জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ/স্বদেশী আন্দোলন

8

স্বদেশী আন্দোলন

 স্বদেশী আন্দোলন বাঙলার তথা ভারতের ইতিহাসে অপূর্ব ঘটনা। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন কলমের খোঁচায় বাঙলা দেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। ফলে তাহার বিরুদ্ধে বাঙালী জাতির মধ্যে প্রবল আন্দোলন আরম্ভ হয় এবং সমগ্র ভারতবর্ষে সে আন্দোলন ছড়াইয়া পড়ে। কিন্তু লর্ড কার্জন বাঙলা দেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়াছিলেন বলিয়াই যে স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হইয়াছিল, নচেৎ হইত না, একথা আমি মনে করি না; ইতিহাসও সেরূপ সাক্ষ্য দেয় না। দীর্ঘকাল ধরিয়া বাঙালী জাতি স্বাধীনতার তপস্যায় হোমাগ্নির যে সমিধ সঞ্চয় করিয়াছিল, এই বঙ্গভঙ্গকে উপলক্ষ্য করিয়া তাহাই আজ পূর্ণবেগে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। বহুকালের জাতীয় অপমান ও নির্যাতনের ফলে জাতির চিত্তে যে রুদ্ধ আবেগ সঞ্চিত হইতেছিল, বঙ্গভঙ্গের আঘাতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুচ্ছ্বাসের মত তাহাই আজ প্রচণ্ড বেগে বাহির হইয়া আসিল এবং দেশব্যাপী বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করিল। নদীর বাঁধ ভাঙিয়া গেলে জোয়ারের জল যেমন প্রচণ্ড বেগে বাহির হইয়া আসে, এ যেন অনেকটা সেইরূপ। আমার বিশ্বাস লর্ড কার্জন যদি বঙ্গভঙ্গ নাও করিতেন, তথাপি অন্য কোন একটা ঘটনাকে উপলক্ষ্য করিয়া স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হইত। মানুষের জীবনেও দেখা যায়, কোন একটা আকস্মিক ঘটনাকে উপলক্ষ্য করিয়াই দীর্ঘকালের প্রতীক্ষিত বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হয়। বাঙালী জাতি যখন দেখিল, তাহাদের জাতীয় সংহতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ভাষা, সাহিত্য সমস্তই বিপর্যস্ত হইতে চলিয়াছে, তখন তাহাদের অবরুদ্ধ শক্তি প্রচণ্ড বিক্ষোভে প্রকাশিত হইয়া পড়িল। ইতিহাসে এরূপ ঘটনা বিরল নহে। গত মহাযুদ্ধের সময় সার্ভিয়ার একজন লোক অস্ট্রিয়ার প্রিন্সকে হত্যা করিয়াছিল; এই ঘটনাকে উপলক্ষ্য করিয়াই বিশ্বব্যাপী সমরানল প্রজ্বলিত হইয়াছিল। অস্ট্রিয়ার প্রিন্সকে হত্যা না করিলে সেই সমরানল প্রজ্বলিত হইত না, এমন কথা কে বলিবে?

 আমরা পূর্বেই বলিয়াছি ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলা দেশে জাতীয় আন্দোলনের দুইটি ধারা স্বতন্ত্রভাবে প্রবাহিত হইয়া আসিতেছিল। একটি ছিল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা। রাজা রামমোহন রায়ের সময় হইতে কংগ্রেসের জন্ম পর্যন্ত এই ধারা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। কংগ্রেস ইহারই উত্তরাধিকারী হইয়াছিল। বাঙলা দেশের নেতারাই কংগ্রেসের জন্ম হইতে উহাতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন। কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি বাঙালী ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, বৈকুণ্ঠনাথ সেন, অম্বিকাচরণ মজুমদার, যাত্রামোহন সেন, আনন্দচন্দ্র রায়, কৃষ্ণকুমার মিত্র, কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ প্রভৃতি কংগ্রেসের স্তম্ভস্বরূপ ছিলেন। যখন বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হইল তখন বাঙলার এই সব কংগ্রেস নেতারাই সর্বাগ্রে উহার পুরোভাগে আসিয়া দাঁড়াইলেন। বাঙলার সর্বত্র সভাসমিতি বক্তৃতা করিয়া জাতিকে সজাগ করিয়া তুলিলেন। বঙ্গভঙ্গ বাতিল করিবার জন্য তাঁহারা ব্রিটিশ গভর্মেণ্টের নিকট তীব্র প্রতিবাদপত্র প্রেরণ করিতে লাগিলেন।

