানজনক ব্যবহার করুক, যত্ন করিয়া ওকে তো দুবেলা সে ভাত বাড়িয়া দিয়াছে। কিন্তু এমন শোক কেন, পুত্রশোকের মত? কালকে মনে করিয়া, কচি বৌটার বিধবার বেশ দেখিয়া শ্যামার বুকের ভিতরটা পাক দিয়া যেন ভাঙিয়া যাইতে লাগিল, উন্মাদিনী মন্দাকে দুটি সবল বাহু দিয়া বুকে জড়াইয়া ধরিয়া অসহ্য বেদনায় শ্যামাও অজস্র চোখের জল ফেলিল। কেন তার এই অস্বাভাবিক ব্যথা?
পরে মন্দার শোকও যখন শান্ত হইয়া আসিয়াছে তখনও শ্যামা যেন অশান্ত হইয়া রহিল মনে মনে। রহস্যময় মনোবেদনা নয়, সাময়িক মনোবিকার নয়, একটা দিনও যে হাসিয়া কথা বলে নাই সেই কালুর জন্য স্পষ্ট দুরন্ত জ্বালা। শ্যামার মত কালুর বৌও অল্প বয়সে বাপ-মাকে হারাইয়াছিল, হঠাৎ শ্যামা যেন তার জন্য পাগল হইয়া উঠিল, নিজের মেয়েকেও সে বুঝি এত ভাল কখনো বাসে নাই। বৌএর বিধবা বেশ মন্দা দেখিতে পারে না, নিজের শোক লইয়াই সে বিব্রত, বৌ সামনে গেলে কখনো সে শাপিতে আরম্ভ করে, বৌকে বলে মানুষখেকো রাক্ষুসী, আবার কখনো বুকে জড়াইয়া হা হা করিয়া কাঁদে, তারপরেই দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দেয়, চোখের সামনে থেকে সরে যা তুই, সরে যা অলক্ষ্মী। শ্যামার মমতায় কালুর বৌ বড় একটি আশ্রয় পাইল। শ্যামার প্রশস্ত বুকে মাথা রাখিয়া সজল চোখে সে ঘুমায়, জাগিয়া ওঠে শ্যামারই বুকে, সারারাত ঠায় একভাবে কাটাইয়া শ্যামার পিঠের মাংসপেশী খিঁচিয়া ধরিয়াছে তবু সে নড়ে নাই, কর্ণ যে ভাবে বজ্রকীটের কামড় সহিয়াছিল তেমনি ভাবে দেহের যাতনা সহিয়াছে,—নড়িতে গেলে ঘুম ভাঙিয়া বৌ যদি আবার কাঁদে?
কালুর জন্য শ্যামার শোক কেন বুঝিতে না পারা যাক, কালুর বৌএর জন্য তার ভালবাসা নিশ্চয় বকুলের বিরহ? কিন্তু তা যদি হয় তবে কালুর জন্য শ্যামার এই শোক বিধানের বিরহ হইতে পারে তো!
ওসব নয়। আসলে শ্যামার মনটাই আগলা হইয়া আসিতেছে, পচিয়া যাইতেছে। গোড়াতে সাত বছর একদিকে পাগলা শীতলের সঙ্গে বাস করিতে করিতে কাঁচা বয়সের মনটা তাহার কুঁক্ড়াইয়া গিয়াছিল, অন্যদিকে ছিল মাতৃত্বলাভের প্রাণপণ প্রয়াসের ব্যর্থতা—দু'টি একটি সঙ্গী অথবা আত্মীয়স্বজন থাকিলে যাহা তাহার এতটুকু ক্ষতি করিতে পারিত না, কিন্তু একা পাইয়া সাত বছরে যাহা তাহাকে প্রায় কাবু করিয়া আনিয়াছিল,—এতকাল পরে এখন, জীবন-যুদ্ধে পরিশ্রান্ত মনটাতে যখন তাহার আর তেমন তেজ নাই, সেই অস্বাভাবিকতা, সেই বিকার আবার অধিকার বিস্তার করিতেছে।
মানুষ নয় শ্যামা? জীবনের তিনভাগ কাটিয়া গেল, এর মধ্যে একদিন সে বিশ্রাম পাইয়াছে? দেহের বিশ্রাম নয়। দেহ তার ভালই আছে, গর্ভের নবাগত সন্তানকে বহিয়া সে কাতর নয়। বিশ্রাম পায় নাই তার মন। এখন তাহার একটু সুখ শান্তি ও স্বাধীনতার প্রয়োজন আছে বৈকি। প্রসবের তিনদিন আগেও শ্যামা একা একশ' জনের ভোজ রাঁধিয়া দিবে, শুধু পরের আশ্রয় হইতে এবার তাকে লইয়া চল, ভবিষ্যতকে একটু নিরাপদ করিয়া দাও, আর ওষুধের মত পথ্যের মত একটু স্নেহ দাও শ্যামাকে। একটু নিঃস্বার্থ অকারণ মমতা।
স্বামী আর আত্মীয়স্বজন শ্যামার সেবা লইয়াছে। সন্তান লইয়াছে সেবা ও স্নেহ। প্রতিদানে সেবা শ্যামা চায় না। আজ শ্যামাকে কেহ একটু স্নেহ দাও?
বড়দিনের সময় বিধান আসিলে সুপ্রভা বলিল, বড় হয়েছো তুমি, তোমার সব বোঝা উচিত বাবা, বাপ তো তোমার সাতেও নেই পাঁচেও নেই—মার দিকে একটু তাকাও? কি রকম হয়ে যাচ্ছে দেখতে পাও না? চাউনি দেখলে বুকের মধ্যে কেমন করতে থাকে। সেদিন দেখি বিড়বিড় করে কি সব বকছে আপন মনে, আমার তো ভাল মনে হয় না।
বিধানের দু'চোখ ভরা রোষ, বলিল, তবু তো খাটিয়ে মারছেন।
সুপ্রভা আহত হইয়া বলিল আমাকে তুমি এমন কথা বললে বিধান, কত বলেছি আমি, তুমি তার কি জানবে? মাকে তোমার একদণ্ড বসিয়ে রাখার সাধ্যি আছে কারো? নইলে এতলোক বাড়িতে, তোমার মা কিছু না করলে কাজ কি এ বাড়ির আটকে থাকবে?—সুপ্রভা অভিমান করিল। বেশ আমরা না হয় পর তুমি তো এসেছ। এবার পার যদি রাখ না মাকে তোমার বসিয়ে?
বিধান কারো অভিমানকে গ্রাহ্য করে না। বলিল, না ছোট পিসি, মাকে আর এখানে আমি রাখব না, আমি নিতে এসেছি মাকে।
ওমা, কোথায়? কোথায় নিয়ে যাবে?
খবর রটিবামাত্র সুপ্রভার মুখের এই প্রশ্ন সকলের মুখে গুঞ্জরিত হইতে থাকে। বিধান শ্যামাকে লইতে আসিয়াছে? মাকে আর এখানে সে রাখিবে না? কোথায় লইবে? কার কাছে? অতটুকু ছেলে এখনো বি-এটা পর্যন্ত পাশ দেয় নাই, এসব কি মতলব সে করিয়াছে?
পড়া ছেড়ে দিয়েছিস খোকা? চাকরি নিয়েছিস? আমাকে না বলে এমন কাজ কেন করতে গেলি বাবা—বলিয়া শ্যামা কাঁদিতে আরম্ভ করে।
বিধান বলে, কাঁদছ কেন, এ্যাঁ? ভাল খবর আনলাম কোথায় আহ্লাদ করবে, তা নয় তুমি কান্না জুড়ে দিলে? পাশ তো দিতাম চাকরির জন্যে? ভাল চাকরি পেয়ে গেলাম আর পাশ দিয়ে কি করব? ব্যাঙ্কে লোক নেবার জন্যে পরীক্ষা হল। শঙ্কর আমাকে পরীক্ষা দিতে বললে। পাশ টাশ করব ভাবিনি মা, তিনশ’ ছেলের মধ্যে থার্ড হয়ে গেলাম। প্রথম সাতজনকে নিলে—নব্বই টাকায় সুরু।
নব্বই? বিশ পঁচিশ টাকার কেরাণী বিধান তবে হয় নাই? শ্যামা একটু শান্ত হয়, বলে, আমায় কিছু লিখিসনি যে?
