জন্ম ও মৃত্যু/অকারণ
অকারণ
মনটা ভালো ছিল না। এক একদিন এ রকম হয়।
কিছু পড়তে ভালো লাগে না, কিছু ভাবতে ভালো লাগে না, কারুর সঙ্গে কথা বলতেও ভালো লাগে না। মনে হয়, যেন মনের চাকার তেল ফুরিয়ে গিয়েচে—‘অয়েল’ না ক’রে নিলে চাকা আর চলবে না, ক্রমে মরচে পড়ে আস্বে। তারপর কবে একদিন ফুট্ করে বন্ধ হয়ে যাবে।
জেলেপাড়া লেনে এক পুরোনো তাসের আড্ডায় গেলুম। সেই সব পুরোনো বন্ধুরা এসে জুটেচে—তাস কিন্তু ভালো লাগল না। তাস খেলে জিতব, অন্যদিন এতে কত উৎসাহ, আনন্দ পাই। আজ মনে হ’ল, না হয় জিতলামই, তাতেই বা কি?—এদের গল্প-গুজব ভালো লাগল না। অর্থহীন—অর্থহীন—এই নিচু বৈঠকখানা ঘর, চূণ বালিখসা দেওয়াল, সেই সব একঘেয়ে সস্তা ওলিওগ্রাফ্ ছবি—কালীয়দমন, অন্নপূর্ণার ভিক্ষাদান, কি একটা মাথামুণ্ডু ল্যাণ্ড্স্কেপ—একঘেয়ে কথাবার্তা, চিরকাল যা শুনে আসচি—হঠাৎ মন বিরস ও বিরূপ হয়ে উঠল—সব বাজে, সব অর্থহীন,—পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করলুম—আপনার বেশ ভালো লাগছে? মনে কোনো রকম—
সে অবাক্ হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। বললে—কেন, ভালো লাগচে না কেন? কেন বলুন তো!—
মন আরও তিক্ত হয়ে উঠল। কাজের ছুতোয় সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লুম। বেলা চারটে বাজে। ফিরিওয়ালারা গলির মধ্যে হাঁকচে—ছেলেরা বই দপ্তর নিয়ে স্কুল থেকে ফিরচে—কলে জল পড়বার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে—গলির মোড়ে রোয়াকে-রোয়াকে এরই মধ্যে আড্ডা বসে গিয়েচে—।
একটা নিতান্ত সরু অন্ধকার গলি, পাশেই একটা মিউনিসিপ্যালিটির নাইবার জায়গা। এই গলিটা দিয়ে যাতায়াত প্রায়ই করি—মিউনিসিপ্যালিটির নাইবার জায়গাটার পাশে একটা খোলার ঘর—এই ঘরখানা ও তার অধিবাসীরা আমার কাছে বড় কৌতূহলের জিনিস। হাত পাঁচেক লম্বা, চওড়াতে ওই রকমই হবে, এই তো ঘরখানা। এরই মধ্যে একটি পরিবার থাকে, স্বামী-স্ত্রী ও দুটি শিশু-সন্তান। না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত, এইটুকু ঘরে কি ভাবে এতগুলি প্রাণী থাকে—তাদের জিনিস-পত্র নিয়ে। কিন্তু সকলের চেয়ে অবিশ্বাসের বিষয় এই যে, ওই পাঁচ বর্গ-হাত ঘরের এক কোণেই ওদের রান্নাঘর। আমি যখন ওখান দিয়ে যাই, প্রায়ই দেখতে পাই—উনুনে কিছুনা-কিছু একটা চাপানো আছে। বৌটি ছোট্ট ছেলে কোলে নিয়ে রাঁধচে, না হয় দুধ জ্বাল দিচ্চে। তার বয়েস দেখলে বোঝা যায় না। তেইশও হতে পারে, ত্রিশও হতে পারে—চল্লিশও হতে পারে। ঘোমটার কাছে ছেঁড়া, আধ ময়লা শাড়ি পরনে। হাতে রাঙা কড় কি রুলি। চোখ মুখ নিষ্প্রভ, নির্বুদ্ধিতার ছায়া মাখানো। স্বামী বোধ হয় কোনো কারখানাতে মিস্ত্রীর কাজ করে, দু’একদিন সন্ধ্যার আগে ফেরবার সময় দেখেচি লোকটা কালি-ঝুলি মেখে ছোট্ট বালতি হাতে পাশের নাইবার জায়গায় ঢুকচে।
