জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ/কৈশোরের স্বপ্ন

কৈশোরের স্বপ্ন

 রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে নূতন কথা বলিবার দুরাকাঙ্ক্ষা আমার নাই। তবে জাতীয় জীবনের সন্ধিক্ষণে মহৎ লোকের কথা শুনিলে মনে আনন্দ হয়। আমি পুরাতন কথাই বলিব। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বলিতে গেলে অনেক কথাই মনে উদিত হয়। কারণ জীবিতকালে তাঁহাকে দেখিবার, তাঁহার সংস্পর্শে আসিবার সৌভাগ্য আমাদের হইয়াছে। একটি প্রবন্ধে তাঁহার কথা বলিয়া শেষ করা যায় না। সে চেষ্টা আমি করিব না। আমি শুধু তাঁহার সম্বন্ধে কতকগুলি প্রধান প্রধান ঘটনার উল্লেখ করিয়া জাতীয় আন্দোলনে তাঁহার মহৎ দানের দিগ্দর্শন করিতে চেষ্টা করিব।

 রবীন্দ্রনাথ যে যুগে জন্মগ্রহণ করেন, তাহাকে আধুনিক বাঙলার “সুবর্ণ যুগ” বলা যায়। এই রকম সময় বাঙলা দেশে খুব কমই দেখা গিয়াছে। উনবিংশ শতাব্দীতে দেশে নবজাগরণের সূচনা হইয়াছিল। তাহার মধ্যে যে সময় রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন, তখন সমস্ত দিক দিয়াই বাঙলা দেশের জাতীয় জীবনে একটা মহৎ সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হইয়াছিল। একদিকে সিপাহী-যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া, অন্যদিকে বহির্জগতের প্রভাব এই জাগরণের মূলে অশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল সন্দেহ নাই। ঊনবিংশ শতাব্দীর ষষ্ঠ দশকেই ম্যাটসিনি, গ্যারিবল্ডি ও কাভুরের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে ইটালী বহুকাল পরে অস্ট্রিয়ার দাসত্ব হইতে মুক্ত হইয়া স্বাধীনতা লাভ করিয়াছিল। এই সময়েই আমেরিকার ক্রীতদাসেরা মানবকল্যাণকামীদের আন্দোলনের ফলে মুক্তিলাভ করিয়াছিল এবং ক্রীতদাসপ্রথা চিরদিনের জন্য লোপ পাইয়াছিল। বহির্জগতের এই সব আন্দোলনের তরঙ্গ বাঙলা দেশের শিক্ষিত সমাজের মনের উপর আসিয়া প্রবলভাবে আঘাত করিয়াছিল। তাহার ফলে সাহিত্যের বিকাশ, জাতীয়তার আন্দোলন, সমাজ-সংস্কার ও ধর্ম-সংস্কারের আন্দোলন—জাতীয় জীবনের সমস্ত দিকেই তখন জাগরণের সাড়া পড়িয়া গিয়াছিল। বাঙলা দেশ সমস্ত ভারতবর্ষে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিল এবং সকল দিকেই অগ্রগামী ও পথপ্রদর্শক হইয়াছিল। একথা আমরা গর্ব করিয়া বলিতেছি না। ইহা খাঁটি সত্য কথা এবং কিছুদিন পূর্বেও সকলেই স্বীকার করিত। দুর্ভাগ্যক্রমে বর্তমানে কেহ কেহ উহাকে আমাদের বৃথা-গর্ব বলিয়া মনে করেন। প্রায় দুই বৎসর পূর্বে সিমলা-শৈলে একটি সভায় অন্যতম কংগ্রেসনেতা শ্রীযুক্ত ভুলাভাই দেশাই বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, “১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর আবির্ভাবের পর হইতে ভারতবর্ষে সত্যকার স্বাধীনতা আন্দোলনের উদ্ভব হয়।” তৎপূর্বে বাঙলা দেশে যে স্বাধীনতা আন্দোলন হইয়াছে অথবা বাঙলা সাহিত্যে কেহ যে স্বাধীনতার কথা বলিয়াছেন, তাহা তিনি স্বীকার করেন নাই। শ্রীযুক্ত ভুলাভাই দেশাই-এর মত একজন ভারতবিখ্যাত নেতার যে এইরূপ অজ্ঞতা থাকিতে ও ভ্রান্ত ধারণা হইতে পারে, ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হইতেই জাতীয় আন্দোলনের ভাবধারা, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বাঙলা সাহিত্যকে প্লাবিত করিয়াছিল। তখনকার অনেক বিশ্রুতকীর্তি কবি, মনীষী ও সাহিত্যিক বাঙলার জাতীয় জীবনের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া আছেন।