 কিন্তু ইতিমধ্যে দেশে আর একদল নেতার আবির্ভাব হইয়াছিল। ইহারা নিয়মতান্ত্রিকতা বা ভিক্ষা-নীতির বিরোধী —আত্মশক্তির সাধক এবং বঙ্কিম-বিবেকানন্দ প্রভৃতি বাঙলার সাহিত্যিক ও মনীষীদের ভাবধারার উত্তরাধিকারী। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই ধারার একজন অগ্রগামী পথিক। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল প্রভৃতিও ছিলেন তাঁহারই সহযাত্রী। যখন স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হইল, তখন এই আত্মশক্তির সাধকেরাও সেই আন্দোলনের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইলেন। এই নবীন দল বলিলেন, ও সব আবেদনে কিছু কাজ হইবে না, আমাদের জাতীয় শক্তির সাধনা করিতে হইবে ও তাহার পরিচয় দিতে হইবে, তবেই ইংরেজ কেবল বঙ্গভঙ্গ বাতিল করিতে বাধ্য হইবে। রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে অর্থনৈতিক সংগ্রাম চালনাও এই নূতন দলের নেতাদেরই পরিকল্পনা। একদিকে আমাদের স্বদেশী শিল্পের পুনরুদ্ধার ও প্রচার, অন্যদিকে বিদেশী শিল্প বর্জন বা বয়কট—অর্থনৈতিক সংগ্রামের এই দুইটি উপায় তাঁহারা নির্দেশ করিলেন। সরকারী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বর্জন এবং জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাও এই নূতন রাজনৈতিক সংগ্রামের আর একটি অস্ত্র বলিয়া গণ্য হইল।

 নূতন দলের শক্তিশালী নেতা ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এই সময়ে ‘সন্ধ্যা’ নামক বিখ্যাত দৈনিকপত্র প্রকাশ করিয়া এই সমস্ত কথা জোরের সঙ্গে প্রচার করিতে লাগিলেন। তাঁহার সঙ্গে আরও অনেক শক্তিমান ব্যক্তি আসিয়া যোগ দিলেন, যথা—শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন গুহ ঠাকুরতা প্রভৃতি। বিপিনচন্দ্র পালও তাঁহার ‘নিউ ইণ্ডিয়া’ পত্রে জ্বালাময়ী ভাষায় নূতন দলের মত প্রচার করিতে লাগিলেন। Passive Resistance বা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের নীতি রাজনৈতিক সংগ্রামের পন্থা হিসাবে বিপিনচন্দ্রই প্রথমে ‘নিউ ইণ্ডিয়া' পত্রে প্রচার করিতে আরম্ভ করেন। ইহার অব্যবহিত পরে মহাত্মা গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘সত্যাগ্রহ’ নীতি অবলম্বন করেন। বিপিনচন্দ্রের ‘নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ’ যে মহাত্মা গান্ধীর ‘সত্যাগ্রহে’র উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। কংগ্রেসের নিয়মতন্ত্রবাদীরা ভারতের জন্য তখন ‘ডোমিনিয়ান স্টেটাস’ বা ‘ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন’ চাহিতেন। বহু বৎসর পর্যন্ত—মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্ব আরম্ভ হইবার পরেও, কংগ্রেসের এই ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের বেশী কিছু দাবী করে নাই। কিন্তু বিপিনচন্দ্র সেই স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা হইতেই জাতির পক্ষ হইতে ‘নিউ ইণ্ডিয়া’ পত্রে জোরের সঙ্গে Full Autonomy বা পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যের দাবী প্রচার করিতে লাগিলেন। নূতন দলের মতবাদ এইভাবে দ্রুত গড়িয়া উঠিতে লাগিল, দেশের যুবকেরা তাহাতে সাড়া দিতে লাগিল।