আজও ওদের দেখলুম। দোরের কাছে বৌটি ছেলে কোলে নিয়ে বসে আছে, ছেলেকে আদর করচে। নির্বোধের মতো আমার দিকে একবার চেয়ে দেখলে। সেই পায়রার খোপের মতো ঘরটা, ছিটেবেড়ার দেওয়ালে মাটির লেপ, তার ওপরে পুরোনো খবরের কাগজ আঁটা, কাগজগুলো হলদে বিবর্ণ হয়ে গিয়েচে—দড়ির আলনায় ময়লা কাপড়-চোপড় ঝুলচে।
মনটা আরও দমে গেল। কি ক’রে এরা এ থেকে আনন্দ পায়? কি ক’রে আছে? কি অর্থহীন অস্তিত্ব! কেন আছে? আচ্ছা, ও ছেলেটা বড় হয়ে কি হবে? ওই রকম মিস্ত্রী হবে তো, ওই রকমই খোলার ঘরে ছেলে বউ নিয়ে ওই ভাবেই মলিন, কুশ্রী, অন্ধকার, অর্থহীন জীবনের দিনগুলো একে একে কাটাতে কাটাতে এগিয়ে চলবে, ততোধিক দীন হীন মরণের দিকে। অথচ মা কত আগ্রহে খোকাকে বুকে আঁকড়ে আদর করছে, কত আশা, কত মধুর স্বপ্ন হয়তো—কিন্তু এখানেও আমার সন্দেহ এল। স্বপ্ন দেখবার মতো বুদ্ধিও বৌটির আছে কি? কল্পনা আছে? নিজেকে এমন অবস্থায় ভাবতে পারে যা বর্তমানে নেই কিন্তু ভবিষ্যতে হতে পারে ব’লে ওর বিশ্বাস? মনের গোপন সাধ-আশাকে মনে রূপ দিতে পারে? নিজের সঙ্কীর্ণ, অসুন্দর বর্তমানকে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের মধ্যে হারিয়ে ফেলতে পারে?
বড় রাস্তার মোড়ে বইএর দোকানগুলো দেখে বেড়ালুম। রাশি রাশি পুরোনো বই, ম্যাগাজিন। অধিকাংশই বাজে। অলস অপরিণত মনের তৈরী জিনিস। চটকদার মলাটওয়ালা অসার বিলিতী নভেল, সিনেমার ম্যাগাজিন ইত্যাদি। অন্যদিন এখানে বেছে বেছে দেখি, যদি ভালো কিছু পাওয়া যায়। আজ আর বাছবার মতো ধৈর্য ছিল না। মনের আকাশের চেহারা আজ ঘসা পয়সার মতো, নীলিমার সৌন্দর্য তো নেই-ই, মেঘভরা বাদল দিনের রূপও নেই—নিতান্তই ঘসা-পয়সার মতো চেহারা।
সিনেমা দেখতে যাব? উট্রাম ঘাটে বেড়াতে যাব? কোথাও বসে খুব গরম চা খাব? লেকের দিকে যাব?—
ধর্মতলার গির্জার সামনে এক জায়গায় লোকের ভিড় জমেচে। একটা সাহেবী পোশাক পরা লোক ফুটপাথে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে, ধড়টা ও মাথাটা পরস্পরের সঙ্গে এমন অস্বাভাবিক কোণের সৃষ্টি করেচে যে, মনে হচ্চে লোকটা মারা গিয়েছে। দুজন সার্জেণ্ট এলো। লোকে বললে, সামনের বাড়ির নিচের তলায় ওই বাথ-রুমের মধ্যে পড়েছিল এই অবস্থায়, বাড়ির দারোয়ান ধরাধরি ক’রে তার সংজ্ঞাহীন নিঃসাড় দেহটা একটা ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে কোথায় গেল।
লোকটার ওপর সহানুভূতি হ’ল আমার। সেই নির্বোধ বধূটার ওপর যা হয়নি, এ বেহুঁশ মাতালের ওপর তা হ’ল। বেচারা আনন্দের খোঁজে বেরিয়েছিল, পথও যা হয় একটা ধরেছিল, হয় তো ভুল পথ, হয় তো সত্যি পথ···আনন্দের সত্যতা তার মাপকাঠি—কে বলবে ওর কি অভিজ্ঞতা, কি তার মূল্য? ওই জানে। কিন্তু ও তো বেহুঁশ।
