১১

 সেই খিদিরপুরের ঘাট থেকে আরম্ভ করে আর এই হংকংএর ঘাট পর্য্যন্ত, বন্দরে বন্দরে বাণিজ্যের চেহারা দেখে আসচি! সে যে কি প্রকাণ্ড, এমন করে তাকে চোখে না দেখ্‌লে বোঝা যায় না—শুধু প্রকাণ্ড নয়, সে একটা জবড়জঙ্গ ব্যাপার। কবিকঙ্কণচণ্ডীতে ব্যাধের আহারের যে বর্ণনা আছে,―সে এক-এক গ্রাসে এক-এক তাল গিলচে, তার ভোজন উৎকট, তার শব্দ উৎকট,―এও সেই রকম। এই বাণিজ্যব্যাধটাও হাঁস্‌ফাঁস কর্‌তে কর্‌তে এক-এক পিণ্ড মুখে যা পূরচে, সে দেখে ভয় হয়—তার বিরাম নেই, আর তার শব্দই বা কি! লোহার হাত দিয়ে মুখে তুলচে, লোহার দাঁত দিয়ে চিবচ্চে, লোহার পাকযন্তে চিরপ্রদীপ্ত জঠরানলে হজম কর্‌চে, এবং লোহার শিরা উপশিরার ভিতর দিয়ে তার জগৎজোড়া কলেবরের সর্ব্বত্র সোনার রক্তস্রোত চালান করে দিচ্ছে।

 এ’কে দেখে মনে হয় যে এ একটা জন্তু, এ যেন পৃথিবীর প্রথম যুগের দানব-জন্তুগুলোর মত। কেবলমাত্র তার ল্যাজের আয়তন দেখ্‌লেই শরীর আঁৎকে ওঠে। তারপরে সে জলচর হবে, কি স্থলচর হবে, কি পাখী হবে, এখনো তা স্পষ্ট ঠিক হয়, নি,—সে খানিকটা সরীসৃপের মত, খানিকটা বাদুড়ের মত, খানিকটা গণ্ডারের মত। অঙ্গসৌষ্ঠব বল্‌তে যা বোঝায়, তা তার কোথাও কিছুমাত্র নেই। তার গায়ের চামড়া ভয়ঙ্কর স্থূল; তার থাবা যেখানে পড়ে, সেখানে পৃথিবীর গায়ের কোমল সবুজ চামড়া উঠে গিয়ে একেবাবে তার হাড় বেরিয়ে পড়ে; চলার সময় তার বৃহৎ বিরূপ ল্যাজটা যখন নড়তে থাকে, তখন তার গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে সংঘর্ষ হয়ে এমন আওয়াজ হতে থাকে যে, দিগঙ্গনারা মূর্চ্ছিত হয়ে পড়ে। তারপরে, কেবলমাত্র তার এই বিপুল দেহটা রক্ষা করার জন্যে এত রাশি রাশি খাদ্য তার দরকার হয় যে, ধরিত্রী ক্লিষ্ট হয়ে ওঠে। সে যে কেবলমাত্র থাবা থাবা জিনিষ খাচ্ছে তা নয়, সে মানুষ খাচ্চে, স্ত্রী পুরুষ ছেলে কিছুই সে বিচার করে না।

 কিন্তু জগতের সেই প্রথম যুগের দানব জন্তুগুলো টিঁকলনা। তাদের অপরিমিত বিপুলতাই পদে পদে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়াতে, বিধাতার আদালতে তাদের প্রাণদণ্ডর বিধান হল। সৌষ্ঠব জিনিষটা কেবলমাত্র সৌন্দর্য্যের প্রমাণ দেয় না, উপযোগিতারও প্রমাণ দেয়। হাঁস্‌ফাঁস্‌টা যখন অত্যন্ত বেশী চোখে পড়ে, আয়তনটার মধ্যে যখন কেবলমাত্র শক্তি দেখি, শ্রী দেখিনে,― তখন বেশ বুঝতে পারা যায় বিশ্বের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য নেই; বিশ্বশক্তির সঙ্গে তার শক্তির নিরন্তর সংঘর্ষ হতে হতে, একদিন তাকে হার মেনে হাল ছেড়ে তলিয়ে যেতে হবেই। প্রকৃতির গৃহিণীপনা কখনই কদর্য্য অমিতাচারকে অধিক দিন সইতে পারে না—তার ঝাঁটা এসে পড়ল বলে! বাণিজ্য-দানবটা নিজের বিরূপতায়, নিজের প্রকাণ্ড ভারের মধ্যে নিজের প্রাণদণ্ড বহন কর্‌চে। একদিন আস্‌চে যখন তার লোহার কঙ্কালগুলোকে আমাদের যুগের স্তরের মধ্যে থেকে আবিষ্কার করে পুরাতত্ত্ববিদ্‌রা এই সর্ব্বভুক দানবটার অদ্ভুত বিষমতা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ কর্‌বে।