 সিপাহী-যুদ্ধের পর দেশে যে একটা নূতন ভাবের সঞ্চার হইয়াছিল, বাঙলা দেশের কবি ও সাহিত্যিকদের মনেই তাহা সর্বপ্রথম প্রতিধ্বনি তুলিয়াছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমর কাব্য ‘মেঘনাদবধ’ কেবল মিত্রাক্ষর ছন্দের শৃঙ্খল ভঙ্গ করিয়া বিদ্রোহের পরিচয় দেয় নাই, ঐ কাব্যের আগাগোড়া স্বাধীনতার একটা দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে। এই সময়েই কবি রঙ্গলাল তাঁহার ‘পদ্মিনী” কাব্যে তূর্যধ্বনি করিয়াছেন,—

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে,
কে বাঁচিতে চায়,
দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় রে
কে পরিবে পায়।

* * * *

দিনেকের স্বাধীনতা স্বর্গসুখ তায় রে,
স্বর্গসুখ তায়।

 দীনবন্ধু মিত্রেরনীলদর্পণ’ নাটক এই সময়েই বিদেশী অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তীব্রকণ্ঠে বিদ্রোহধ্বনি তুলিয়াছিল।

 এইরূপ যুগসন্ধিক্ষণে ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ‘জীবন-স্মৃতি’তে বলিয়াছেন,—তিনি যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, সে পরিবারে পূর্ব হইতে স্বদেশী ও জাতীয় ভাব প্রবল ছিল। তাঁহার পিতা ও সহোদরগণ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রমুখ বিশ্রুতকীর্তি পুরুষদের দানে জাতীয় জীবনের নানা দিক পুষ্ট হইয়াছে। বিশেষত, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রবর্তিত ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ যে স্বদেশী ভাব প্রচারের যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। এইরূপ পরিবারের মধ্যে জন্মগ্রহণ করা তাঁহার পক্ষে সৌভাগ্যের বিষয় হইয়াছিল।

 রবীন্দ্রনাথের শৈশবে “হিন্দু মেলা”র সৃষ্টি হয়। কংগ্রেসের জন্মের ১৮ বৎসর পূর্বে ১৮৬৭ সালে “হিন্দু মেলা”র সূচনা। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত প্রতি বৎসর এই মেলা হইত। তখনকার দিনে দেশের যত জ্ঞানী, গুণী, চিন্তানায়ক, কবি, সাহিত্যিক প্রভৃতি ছিলেন, তাঁহারা প্রায় সকলেই “হিন্দু মেলা”য় যোগ দিয়াছিলেন। উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য— গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি মনোমোহন বসু, শিশিরকুমার ঘোষ, নবগোপাল মিত্র প্রভৃতি।

