জন্ম ও মৃত্যু/বড়বাবুর বাহাদুরী

বড়বাবুর বাহাদুরি

 আপিসে মাঝে মাঝে নানা পার্টি আসিয়া গোলঞ্চ লতা ও গাছ-গাছড়া বিক্রি করিয়া যাইত। ইহাদের নাম লেখা আছে বটে, কিন্তু অনেকেরই ঠিকানা কিছু লেখা থাকে না। এখানে ছোট-খাটো কাজকর্ম সবই হয় নগদ—বড়বাবুর এসিষ্ট্যাণ্ট, সে সব পাওনাদারকে সাহেব তো দূরের কথা, বড় বাবুর কাছে পর্যন্ত যাইতে দেয় না।

 হরিপদ এবার নগু দালালের হাত দিয়া জিনিস না বেচিয়া নিজেই সরাসরি কোম্পানীর আপিসে লইয়া গিয়া নামাইয়াছিল।

 যে পাড়াগাঁয়ে হরিপদ থাকে, গাছ-গাছড়ার সেখানে অভাব নাই। নগু দালালের পরামর্শেই সে এই সব গাছ-গাছড়া সংগ্রহ করিতে আরম্ভ করে। তাহাকে সে সব চিনাইয়াছিল শান্তি কবিরাজ।

 মন পিছু দু’টাকা লরি ভাড়া দিয়া বার বার মাল আনিয়া পোষায় না। হরিপদ সেজন্য এক বছর ধরিয়া বিস্তর গাছপালা মজুদ করিতেছিল। নগু দালাল ইহার মধ্যে দু’তিনবার সন্ধান লইয়াছেও।

 —ওহে হরিপদ, মালগুলো এবার দেখচি তুমি পচাবে। আপাং শিমুলের শেকড়, শ্বেতপর্পটি এ সব ছ’মাসের বেশি থাকে না, পচে’ নষ্ট হয়ে যায়। তখন দু’খানা করেও বিক্রি হবে না। নিয়ে এসো হে, নিয়ে এসে ফেল কলকাতায়—। কিন্তু হরিপদ খুব কাঁচা ছেলে নয়।

 বেলেঘাটার মুখুয্যে মশায়ের আড়তে সে আর যাইতে প্রস্তুত নয়। অবিশ্যি এ কথা ঠিক যে, তাহার থাকিবার ও খাইবার কোনাে কষ্ট কলিকাতায় হয় না। আজকাল আড়তে উঠিলেই হইল। আড়তের রাঁধুনী বামুন তাহাকে চিনে, তাহাকে গিয়া বলিলেই হইল—ও কুবের ঠাকুর। এখানে দুটো খাব এ বেলা।

 উহারা যতই খাতির করুক, এবার হরিপদ বেলেঘাটার আড়তে গিয়া উঠে নাই।

 নগু দালাল তাে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরিয়া গাছ-গাছড়া সংগ্রহ করে, তাহাকে সে লাভের একটা মােটা অংশ কেন দিতে যাইবে?

 কলিকাতায় এবার আসিয়া সে শুনিল, হিন্দুস্থান কেমিক্যাল্ কোম্পানী শীতের মরসুমে এই রকম গাছ-গাছড়া কিনিয়া থাকে।

 সে সােজা গিয়া হাজির হইল হিন্দুস্থান কেমিক্যাল্ কোম্পানীর আপিসে। প্রচণ্ড ব্যাপার। লােকজন, লিফ্‌ট্, দরওয়ান, ঘােরানাে দরজা, দিনমানে ইলেক্‌ট্রিক্ আলো জালিয়া কাজ চলিতেছে। ঘন ঘন টেলিফোন বাজিবার শব্দ। এই জন্যেই বােধ হয় নগু দালালের শরণাপন্ন হইতে হয়। এখানে জিনিস বেচা কি পাড়াগাঁয়ে লােকের কর্ম? অবশেষে সন্ধান মিলিল এন্‌কোয়ারী আপিস থেকে।