 এই সময়ে সর্বপ্রধান স্মরণীয় ঘটনা বাঙলার রাজনীতিক্ষেত্রে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষের যোগদান। এই অসাধারণ শক্তিশালী পুরুষ যেন যাদুমন্ত্রবলে বাঙলার রাজনৈতিক-ক্ষেত্রে যুগান্তর সৃষ্টি করিলেন। ব্রহ্মবান্ধব ও বিপিনচন্দ্রের নেতৃত্বে যে নূতন শক্তি দেশের মধ্যে জাগিয়া উঠিয়াছিল, শ্রীঅরবিন্দ অত্যন্ত সহজভাবেই তাহার নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন। নূতন দল প্রতিষ্ঠিত হইল—নব জাতীয়তা আন্দোলনের সৃষ্টি হইল। শ্রীঅরবিন্দের সম্পাদনায় ইংরেজী দৈনিক পত্র ‘বন্দে মাতরম্’ নবীন দলের মুখপত্ররূপে এই নব জাতীয়তা আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করিতে লাগিল। সে আন্দোলন আর বাঙলা দেশে সীমাবদ্ধ থাকিল না—দেখিতে দেখিতে উহা ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও ছড়াইয়া পড়িল। মহারাষ্ট্রের লোকমান্য তিলক, পাঞ্জাবকেশরী লালা লাজপত রায়, মধ্যপ্রদেশের ডাঃ মুঞ্জে এই নব জাতীয়তা আন্দোলনের পতাকা দৃঢ়মুষ্টিতে ধারণ করিলেন। বিপিনচন্দ্র দাবী করিয়াছিলেন Full Autonomy বা পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য্। শ্রীঅরবিন্দ আরও স্পষ্টভাবে জাতির পক্ষ হইতে দাবী করিলেন—Independence বা স্বাধীনতা। সে স্বাধীনতা যে ভিক্ষার পথে লাভ হইবে না, তাহার জন্য আত্মশক্তির সাধনা করিতে হইবে, ইহাও তিনি নির্ভীকভাবে জাতির নিকট প্রচার করিলেন। এই সম্পর্কে ‘বন্দে মাতরম্’-এর‘Crime of Nationalism’ প্রবন্ধ বাঙলার জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে অমর হইয়া রহিয়াছে।

 একটু অনুধাবন করিলেই বুঝা যায় যে, শ্রীঅরবিন্দ–বিপিনচন্দ্র-ব্রহ্মবান্ধবের প্রচারিত এই নব জাতীয়তাবাদ বঙ্কিমচন্দ্রের আদর্শ ও ভাবধারার দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হইয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর ১২ বৎসর পরে স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হয়। তাঁহার প্রচারিত আদর্শ ও ভাবধারা এই আন্দোলনের মধ্যে মূর্তি পরিগ্রহ করিল। বঙ্কিমচন্দ্র দেশমাতৃকার যে চিন্ময়ী রূপ ধ্যান করিয়াছিলেন, শ্রীঅরবিন্দ প্রমুখ নব জাতীয়তাবাদীরা সেই রূপই যেন প্রত্যক্ষ করিলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের উপদিষ্ট আত্মোৎসর্গ, কর্মযোগ ও শক্তির সাধনাকেই তাঁহারা স্বাধীনতালাভের পন্থা বলিয়া গ্রহণ করিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের “বন্দে মাতরম্” সংগীত জাতীয় সংগীত বলিয়া গৃহীত হইল, “বন্দে মাতরম্” শব্দ দেশসেবক সন্তানদের ‘মন্ত্র’ বলিয়া গণ্য হইল। শ্রীঅরবিন্দ এই “বন্দে মাতরম্” মন্ত্রের যে অপূর্ব ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা সকলেরই সুবিদিত; তিনিই প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্রকে “বন্দে মাতরম্” মন্ত্রের ঋষি বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন এবং সমগ্র ভারত আজ সেইভাবেই বঙ্কিমচন্দ্রকে দেখিয়া থাকে।