 জাতীয় ভাবের বক্তৃতা, জাতীয় সংগীত প্রভৃতির দ্বারা এই হিন্দু মেলায় দেশবাসীর চিত্তে স্বদেশপ্রেমের উদ্বোধন করিবার চেষ্টা হইত। স্বদেশী শিল্পের পুনরুদ্ধারের আয়োজনও এই মেলাতেই সর্বপ্রথম হইয়াছিল। হিন্দু মেলায় যে জাতীয় আন্দোলনের সূচনা হইয়াছিল, তাহার মধ্যে আমরা কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখিতে পাই। প্রথমত, হিন্দু মেলার উদ্যোক্তারা অখণ্ড ভারত ও এক ভারতীয় মহাজাতি গঠনের স্বপ্নই দেখিয়াছিলেন, কেবল বাঙলা ও বাঙালীর কথা ভাবেন নাই। ইহার পূর্বে ভারতবর্ষের কোন প্রদেশে কেহ অখণ্ড ভারত ও ভারতীয় মহাজাতির কথা বলেন নাই। এ গৌরব বাঙলারই প্রাপ্য এবং হিন্দু মেলার উদ্যোক্তাদের নিকটই সমগ্র দেশ এজন্য ঋণী। রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ‘জীবনস্মৃতি’তে এবং অবনীন্দ্রনাথ তাঁহার ‘ঘরোয়া’তে একথা স্পষ্টভাবেই বলিয়াছেন। যাঁহারা বলেন, কংগ্রেসই ‘ভারতীয় মহাজাতি’র কথা প্রথম বলিয়াছেন, তাঁহারা ভুল বলেন, কংগ্রেসের পূর্ববর্তী বাঙলার আর একটি প্রতিষ্ঠান ‘ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ও এই ভাব প্রচার করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাহাও হিন্দু মেলার পরে এবং ‘ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ যে হিন্দু মেলার নিকট হইতেই এই ভাব গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। হিন্দু মেলা প্রবর্তনের ৯ বৎসর পরে ১৮৭৬ সালে ‘ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রতিষ্ঠা হয়। (শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘আত্মচরিত’ দ্রষ্টব্য)।

 হিন্দু মেলার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ইহার অনুষ্ঠাতারা ‘আত্মশক্তি’র বলেই দেশের স্বাধীনতা লাভ করিতে চাহিয়াছিলেন, আবেদন-নিবেদনের পথে নয়।

 তৃতীয়ত, দেশের দারিদ্র্য দূর করিতে হইলে যে স্বদেশী শিল্পের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের প্রয়োজন, হিন্দু মেলায় এই ভাবও সর্বাগ্রে হাতে-কলমে প্রচার করা হইয়াছিল।

 হিন্দু মেলাতেই সর্বপ্রথম ‘জাতীয় সংগীত’ রচিত ও গীত হইয়াছিল। গণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘লজ্জায় ভারত-যশ গাহিব কি করে’, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি’, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মিলে সব ভারত সন্তান’, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর ‘না জাগিলে সব ভারত-ললনা, এ ভারত আর জাগে না, জাগে না’, কবি মনোমোহন বসুর ‘দিনের দিন সবে দীন’ প্রভৃতি বিখ্যাত জাতীয় সংগীত এই হিন্দু মেলাতেই গীত হইয়াছিল। কবি মনোমোহনের গানে দেশের অর্থ নৈতিক দুর্গতি এবং স্বদেশী শিল্পের পুনরুদ্ধারের বার্তা ওজস্বিনী ভাষায় প্রকাশ করা হইয়াছিল—

দিনের দিন সবে দীন
ভারত হয়ে পরাধীন।
অন্নাভাবে শীর্ণ চিন্তাজ্বরে জীর্ণ
অনশনে তনু ক্ষীণ।

* * *

আজ যদি এ রাজ্য ছাড়ে তুঙ্গরাজ
কলের বসন বিনে কিসে রবে লাজ,
ধরবে কি লোকে তবে দিগম্বরের সাজ
বাকল টেনা ডোর্ কপিন্

ছুঁইসূতো পর্যন্ত আসে তুঙ্গ হতে,
দীয়াশলাই কাটি তাও আসে পোতে;
প্রদীপটি জ্বালিতে খেতে শুতে যেতে
কিছুতেই লোক নয় স্বাধীন।

ইত্যাদি।

সত্যেন্দ্রনাথের রচিত ‘জাতীয় সংগীত’ জাতীয় জীবনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হইয়া থাকিবে। বস্তুত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন-অধিনায়ক’ ব্যতীত এমন উদ্দীপক জাতীয় সংগীত বাঙলা ভাষায় আর রচিত হয় নাই:—

মিলে সব ভারত সন্তান
এক তান মনঃপ্রাণ;
গাও ভারতের যশোগান।
ভারত ভূমির তুল্য আছে কোন স্থান?
কোন অদ্রি হিমাদ্রি সমান?
ফলবতী বসুমতী, স্রোতস্বতী পুণ্যবতী,
শতখনি রত্নের নিধান,
হোক ভারতের জয়,
জয় ভারতের জয়,
গাও ভারতের জয়,