 জিনিস ক্রয় করিবার ভার যার উপর, তার বয়েস খুব বেশি নয়। লােকটা মাল দেখিয়া শুনিয়া যা দর বলিল, বেলেঘাটা মুখুয্যে মশায়ের আড়তের দরের তুলনায় মনপিছু অন্ততঃ আট আনা বেশি।

 মাল নামাইয়া ওজন করিয়া দিতে দেরি হইয়া গেল। কেরানী বাবুটি জিজ্ঞাসা করিল—আপনি চেক নেবেন, না নগদ টাকা? কাল এসে টাকা নিয়ে যাবেন তবে। আজ ক্যাশ থেকে টাকা বের ক’রে রেখে দেব। একটা বিল ক’রে বড় বাবুর কাছে সই ক’রে নিয়ে আসুন। বিলখানা এখানে দিয়ে যাবেন।

 পরদিন কাউণ্টারে বেজায় ভিড়। আজ টাকা দিবার দিন, অনেক লোক টাকা লইতে আসিয়াছে। একখানা খামের উপর পাওনাদারের নাম টাইপ করা।

 কেরানী বাবু জিজ্ঞাসা করিতেছে—কি নাম? রামশরণ পাল? —এই নিন্। পাওনাদার একখানা খাম লইয়া চলিয়া যাইতেছে—কেহ কেহ বা খাম খুলিয়া নোটগুলি দেখিয়া লইতেছে।

 হরিপদর হাতে কেরানী এমনি একখানা খাম দিল। তার ওপরে লেখা আছে H. P. B. সামান্য চল্লিশ টাকার জন্য খাম খুলিয়া টাকা দেখিয়া লইতে তাহার লজ্জা করিতে লাগিল। এত কাণ্ডকারখানা যেখানে, সেখানে কি আর ভুল হইবার সম্ভাবনা আছে? খামের বাহিরে টাইপ করা অক্ষরে তার নাম লেখা ঠিকই আছে।

 কিন্তু শেয়াল দ’ স্টেশনে আসিয়া খাম খুলিয়া নোটগুলি কি ভাবিয়া একবার দেখিয়া লইতে গিয়া হরিপদ মাথা ঘুরিয়া সেখানে বসিয়া পড়িল। চারিদিকে চাহিয়া সে তাড়াতাড়িই নোটের খামখানা পকেটে পুরিয়া সোজা প্যাটফর্মে ঢুকিয়া ট্রেণে চড়িয়া বসিল। শীতকালেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল। সর্বনাশ! সব ক’খানাই একশো টাকার নোট, সর্বশুদ্ধ এগারো খানা। চল্লিশ টাকার জায়গায় এগারশো টাকা!

 এ ভুল কি করিয়া হইল হরিপদ বুঝিতে পারিল না। হয়তো তাড়াতাড়িতে অন্য কোনো বড় পাওনাদারের খাম তাহাকে দিয়াছে। তাহারও নাম বোধ হয় H. P. B. অত ভিড়ের মধ্যে কেরানী বাবু কাহার নামের খাম কাহাকে দিয়াছে।

 এগারশো টাকা তাহার নিকট অ-নে-ক টাকা। সামান্য অবস্থার মানুষ সে, গাছ-গাছড়া বেচিয়া সংসার চালায়! ভগবান দিয়া দিয়াছেন—উঃ, আর কি সময়েই দিয়াছেন— ভগবানের দান ত! সারা জীবন গাছ-গাছড়। বিক্রয় করিয়াও সে এগারোশো টাকা জমাইতে পারিত না। আর একসঙ্গে নগদ এতগুলি টাকা হাতে পাওয়া কি সোজা কথা? কার মুখ দেখিয়াই না সে উঠিয়াছিল!

 ট্রেণে যাইতে যাইতে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগিয়া তাহার উত্তেজনা অনেকটা শান্ত হইল। কিন্তু একটা উত্তেজনা তখনও কমিল না—কতক্ষণে স্ত্রীর কাছে কথাটা বলিবে। গাড়ি যেন চলিতে চাহিতেছে না, এত বড় আনন্দের খবর কাহাকেও না জানাইতে পারিয়া, ভগবান জানেন, কি অসহ্য যন্ত্রণা যে তাহার হইতেছে!