 নব জাতীয়তাবাদীরা বঙ্কিমচন্দ্রের ভাবে কতদূর অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন, তাহার অসংখ্য দৃষ্টান্তের মধ্যে মাত্র দুইটি দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করিতেছি। প্রথম “বন্দে মাতরম্ সম্প্রদায়”। উত্তর কলিকাতার দেশভক্ত শিক্ষিত যুবকেরা এই সম্প্রদায় গঠন করিয়াছিলেন। এই সম্প্রদায় রাজপথে “বন্দে মাতরম্” গান গাহিয়া জাতীয় ভাণ্ডারের জন্য অর্থসংগ্রহ করিতেন। তখনকার অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে রাজপথে “বন্দে মাতরম্” গান গাহিয়া যাইতে দেখিয়াছি। এই সম্প্রদায়ের সভাগৃহে জাতীয়ভাব প্রচারের উদ্দেশ্যে সভা-সমিতি, বক্তৃতা প্রভৃতিও হইত। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় উহাতে মাঝে মাঝে যোগ দিতেন এবং স্বরচিত গান গাহিতেন।

 দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত, কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিম-স্মৃতি উৎসব। বঙ্কিমচন্দ্রের পৈতৃক বাসভবনেই এই উৎসব হইয়াছিল। উৎসবের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়। ‘বন্দে মাতরম সম্প্রদায়’ সদলবলে এই উৎসবে যোগদান করিয়াছিলেন এবং জাতীয় সংগীত গান করিয়াছিলেন। কলিকাতা হইতে কয়েক সহস্র লোক এই উৎসবে যোগ দিতে গিয়াছিল। কাঁঠালপাড়ার চতুষ্পার্শবর্তী গ্রামসমূহ হইতেও বহু লোক আসিয়াছিল। উৎসবের প্রধান অঙ্গ ছিল জাতীয় মেলা। বঙ্কিমচন্দ্রের বাসভবনের সম্মুখের বিস্তৃত মাঠে এই মেলা বসিয়াছিল। গ্রামের লোকেরা তাহাদের নানা কৃষিজাত ও কুটিরশিল্পজাত দ্রব্য মেলায় বিক্রয় করিতে আনিয়াছিল। যতদুর মনে পড়ে, কবির দল, পাঁচালীর দল, তীর ধনুকের খেলা প্রভৃতি গ্রাম্য আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থাও ছিল। উপাধ্যায় বলিতেন যে, বিলাতী কায়দায় স্মৃতিসভা করা আমাদের জাতির ধাতের সঙ্গে খাপ খায় না, এই গ্রাম্য মেলার দ্বারাই আমরা জাতীয় বৈশিষ্ট্য অনুসারে আরও ভাল করিয়া স্মৃতিরক্ষার ব্যবস্থা করিতে পারি। সে যাহা হউক, অপরাহ্ণে আধুনিক রীতিতেও মেলাক্ষেত্রে একটি সভা হইয়াছিল। সভাপতি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের বন্ধু ও সাহিত্য-শিষ্য অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয়। তিনি সঙ্গে দুইটি বালক গায়ককে লইয়া আসিয়াছিলেন। সভার প্রথমে তাহারা উঠিয়া জয়দেবের ‘দশাবতার স্তোত্র’ মধুর কণ্ঠে গান করিল। একটি বালিকা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাজিয়ে যাব মল’ কবিতাটি চমৎকার আবৃত্তি করিল। তারপর শ্বেতকেশ, শ্বেতশ্মশ্রু অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় বক্তৃতা করিতে উঠিলেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের কথা মনে করিয়া তাঁহার এমন ভাবাবেগ হইল যে, তিনি বক্তৃতা করিতে পারিলেন না, অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বসিয়া পড়িলেন। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী প্রভৃতি কয়েকজন বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে বক্তৃতা করিয়া সভা শেষ করিলেন। সন্ধ্যার পর বঙ্কিমচন্দ্রের পূজার দালানে রঙ্গমঞ্চ সাজাইয়া ‘আনন্দমঠ’ অভিনীত হইল। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় স্বয়ং সত্যানন্দের ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন। ভবানন্দ, জীবানন্দ, মহেন্দ্র প্রভৃতির ভূমিকা কাহারা গ্রহণ করিয়াছিলেন মনে পড়িতেছে না। এইরূপে রাত্রি প্রায় ৯টার পর বঙ্কিম-স্মৃতি উৎসব শেষ হইল।