কি ভয় কি ভয়,
গাও ভারতের জয়।

* * *

কেন ডর, ভীরু, কর সাহস আশ্রয়,
যতো ধর্ম স্ততো জয়।
ছিন্ন ভিন্ন হীনবল ঐক্যেতে পাইবে বল,
মায়ের মুখ উজ্জ্বল করিতে কি ভয়?
হোক ভারতের জয়,
জয় ভারতের জয়,
গাও ভারতের জয়,
কি ভয় কি ভয়,
গাও ভারতের জয়।

 বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শনে’ এই মহান জাতীয় সংগীতের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়া লিখিয়াছিলেন,—

 “এই মহাগীত ভারতের সর্বত্র গীত হউক! হিমালয় কন্দরে প্রতিধ্বনিত হউক! গঙ্গা যমুনা সিন্ধু নর্মদা গোদাবরী তটে বৃক্ষে বৃক্ষে মর্মরিত হউক! পূর্ব-পশ্চিম সাগরের গম্ভীর গর্জনে মন্দ্রীভূত হউক! এই বিংশতি কোটি ভারতবাসীর হৃদয়যন্ত্র ইহার সঙ্গে বাজিতে থাকুক!” (বঙ্গদর্শন, চৈত্র, ১২৭৯)।

 হিন্দু মেলার উদ্যোক্তাদের মধ্যে দুইজনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য—রাজনারায়ণ বসুনবগোপাল মিত্ররাজনারায়ণ বসুর কল্পনা এবং নবগোপাল মিত্রের উৎসাহ ও কার্যকরী শক্তিই এই হিন্দু মেলার সাফল্যের প্রধান কারণস্বরূপ হইয়াছিল। রাজনারায়ণ বসুর প্রগাঢ় স্বদেশপ্রেমের তুলনা মিলে না। হিন্দু মেলায় জাতীয় ভাব সঞ্চারের মূলে ছিলেন তিনি। তাঁহার ‘হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা’, ‘সেকাল আর একাল’ প্রভৃতি কয়েকটি প্রসিদ্ধ বক্তৃতা তিনি “জাতীয় সভা”তেই দিয়াছিলেন।

 নবগোপাল মিত্র ছিলেন আগাগোড়া জাতীয়ভাবে ভরপুর, লোকে তাঁহার নামই দিয়াছেন ‘ন্যাশনাল নবগোপাল’। জাতীয়ভাব প্রচারের জন্য ‘ন্যাশনাল পেপার’ নামে তিনি একখানি সংবাদপত্র প্রকাশ করিয়াছিলেন। হিন্দু মেলার জন্য তিনি সর্বস্ব পণ করিয়াছিলেন বলিলেই হয়। তিনি তখনকার দিনে একজন ধনীলোক ছিলেন, কিন্তু এই হিন্দু মেলা ও ‘ন্যাশনাল পেপার’ প্রভৃতির জন্য বহু অর্থব্যয় করিয়া অবশেষে ঋণগ্রস্ত হইয়াছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার জীবন-স্মৃতিতে লিখিয়াছিলেন,—“নবগোপাল মিত্র মহাশয়ের উদ্যোগে ও গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের আনুকূল্যে ও উৎসাহে হিন্দু মেলা প্রতিষ্ঠিত হইল। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক মহাশয়েরা হইলেন মেলার পৃষ্ঠপোষক। শ্রীযুত শিশিরকুমার ঘোষমনোমোহন বসুও এই মেলায় খুব উৎসাহী হইলেন। এই হিন্দু মেলাতেই বঙ্গদেশে, যদি সমগ্র ভারতবর্ষে নাও হয়, সর্বপ্রথম জাতীয় শিল্প প্রদর্শনীর পত্তন হইল। ঐ মেলায় তখন কৃষি, চিত্র, শিল্প, ভাস্কর্য স্ত্রীলোকদের সূচী ও কারুকার্য, দেশীয় ক্রীড়াকৌতুক, ব্যায়াম প্রভৃতি জাতীয় সমস্ত বিষয়ই প্রদর্শিত হইত। এই মেলা উপলক্ষে কবিতা প্রবন্ধাদিও পঠিত হইত।”