 গাড়ির কোণে একটা প্রৌঢ় ভদ্রলোক গলায় কম্ফর্টার জড়াইয়া বসিয়া আছেন। তাঁহাকে গিয়া কথাটা বলিবে।

 —দেখুন মশায়, বড় একটা মজা হয়েচে। একটা আপিসে চল্লিশটা টাকা পেতুম, তারা ভুল ক’রে এগারোশো টাকা দিয়েছে। এই দেখুন টাকা।

 আপিসের নাম সে তো বলিতে যাইতেছে না?

 দরকার নাই, সন্দেহ করিয়া লোকটা যদি পুলিশে খবর দেয়!

 আপিসের লোকে নিশ্চয়ই ভুল ধরিয়া ফেলিবে এবং তখনি তাহার সন্ধানে লোক ছুটিবে। ছুটিলেও তাহার ঠিকানা বাহির করার কোনো উপায় নাই। একশো টাকার নোটগুলি ভাঙ্গাইয়া ফেলিতে হইবে। সিরাজগঞ্জে তাহার মামা পাটের আপিসে কাজ করেন, মামার সাহায্যে একশো টাকার নোট ভাঙ্গাইয়া খুচরা দশ টাকার নোট সংগ্রহ করিতে হইবে। কালই সকালের ট্রেণে সিরাজগঞ্জ রওনা হওয়া দরকার।

 হরিপদর স্ত্রী আশালতা নোটের তাড়া দেখিয়া অবাক্ হইয়া স্বামীর দিকে চাহিয়া রহিল। বলিল—হ্যাঁগা, তারা বুঝতে পারলে না, ভুল ক’রে কার টাকা কাকে দিলে!

 বড় বড় আপিসের মজাই তো তাই। বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। এদিকে এক এক ডিপার্টমেণ্টে পঞ্চাশ ষাট একশো লোক খাটছে, আর ওদিকে এই কাণ্ড। বড়বাবুর কাছে যাও, বিল সই করে নিয়ে এসো, ক্যাশ লও, আবার সই করাও। সব মিথ্যে জাঁকজমক আর কেতাদুরস্ত।

 আশালতা বলিল, কিন্তু ওসব নোটের শুনেচি নম্বর থাকে, যদি পুলিশে হুলিয়া করে দেয়, তুমি নোট ভাঙ্গাবে কি করে? ওইখানেই তো ভয়!

 কিছু ভয় নেই। প্রথম তো আজকাল একশো টাকার নোটে নম্বর থাকে না শুনেচি। অত বড় আপিসে একশো টাকার যে সাধারণ নম্বর থাকে, তা টুকে রাখবে না। আর তা ছাড়া কালই সিরাজগঞ্জে গিয়ে মামার কাছ থেকে সব নোট ভাঙ্গিয়ে আনচি। আমার ঠিকানা ওদের কাছ নেই যে ধরবে। নাম দেখে ধরতে পারবে না।

 হরিপদর স্ত্রী বলিল—ভালোয় ভালোয় নোটগুলো ভাঙ্গিয়ে তো আনো। সামনের পুন্নিমের দিন সত্যনারায়ণের শিন্নি দিয়ে দিই। ও টাকা ভগবান আমাদের মুখ চেয়েই দিয়েছেন।

 সিরাজগঞ্জে গিয়া টাকা ভাঙ্গাইয়া আনিতে কোনো বাধা হইল না। কথা ফাঁস করিতে নাই, চতুর হরিপদ মামাকে বলিল, ব্রহ্মোত্তর ধানের জমিগুলো সব বেচে দিলুম। কি করি, একটা ব্যবসা খুলব, টাকা যোগাড় করি কোথা? সত্যনারায়ণের শিন্নি দেওয়াও ভুলিয়া গেল।

 মাস খানেক কাটিয়া গিয়াছে। অন্য কোনো দিক হইতেই হাঙ্গামা বাধে নাই বটে, কিন্তু হরিপদ বড় বিপদে পড়িয়াছে, এই এক মাস তাহার মনের দিক হইতে একটা বড় গোলমাল বাধিয়া গিয়াছে। এই টাকাটা লইয়া সে কি ভালো করিল!