বঙ্গভঙ্গের ফলে দেশব্যাপী যে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি হইল, তাহার সম্মুখে এইরূপে প্রাচীন ও নবীন দুই দলই আসিয়া দাঁড়াইলেন। সৌভাগ্যক্রমে প্রাচীন নিয়মতান্ত্রিকতার ধারা এবং নবীন আত্মশক্তির ধারা কর্মক্ষেত্রে বহুল পরিমাণে মিলিত মিশ্রিত হইয়া গেল। গঙ্গা ও যমুনার দুই ধারা যেমন প্রয়াগ-সঙ্গমে আসিয়া মিলিত হইয়াছে, তেমনি করিয়া বাঙলার রাজনীতির এই প্রাচীন ও নবীন ধারা মিলিত হইয়া বিরাট স্বদেশী আন্দোলনে পরিণত হইল। স্বদেশী আন্দোলন যে এমন শক্তিশালী হইয়াছিল, দেশের চিত্তে সমস্ত দিক হইতে যুগান্তর সৃষ্টি করিয়াছিল, সমগ্র ভারতে উহার প্রভাব বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছিল, তাহার মূল কারণ ইহাই। ১৯০৬ সালে কলিকাতায় দাদাভাই নৌরজীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের যে অধিবেশন হইল, তাহাতে প্রাচীন ও নবীন দলের মিলিত শক্তির প্রভাব সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত হইল। বলিতে গেলে কংগ্রেসের আর সে পূর্বের মূর্তি রহিল না, উহা নবরূপান্তরিত হইল। আর বঙ্গভঙ্গের আদেশ প্রচারের পর দীর্ঘ সাত বৎসর ধরিয়া বাঙলা দেশ তাহার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে আন্দোলন চালাইয়া “settled fact”কে যে “unsettled” করিয়াছিল, ব্রিটিশ গভর্মেণ্টের নিশ্চিত সিদ্ধান্তকে উল্টাইয়া দিয়াছিল, তাহাও এই সম্মিলিত শক্তির জোরেই সম্ভব হইয়াছিল।

 রবীন্দ্রনাথ এই স্বদেশী আন্দোলনের মধ্যে প্রদীপ্ত ভাস্কর মূর্তিতে দেখা দিয়াছিলেন। তাঁহার প্রতিভার পরিপূর্ণ প্রকাশ এই সময়েই হইয়াছিল; কৈশোর হইতে তিনি যে দেশপ্রেম ও সেবার সাধনা করিয়াছিলেন, তাহার ফল এই সময়েই জাতিকে তিনি পূর্ণরূপে দান করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। ইহা কেবল আমাদেরই অভিমত নহে, রবীন্দ্রনাথ নিজেও এইরূপ মনে করিতেন। শ্রীমতী রাণী চন্দকে তিনি বলিয়াছিলেন, “তখন, ভাবতে আশ্চর্য লাগে, কি নিঃশঙ্ক বেপরোয়াভাবে কাজ করেছি! যা মাথায় ঢুকেছে করে গেছি—কোনো ভয়-ডর ছিল না। আশ্চর্য রূপ দিয়েছে, ছবির পর ছবি ফুটিয়ে গেছে অবন। সে একটা যুগ, আর তাদের রবিকাকা তার মধ্যে ভাসমান। আজ অবনের গল্পে সে কালটা যেন সজীব প্রাণবস্ত হয়ে ফুটে উঠল। আবার সে যুগে ফিরে গিয়ে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। ঐখানেই পরিপূর্ণ আমি। পরিপূর্ণ আমাকে লোকে চেনে না—তারা আমাকে নানাদিক থেকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেখেছে। তখন বেঁচে ছিলুম,—আর এখন আধমরা হয়ে ঘাটে এসে পৌঁচেছি।”[]