 নবগোপাল মিত্রের কথায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলিয়াছেন, তিনি দেখা হইলেই, জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে উত্তেজনাপূর্ণ জাতীয় ভাবের কবিতা লিখিতে অনুরোধ করিতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সে অনুরোধ পালনও করিয়াছিলেন। হিন্দু মেলা বন্ধ হইবার পর বৃদ্ধকালে নবগোপালবাবু “কতকগুলি মড়াখেগো” ঘোড়া লইয়া একটি দেশী সার্কাসের দলও গঠন করিয়াছিলেন। ইহাই বাঙালীর প্রথম সার্কাস। মোট কথা, সর্ববিধ জাতীয় অনুষ্ঠানে নবগোপালবাবুর মহা উৎসাহ ছিল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, জাতীয়ভাবের অন্যতম প্রধান উদ্গাতা এই মহাপ্রাণ ব্যক্তিকে বাঙালী জাতি স্মরণ করিয়া রাখে নাই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ক্ষোভের সঙ্গে বলিয়াছেন,—“তিনি এত করিলেন, অথচ এখন তাঁহার নামও কেহ করে না। ইহা বড়ই আক্ষেপের বিষয়। এদেশে তাঁহার ন্যায় স্বদেশানুরাগী নীরব কর্মবীরের একটা স্থায়ী স্মৃতিচিহ্ন থাকা নিতান্ত আবশ্যক।”

 জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজেও এই হিন্দু মেলার একজন প্রধান উৎসাহী কর্মী ছিলেন। তরুণ বয়স হইতেই তাঁহার প্রাণে জ্বলন্ত স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হইয়াছিল। দেশবাসীর মধ্যে নানাভাবে জাতীয়ভাব প্রচারের তিনি চেষ্টা করিতেন এবং সেজন্য লোকলজ্জা, মান, সম্ভ্রম প্রভৃতি উপেক্ষা করিতেও তিনি দ্বিধা করিতেন না। সমগ্র ভারতের জন্য একটা “সার্বজনীন জাতীয় পরিচ্ছদ”-এর পরিকল্পনা তিনিই প্রথম করেন এবং সেই অদ্ভুত পোষাক পরিয়া দিবা দ্বিপ্রহরে রাস্তায় বাহির হইতেও তিনি লজ্জাবোধ করেন নাই। (রবীন্দ্রনাথ—‘জীবন-স্মৃতি’)। স্ত্রীস্বাধীনতার দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের জন্য সেই সনাতনী রক্ষণশীল যুগে লোকনিন্দা অগ্রাহ্য করিয়া তিনি সস্ত্রীক ঘোড়ায় চড়িয়া জোড়াসাঁকোর বাড়ি হইতে গড়ের মাঠ পর্যন্ত বেড়াইতে যাইতেন। (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ—‘জীবন-স্মৃতি’)। স্বদেশী শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসারের জন্য তিনি বহু অর্থ ব্যয় করিয়া ঋণগ্রস্ত হইয়াছিলেন। বাঙলা ভাষায় জাতীয় ভাবোদ্দীপক নাটক ‘পুরু-বিক্রম’ ও ‘সরোজিনী’ তিনিই প্রথম রচনা করেন। এই দুই নাটক তখনকার দিনে রঙ্গমঞ্চে মহাসমারোহে অভিনীত হইয়াছিল। ‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ, পরাণ সঁপিবে বিধবা বালা’—এই বিখ্যাত গানটি ‘সরোজিনী’ নাটকে তরুণবয়স্ক রবীন্দ্রনাথ সংযোগ করিয়া দিয়াছিলেন। (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ—‘জীবন-স্মৃতি’)। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রচিত বিখ্যাত জাতীয় সংগীত ‘চলরে চল্ সবে ভারত-সন্তান মাতৃভূমি করে আহ্বান’ বাঙলা সাহিত্যে অমর হইয়া আছে। গিরিশচন্দ্র ঘোষের আগমনের পূর্বে নাট্যকার হিসাবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। সংগীতকলাতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের যে অসাধারণ প্রতিভা ছিল, তাহা সুবিদিত। কবিতা ও সংগীত রচনায় অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নিকটেই রবীন্দ্রনাথের হাতেখড়ি হইয়াছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাহচর্যে ও দৃষ্টান্তে রবীন্দ্রনাথের মনে জাতীয়ভাবের সঞ্চার হইয়াছিল, একথা নিঃসংশয়ে বলা যাইতে পারে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মত বাঙলা সাহিত্যের এমন অক্লান্ত সেবক বিরল। শেষ বয়স পর্যন্ত সংস্কৃত নাটক ও ফরাসী গ্রন্থের অনুবাদ করিয়া তিনি বাঙলা সাহিত্যের পরিপুষ্টি করিয়া গিয়াছেন। এই বহুমুখী প্রতিভাশালী ব্যক্তি বাঙলার জাতীয় জীবন ও সাহিত্যে অমর হইয়া থাকিবেন।