 আপিসের তাহারা এতদিন তাহাদের ভুল নিশ্চয়ই জানিয়া ফেলিয়াছে। তাহার খোঁজও করিয়াছে। কিন্তু কোথায় পাইবে তাহার পাত্তা। সেই কেরানী বাবুর উপরে নিশ্চয়ই সব দায়িত্ব পড়িয়াছে এবং এতদিন বেচারীর চাকরি আছে কিনা সন্দেহ।

 যতই দিন যাইতে লাগিল, হরিপদ ততই মনে অস্বস্তিবোধ করিতে লাগিল। যতদিন পুলিশের ভয় ছিল, বা আপিস হইতে তাহার টাকা কাড়িয়া লইবার ভয় ছিল, ততদিন তাহার মনে এ কথা ওঠে নাই যে, এ টাকা লওয়া অন্যায় বা পাপ। কিন্তু এ সম্বন্ধে যতই সে নিজেকে নিরঙ্কুশ বোধ করিতে লাগিল, ততই মনে হইতেছিল এ টাকায় তাহার কোনো অধিকার নাই, এ অপরের টাকা সে চুরি করিয়া আনিয়াছে।

 ছ’মাস কাটিয়া গেল; কখনো সে ভাবে, টাকাটা ফিরাইরা দিব; আবার পরদিনই মনে হয় এই এগারোশো টাকার একখানি মুদীর দোকান খুলিয়া গ্রামে বসিয়াই সে চমৎকার চালাইতে পারে। ভগবান তাহাদের দুঃখ দেখিয়া মূলধন যোগাড় করিয়া দিয়াছেন। থাক্, টাকাটা।

 টাকা ফেরত দেওয়ার একটা প্রধান বাধা দাঁড়াইয়াছে হরিপদর স্ত্রী। সে যেদিন হইতে শুনিয়াছে স্বামী টাকা ফেরত দেওয়ার সংকল্প করিতেছে, সেদিন হইতে সে কাঁদিয়া কাটিয়া অনর্থ বাধাইয়াছে। গরীবের ঘরের মেয়ে, গরীরের ঘরের বৌ—তার কাছে এগারোশো টাকা একটা খুব বড় ব্যাপার।

 হরিপদ তাহাকে বুঝাইয়া বলিল—দ্যাখো, ফাঁকির টাকা তো বটে! এতদিন কথাটা ভালো করে বুঝিনি, আজকাল রাত্রে আমার ঘুম হয় না ভেবে ভেবে তা জানো? কাজ নেই বাপু, এগারোশো টাকা ক’দিন খাব? ওটা তাদের দিয়েই আসি।

 আশালতা বলিল—ফাঁকির টাকা হ’ল কি ক’রে? ভগবান না দিলে তাদেরই বা ভুল হবে কেন? ও যখন ঘরে এসেছে, তখন হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলো না, আমার কথা শোনো, ও নিয়ে ভেবে মিথ্যে মাথা খারাপ কোরো না লক্ষ্মীটি। তুমি কোন একটা লোককে ফাঁকি দিয়ে নিয়ে আসোনি, তারা ভুল করে দিয়েচে, এতে তোমার দোষ কি? কারো একজনের টাকা নয়, কোম্পানীর টাকা, বড় লোক কোম্পানী, তাদের কাছে এগারোশো টাকা কিছুই নয়, কিন্তু আমাদের কাছে অনেক বেশি। সারা জীবনের একটা হিল্লে হয়ে যাবে। আমি কি আমার নিজের জন্যেই বলি, নিজের চেহারাটা একবার আয়নায় দেখো। দিকি? বনে-জঙ্গলে ঘুরে গাছপালা খুঁজে খুঁজে কি ছিরি বেরিয়েছে! ওই টাকায় একখানা দোকান করো, বসে চলবে।