এটা বোঝানো একটু কঠিন শ্যামাকে। পড়াশোনা করিয়া বিধান এক দিন বড় হইবে, এত বড় হইবে যে চারিদিকে রব উঠিবে ধন্য ধন্য—শ্যামার এ স্বপ্নের খবর বিধানের চেয়ে কে ভাল করিয়া রাখে? তাই পড়া ছাড়িয়া চাকরি লইয়াছে, চিঠিতে শ্যামাকে একথা লিখিতে বিধানের ভয় হইয়াছিল। শুধু তাই নয়। বিধান ভাবিয়াছিল সে দু'শ চারশ' টাকার চাকরি করিবে এই প্রত্যাশায় শ্যামা দিন গুনিতেছে, নব্বই টাকার চাকরি শুনিয়া সে যদি ক্ষেপিয়া যায়?
পরীক্ষা পর্যন্ত আরও একটা বছর ছেলের পড়ার খরচ দিতে পারিবে না ভাবিয়াই শ্যামা যে ক্ষেপিয়া যাইতে বসিয়াছিল, বিধান তো তাহা জানিত না। চাকরিটা তাহার নব্বই টাকার শুনিয়াই শ্যামা এমনভাবে কৃতার্থ হইয়া গেল যে বিধান অবাক হইয়া রহিল। সন্দিগ্ধভাবে সে জিজ্ঞাসা করিল, খুসি হওনি মা তুমি?
খুসি হয় নাই।—খুসিতে শ্যামা আবোল তাবোল বকিতে আরম্ভ করে। এতকাল শ্যামাকে যারা অবহেলা অপমান করিয়াছে তাদের টিটকারি দেয়। কলিকাতায় মস্ত বাড়ি ভাড়া নেয়, বকুলকে আনে, বিধানের বিবাহ দেয়, দাস দাসীতে ঘরবাড়ি ভরিয়া ফেলে। তারপর হাসিমুখে সকলকে ডাকিয়া বিধানের চাকরির কথা শোনায়। তার দুধের ছেলে নব্বই টাকার চাকরি যোগাড় করিয়াছে, কারো সাহায্য চায় নাই, কারো তোষামোদ করে নাই—বল তো বাছা এবার তাদের মুখ রইল কোথায় ছেলেকে আমার পড়ার খরচটুকু পর্যন্ত যারা দিতে চায় নি? কথাবার্তা শুনিয়া মনে হয় শ্যামা সত্যই বড় অকৃতজ্ঞ। এতগুলি বছর যার আশ্রয়ে সে থাকিয়াছে, এখন ছেলের চাকরি হওয়ামাত্র নিন্দা আরম্ভ করিয়াছে তার। এরা যে কত করিয়াছে তার জন্য সব সে ভুলিয়া গিয়াছে, মনে রাখিয়াছে শুধু ত্রুটি বিচ্যুতি, অপমান অবহেলা। মন্দা রাগিয়া বলে, ধন্যি তুমি বৌ, এতও ছিল তোমার পেটে পেটে। এত যদি কষ্ট পেয়েছ তুমি এখেনে থেকে থাকলে কেন? নিজের রাজ্যপাটে গিয়ে বসলে না কেন রাজরাণী হয়ে? আজ পাঁচ বছর তোমাদের পাঁচটি প্রাণীকে আমি পুষলাম, ছেলে পড়ালাম, মেয়ে বিয়ে দিলাম তোমার, আজ দিন পেয়ে আমাদের তুমি শাপছ!
অবাক হইয়া শুনিয়া শ্যামা কাঁদিতে কাঁদিতে বলে, না ঠাকুরঝি, তোমাদের কিছু বলিনি তো আমি, কেন বলব তোমাদের? কম করেছ আমার তোমরা! আমাকে কিনে রেখেছ ঠাকুরঝি, তোমাদের ঋণ আমি সাত জন্মে শোধ দিতে পারব না। তোমাদের নিন্দে করে একটি কথা কইলে মুখ আমার খসে যাবে না, কুষ্ঠ হবে না আমার জিভে!—বলে আর হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া শ্যামা ভাসাইয়া দেয়।
শ্যামা কি পাগল হইয়া গিয়াছে? এতদিনে তার আবার সুখের দিন সুরু হইল, এমন সময় মাথাটা গেল তার খারাপ হইয়া? অনেক বলিয়া বিধান তাহাকে শোয়াইয়া রাখিল, বারবার জিজ্ঞাসা করিল, তোমার কি হয়েছে মা?—তারপর শ্যামা অসময়ে আজ ঘুমাইয়া পড়িল। অনেকক্ষণ ঘুমাইয়া সে যখন জাগিল আর তাকে অশান্ত মনে হইল না। সে শান্ত নীরব হইয়া রহিল।
কত কথা শ্যামার বলিবার ছিল, কত হিসাব কত পরামর্শ, কিন্তু এক অসাধারণ নীরবতায় সব চাপা পড়িয়া রহিল। বিধান বলিল, কলিকাতায় সে বাড়ি ভাড়া করিয়া আসিয়াছে, শ্যামা জিজ্ঞাসাও করিল না কেমন বাড়ি, ক'খানা ঘর, কত ভাড়া। এতকাল এখানে থাকিয়া তার চাকরি হওয়ামাত্র একটা মাসও অপেক্ষা না করিয়া সকলের চলিয়া যাওয়াটা বোধ হয় ভাল দেখাইবে না, বিধান এই কথা বলিলে শ্যামা সায় দিয়া গেল। কিন্তু ঝোঁকের মাথায় বাড়িটাড়ি যখন সে ঠিক করিয়াই আসিয়াছে, দু চার দিন পরে চলিয়া তাদের যাইতে হইবে, বিধান এই কথা বলিলে শ্যামা তাতেও সায় দিল। ছেলের সব কথাতেই সে সায় দিয়া গেল।
শেষে বিধান বলিল, পড়া ছেড়েছি বলে তুমি নিশ্চয় রাগ করেছ মা!
শ্যামা একটু হাসিল, না খোকা রাগ করিনি, বড় হয়েছ এখন তুমি বুঝে শুনে যা করবে তাই হবে বাবা, তোমার চেয়ে আমি তো ভাল বুঝিনে, আমার বুদ্ধি কতটুকু?