 কিশোর বয়সেই রবীন্দ্রনাথ অগ্রজদের সঙ্গে হিন্দু মেলায় যান। ১৮৭৫ সালে (রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ১৪ বৎসর), হিন্দু মেলায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা (“হিন্দুমেলার উপহার”) পঠিত হয়। ১৮৭৭ সালে হিন্দু মেলায় তিনি আর একটী জাতীয় ভাবোদ্দীপক কবিতা পাঠ করেন। এই। সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ‘জীবন-স্মৃতি’তে লিখিয়াছেন,—

 “লর্ড কার্জনের সময় দিল্লী দরবার সম্বন্ধে একটা গদ্য প্রবন্ধ লিখিয়াছি—লর্ড লিটনের সময় লিখিয়াছিলাম পদ্যে। তখনকার ইংরেজ গভর্মেণ্ট রুশিয়াকেই ভয় করিত, কিন্তু চোদ্দ পনের বছর বয়সের বালক কবির লেখনীকে ভয় করিত না। এই জন্য সেই কাব্যে বয়সোচিত উত্তেজনা প্রভূত পরিমাণ থাকা সত্ত্বেও তখনকার প্রধান সেনাপতি হইতে আরম্ভ করিয়া পুলিসের কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত কেহ বিচলিত হইবার লক্ষণ প্রকাশ করেন নাই। ......সেটা পড়িয়াছিলাম হিন্দু মেলায় গাছের তলায় দাঁড়াইয়া। শ্রোতাদের মধ্যে নবীন সেন মহাশয় উপস্থিত ছিলেন।”

 শ্রীযুক্ত সজনীকান্ত দাসব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই কবিতাটিই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘স্বপ্নময়ী নাটকে’ “দেখিছ না অয়ি ভারত-সাগর” শীর্ষক কবিতা বলিয়া প্রমাণ করিয়াছেন।

 এই সময়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এবং বৃদ্ধ রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে একটি ‘স্বাদেশিক সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিশোর রবীন্দ্রনাথ ইহার একজন সভ্য ছিলেন। হিন্দু মেলার ন্যায় এই ‘স্বাদেশিক সভা’ও রবীন্দ্রনাথের মনের উপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। এই সভা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ‘জীবন-স্মৃতি’তে লিখিয়াছেন,—