 কি ভয়ানক বাধা হইয়া উঠিয়াছে স্ত্রীর এই অনুরোধ! কেন ছাই এ কথা ও স্ত্রীকে বলিতে গিয়াছিল? ওর মুখের দিকে চাহিলে কষ্ট হয়, ওর কাতর অনুরোধ শুনিলে মনে হয়—দূর করো, কাজ নাই সাধুতা দেখাইয়া। ওই অভাগিনীকে জীবনে কখনো সে সুখী করিতে পারে নাই, টাকাটায় একটা ব্যবসা খুলিয়া দিলে অন্নবস্ত্রের কষ্টের একটা মীমাংসা হইবে। এখানে সাধু সাজা স্বার্থপরতা, ঘোর স্বার্থপরতা।

 আশালতার বয়েস কম, জীবনে কোনো সাধ ওর পূর্ণ হয় নাই। ওর মুখের দিকে চাহিয়া না হয় সে নিজের কাছে অসাধুই হইয়া রহিল।

 দিনে এই সব ভাবে, কিন্তু গভীর রাত্রে যখন গ্রাম নিষুতি হইয়া যায়, আশালতা ঘুমাইয়া পড়ে, তখন তার মনে হয় চুরির স্বপক্ষে কি চমৎকার যুক্তিই সে বাহির করিয়াছে। জুয়াচুরি জুয়াচুরিই, তার স্বপক্ষে কোনো যুক্তি নাই, তর্ক নাই। টাকা তাকে ফিরাইয়া দিতেই হইবে, নিজের কাছে চোর হইয়া সে থাকিতে পারিবে না।

 নিদ্রিত আশালতার মুখের দিকে চাহিয়া সে ভাবিল—ছি ছি, মেয়েমানুষ জাতটা কি ভয়ঙ্কর! ওদের মনে কি এতটুকু সৎ কিছু মানে না? কেবল টাকা-কড়ি, গহনা, চাল-ডালের দিকে নজর?

 দিন যায়। হরিপদ দেখিল, সে স্ত্রীকে মনে মনে অশ্রদ্ধা করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহার কত আদরের আশালতা! যাহাকে চোখ ভরিয়া দেখিয়াও চোখের তৃপ্তি হইত না, তাহার সম্বন্ধে এ সব কি ভাবনা তার মনে?

 একদিন হঠাৎ তাহাদের একটা বাছুর মরিয়া গেল।

 এবার হরিপদ ভাবিল—তা যাবে না? সংসারে যখন ওর মতো মেয়ে এসেচে! তখন ওর পরামর্শেই সংসার এবার উচ্ছন্নে যাবে।

 দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণা তাহার বদ্ধমূল হইতে লাগিল। আজকাল স্ত্রীর প্রতি ব্যবহারটা দিন দিন রুক্ষ হইয়া উঠিতেছে। সামান্য কথায় খিটখিট করে, সামান্য ব্যাপার লইয়া স্ত্রীকে দু’কথা শুনাইয়া দেয়। মনের মিলের জোড় ক্রমে অলক্ষিতে খুলিতে লাগিল। আশালতা ভাবিয়া কূল পায় না, তাহার অমন স্বামী কেন এমন হইয়া যাইতেছে দিন দিন? ক্রমে তাহার মনেও ভাঙন শুরু হইল। ভাবে এত হেনস্তা কিসের? কোন্ জিনিসটাতে আমার ত্রুটি হয়? উদয়াস্ত মুখে রক্ত উঠে খেটে মরি, সে কথা একবার বলা তো দূরের কথা, উল্টে আবার পান থেকে চুন খসলেই এই সব গাল-মন্দ, অপমান?