কাজে যোগ দিতে বিধানের দিন দশেক দেরি ছিল, যাই যাই করিয়াও দিন সাতেক এখানে তাহারা রহিয়া গেল। শীতল চাকরি ছাড়িয়া দিয়া নিশ্চিন্ত মনে জামগাছের তলে বসিয়া তামাক টানিতে লাগিল, পোষা কুকুরটি শুইয়া রহিল তাহার পায়ের মধ্যে মুখ গুঁজিয়া। শীতলের ইচ্ছা আছে কুকুরটিকেও সঙ্গে লইয়া যাইবে কলিকাতায়, কিন্তু মনের ইচ্ছা প্রকাশ করিতে তার সাহস হইল না।
পাগল হওয়ার আর কোন লক্ষণ শ্যামার দেখা গেল না, সেদিন ঘুমাইলা উঠিয়া তার যে অসাধারণ নীরবতা আসিয়াছিল তাই শুধু কায়েমি হইয়া রহিল। আর যেন তাহার কোন বিষয়ে দায়িত্ব নাই, মতামত নাই, সে মুক্তি পাইয়াছে। জীবন যুদ্ধ তাহার শেষ হইয়া গিয়াছে। এবার বিধান লড়াই চালাক, বিধান সব ব্যবস্থা করুক, সংসারের ভাল মন্দের দায়িত্ব থাক বিধানের। শ্যামা কিছু জানে না, জানিতে চাহে না,—ঘরের মধ্যে অন্তঃপুরের গোপনতায় তার যা কাজ এবার তাই শুধু সে করিবে: উপকরণ থাকিলে রাঁধিয়া দিবে পোলাউ, না থাকিলে দিবে শাক ভাত। বিধান তাহাকে এখানে রাখিলে এখানেই সে থাকিবে, কলিকাতা লইয়া গেলে কলিকাতা যাইবে। সব সমান শ্যামার কাছে। বিধানের চাকুরি-লাভও শ্যামার কাছে যেন আর উল্লাসের ব্যাপার নয়, খুবই সাধারণ ঘটনা। এই তো নিয়ম সংসারের? স্বামী পুত্র উপার্জন করে, স্ত্রী ও জননী ভাত রাঁধে। আর ভালবাসে। আর সেবা-যত্ন করে। আর নির্ভয় নিশ্চিন্ত হইয়া থাকে অক্ষয় অমর একটি নির্ভরে।
শহরতলীতে নয় এবার খাস কলিকাতায় নূতন বাড়িতে শ্যামা নূতন সংসার পাতিল। বাড়িটা নূতন সন্দেহ নাই, এখনো রঙের গন্ধ মেলে। দোতালা বাড়ি, একতলাতে বাড়িওলা থাকে। দোতালার মাঝামাঝি কাঠের ব্যবধান, প্রত্যেক ভাগে দু'খানা ঘর। রান্নার জন্য ছাদে দুটি ছোট ছোট টিনের চালা। শ্যামারা থাকে দোতালার সামনের অংশটিতে, রাস্তার উপরে ছোট একটু বারান্দা আছে। একটি স্বামী ও দু'টি কন্যা সহ অপর অংশে বাস করে শ্রীমতী সরযূবালা দে, পাশকরা ধাত্রী।
সরযূ যেমন বেঁটে তেমনি মোটা, ফুটবলের মত দেখিতে। দেহের ভারেই সে যেন সব সময় হাঁপায়। কাজে যাওয়ার সময় সে যখন সাদা কাপড় ঢাকা রিক্সয় চাপে আর শীর্ণকায় কুলিটি রিক্স টানিয়া লইয়া যায় উপর হইতে দেখিয়া শ্যামা হাসি চাপিতে পারে না।
সরযূর মেয়ে দুটি সুন্দরী। বড় মেয়েটির নাম বিভা। বিধানের সে সমবয়সীই হইবে—মেয়ে স্কুলে গান শেখায়। ছোট মেয়েটির নাম শামু, বিধানের বৌ হইলে মানায় এমনি বয়স, পড়ে স্কুলে। সরযূর সাধ শামুকে মেডিকেল কলেজ হইতে পাশ করাইয়া একেবারে ডাক্তার করিয়া ছাড়িবে—পাশ করা ধাত্রী নয়, লেডি ডাক্তার। লেডি ডাক্তাররা বড় অবজ্ঞার চোখে দেখে সরযূকে, এতটুকু নিজের বুদ্ধি খাটাইতে গেলেই বকে। মেয়েকে এম. বি করিতে পারিলে গায়ের জ্বালা সরযূর হয়ত একটু কমিবে—অন্তত তাই আশা।
ওমা, সে কি, মেয়েদের বিয়ে দেবেন না দিদি? শ্যামা বলে।
করুক না বিয়ে? আমি কি ধরে রেখেছি?—বলিয়া সরযূ হাসে।
ওদের ব্যাপারটা শ্যামা ভাল বুঝিতে পারে না। সরযূর স্বামী নৃত্যলাল কিছু করে না, বসিয়া বসিয়া খায় শীতলের মত, তবু গরীব ওরা নয়। সরযূ নিজে মন্দ রোজগার করে না, বিভাও পঞ্চাশ টাকা করিয়া পায়। কানা খোঁড়া কুৎসিতও নয় মেয়ে দুটি সরযূর। বিবাহ দেয় না কেন ওদের? বাধা কিসের? বিভার মত বয়স পর্যন্ত বকুলকে অবিবাহিতা রাখিলে শ্যামা তো ক্ষেপিয়াই যাইত। ভাবনা হয় না সরযূর?
কি আনন্দেই ওরা দিন কাটায়। সাজিয়া গুজিয়া ফিটফাট হইয়া থাকে, গান করে, গ্রামোফোন বাজায়, দিবারাত্রি শ্যামার কানে ভাসিয়া আসে ওদের হাসির শব্দ। মেয়ে দুটি শুধু নয়, মোটা সরযূ পর্যন্ত যেন উল্লাসের একটা হাল্কা হিল্লোলে ভাসিয়া বেড়ায়। বাপ মা আর মেয়েরা যেন বন্ধু, সমানভাবে তাহারা হাসি-তামাসা করে, তাস খেলে চারজনে মিলিয়া, একসঙ্গে সিনেমা দেখিতে যায়। বাড়িতে লোকজনও কি আসে কম। সকলে তাহারা ধাত্রী ডাকিতে আসে না। অনেক বন্ধুবান্ধব আছে ওদের,—স্ত্রী ও পুরুষ। তাদের মধ্যে কয়েকটি যুবক যে প্রায়ই কেন আসে শ্যামা তাহা বেশ বুঝিতে পারে। কাঠের বেড়ার একটি ফোকরে চোখ রাখিয়া ও-বাড়িতে পুরুষ ও নারীর নিঃসঙ্কোচ মেলামেশা দেখিয়া শ্যামা থ বনিয়া যায়, গান শুনিতে শুনিতে তাহার ভাত পোড়া লাগে।
বিভা এ-বাড়িতে বেশি আসে না, সে একটু অহঙ্কারী। শামু হরদম আসা-যাওয়া করে। শামুর প্রকৃতিটা শ্যামার একটু অদ্ভুত মনে হয়, একদিকে যেমন সে সরল অন্যদিকে আবার তেমনি পাকা। পোকায় কাটা ফুলের মত সে, খানিক অসাধারণ ভাল, খানিক অসাধারণ মন্দ। এমনি বয়সে বিবাহ হইয়া বকুল শ্বশুরবাড়ি গিয়াছে, মেয়েটাকে শ্যামার একটু ভালবাসিতে ইচ্ছা হয়, শিশুর মত সরল আগ্রহের সঙ্গে শামু তাহার ভালবাসাকে গ্রহণ করে, শ্যামা হয় খুসি। কিন্তু বিধানের সঙ্গে শামুর আলাপ করিবার ভঙ্গিটা শ্যামার ভাল লাগে না। কেমন সব হেঁয়ালিভরা ঠাট্টা শামু করে, কেমন দুষ্টু দুষ্টু মুচকি হাসি হাসে, আড়চোখে কেমন করিয়া সে যেন বিধানের দিকে তাকায়,—সকলের সামনে কি একটা অদ্ভুত কৌশলে সে যেন গোপন একটা ভাবতরঙ্গ তার আর বিধানের মধ্যে প্রবাহিত করিয়া রাখে। অতিশয় দুর্বোধ্য, সূক্ষ্ম ও গভীর একটা লুকোচুরি খেলা। শ্যামা কিছু বুঝিতে পারে না, তবু ভালও তাহার লাগে না। একটু সে সতর্ক হইয়া থাকে। শামু বিধানের ঘরে গেলে মাঝে মাঝে নানা ছলে দেখিয়া আসে ওরা কি করিতেছে। কোনদিন শামুকে বিধান পড়া বলিয়া দেয়, সেদিন শামুর শ্রদ্ধাপূর্ণ নিরীহ ভাবটি শ্যামার ভাল লাগে। কোনদিন বিধান জ্ঞানবিজ্ঞানের কথা বলে, বুঝিতে না পারিয়া শামু ফ্যাল ফ্যাল করিয়া তাকায়, আর থাকিয়া থাকিয়া ঢোক গেলে, সেদিনও শ্যামার মন্দ লাগে না। সে অসন্তুষ্ট হয় সেদিন, যেদিন শামু করে দুষ্টামি। দরজার বাহিরে শ্যামা থমকিয়া দাঁড়ায়। চোখ ঘুরাইয়া মুখভঙ্গি করিয়া শামু কথা বলে, বিধানের মুখের কাছে তর্জনী তুলিয়া শাসায়, তারপর হাসিয়া যেন গলিয়া পড়ে—দেখিয়া রাগে শ্যামার গা রি রি করিতে থাকে। একি নির্লজ্জ ব্যবহার অতবড় আইবুড়ো মেয়ের! এত কিসের অন্তরঙ্গতা? বিধান ওকে এত প্রশ্রয় দেয় কেন?
ঘরে ঢুকিয়া শ্যামা বলে, কি হচ্ছে তোদের!—খুব সাবধানে বলে। বিধান না টের পায় সে অসন্তুষ্ট হইয়াছে।
শামু বলে, মাসিমা, আপনার ছেলে বাজি হেরে দিচ্ছে না—দিন তো শাসন করে?