 স্বদেশী আন্দোলনের প্রারম্ভ হইতেই রবীন্দ্রনাথ তাহার তরঙ্গের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন। ১৯০৫ সালের ২৫শে আগস্ট বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কলিকাতা টাউন হলে যে বিরাট সভা হয়, রবীন্দ্রনাথ তাহাতে তাঁহার বিখ্যাত প্রবন্ধ “অবস্থা ও ব্যবস্থা” পাঠ করেন। ভীড় এত বেশী হইয়াছিল যে, বহু লোক টাউন হলে প্রবেশ করিতে পারে নাই। সেই কারণে এক সপ্তাহ পরে আর এক স্থানে সভা করিয়া পুনরায় ঐ প্রবন্ধ পঠিত হয়। ইহার পর প্রায় প্রতিদিনই নানা স্থানে জনসভা হইতে লাগিল এবং রবীন্দ্রনাথ বহু সভাতেই যোগদান করিয়া প্রবন্ধ পাঠ বা বক্তৃতা করিতে লাগিলেন। নিত্য নূতন জাতীয় সংগীতও রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে রচনা করিতে লাগিলেন ও প্রত্যেক সভাতেই ঐ সমস্ত সংগীত গীত হইতে লাগিল। সমগ্র দেশ এইভাবে স্বদেশী আন্দোলনে মাতোয়ারা হইয়া উঠিল।

 ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর হইতে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হইবে বলিয়া গভর্মেণ্ট ঘোষণা করেন। ঐ দিনই চিরস্মরণীয় রাখীবন্ধনের উৎসব ধার্য হয়। পূর্বেই বলিয়াছি, রবীন্দ্রনাথই মনীষী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সহযোগিতায় এই উৎসবের পরিকল্পনা করেন। সমগ্র বাঙালী জাতি অতি সহজেই এই উৎসব গ্রহণ করিয়াছিল এবং বঙ্গভঙ্গ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত এবং তাহারও পর কয়েক বৎসর পর্যন্ত ১৬ই অক্টোবর (৩০শে আশ্বিন) তারিখে এই উৎসব পূর্ণোদ্যমে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। বিশেষ করিয়া এই উৎসবের জন্যই রবীন্দ্রনাথ নিম্নলিখিত গানটি রচনা করিয়া গিয়াছেন—

বাঙলার মাটি বাঙলার জল
বাঙলার বায়ু বাঙলার ফল
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান্।

বাঙলার ঘর বাঙলার হাট
বাঙলার বন বাঙলার মাঠ
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান্।
বাঙালীর পণ বাঙালীর আশা
বাঙালীর কাজ বাঙালীর ভাষা
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান্।
বাঙালীর প্রাণ বাঙালীর মন
বাঙালীর ঘরে যত ভাইবোন
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান্।

 এই গান গাহিয়া অখণ্ড বাঙলা ও ভ্রাতৃত্বের চিহ্নস্বরূপ লোকে পরস্পরের হাতে রাখী বন্ধন করিত। সে এক অপূর্ব দৃশ্য, অপূর্ব অনুভূতি—যাহারা উহা প্রত্যক্ষ করিয়াছে, তাহারা জীবনে কখনও ভুলিতে পারিবে না।

 ১৬ই অক্টোবর সকালবেলায় রবীন্দ্রনাথ নিজে গঙ্গার ঘাটে স্নান করিয়া রাখীবন্ধন উৎসব করিয়াছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের ‘ঘরোয়া’ গ্রন্থ হইতে তাহার অপূর্ব শব্দচিত্র পাঠকদের সম্মুখে উপস্থিত করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না:—