 গত মাসখানেক সেই আপিসের টাকাতে হাত পড়িয়াছে। এরই মধ্যে ত্রিশ চল্লিশ টাকা খরচ হইয়া গিয়াছে। আশালতা ভাবে—‘ওর শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েচে রোদে রোদে সাত গাঁয়ের বন-জঙ্গলে ঘুরে। ওকে একটু সারিয়ে তুলি।’ গত মাস হইতে আশালতা রাত্রে প্রায়ই লুচি ভাজিয়া স্বামীকে খাওয়ায়। মাঝে মাঝে ভালো খাবার-দাবার করে। একদিন বলিল—ওগো, তোমার পায়ের দিকে একবার নজর দাও। এক জোড়া জুতো কিনো দিকি ভালো দেখে। জলে-জলে পা হেজে পাকুই ধরে গেল যে!

 একদিন সন্ধ্যার পর হরিপদ খাইতে বসিয়াছে, আশালতা তাহার জন্য দুধ গরম করিয়া আনিতে গিয়াছে। হঠাৎ হরিপদ লুচি চিবাইতে চিবাইতে বেকাদায় জিভ কামড়াইয়া ফেলিয়া যন্ত্রণায় বলিয়া উঠিল—উঃ—

 ঠিক সেই সময় আশালতা দুধের বাটি লইয়া আসিয়া বলিল— কি হ’ল গা? হরিপদ বাঁ হাত দিয়া গলাটা চাপিয়া ধরিয়া খানিকক্ষণ চুপ করিয়া মুখ বিকৃত করিয়া বসিয়া রহিল, কোন কথা বলিল না।

 আশালতা পুনরায় উদ্বেগের সুরে বলিল—কি হয়েছে, হ্যাঁগা? অমন করে আছ কেন? হরিপদ সঙ্গে সঙ্গে রুক্ষসুরে চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল—হবে আর কি, যেদিন থেকে তুমি অলখ্যি ঘরে ঢুকেচ, সেদিন থেকে এ সংসারের ভাষ্যি নেই। শুধু শুধু নইলে গরুর বাছুরটাই বা মরে যাবে কেন, আর—বলিয়া লুচির থালা হাতের ঠেলায় সজোরে দশ হাত তফাতে ছিটকাইয়া ফেলিয়া হরিপদ উঠিয়া ঘরের বাহিরে চলিয়া গেল।

 আশালতা দুধের বাটি-হাতে আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

 হরিপদ অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরিল। আসিয়া দেখিল, স্ত্রী বারান্দায় চুপ করিয়া বসিয়া আছে। জিবের ব্যথা কমিয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাহার মনে হইয়াছে—ছিঃ, অমন করে তখন বলাটা ভালো হয়নি—নাঃ, একটু বেশি বলা হয়ে গিয়েছে—তখন আর মাথার ঠিক ছিল না তো।—ছিঃ! ঘরে ঢুকিয়া স্ত্রীকে ওভাবে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া বলিল—‘নাও ওঠো, রাগ করেচ নাকি? খাওয়া-দাওয়া হয়েচে?’ আশালতা ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল, কোন কথা বলিল না।

 হরিপদ স্ত্রীর হাত ধরিয়া উঠাইতে গেল। আশালতা আঁচলে চোখ মুছিয়া বলিল, থাক্, বোসো এখানে, একটা কথা বলি।

 কি?

 দেখো, সে টাকা তুমি ফেরত দিয়ে এসো। যা খরচ হয়ে গিয়েছে, আমার চুড়ি ক’গাছা বন্ধক দিয়ে হোক, বেচে হোক, সেটা পুরিয়ে দাও গিয়ে। ওই টাকা যেদিন থেকে ঘরে ঢুকেচে, সেদিন থেকে সংসারের শান্তি চলে গিয়েচে, ও আর কিছুদিন থাকলে একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তুমি কাল যাও, টাকা ফেলে দিয়ে এসো গিয়ে।

 রাত্রিটা কাটিয়া গেলে হরিপদ দেখিল, প্রায় একশো টাকা আন্দাজ খরচ হইয়া গিয়াছে সেই টাকা হইতে। স্ত্রীর গহনা লইয়া সেদিনই সে কলিকাতা রওনা হইল এবং পোদ্দারের দোকানে বেচিয়া টাকাটা সংগ্রহ করিল। কোম্পানীর আপিসে গিয়া ভাবিল, কোনো ছুটো কেরানীর কাছে টাকাটা দেব না,—হিসেবের বাহিরের টাকা সে মেরে দেবে। সে একেবারে সরাসরি বড়বাবুর ঘরে গিয়া হাজির হইল।

 বড়বাবু বলিলেন, কি চাই?