কিসের বাজি বাছা?—শ্যামা বলে।
বললে জিভ দিয়ে আমি যদি নাক ছুঁতে পারি দু'টাকার সন্দেশ খাওয়াবে। নাক ছুঁলাম, এখন দিচ্ছে না টাকা।
জিভ দিয়া নাক ছোঁয়া? এই ছেলেমানুষী ব্যাপার লইয়া ওদের হাসাহাসি? ছি, কি সব ভাবিতেছিল সে! তার সোনার টুক্রো ছেলে, তার সম্বন্ধে ওকথা মনে আনাও উচিত হয় নাই। শ্যামা অপ্রতিভ হইয়া যায়।
বিভা আসিলে বসে না, দাঁড়াইয়া দু'চারটি কথা বলিয়া চলিয়া যায়। আঁচল লুটানো শিথিল-কবরী বিলাসী বাবু মেয়ে সে, উদাসী আনমনা তার ভাব, এ বাড়ির সকলের কত গভীর অপরাধ সে যেন ক্ষমা করিয়াছে এমনি উদার ও নম্র তাহার গর্ব। রাজরাণী যেন সখ করিয়া দরিদ্র প্রজার গৃহে আসিয়াছে, স্মিত একটু হাসি, ছেঁড়া লেপ তোষক ভাঙ্গা বাক্স প্যাঁটরা ময়লা জামা কাপড় দেখিয়াও নাক-না-সিঁটকানোর মহৎ উদারতা, এই সব উপহার দিয়া সে চলিয়া যায়। বসিতে বলিলে বলে, এই যে বসি, বসার জন্য কি, বসেই তো আছি সারাদিন। এদিক ওদিক তাকায় বিভা, শ্যামার হাঁড়ি কলসী, লোহার চায়ের কাপ, ছেঁড়া চটের আসন, গোবর লেপা ন্যাতা সব লক্ষ্য করে—কিন্তু না, বিভার স্বপন-লাগা চোখে সমালোচনা নাই। কৃত্রিম না-থাকা নয়, সত্যই নাই। শ্যামা গামছা পরিয়া গা ধোয় বলিয়া বিভা তাকে অসভ্য মনে করে না, হাসে না মনে মনে। সে শুধু দুঃখ পায়। তার দয়া হয়। খাঁটি সমবেদনার সঙ্গেই সে মনে করে যে আহা, একটু শিক্ষা দীক্ষা পাইলে এমনটা হইত না, সকলের সামনে গামছা পরিতে শ্যামা লজ্জা পাইত।
হাসি যদি কখনো পায় বিভার, সে বিধানের জন্য। হঠাৎ ঘর হইতে বাহির হইয়া বিভাকে দেখিলে আবার সে ঘরে ঢুকিয়া যায়, বিভা যেন অসূর্যম্পশ্যা অন্তঃপুরচারিণী, নিচের বাড়িওয়ালার মেয়ে-বৌএর মত লজ্জাশীলা। বিধান নিজে লজ্জা পাইয়া সরিয়া গেলে কথা ছিল না, বিভার লজ্জা বাঁচানোর জন্য ভদ্রতা করিয়া সে সরিয়া যায় বলিয়াই বিভার হাসি পায়।
আপনার বড় ছেলে বুঝি?—সে জিজ্ঞাসা করে।
শ্যামা বলে, হ্যাঁ।
এত অল্প বয়সে পড়া ছেড়ে চাকরিতে ঢুকেছেন?
দুঃখের সংসার মা, উপায় কি! নইলে ছেলে আমার বড় ভাল ছিল পড়াশোনায়, ওর কি এ সামান্য চাকরি করার কথা? বলিয়া শ্যামা নিশ্বাস ফেলে, কি পরীক্ষা দিয়ে ডেপুটি হয় না, তাই দেবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল, ভগবান বিরূপ হলেন।
বিভা বলে, ও।
শ্যামার একদিকের প্রতিবেশিরা এমনি। নিচের তলার বাড়িওলা তাদের মতই ঘরোয়া গৃহস্থ মানুষ, সরযূদের মত উড়ু উড়ু পাখী নয়। শ্যামার মত তাদেরও ছোট-ছেলের-গন্ধভরা ছেঁড়া লেপতোষক! কর্তা ছিলেন আদালতের পেস্কার, পেনসন লইয়া এখন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেন। প্রতি মাসের দুই তারিখে সকালবেলা ভাড়ার রসিদ হাতে সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠিয়া ডাকেন, বিধানবাবু! নেত্যবাবু! আছেন না কি?
বাড়িওলার ছেলেমেয়ে বৌ নাতিনাতনিতে একতলাটা বোঝাই হইয়া থাকে,—ক'খানা মাত্র ঘর, কি করিয়া ওদের কুলায় কে জানে। তিনটি বিবাহিত পুত্রকে তিনখানা ঘর ছাড়িয়া দিলে বাকি সকলে থাকে কোথায়? বাকি ঘর তো থাকে মোটে একখানি। কর্তা গিন্নি, একটি বিধবা মেয়ে, ছোট মেয়ে আর মেয়ের জামাইও এখানে থাকে তারা, পেটেণ্ট ওষুদের ক্যানভাসার ভাইপোটি, সকলে ওই একখানা ঘরে থাকে নাকি? প্রথমটা শ্যামার বড় দুর্ভাবনা হইত। তারপর একদিন রাত্রে রাঁধিয়া বাড়িয়া বাড়িওলা গিন্নির সঙ্গে খানিক আলাপ করিতে গিয়া সে ব্যাপার বুঝিয়া আসিয়াছে। বড় দু'খানা ঘরের প্রত্যেকটির মাঝামাঝি এ দেয়াল হইতে ও দেয়াল পর্যন্ত তার টাঙ্গানো আছে, তাতে ঝুলানো আছে ছিটের পর্দা। দিনের বেলা পর্দা গুটানো থাকে, রাত্রে পর্দা টানিয়া দু'খানা ঘরকে চারখানা করিয়া তিন ছেলে আর মেয়ে-জামাই শয়ন করে। পর্দার উপরে একটি বিদ্যুতের বাতি জ্বালিয়া দু'দিকের দম্পতিকে আলো দেয়।
সিঁড়ির নিচে যে স্থানটুকু আছে ক্যানভাসার ভাইপোটি সেখানে থাকে। নাম তাহার বনবিহারী। সিঁড়ির উপরে রেলিং ঘেঁষিয়া দাঁড়াইলে নিচে বনবিহারীকে দেখিতে পাওয়া যায়। সারাদিন বাহিরে বাহিরে ঘুরিয়া রাত্রি আটটা ন'টার সময় সে ফিরিয়া আসে। ওষুধের সুটকেশটি চৌকির নিচে ঢুকাইয়া জামাটি খুলিয়া সে পেরেকে টাঙ্গাইয়া দেয়, কাপড় গায়ে দিয়া চৌকিতে বসিয়া জুতার ফিতা খোলে। তারপর চৌকিতে পা তুলিয়া নিজের পা টিপিতে আরম্ভ করে নিজেই। হঠাৎ বাড়িওলা গিন্নি ডাক দেয়, বনু এলি, বনু? পাঁউরুটি আনা হয় নি, ভোলা তুলে এসেছে, যা তো বাবা মোড়ের দোকান থেকে চট করে একটা রুটি নিয়ে আয়,—সকালে উঠে খাই খাই করে সবাই তো খাবে আমায়। কোনদিন বড়বৌ কোলের ছেলেটিকে দিয়া যায়, বলে, দেখো তো ভাই পার নাকি ঘুম পাড়াতে হেঁটে হেঁটে? ডানা আমার ছিঁড়ে গেল। কোনদিন বাড়িওলা স্বয়ং আসেন। দাবার ছক লইয়া বলেন, আয় বনু বসি একদান।—বনুর ভাত ঢাকা দিয়ে রাখো বৌমা, দুধ থাকে তো দিও দিকি বনুকে একটু, দু' হাতাই দিও,—ক্ষীর করে রাখ বাকিটা। কালের মত ঘন কোরো না বাছা ক্ষীর, ঘন ক্ষীর খেয়ে আজ পেট কামড়েছে, পাতলাই রেখো আর চিনি দিও একটু। ভানু, ও ভানু, তামাক দে দিকি মা—বড় কলকেতে দিস বেশি তামাক দিয়ে।
এসব দেখিয়া শুনিয়া শ্যামার চোখে যদি জল আসিত, সে জল সোজা গিয়া পড়িত বনবিহারীর মাথায় পথের ধূলায় ধূসর রুক্ষ চুলে। এক একদিন বিভা আসিয়া দাঁড়ায়। ঝুঁকিয়া দেখিয়া ফিস ফিস করিয়া বলে, অনেক মানুষ দেখেছি, এমন বোকা কখনো দেখিনি মাসিমা। এমন করে এখানে তোর পড়ে থাকা কেন? মেসে গিয়ে থাকলেই হয়।
রোজগারপাতি বুঝি নেই।—শ্যামা বলে।
কুড়ি পঁচিশ ও যা পায় মাসিমা, একজনের পক্ষে তাই ঢের। তা'ছাড়া এমন করে থাকার চেয়ে না খেয়ে মরাও ভাল।—পুরুষমানুষ নয় ও।
রাগে বিভা গরগর করে। শ্যামা একটু অবাক হয়, এত রাগ কেন বিভার? কোথায় কোন কাপুরুষ যুবক ক্রীতদাসের জীবন যাপন করে খেয়াল করিয়া বিচলিত হওয়ার স্বভাব তো বিভার নয়। হঠাৎ বিভা করে কি, ঝুঁকিয়া ডাক দেয়, বনবাবু, মা আপনাকে ডাকছেন, উপরে আসবেন একবার?