 প্রাণীজগতে মানুষের যে যোগ্যতা, সে তার দেহের প্রাচুর্য্য নিয়ে নয়! মানুষের চামড়া নরম, তার গায়ের জোর অল্প, তার ইন্দ্রিয় শক্তিও পশুদের চেয়ে কম বই বেশী নয়। কিন্তু সে এমন একটি বল পেয়েচে যা চোখে দেখা যায় না, যা জায়গা জোড়ে না, যা কোনো স্থানের উপর ভর না করেও সমস্ত জগতে, আপন অধিকার বিস্তার কর্‌চে। মানুষের মধ্যে দেহ পরিধি দৃশ্যজগৎ থেকে সরে গিয়ে অদৃশ্যের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেচে। বাইবেলে আছে, যে নম্র সেই পৃথিবীকে অধিকার কর্‌বে― তার মানেই হচ্চে নম্রতার শক্তি বাইরে নয়, ভিতরে; সে যত কম আঘাত দেয়, ততই সে জয়ী হয়; সে রণক্ষেত্রে লড়াই করে না; অদৃশ্যলোকে বিশ্বশক্তির সঙ্গে সন্ধি করে সে জয়ী হয়।

 বাণিজ্য-দানবকেও একদিন তার দানবলীলা সম্বরণ করে মানব হতে হবে! আজ এই বাণিজ্যের মস্তিষ্ক কম, ওর হৃদয় ত একেবারেই নেই, সেইজন্যে পৃথিবীতে ও কেবল আপনার ভার বাড়িয়ে চলেছে। কেবলমাত্র প্রাণপণ শক্তিতে আপনার আয়তনকে বিস্তীর্ণতর করে করেই ও জিত্‌তে চাচ্চে। কিন্তু একদিন যে জয়ী হবে তার আকার ছোট, তার কর্ম্মপ্রণালী সহজ; মানুষের হৃদয়কে, সৌন্দর্য্যবোধকে, ধর্ম্মবুদ্ধিকে সে মানে; স নম্র, সে সুশ্রী, সে কদর্য্যভাবে লুব্ধ নয়, তার প্রতিষ্ঠা অন্তরের সুব্যবস্থায়, বাইরের আয়তনে না; সে কাউকে বঞ্চিত করে বড় নয়, সে সকলের সঙ্গে সন্ধি করে বড়। আজকের দিনে পৃথিবীতে মানুষের সকল অনুষ্ঠানের মধ্যে এই বাণিজ্যের অনুষ্ঠান সব চেয়ে কুশ্রী, আপন ভারের দ্বারা পৃথিবীকে সে ক্লান্ত কর্‌চে, আপন শব্দের দ্বারা পৃথিবীকে বধির কর্‌চে, আপন আবর্জ্জনার দ্বারা পৃথিবীকে মলিন কর্‌চে, আপন লোভের দ্বার পৃথিবীকে আহত কর্‌চে। এই যে পৃথিবীব্যাপী কুশ্রীতা, এই যে বিদ্রোহ,—রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ,স্পর্শ এবং মানব-হৃদয়ের বিরুদ্ধে, ―এই যে লোভকে বিশ্বের রাজসিংহাসনে বসিয়ে তার কাছে দাসখত লিখে দেওয়া, এ প্রতিদিনই মানুষের শ্রেষ্ঠ মনুষ্যত্বকে আঘাত কর্‌চেই, তার সন্দেহ নেই। মুনফার নেশায় উন্মত্ত হয়ে এই বিশ্বব্যাপী দ্যূতক্রীড়ায় মানুষ নিজেকে পণ রেখে কতদিন খেলা চালাবে? এ খেলা ভাঙতেই হবে। যে খেলায় মানুষ লাভ কর্‌বার লোভ নিজেকে লোকসান করে চলেচে, সে কখনই চল্‌বে না!