কার্জন-পার্কের সামনে এলুম। অনেকগুলো চাকর ও আয়া সাহেবদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে বৃষ্টির ভয়ে গাড়িবারান্দার নিচে ফুটপাথের উপরে বসে আছে। বৃষ্টি একটু একটু বাড়ছে, আমিও সেখানে দাঁড়ালুম। একটা ছোট্ট ছেলে, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া সোনালী চুল, নীল চোখ, বছর দেড় কি দুই বয়েস—সে তার চাকরের টুপিটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে টলতে টলতে উঠে অতি কষ্টে নাগাল পেয়ে চাকরের মাথায় টুপিটা পরিয়ে দিচ্চে। আর যেমন পরানো যাচ্চে, অমনি হাত নেড়ে, ঘড়ি দুলিয়ে দন্তহীন মুখে হেসে কুটি কুটি হচ্চে। কিন্তু টুপিটা ভালো করে মাথায় বসাতে পারচে না, একটু পরেই গড়িয়ে পড়ে যাচ্চে, আবার খোকা অতি কষ্টে টুপিটা মাথায় তুলে দিচ্ছে···আবার সেই হাসি, সেই হাত-পা নাড়া, সেই নাচ।···তাকে কেউ দেখচে না, কারুর দেখবার সে অপেক্ষাও রাখচে না, তার চাকর পার্শ্ববর্তিনী আয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলাপে এমন অন্যমনস্ক, খোকা কি করচে না করচে সেদিকে তার আদৌ খেয়াল নেই, নিকটের অন্য অন্য ছেলেমেয়েরাও নিতান্ত শিশু—ওই খোকাটি আপন মনে বার বার টুপি পরানো খেলা করচে।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলুম। নরম-নরম কচি হাত পায়ের সে কি ছন্দ, কি প্রকাশ—ভঙ্গির কি সজীবতা, কি অবোধ উল্লাস, কি অপূর্ব সৌন্দর্য!···খুশির আতিশয্যে খোকা আবার সামনে ঝুঁকে-ঝুঁকে পড়চে, একগাল হাসচে, ছোট ছোট মুঠি বাঁধা হাত দু’টো একবার তুলচে, একবার নামাচ্চে···শিশুমনের আগ্রহভরা উল্লাসের সে কি বিচিত্র, কি সুস্পষ্ট, ভাষাহীন বার্তা!······
আমি আর চোখ ফেরাতে পারিনে। হঠাৎ অদৃষ্টপূর্ব, অপ্রত্যাশিত সৌন্দর্যের সামনে পড়ে গিয়েছি যেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলুম। হঠাৎ চাকরটার হুঁশ হ’ল—সে আয়ার সঙ্গে গল্প বন্ধ করে খোকার দিকে ফিরে টুপিটা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে পাশে একটা পিরাম্বুলেটারের মধ্যে রেখে দিলে। খোকার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। সে টলতে টলতে পিরাম্বুলেটারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু বড্ড উঁচু—তার ছোট্ট হাত দুটি সেখানে পৌঁছয় না। সে একবার অসহায়ভাবে এদিক ওদিক্ চাইলে, তারপর থপ্ করে বসে পড়ল। চাকরটা আয়ার সঙ্গে গল্পে মত্ত।
কার্জন-পার্কের বেঞ্চির ওপর গিয়ে বসলুম। সূর্য অস্ত যাচ্চে। গঙ্গার অপর পারে আকাশ রাঙা হয়ে এসেচে।
খোকার মনের সে অর্থহীন আনন্দ আমার মনে অলক্ষিতে কখন সংক্রামিত হয়েচে দেখলুম। খোলার ঘরের সেই মেয়েটিকে আর নির্বোধ মনে হ’ল না।
শেষ