বনবিহারী মুখ তুলিয়া তাকায়, বলে, যাই।
সে উঠিয়া আসিলে শ্যামাকে অবাক করিয়া দিয়া বিভা তাহাকে বকে। রীতিমত ধমকায়। বলে, কি যে প্রবৃত্তি আপনার বুঝিনে কিছু, একেবারে আপনার ব্যাক্বোন নেই, সারাদিন ঘুরে এত রাত্রে ফিরে এলেন। এখনও আপনাকে সংসারের কাজ করতে হবে? কেন করেন আপনি? আমি হলে তো সবাইকে চুলোয় যেতে বলে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তাম, এত কি আহ্লাদ সকলের! বিনে মাইনের চাকর নাকি আপনি!—এমনি ভাবে কত কথাই যে বিভা তাহাকে বলে। বলে সংসারে এমন নিরীহ হইয়া থাকিলে চলে না। একটু শক্ত হইতে হয়। অপদার্থ জেলিফিশ তো নয় বনবিহারী।
বলিতে বলিতে এত রাগিয়া ওঠে বিভা যে হঠাৎ মুখ ঘুরাইয়া গটগট করিয়া সে ভিতরে চলিয়া যায়। মুখ নিচু করিয়া বনবিহারী নামে নিচে। শ্যামা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ভাবিতে থাকে যে বিভা অনেকদিন এখানে আছে, বনবিহারীর সঙ্গে পরিচয় তাহার অনেক দিনের। বিভার গায়ে পড়িয়া বকাবকি করাটা যেমন বিসদৃশ শোনাইল আসলে হয়ত তা তেমন খাপছাড়া নয়।
এখানে আসিয়া অল্পে অল্পে শ্যামার মন কিছু সুস্থ হইয়াছে।
তবে শ্যামা আর সে শ্যামা নাই। বনগাঁয়ে হঠাৎ সে যেরকম শান্ত ও নির্বাক হইয়া গিয়াছিল এখানেও সে প্রায় তেমনি হইয়া আছে, শুধু তার এই পরিবর্তন এখন আর অস্বাভাবিক মনে হয় না। আসন্ন সন্তান সম্ভাবনার সঙ্গে পরিবর্তনটুকু খাপ খাইয়া গিয়াছে। চলাফেরা কাজকর্ম সমস্তই তার ধীর মন্থর, সংসারটাকে ঠেলিয়া তুলিবার জন্য তার ধৈর্যহীন উৎসাহ আর নাই। নিজের সংসারে থাকিবার সময় সে একদিন ছেলেমেয়ের জামার ছাঁটটি পর্যন্ত ক্রমাগত উন্নততর করিতে না পারিলে স্বস্তি পাইত না। সংসারে তুচ্ছতম খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলি পর্যন্ত তার কাছে ছিল গুরুতর। এখন সে শুধু মোটামুটি সংসারটা চালাইয়া যায়, ছোটখাট ত্রুটি ও ফাঁকি সে অবহেলা করে। সংসারের যেখানে বোতাম ছিঁড়িয়া ফাঁক বাহির হয় সেখানে সেফটিপিন গুঁজিয়া কাজ চালাইতে তাহার বাধে না। ছেলেদের জীবনের প্রত্যেকটি মিনিটের হিসাব রাখা আর হইয়া ওঠে না। বিধান দেরি করিয়া বাড়ি ফিরিলে কারণ জিজ্ঞাসা করিতে সে ভুলিয়া যায়, শীতের সন্ধ্যায় ফণীর পায়ে মোজা না উঠিলেও তার চলে। ঘরের আনাচে কানাচে ধূলাবালি জামাকাপড়ে ময়লা চৌবাচ্চায় শ্যাওলা জমিতে পায়।
নূতন যারা শ্যামাকে দেখিল, তারা কিছু বুঝিতে পারে না। আগে যারা তাহাকে দেখিয়াছে তারাই শুধু টের পায় বনগাঁ তাহাকে কি ভাবে বদলাইয়া দিয়াছে।
আবার শীত শেষ হইয়া আসিল। ফাল্গুন মাসে একটি কন্যা জন্মিল শ্যামার। বকুল বুঝি আবার সুরু হইল গোড়া হইতে। কিন্তু বকুলের কি দু'টি ডাগর চোখ ছিল। এ মেয়ের চোখ কোথায়? হায়, শ্যামার মেয়ে জন্মিয়াছে অন্ধ হইয়া। গর্ভের অনাদিকালের অন্ধকার তাকে ঘিরিয়া রহিল, এ জগতের আলো সে চিনিবে না কোনদিন।
জন্মান্ধ? কার পাপের ফল ভোগ করিতে তুই পৃথিবীতে আসিলি খুকি! দৃষ্টি তোর হরণ করিল কে? ভাবিতে ভাবিতে শ্যামা স্মরণ করে, বনগাঁয় একদিন সন্ধ্যার সময় কলাবাগানে ছায়ার মত কি যেন দেখিয়া তার গা ছম্ছম্ করিয়াছিল, স্নানের আগে এলোচুলে তেল মাখিবার সময় আর একদিন পাগলা হাবুর বুড়ি দিদিমা তাহাকে দেখিয়া ফেলিয়াছিল, অজ্ঞাতসারে আরও কবে কি ঘটিয়াছিল কে জানে!