 ৯ই জ্যৈষ্ঠ। মেঘ বৃষ্টি, বাদল কুয়াশায় আকাশ ঝাপসা হয়ে আছে—হংকং বন্দরে পাহাড়গুলো দেখা দিয়েছে তাদের গা বেয়ে বেয়ে ঝরনা ঝরে পড়েছে। মনে হচ্চে দৈত্যের দল সমুদ্রে ডুব দিয়ে তাদের ভিজে মাথা জলের উপর তুলেচে, তাদের জটা বেয়ে দাড়ি বেয়ে জল ঝরচে! এণ্ড্রুজ সাহেব বল্‌চেন দৃশ্যটা যেন পাহাড়-ঘেরা স্কটল্যাণ্ডের হৃদের মত, তেম্‌নিতর ঘন সবুজ বেঁটে বেঁটে পাহাড়, তেম্‌নিতর ভিজে কম্বলের মত আকাশের মেঘ, তেম্‌নিতর কুয়াসার ন্যাতা বুলিয়ে অল্প অল্প মুছে ফেলা জলস্থলের মূর্ত্তি। কাল সমস্ত রাত বৃষ্টি বাতাস গিয়েচে―কাল বিছানা আমার ভার বহন করে নি, আমিই বিছানাটাকে বহন করে ডেকের এধার থেকে ওধারে আশ্রয় খুঁজে খুঁজে ফিরেচি। রাত যখন সাড়ে দুপুর হবে, তখন এই বাদলের সঙ্গে মিথ্যা বিরোধ কর্‌বার চেষ্টা না করে তাকে প্রসন্ন মনে মেনে নেবার জন্যে প্রস্তুত হলুম। একধারে দাঁড়িয়ে ঐ বাদ্‌লার সঙ্গে তান মিলিয়েই গান ধরলুম “শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে।” এমনি করে ফিরে ফিরে অনেকগুলো গান গাইলুম,—বানিয়ে বানিয়ে একটা নতুন গানও তৈরি করলুম,―কিন্তু বাদলের সঙ্গে কবির লড়াইয়ে এই মর্ত্ত্যবাসীকেই হার মান্‌তে হল। আমি অত দম পাব কোথায়, আর আমার কবিত্বের বাতিক যতই প্রবল হোক না, বায়ুবলে আকাশের সঙ্গে পেরে উঠব কেন?

 কাল রাত্রেই জাহাজের বন্দরে পৌঁছিবার কথা ছিল, কিন্তু এইখানটায় সমুদ্রবাহী জলের স্রোত প্রবল হয়ে উঠ্‌ল, এবং বাতাসও বিরুদ্ধ ছিল তাই পদে পদে দেরি হতে লাগল। জায়গাটাও সঙ্কীর্ণ এবং সঙ্কটময়। কাপ্তেন সমস্ত রাত জাহাজের উপরতলায় গিয়ে সাবধানে পথের হিসাব করে চলেচেন। আজ সকালেও মেঘবৃষ্টির বিরাম নেই। সূর্য্য দেখা দিল না, তাই পথ ঠিক করা কঠিন। মাঝে মাঝে ঘণ্টা বেজে উঠ্‌চে, এঞ্জিন থেমে যাচ্চে, নাবিকের দ্বিধা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। আজ সকালে আহারের টেবিলে কাপ্তেনকে দেখা গেল না। কাল রাত দুপুরের সময় কাপ্তেন একবার কেবল বর্ষাতি পরে নেমে এসে আমাকে বলে গেলেন, ডেকের কোনো দিকেই শোবার সুবিধা হবে না, কেননা বাতাসের বদল হচ্চে।