 “ঠিক হলো সকালবেলা সবাই গঙ্গাস্নান ক’রে সবার হাতে রাখী পরাবে। এই সামনেই জগন্নাথ ঘাট, সেখানে যাব। রবিকাকা বললেন, সবাই হেঁটে যাব, গাড়ি ঘোড়া নয়। কী বিপদ, আমার আবার হাঁটাহাটি ভালো লাগে না! কিন্তু রবিকাকার পাল্লায় পড়েছি, তিনি তো কিছু শুনবেন না। কী আর করি—হেঁটে যেতেই যখন হবে, চাকরকে বল্লুম যে, সব কাপড় জামা নিয়ে চল্ সঙ্গে। তারাও নিজের নিজের গামছা নিয়ে চল্‌ল স্নানে—মনিব-চাকরে এক সঙ্গে স্নান হবে। রওনা হলুম সবাই গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে, রাস্তার দুধারে বাড়ির ছাদ থেকে আরম্ভ ক’রে ফুটপাত অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে— মেয়েরা খৈ ছড়াচ্ছে, শাঁক বাজাচ্ছে, মহা ধূমধাম—যেন একটা শোভাযাত্রা। দিনুও ছিল সঙ্গে—গান গাইতে গাইতে রাস্তা দিয়ে মিছিল চল্‌ল—

বাঙলার মাটি
বাঙলার জল
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান্।

 এই গানটি সে সময়েই তৈরী হয়েছিল। ঘাটে সকাল থেকে লোকারণ্য। রবিকাকাকে দেখবার জন্য আমাদের চারিদিকে ভিড় জমে গেল। স্নান সারা হলো—সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল একগাদা রাখী, এ ওর হাতে রাখী পরালুম। অন্যরা যারা কাছাকাছি ছিল, তাদেরও হাতে রাখী পরানো হলো। হাতের কাছে ছেলেমেয়ে যাকে পাওয়া যাচ্ছে, কেউ বাদ পড়ছে না, সবাইকে রাখী পরানো হচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে সে এক ব্যাপার। পাথুরেঘাটা দিয়ে আস্‌ছি, দেখি বীরু মল্লিকের আস্তাবলে কতকগুলো সহিস ঘোড়া মল্‌ছে। হঠাৎ রবিকাকারা ধাঁ করে বেঁকে গিয়ে ওদের হাতে রাখী পরিয়ে দিলেন। ভাবলুম রবিকাকারা করলেন কী, ওরা যে মুসলমান, মুসলমানকে রাখী পরানো—এইবার একটা মারপিট হবে। মারপিট আর হবে কী। রাখী পরিয়ে আবার কোলাকুলি, সহিসগুলো তো হতভম্ভ কাণ্ড দেখে। আসছি, হটাৎ রবিকাকার খেয়াল হল চীৎপুরের বড় মসজিদে গিয়ে সবাইকে রাখী পরাবেন। হুকুম হোলো চলো সব। এইবারে বেগতিক—আমি ভাবলুম, গেলুম রে বাবা, মসজিদের ভিতরে গিয়ে রাখী পরালে একটা রক্তারক্তি ব্যাপার না হয়ে যায় না।

 ......আমরা সব বসে ভাবছি —এক ঘণ্টা কি দেড় ঘণ্টা বাদে রবিকাকারা সবাই ফিরে এলেন। আমরা সুরেনকে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, কী কী হলো তোমাদের। সুরেন যেমন কেটে কেটে কথা বলে,—বললে, কী আর হবে, গেলুম মসজিদের ভিতর, মৌলবী টৌলবী যাদের পেলুম, হাতে রাখী পরিয়ে দিলুম। আমি বললুম—আর মারামারি। সুরেন বললে, মারামারি কেন হবে, ওরা একটু হাসলে মাত্র। যাক্ বাঁচা গেল। এখন হোলে—এখন যাও তো দিকিনি, মসজিদের ভিতর গিয়ে রাখী পরাও তো—একটা মাথা ফাটাফাটি কাণ্ড হয়ে যাবে।”


  1. শ্রীঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত ‘ঘরোয়া’ গ্রন্থের ভূমিকা।