কি আর করা যায়, অন্ধ মেয়েকে শ্যামা সমান আদরেই মানুষ করে, যেমন সে করিয়াছিল বকুলকে, যার ডাগর দু'টি চোখ শ্যামাকে অবিরত অবাক করিয়া রাখিত। দু'মাস বয়স হইতে না হইতে শীতল মেয়েকে বড় ভালবাসিল। বিধান একটা ঠাকুর আনিয়াছিল, তাহাকে ছাড়াইয়া দিয়া শ্যামা আবার রান্না আরম্ভ করিলে মেয়ে কোলে করিয়া বসিয়া থাকার কাজটা পাইয়া শীতল ভারি খুসি। এখানে আসিয়া বনগাঁর পোষা কুকুরটির জন্য শীতলের মন কেমন করিত, খুকিকে কোলে পাইয়া কুকুরের শোক সে ভুলিয়া গেল। শীতলের বাঁ পায়ের বেদনাটা আবার চাড়া দিয়া উঠিয়াছে। এ জন্য দোষী করে সে শ্যামাকে। শ্যামার জন্যই তো চাকরি করিতে দুর্বল পা লইয়া দু'বেলা তাহাকে হাঁটাহাঁটি করিতে হইত বনগাঁয়।
অবসর সময়টা শ্যামা তার পায়ে তার্পিন তেল মালিশ করিয়া দেয়। অসুস্থ স্বামীকে চাকরি করিতে পাঠাইয়া অপরাধ যদি তার হইয়া থাকে, এ তার অযোগ্য প্রায়শ্চিত্ত নয়।
মোহিনী কলিকাতায় চাকরি করে কিন্তু শ্বশুরবাড়ি বেশি সে আসে না, বোধ হয় পিসির বারণ আছে। শ্যামা তাকে দু'দিন নিমন্ত্রণ করিয়াছিল, দুদিন আসিয়া সে খাইয়া গিয়াছে, নিজে হইতে একদিনও খোঁজখবর নেয় নাই। বিধান প্রথম প্রথম কাকার বাড়ি গিয়া মোহিনীর সঙ্গে সর্বদা দেখাসাক্ষাৎ করিত, এখন সেও আর যায় না। রাগ করিয়া শ্যামাকে সে বলে, এমনি লাজুক হলে কি হবে, মোহিনী বড় অহঙ্কারী মা,—কতবার গিয়েছি আমি, কত বলেছি আসতে, এল একবার? নেমন্তন্ন না করলে বাবুর আসা হয় না, ভারি জামাই আমার। এদিকে তো মাছিমারা কেরানী পোস্টাপিসের।
কিন্তু মোহিনী একদিন বিনা আহ্বানেই আসিল। লজ্জায় মুখ রাঙা করিয়া বিধানের কাছে সে স্বীকার করিল যে বকুলের চিঠি পাইয়া সে আসিয়াছে। বকুলকে এখন একবার আনা দরকার। পনের দিনের ছুটি লইয়া সে বাড়ি যাইতেছে। ইতিমধ্যে শ্যামা যদি তাহার পিসিকে একখানা চিঠি লিখিয়া দেয় আর চিঠির জবাব আসার আগেই বিধান যদি সেখানে গিয়া পড়ে, বকুলকে পাঠানোর একটা ব্যবস্থা মোহিনী তবে করিতে পারে।
মোহিনীর কথাবার্তা বিধানের কাছে হেঁয়ালির মত লাগে। সে বলে, বোসো তুমি মাকে বলি।
মোহিনী বলে, না না আমি গেলে বলবেন।
কিন্তু তা হয় না। শ্যামাকে না বলিলে এসব সাংসারিক ঘোরপ্যাঁচ কে বুঝিতে পারিবে।
বিধান শ্যামাকে সব শোনায়। শুনিবামাত্র ব্যাপার আঁচ করিয়া শান্ত নির্বাক শ্যামার সহসা আজ দেখা দেয় অসাধারণ ব্যস্ততা।
কই মোহিনী? ডাক খোকা মোহিনীকে ডাক।
শ্যামার চোখ ছল ছল করে। আসিবার জন্য তাই বকুল ইদানিং এত করিয়া লিখিতেছিল। তারা আনিবার ব্যবস্থা করিতে পারে নাই বলিয়া মেয়ে তার জামাইকে এমন চিঠি লিখিয়াছে যে বিনা নিমন্ত্রণে যে কখনো আসে না সে যাচিয়া আসিয়াছে বকুলকে আনানোর ষড়যন্ত্র করিতে, ছুটি লইয়া যাইতেছে বাড়ি। মোহিনীকে কত জেরাই যে শ্যামা করে! সজল চোখে কতবার যে সে মোহিনীকে মনে করাইয়া দেয় তার হাতে যেদিন মেয়েকে সঁপিয়া দিয়াছিল সেইদিন হইতে শ্যামার ছেলের সঙ্গে তার কোন পার্থক্য নাই, বিধান যেমন মোহিনীও তেমনি শ্যামার কাছে। অনুযোগ দিয়া বলে তোমার বাড়ির কারুর কি উচিত ছিল না বাবা একথাটা আমায় লিখে জানায়। আমি তার মা, আমি জানতেও পেলাম না ক'মাস কি বৃত্তান্ত? পিসি না বুঝুক, তুমি তো বোঝ বাবা মার দুঃখু?
মোহিনীকে সে-বেলা এখানেই খাইয়া যাইতে হয়। জামাই কোনদিন পর নয় তবু আজ মোহিনী যেন বিশেষ করিয়া আপন হইয়া যায়। মনটা ভাল মোহিনীর, বকুলের জন্য টান আছে মোহিনীর, না আসুক সে নিমন্ত্রণ না করিলে, অবুঝ গোঁয়ার সে নয়। মধুর স্বভাব তার।
চার পাঁচদিন পরে বিধান গিয়া বকুলকে লইয়া আসিল। বলিল, উঃ মাগো কি গালটা পিসি আমাকে দিলে। বাড়িতে পা দেয়া থেকে সেই যে বুড়ি মুখ ছুটাল মা, থামল গিয়ে একেবারে বিদায় দেবার সময়। অমঙ্গল হবে ভেবে তখন বোধ হয় কিছু বলতে সাহস হ'ল না। মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি আর যাচ্ছিনে বাবু খুকির শ্বশুরবাড়ি এ জন্মে।
বকুল তো আসিল, এ কোন বকুল? একি রোগা শরীর বকুলের! নিষ্প্রভ কপোল, ভীরু চোখ, কান্তিবিহীন মুখ, লাবণ্যহীন বর্ণ—মেয়েকে তার এমন করিয়া দিয়াছে ওরা।—পেট ভরে খেতেও ওরা তোকে দিত না বুঝি খুকি? খাটিয়ে মারত বুঝি তোকে দিনরাত? আমি কি জানতাম মা এত তোকে কষ্ট দিচ্ছে। আনবার জন্যে লিখতিস, ভাবতাম আসবার জন্যে মন কেমন করছে তাই ব্যাকুল হয়েছিস,—পোড়া কপাল আমার।
শ্যামার মুখে হঠাৎ যে খিল পড়িয়াছিল বকুল আসিয়া যেন তা খুলিয়া দিয়াছে। সেটা আশ্চর্য নয়। মনের অবস্থা অস্বাভাবিক হইয়া আসিলে এই তো তার সবার বড় চিকিৎসা, এমনি ভাবে মশগুল হইতে পারা জীবনের স্বাভাবিক বিপদে সম্পদে যার মহা সমন্বয় সংসারধর্ম। বহু দিনের দুর্ভাবনায়, বনগাঁর পরাশ্রিত জীবনযাপনে, শ্যামার মনে যদি বৈকল্য আসিয়া থাকে, ছেলেব চাকরি, অন্ধ মেয়ের জন্ম, বকুলের এভাবে আসিয়া পড়া, এততেও সেটুকু কি শোধরাইবে না? আগের মত হওয়া শ্যামার পক্ষে আর সম্ভব নয়, তবু পরিবর্তিত পরিশ্রান্ত ক্ষয় পাওয়া শ্যামার মধ্যে একটু শক্তি ও উৎসাহ, একটু চাঞ্চল্য ও মুখরতা এখন আসিতে পারে, আসিতে পারে জীবনের হাসি-কান্নার আরও তেজী মোহ সুখের নিবিড়তর স্বাদ।
মহোৎসাহে শ্যামা বকুলের সেবা আরম্ভ করিল।
বনগাঁয়ে চুরি করিয়া বিধানকে সে ভাল জিনিস খাওয়াইত, এখানে নিজের মুখের খাবারটুকু সে মেয়ের মুখে তুলিয়া দিতে লাগিল। নব্বই টাকা আয়ে তো কলিকাতা শহরে রাজার হালে থাকা যায় না, নিজেকে বঞ্চিত না করিয়া মেয়েকে দিবার দুধটুকু ঘিটুকু ফলটুকু কোথায় পাইবে সে? কচি মেয়ে মাই খায়। শ্যামার নিজেরও দারুণ ক্ষুধা, পাতের মাছটি তবু সে বকুলের থালায় তুলিয়া দেয়। মণিকে দিয়া চিনিপাতা দই আনায় দু'পয়সার, বলে দই মুখে রুচবে লো, ভাতকটা সব মেখে খেয়ে নে চেঁছেপুছে, লক্ষ্মী খা। দই খেলে আমার বমি আসে, তুই খা তো। ও মণি, দে বাবা একটু আচার এনে দে দিদিকে।
বকুলকে সে বসাইয়া রাখে, কাজ করিতে দেয় না।
দেখিতে দেখিতে বকুলের চেহারার উন্নতি হয়।
কিন্তু মুস্কিল বাধায় সরযূ। বলে মেয়েকে কাজকর্ম করতে দিচ্ছ না এ কিন্তু ভাল নয় ভাই।
শ্যামা বলে খেটে খেটে সারা হয়ে এল ওকে আর কাজ করতে দিতে কি মন সরে দিদি? অল্পবিস্তব কাজ ধরতে গেলে করে বৈকি। মেয়ে বিছানা টিছানা পাতে। বিকেলে খানিকক্ষণ হেঁটেও বেড়ায় ছাতে তা তো দেখতেই পাও?
মনে হয় সরযূর অনধিকার চর্চায় শ্যামা রাগ করে। পাশকরা ধাত্রী। পাঁচটি সন্তানের জননী সে। মেয়ের কিসে ভাল কিসে মন্দ সে তা বোঝে না, পাশকরা ধাত্রী তাকে শিখাইতে আসিয়াছে।
শ্যামা প্রাণপণে মেয়েকে এটা ওটা খাওয়াইবার চেষ্টা করে, বকুলের কিন্তু অত খাওয়ার সখ নাই। তার সব চেয়ে জোরালো সখটি দেখা যায়, বিধানের বিবাহ সম্বন্ধে। শ্যামাকে সে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তোলে। বলে, কি করছ মা তুমি? চাকরী বাকরি করছে এবার দাদার বিয়ে দাও। শামুর সঙ্গে দাদার অত মাখামাখি দেখে ভয়ও কি হয় না তোমার?