 এর মধ্যে একটি ব্যাপার দেখে আমার মনে বড় আনন্দ হয়েছিল। জাহাজের উপর থেকে একটা দড়িবাঁধা চামড়ার চোঙে করে মাঝে মাঝে সমুদ্রের জল তোলা হয়। কাল বিকেলে এক সময়ে মুকুলের হঠাৎ জানতে ইচ্ছা হল, এর কারণটা কি? সে তখনি উপরতলায় উঠে গেল। এই উপর তলাতেই জাহাজের হালের ঢাকা, এবং এখানেই পথনির্ণয়ের সমস্ত যন্ত্র। এখানে যাত্রীদের যাওয়া নিষেধ। মুকুল যখন গেল, তখন তৃতীয় অফিসার কাজে নিযুক্ত। মুকুল তাঁকে প্রশ্ন কর্‌তেই, তিনি ওকে বোঝাতে শুরু কর্‌লেন। সমুদ্রের মধ্যে অনেকগুলি স্রোতের ধারা বইচে, তাদের উত্তাপের পরিমাণ স্বতন্ত্র। মাঝে মাঝে সমুদ্রের জল তুলে তাপমান দিয়ে পরীক্ষা করে সেই ধারাপথ নির্ণয় করা দরকার। সেই ধারার ম্যাপ বের করে তাদের গতিবেগের সঙ্গে জাহাজের গতিবেগের কি রকম কাটাকাটি হচ্চে, তাই তিনি মুকুলকে বোঝাতে লাগ্‌লেন। তাতেও যখন সুবিধা হল না, তখন বোর্ডে খড়ি দিয়ে এঁকে ব্যাপারটাকে যথাসম্ভব সরল করে দিলেন।

 বিলিতি জাহাজে মুকুলের মত বালকের পক্ষে এটা কোনোমতেই সম্ভবপর হত না। সেখানে ওকে অত্যন্ত সোজা করেই বুঝিয়ে দিত যে, ও জায়গায় তার নিষেধ। মোটের উপরে জাপানী অফিসরের সৌজন্য, কাজের নিয়মবিরুদ্ধ। কিন্তু পূর্ব্বেই বলেচি, এই জাপানী জাহাজে কাজের নিয়মের ফাঁক দিয়ে মানুষের গতিবিধি আছে। অথচ নিয়মটা চাপা পড়ে যায় নি, তাও বারবার দেখেচি। জাহাজ যখন বন্দরে স্থির ছিল, যখন উপরতলার কাজ বন্ধ, তখন সেখানে বসে কাজ কর্‌বার জন্যে আমি কাপ্তেনের সম্মতি পেয়েছিলুম। সেদিন পিয়ার্সন সাহেব দুজন ইংরেজ আলাপীকে জাহাজে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ডেকের উপর মাল তোলার শব্দে আমাদের প্রস্তাব উঠল, উপরের তলায় যাওয়া যাক। আমি সম্মতির জন্য প্রধান অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলুম,—তিনি তখনি বল্লেন, “না”। নিয়ে গেলে কাজের ক্ষতি হত না, কেননা কাজ তখন বন্ধ ছিল। কিন্তু নিয়মভঙ্গের একটা সীমা আছে, সে সীমা বন্ধুর পক্ষে যেখানে, অপরিচিতের পক্ষে সেখানে না। উপরের তলা ব্যবহারের সম্মতিতেও আমি যেমন খুসি হয়েছিলুম, তার বাধাতেও তেমনি খুসি হলুম। স্পষ্ট দেখতে পেলুম, এর মধ্যে দাক্ষিণ্য আছে, কিন্তু দুর্ব্বলতা নেই।

 বন্দরে পৌঁছবামাত্র জাপান থেকে কয়েকখানি অভ্যর্থনা টেলিগ্রাম ও পত্র পাওয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে প্রধান অফিসার এসে আমাকে বল্লেন, এ যাত্রায় আমাদের সাঙ্ঘাই যাওয়া হল না; একেবারে এখান থেকে জাপান যাওয়া হবে। আমি জিজ্ঞাসা কর্‌লুম, কেন? তিনি বল্লেন, জাপানবাসীরা আপনাকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে, তাই আমাদের সদর অফিস থেকে টেলিগ্রামে আদেশ এসেচে, অন্য বন্দরে বিলম্ব না করে চলে যেতে। সাঙ্ঘাইয়ের সমস্ত মাল আমরা এইখানেই নামিয়ে দেব ―অন্য জাহাজে করে সেখানে যাবে।