 “কলিকাতার এক গলির মধ্যে এক পোড়ো বাড়িতে এই সভা বসিত। সেই সভার সমস্ত অনুষ্ঠান রহস্যে আবৃত ছিল। বস্তুত তাহার মধ্যে ঐ গোপনীয়তাটাই একমাত্র ভয়ঙ্কর ছিল। আমাদের ব্যবহারে রাজার বা প্রজার ভয়ের বিষয় কিছু ছিল না। আমরা মধ্যাহ্নে কোথায় কি করিতে যাইতেছি তাহা আমাদের আত্মীয়রাও জানিতেন না। দ্বার আমাদের রুদ্ধ, ঘর আমাদের অন্ধকার, দীক্ষা আমাদের ঋক্‌মন্ত্রে, কথা আমাদের চুপিচুপি—ইহাতেই সকলের রোমহর্ষণ হইত, আর বেশী কিছুই প্রয়োজন ছিল না। আমার মত অর্বাচীনও এই সভার সভ্য ছিল। সেই সভায় আমরা এমন একটি ক্ষ্যাপামির তপ্ত হাওয়ার মধ্যে ছিলাম যে অহরহ উৎসাহে যেন আমরা উড়িয়া চলিতাম। লজ্জা ভয় সংকোচ আমাদের কিছুই ছিল না। এই সভায় আমাদের প্রধান কাজ উত্তেজনার আগুন পোহানো। বীরত্ব জিনিসটা কোথাও বা অসুবিধাকর হইতে পারে, কিন্তু ওটার প্রতি মানুষের একটা গভীর শ্রদ্ধা আছে। সেই শ্রদ্ধাকে জাগাইয়া রাখিবার জন্য সকল দেশের সাহিত্যেই প্রচুর আয়োজন দেখিতে পাই। কাজেই যে অবস্থাতেই মানুষ থাক্ না, মনের মধ্যে ইহার ধাক্কা না লাগিয়া তো নিষ্কৃতি নাই। আমরা সভা করিয়া, কল্পনা করিয়া, বাক্যালাপ করিয়া, গান গাহিয়া সেই ধাক্কাটা সামলাইবার চেষ্টা করিয়াছি।”

 এই সভার কোন সুনির্দিষ্ট কার্যপ্রণালী ছিল না। দল বাঁধিয়া শিকারে যাওয়া, বাগান-বাড়িতে জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে চড়ুইভাতি করা, ঝড়ের মধ্যে গঙ্গার ধারে দাঁড়াইয়া সকলে মিলিয়া চীৎকার করিয়া জাতীয় সংগীত গান করা প্রভৃতি যখন যাহা খেয়াল হইত, তাহাই সদস্যেরা করিতেন। স্বদেশী দেশলাইয়ের কারখানা, কাপড়ের কল তৈয়ারি প্রভৃতিও তাঁহাদের পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সভার সভাপতি রাজনারায়ণবাবু সদস্যদের পিতামহের বয়সী হইলেও, তাঁহার মনটা শিশুর মতই সরল ছিল, আনন্দে ও উৎসাহে তিনি কিশোর সদস্যদের চেয়ে কোন অংশে কম ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ‘জীবন-স্মৃতি’তে অমর তুলিকায় রাজনারায়ণ বসুর যে চিত্র অঙ্কিত করিয়া গিয়াছেন, তাহা চিরদিন উজ্জ্বল হইয়া থাকিবে। তখনকার দিনে বাঙলার জাতীয়তাবাদীদের স্বাধীনতার স্বপ্ন রাজনারায়ণ বসুর লেখনীমুখেই ব্যক্ত হইয়াছিল,—“আমি দেখিতেছি আমার সম্মুখে মহাবলপরাক্রান্ত হিন্দুজাতি নিদ্রা হইতে উত্থিত হইয়া বীরকুণ্ডল পুনরায় স্পন্দন করিতেছে এবং দেববিক্রমে উন্নতির পথে ধাবিত হইতে প্রবৃত্ত হইতেছে। আমি দেখিতেছি যে, এই জাতি পুনরায় নবযৌবনান্বিত হইয়া পুনরায় জ্ঞান, ধর্ম ও সভ্যতাতে উজ্জ্বল হইয়া পৃথিবীকে সুশোভিত করিতেছে; হিন্দুজাতির কীর্তি, হিন্দু জাতির গরিমা পৃথিবীময় পুনরায় বিস্তারিত হইতেছে। এই আশাপূর্ণ হৃদয়ে ভারতের জয়োচ্চারণ * * * করিতেছি।”

 এইরূপে অনুকূল পরিবেশের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের কৈশোর জীবন আরম্ভ হইল। ঘরে-বাহিরে সর্বত্র জাতীয় ভাবের সংস্পর্শে আসিবার সুযোগ তিনি লাভ করিলেন। বাঙলার আকাশে-বাতাসে তখন যে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয় ভাবের আগমনবার্তা ঘোষিত হইতেছিল, কিশোর রবীন্দ্রনাথের জীবনে তাহারই মধ্যে স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তা মুকুলিত হইয়া উঠিল।