কিসের মাখামাখি লো?—শ্যামা সভয়ে বলে।
নয়? বিয়ের যুগ্যি মেয়ে ও। কেন রোজ পড়া জানতে আসবে দাদার কাছে। পড়া জানবার দরকার হয় মাষ্টার রাখুক না। না মা দাদার তুমি বিয়ে দাও এবার।
শামুর আসা যাওয়া শ্যামার চেয়েও বকুল বেশি অপছন্দ করে। কি পাকা গিন্নিই বকুল হইয়াছে। সাংসারিক জ্ঞান বুদ্ধিতে কচি মনটি যেন তার টইটম্বুর, আঁটিতে চায় না। শামুর কাপড়পরা বেণীপাকানো, পাউডার-মাখার ঢং দেখিয়া গা যে তার জ্বলিয়া যায় শ্যামা ভিন্ন কার সাধ্য আছে তা টের পাইবে। মনে হয় শামুর সঙ্গে সখিত্বই বুঝি তার গড়িয়া উঠিল। বনগাঁর সেই ঢেঁকি ঘরখানার চালায় ইতিমধ্যে বুঝি নূতন খড়ও ওঠে নাই এক আঁটি, শঙ্করের গায়ের সেই জামাটি বুঝি আজও ছেঁড়ে নাই। অশ্রুমুখী সেই অবোধ বালিকা বকুল আজ এই বকুল হইয়াছে। দুটি ছেলেমানুষ ছেলেমেয়ের সহজ বন্ধুত্বে সে আঁসটে গন্ধ পায় এবং বেমালুম তাহা গোপন রাখিয়া ওদের দেখায় হাসিমুখ। নাক সিঁটকায় মার কাছে আর করে ষড়যন্ত্র। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা গড়িয়া পিটিয়া বকুলকে মানুষ করিয়া দিয়াছে সন্দেহ নাই।
ষড়যন্ত্রে শ্যামার সায় আছে। মিথ্যা নয়, বিধানের এবার বিবাহ দেওয়া দরকার বটে।
বিধান শুনিয়া হাসে। বলে পিসির গাল সয়ে নিয়ে এলাম কি না, মাকে বুঝি তাই এসব কুপরামর্শ দিচ্ছিস খুকী? তারপর গম্ভীর হইয়া বলে, এদিকে খরচ চলে না সে খবর রাখিস তুই? ট্রামের টিকিট না কিনে মণির স্কুলের মাইনে দিয়েছি এবার, তুই আছিস কোন তালে।
বকুল বলে, আমাকে এনে তোমার খরচ বাড়ল দাদা।
তবু তো আছিস আমায় ডুবিয়ে যাবার ফিকিরে।
বকুল অভিমান করে। সে আসিয়া খরচ বাড়াইয়াছে বিধান একথার প্রতিবাদ করিলে সে খুসি হইত। কারো মন বুঝিয়া একটা কথা যদি বিধান কোনদিন বলিতে পারে। খানিক পরে আবার উল্টা কথা ভাবিয়া বকুলের অভিমান কমিয়া যায়। তাই বটে। দাদা কি পর যে তোষামোদ করিয়া কথা কহিবে তার সঙ্গে? আবার সে প্যান প্যান সুরু করিয়া দেয়। যুক্তি দেখায় যে ও-সব বাজে ওজোর। বিধানের এই যে সে আসিয়াছে, সংসার অচল হইয়াছে কি? একটা বৌ আসিলেও স্বচ্ছন্দে সংসার চলিবে। তার চেয়ে বেশি ভাত বৌ খাইবে না নিশ্চয়।
সংসারের ভার গ্রহণ করার আনন্দ বিধানের এদিকে কয়েক মাসের মধ্যেই তিতো হইয়া গিয়াছিল: এই বয়সে ভাইএর স্কুলের মাহিনা দিতে রোজ হাঁটিয়া আপিস করা যদি বা সহ্য হয় একেবারে নব্বই নব্বইটা টাকাতেও যে মাসের খরচ কুলায় না এটুকু মাথা গরম করিয়া দেয় তরুণ মানুষের। বকুলকে একদিন বিধান ভয়ানক ধমকাইয়া দিল। বলিল বিয়ে! বিয়ে! একটা ট্যুসনি খুঁজে পাচ্ছি না। বিয়ে বিয়ে করে পাগল করে দিল আমায়। ফের ও কথা বললে চড় খাবি খুকী।
বলিয়া সে আপিস গেল। বকুল নাইল না, খাইল না। গোসা করিয়া শুইয়া রহিল। বিকালে বাড়ি ফিরিয়া বিধান শুনিল শ্যামার বকুনি। তারপর সে বকুলকে তুলিয়া খাওয়াইতে গেল।
আজ বিভা বসিয়াছিল বকুলের কাছে।
বিধানের সঙ্গে আগে সে কোনদিন কথা বলে নাই। আজ দয়া করিয়া বলিল, পালাচ্ছেন কেন? আসুন না। কি বলেছেন বোনকে, বোন আজ রাগ করে সারাদিন খায় নি?
তারপর বিভা বলিল, শামু খুব প্রশংসা করে বিধানের। জগতে নাকি এমন বিষয় নাই বিধান যা জানে না। পড়াটড়া জানিতে আসিয়া শামু বোধ হয় খুব বিরক্ত করে বিধানকে? আশ্চর্য মেয়ে! মানুষকে এমন জ্বালাতন করিতে পারে ও। বিভা এই সব বলে, বিধান মুখ লাল করিয়া আড়ষ্ট ভাবে শোনে। শ্যামাও তো পিছু পিছু আসিয়াছিল বিধানের। সে আর বকুল ভাবে শামুর কথা ওঠায় বিধানের মুখ লাল হইয়াছে। তারা তা বুঝিতে পারে না জীবনে যে কখনো মেয়েদের ধারে কাছে ঘেঁষে নাই, বিভার মত গান জানা মন টানা আধুনিক মেয়ের কাছে কি তার দারুণ অস্বস্তি।
গভীর বিষাদে শ্যামার মন ভরিয়া যায়। এইবাব বুঝি তার একবারে হাল ছাড়িয়া দিবার দিন আসিয়াছে। অন্ধ মেয়ে দিয়া ভগবানের সাধ মিটিল না, ছেলে কাড়িয়া নেওয়ার ব্যবস্থা করিয়াছেন এবার। বিধানের স্নেহের স্রোত আর কি তার দিকে বহিবে? তার কড়া হাতের সেবা আব কি ভাল লাগিবে বিধানের? জননীকে আর তো বিধানের প্রয়োজন নাই। নিজের জীবন এবার নিজেই সে গড়িয়া তুলিবে যে অধিকার এতদিন শ্যামার ছিল নিজস্ব। শ্যামা বুঝিতে পারে জগতে এই পুবষ্কার মা পায়। বকুলকে বড় করিয়া দান করিয়াছে পরের বাড়ি, তার চোখের সামনে বিধানের নিজের স্বতন্ত্র জগৎ গড়িয়া উঠিতেছে, যেখানে তার ঠাঁই নাই এতটুকু। মণির বেলা ফণীর বেলাও হইবে এমনি। আপন হইয়া কেহ যদি চিরদিন থাকে শ্যামার, থাকিবে ওই অন্ধ শিশুটি, যার নিমীলিত আঁখি দুটির জন্য শ্যামার আঁখি সজল হইয়া থাকিবে আজীবন।