 এই খবরটি আমার পক্ষে যতই গৌরবজনক হোক, এখানে লেখার দরকার ছিল না। কিন্তু আমার লেখার কারণ হচ্চে এই যে, এই ব্যাপারের একটু বিশেষত্ব আছে, সেটা আলোচ্য। সেটা পুনশ্চ ঐ একই কথা। অর্থাৎ ব্যবসার দাবী সচরাচর যে-পাথরের পাঁচিল খাড়া করে আত্মরক্ষা করে, এখানে তার মধ্যে দিয়েও মানব সম্বন্ধের আনাগোনার পথ আছে। এবং সে পথ কম প্রশস্ত নয়।

 জাহাজ এখানে দিন দুয়েক থাক্‌বে। সেই দু’দিনের জন্যে সহরে নেবে হোটেলে থাকবার প্রস্তাব আমার মনে নিলে না। আমার মত কুঁড়ে মানুষের পক্ষে আরামের চেয়ে বিরাম ভাল; আমি বলি, সুখের ল্যাঠা অনেক, সোয়াস্তির বালাই নেই। আমি মাল তোলা-নামার উপদ্রব স্বীকার করেও, জাহাজে রয়ে গেলুম। সে জন্যে আমার যে বক্‌শিস্ মেলেনি, তা নয়।

 প্রথমেই চোখে পড়ল জাহাজের ঘাটে চীনা-মজুরদের কাজ। তাদের একটা করে নীল পায়জামা পরা এবং গা খোলা। এমন শরীরও কোথাও দেখি নি, এমন কাজও না। একেবারে প্রাণসার দেহ, লেশমাত্র বাহুল্য নেই। কাজের তালে তালে সমস্ত শরীরের মাংসপেশী কেবলি ঢেউ খেলাচ্চে। এর বড় বড় বোঝাকে এমন সহজে এবং এমন দ্রুত আয়ত্ত করচে যে সে দেখে আনন্দ হয়। মাথা থেকে পা পর্য্যন্ত কোথাও অনিচ্ছা, অবসাদ বা জড়ত্বের লেশমাত্র লক্ষণ দেখা গেল না। বাইরে থেকে তাদের তাড়া দেবার কোন দরকার নেই। তাদের দেহের বীণাযন্ত্র থেকে কাজ যেন সঙ্গীতের মত বেজে উঠ্‌চে। জাহাজের ঘাটে মাল তোলা-নামার কাজ দেখতে যে আমার এত আনন্দ হবে, একথা আমি পূর্ব্বে মনে করতে পারতুম না। পূর্ণ শক্তির কাজ বড় সুন্দর; তার প্রত্যেক আঘাতে আঘাতে শরীরকে সুন্দর কর্‌তে থাকে, এবং সেই শরীরও কাজকে সুন্দর করে তোলে। এইখানে কাজের কাব্য এবং মানুষের শরীরের ছন্দ আমার সাম্‌নে বিস্তীর্ণ হয়ে দেখা দিলে। এ কথা জোর করে বল্‌তে পারি, ওদের দেহের চেয়ে কোন স্ত্রীলোকের দেহ সুন্দর হতে পারে না,― কেননা শক্তির সঙ্গে সুষমার এমন নিখুঁৎ সঙ্গতি মেয়েদের শরীরে নিশ্চয়ই দুর্লভ। আমাদের জাহাজের ঠিক সামনেই আর একটা জাহাজে বিকেল বেলায় কাজকর্ম্মের পর সমস্ত চীনা মাল্লা জাহাজের ডেকের উপর কাপড় খুলে ফেলে স্নান করছিল,―মানুষের শরীরের যে কি স্বর্গীয় শোভা, তা আমি এমন করে আর কোনদিন দেখতে পাই নি