 হরিপদ সব খুলিয়া বলিল। ঘরে আর কেহ ছিল না। বড়বাবু আশ্চর্য হইয়া গেলেন। এই টাকা লইয়া আপিসে যথেষ্ট গোলমাল হইয়া গিয়াছে। হরিপদ যাইবার দু’দিন পরে ভুল ধরা পড়ে। তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিবার যথেষ্ট চেষ্টা করা হইয়াছিল, কিন্তু পারা যায় নাই। যে কেরানী ভুল করিয়াছিল, তাহার মাহিনা হইতে প্রতি মাসে ত্রিশ টাকা করিয়া কাটিয়া লওয়া হইতেছে এবং পূজার বোনাস্ সে কখনো পাইবে না, এই বন্দোবস্ত হইয়াছিল।

 আজ দু’মাস আড়াই মাস পরে সেই পলাতক লোকটি টাকা ফেরত দিতে আসিয়াছে। ব্যাপারখানা কি? বড়বাবু এমন কাণ্ড কখনো তাঁহার বাহান্ন বছর বয়সে দেখেন নাই।

 জিজ্ঞাসা করিলেন, পুরো টাকাই দেবেন তো? নিয়ে এসেচেন সব? তা এতদিন আসেন নি কেন? হরিপদ বলিল, যখন টাকাটা এখান থেকে নিয়ে গেলুম, তখন বুঝতে পারিনি যে এত টাকা নিয়ে যাচ্ছি। ধরা পড়ল অনেক পরে বাড়ি গিয়ে। তারপর লোভ প্রবল হয়ে উঠল বড়বাবু, আমরা গরীব লোক, এতগুলো টাকার লোভ সামলানো সোজা কথা তো নয়!

 বড়বাবু বলিলেন—বেশ, টাকা দিয়ে যান।

 টাকা গুনিয়া দিয়া হরিপদ চলিয়া গেল। আপিসে ইতিমধ্যে অনেকেই কথাটা শুনিয়াছে, তাহারা বড়বাবুর কাছে কথাটা শুনিতে আসিল। এতদিন পরে টাকা ফেরত দিতে আসিল কি ব্যাপার?

 বড়বাবু মৃদু হাসিয়া বলিলেন—হুঁ-হুঁ—তোমরা তো জানো না। কোম্পানীর জন্যে কত খেটে মরি, নামও নেই এ আপিসে, যশও নেই। বাছাধন আজ এতকাল পরে এসেচেন বোধ হয় মাল বিক্রি করতে। ভেবেচেন এতদিনে আর চিনতে পারবে না। জিজ্ঞেস করলুম, আপনার নামটি কি? আপনি একবার জিনিস বেচতে এসে বেশি পেমেণ্ট নিয়ে গিয়েছিলেন না? আমি ওকে বিল সই করতে দেখেচি—চেহারা দেখেই ভাবলুম, এ ঠিক সেই লোক। যেমন বলেচি, বাছাধনের মুখটি চুন। বললুম, টাকা ফেলো, নইলে পুলিশে দেব। ব্যবসাদার লোক, পাওনা টাকা আদায় করেছিল বোধ হয়। সঙ্গে টাকাও ছিল, তা থেকে ভয়ে ভয়ে আমাদের টাকাটা বে’র করে দিলে। যাবে কোথায়? কত বড় ফাঁদে পা দিয়েছে, জানে না।

 বড়বাবুর জয় জয়কার পড়িয়া গেল।