এক বাড়িতে বাস করিলে পরের জীবনের গোপন ও গভীর জটিলতাগুলি, কেহ বলিয়া না দিলেও, ক্রমে ক্রমে সকলেই টের পাইয়া যায়। বিভা ও বনবিহারীর ব্যাপারটা বুঝিতে পারিয়া শ্যামা ও বকুল হাসাহাসি করে নিজেদের মধ্যে। বিভার জন্য ভেড়া বনিয়া এখানে পড়িয়া আছে বনবিহারী, একটু চোখের দেখা, একটু গান শোনা, বিভার যদি দয়া হয় কখনো দুটি কথা বলা এইটুকু সম্বল বনবিহারীর,—মাগো মা, কি অপদার্থ পুরুষ। না জানিস ভালরকম লেখাপড়া, করিস ক্যানভাসারি, থাকিস পরের বাড়ি দাস হইয়া, তোর একি দুরাশা! সিঁড়ির নিচে ভাঙ্গা চৌকীতে যার বাস তার কেন আকাশের চাঁদ ধরার সাধ? বনবিহারীর পাগলামি বিশেষ অস্পষ্ট নয়, সকলেই জানে: সে নিজেই শুধু তা জানে না, ভাবে গোপন কথাটি তার গোপন হইয়াই আছে, ছড়াইয়া পড়ে নাই বাহিরে। টের পাওয়া অবশ্য কারো উচিত হয় নাই, কারণ বনবিহারী কিছুই করে না প্রেমিকের মত, বিভা সিঁড়ি দিয়া নামিলে শুধু চাহিয়া থাকে, বিভা গান ধরিলে যদি আশেপাশে কেহ না থাকে তবেই সে সিঁড়ি দিয়া গুটি গুটি উপরে উঠিয়া দাঁড়াইয়া থাকে, আর যা কিছু সে করে সব চুরি করিয়া, কারো তা দেখিবার কথা নয়। ক্যানভাস করিতে বাহির হইয়া বিভার স্কুলের কাছাকাছি কোথাও সে রোজই দাঁড়াইয়া থাকে ছুটির সময়, কোনদিন সাহস করিয়া সামনে গিয়া বলে, ছুটি হয়ে গেল আপনার?—কোনদিন দূর হইতেই সরিয়া পড়ে। এইটুকু যে সকলে জানিয়া ফেলিয়াছে টের পাইলে লজ্জায় বনবিহারী মরিয়া যাইবে। তারপর বিভার কাজ করিয়া দিতেও সে ভালবাসে বটে। লণ্ড্রিতে কাপড় দিয়া লইয়া আসে, ফর্দ মাফিক মার্কেট হইতে জিনিসপত্র কিনিয়া আনে, যে দুটি ছোট ছোট মেয়ে সকালবেলা গান শিখিতে আসে বিভার কাছে, দরকার হইলে তাদের বাড়ি পৌঁছাইয়া দেয়। এখন এসব ছোটখাট উপকার কে না কার করে জগতে? বাড়ির কাজও তো সে কম করে না। বিভার দুটি একটি কাজ করিয়া দেওয়ার মধ্যে তার গোপন মনের প্রতিচ্ছবি যে সকলে দেখিয়া ফেলিবে কেমন করিয়া সেটুকু অনুমান করিবে বনবিহারী? বিভার যে ফটোখানা সে চুরি করিয়াছে, সেখানা সে লুকাইয়া রাখিয়াছে ক্যানভাসিংএ যাওয়ার সুটকেশটির মধ্যে, আর পুরোনো ব্লাউজটি রাখিয়াছে তার ট্রাঙ্কে তালাচাবি দিয়া। চুপি চুপি লুকাইয়া এগুলি সকলে যে আবিষ্কার করিয়াছে তাই বা সে জানিবে কিরূপে?
বিভা বিব্রত হইয়া থাকে। বনবিহারী এমন নিরীহ, যত স্পষ্টই হোক এমন মূক ও নিষ্ক্রিয় তার প্রেম, তার বিরুদ্ধে নালিশ খাড়া করিবার তুচ্ছতম প্রমাণটিরও এমন অভাব যে এ বিষয়ে সকলের যেমন তারও তেমনি কিছু বলিবার অথবা করিবার উপায় নাই। মনে মনে সে কখনো রাগে কখনো বোধ করে মমতা। সিঁড়ি দিয়া নামার সময় কোনদিন তাকায় ক্রুদ্ধ ভর্ৎসনার চোখে, কোন দিন দুটি একটি স্নিগ্ধ কথা বলে। ভাল যে লাগে না একেবারে তা নয়। একটা কুকুরও কুকুরের মত পোষ মানিলে মানুষের তাতে কত গর্ব— কত আনন্দ, এতো একটা মানুষ। অথচ এরকম পূজা গ্রহণ করিবার উপায় না থাকিলে কি বিশ্রীই যে লাগে মানুষের মনে যার একফোঁটা দয়ামায়া থাকে।
বকুলের সঙ্গে হাসাহাসি করে বটে মনে মনে শ্যামা কিন্তু ব্যথা পায়। শক্ত সমর্থ যুবক, একি ব্যাধি তার মনের। মেরুদণ্ডটা পর্যন্ত যে ওর গলিয়া গেল। সুযোগ পাইয়া কি ব্যবহারটাই বাড়ির লোকে করে ওর সঙ্গে! নিজের মনুষ্যত্ব যে বিসর্জন দিয়াছে কে তাকে মানুষ জ্ঞান করিবে, দোষ কারো নাই।
আচ্ছা শামুর জন্য বিধানও যদি অমনি হইয়া যায়? অমনি উন্মাদ? ও ভগবান শ্যামা তবে নিজেই পাগল হইয়া যাইবে।
অনেক ভাবিয়া শ্যামা শেষে একদিন বকুলকে বলে, শোন খুকী, বলি দ্যাখ শামুকে যদি খোকার পছন্দ হয়ে থাকে, ওর সঙ্গেই না হয় দিই খোকার বিয়ে? স্বঘর তো, দোষ কি?
বকুল স্তম্ভিত হইযা যায়। বলে ক্ষেপেছ নাকি তুমি মা? কি বলছ তার ঠিক ঠিকানা নেই। ওই মেয়ের সঙ্গে তুমি বিয়ে দিতে চাও দাদার! শামু ভাল নয় মা—সয়তানের একশেষ। এমন কথা মনেও ঠাঁই দিও না।
কি হইবে তবে? একদিন শামু না আসিলে বিধান যে উসখুস করিতে থাকে। শামুর হাসির হিল্লোলে সংসার যে শ্যামার ভাসিয়া যাইতে বসিয়াছে!
ভগবান মুখ তুলিলেন।
অনেক দুঃখ শ্যামা পাইয়াছে, আর কি তিনি তাকে কষ্ট দিতে পারেন। একদিন বিধান বলিল, শঙ্করের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম মা, আমাদের বাড়িটা দেখে আসতে ইচ্ছে হ'ল, গিয়ে দেখি ভাড়ার নোটিশ ঝুলছে। যাবে ও বাড়িতে?
আমাদের বাড়ি। আজও সে বাড়ির কথা বলিতে ইহারা বলে আমাদের বাড়ি।
শ্যামা সাগ্রহে বলিল, সত্যি খোকা?—যাব, চল সামনের মাসেই আমরা চলে যাই, পয়লা তারিখে।
সামনের মাসে পয়লা তারিখে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহারা বাড়ি বদলাইয়া ফেলিল। বিধান ছুটি লইল একদিনের। সকালে একা গিয়া জিনিসপত্র রাখিয়া আসিতে বেলা তার বারোটা বাজিয়া গেল। শামু আব বিভা দুজনেই তখন স্কুলে গিয়াছে, বাড়িওয়ালার ছেলেরা গিয়াছে আপিস, বনবিহারী গিয়াছে ওষুদ ক্যানভাস করিতে। দুপুরে এখানেই পাতা পাতিয়া তাহারা ভাত খাইল। তারপর বাকি জিনিসপত্র সমেত রওনা হইয়া গেল সহরতলীর সেই বাড়ির উদ্দেশে, শ্যামার জীবনের দুটি যুগ যেখানে কাটিয়াছিল।
তেমনি আছে ঘরবাড়ি শ্যামার। শেষবার এবাড়ি হইতে সে যখন বিদায় লইয়াছিল তখন বাড়িটা শুধু ছিল একটু বিবর্ণ, বাড়ির মালিক এখন আগাগোড়া চূণকাম করিয়াছে, রঙ দিয়াছে। শ্যামা সোজা উঠিয়া গেল উপরে। উপরের ঘরখানাকে আর নূতন বলিয়া চেনা যায় না, বাড়ির বাকি অংশের সঙ্গে মিশ খাইয়া গিয়াছে। নকুড় বাবু দোতলায় ঘর তুলিয়াছে একখানা। রেলের বাঁধটার খানিকটা আড়াল পড়িয়া গিয়াছে। আর কিছুই বদলায় নাই। ধানকলের বিস্তৃত অঙ্গনে তেমনি ধান মেলা আছে, পায়রার ঝাঁক তেমনি খাইতেছে ধান, উঁচু চোঙাটা দিয়া তেমনি অল্প অল্প ধোঁয়া বাহির হইয়া উড়িয়া যাইতেছে বাতাসে।