 কাজের শক্তি, কাজের নৈপুণ্য এবং কাজের আনন্দকে এমন পুঞ্জীভূত ভাবে একত্র দেখতে পেয়ে, আমি মনে মনে বুঝতে পারলুম এই বৃহৎ জাতির মধ্যে কতখানি ক্ষমতা সমস্ত দেশ জুড়ে সঞ্চিত হচ্চে। এখানে মানুষ পূণপরিমাণে নিজেকে প্রয়োগ কর্‌বার জন্যে বহুকাল থেকে প্রস্তুত হচ্চে। যে-সাধনায় মানুষ আপনাকে আপনি ষোলো-আনা ব্যবহার কর্‌বার শক্তি পায়, তার কৃপণতা ঘুচে যায়, নিজেকে নিজে কোন অংশে ফাঁকি দেয় না,―সে যে মস্ত সাধনা। চীন সুদীর্ঘকাল সেই সাধনায় পূর্ণভাবে কাজ কর্‌তে শিখেচে, সেই কাজের মধ্যেই তার নিজের শক্তি উদারভাবে আপনার মুক্তি এবং আনন্দ পাচ্চে;― এ একটি পরিপূর্ণতার ছবি। চীনের এই শক্তি আছে বলেই আমেরিকা চীনকে ভয় করেচে―কাজের উদ্যমে চীনকে সে জিত্‌তে পারে না, গায়ের জোরে তাকে ঠেকিয়ে রাখ্‌তে চায়.

 এই এতবড় একটা শক্তি যখন আপনার আধুনিক কালের বাহনকে পাবে, অর্থাৎ যখন বিজ্ঞান তার আয়ত্ত হবে, তখন পৃথিবীতে তাকে বাধা দিতে পারে এমন কোন শক্তি আছে? তখন তার কর্ম্মের প্রতিভার সঙ্গে তার উপকরণের যোগসাধন হবে। এখন যে-সব জাতি পৃথিবীর সম্পদ ভোগ কর্‌চে, তারা চীনের সেই অভ্যুত্থানকে ভয় করে, সেই দিনকে তারা ঠেকিয়ে রাখ্‌তে চায়। কিন্তু যে জাতির যে দিকে যতখানি বড় হবার শক্তি আছে, সে দিকে তাকে ততখানি বড় হয়ে উঠ্‌তে দিতে বাধা-দেওয়া যে স্বজাতিপূজা থেকে জন্মেছে, তার মত এমন সর্ব্বনেশে পূজা জগতে আর কিছুই নেই। এমন বর্ব্বর-জাতির কথা শোনা যায়, যারা নিজের দেশের দেবতার কাছে পরদেশের মানুষকে বলি দেয়,—আধুনিক কালের স্বজাতীয়তা তার চেয়ে অনেক বেশী ভয়ানক জিনিস, সে নিজের ক্ষুধার জন্যে এক-একটা জাতিকে-জাতি দেশকে-দেশ দাবী করে।

 আমাদের জাহাজের বাঁ পাশে চীনের নৌকার দল। সেই নৌকাগুলিতে স্বামী স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে সকলে মিলে বাস কর্‌চে এবং কাজ কর্‌চে। কাজের এই ছবিই আমার কাছে সকলের চেয়ে সুন্দর লাগল। কাজের এই মুর্ত্তিই চরম মূর্ত্তি, একদিন এরই জয় হবে। না যদি হয়,―বাণিজ্যদানব যদি মানুষের ঘরকর্‌না, স্বাধীনতা সমস্তই গ্রাস করে চল্‌তে থাকে, এবং বৃহৎ এক দাস-সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করে তোলে তারই সাহায্যে অল্প কয়জনের আরাম এবং স্বার্থ সাধন কর্‌তে থাকে, তাহলে পৃথিবী রসাতলে যাবে। এদের মেয়ে পুরুষ ছেলে, সকলে মিলে কাজ কর্‌বার এই ছবি দেখে আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। ভারতবর্ষে এই ছবি কবে দেখ্‌তে পাব? সেখানে মানুষ আপনার বারোআনাকে ফাঁকি দিয়ে কাটাচ্চে। এমন সব নিয়মের জাল, যাতে মানুষ কেবলি বেধে-বেধে গিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে পড়েই নিজের অধিকাংশ শক্তির বাজে খরচ করে এবং বাকি অধিকাংশকে কাজে খাটাতে পারে না;―এমন বিপুল জটিলতা এবং জড়তার সমাবেশ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। চারিদিকে কেবলি জাতির সঙ্গে জাতির বিচ্ছেদ, নিয়মের সঙ্গে কাজের বিরোধ, আচার-ধর্ম্মের সঙ্গে কাল ধর্ম্মের দ্বন্দ্ব।

 চীন সমুদ্র

 তোসা মারু জাহাজ