জাপান-যাত্রী/১৪
১৪
যেমন-যেমন দেখচি তেমনি-তেমনি লিখে যাওয়া আর সম্ভব নয়। পূর্ব্বেই লিখেচি, জাপানীরা বেশী ছবি দেয়ালে টাঙায় না, গৃহসজ্জায় ঘর ভরে ফেলে না। যা তাদের কাছে রমণীয়, তা তারা অল্প করে দেখে; দেখা সম্বন্ধে এরা যথার্থ ভোগী বলেই, দেখা সম্বন্ধে এদের পেটুকতা নাই। এরা জানে, অল্প করে না দেখলে পূর্ণ পরিমাণে দেখা হয় না। জাপান-দেখা সম্বন্ধেও আমার তাই ঘট্চে;― দেখবার জিনিষ একেবারে হুড়মুড় করে চারদিক থেকে চোখের উপর চেপে পড়চে;―তাই প্রত্যেকটিকে সুস্পষ্ট করে সম্পূর্ণ করে দেখা এখন আর সম্ভব হয় না। এখন কিছু রেখে কিছু বাদ দিয়ে চল্তে হবে।
এখানে এসেই আদর অভ্যর্থনার সাইক্লোনের মধ্যে পড়ে গেচি; সেই সঙ্গে খবরের কাগজের চরেরা চারিদিকে তুফান লাগিয়ে দিয়েচে। এদের ফাঁক দিয়ে যে জাপানের আর কিছু দেখব, এমন আশা ছিল না। জাহাজে এরা হেঁকে ধরে, রাস্তায় এরা সঙ্গে সঙ্গে চলে, ঘরের মধ্যে এরা ঢুকে পড়তে সঙ্কোচ করে না।
এই কৌতূহলীর ভিড় ঠেল্তে ঠেল্তে, অবশেষে টোকিয়ো সহরে এসে পৌঁছন গেল। এখানে আমাদের চিত্রকর বন্ধু য়োকোয়ামা টাইক্কানের বাড়িতে এসে আশ্রয় পেলুম। এখন থেকে ক্রমে জাপানের অন্তরের পরিচয় পেতে আরম্ভ করা গেল।
প্রথমেই জুতো জোড়াটাকে বাড়ির দরজার কাছে ত্যাগ কর্তে হল। বুঝলুম জুতো জোড়াটা রাস্তার, পা জিনিষটাই ঘরের। ধুলো জিনিষটাও দেখলুম এদের ঘরের নয়, সেটা বাইরের পৃথিবীর। বাড়ির ভিতরকার সমস্ত ঘর এবং পথ মাদুর দিয়ে মোড়া, সেই মাদুরের নীচে শক্ত খড়ের গদি; তাই এদের ঘরের মধ্যে যেমন পায়ের ধুলো পড়ে না, তেমনি পায়ের শব্দও হয় না। দরজাগুলো ঠেলা দরজা, বাতাসে যে ধড়াধ্বড় পড়বে এমন সম্ভাবনা নেই।
আর একটা ব্যাপার এই,—এদের বাড়ি জিনিষটা অত্যন্ত অধিক নয়। দেয়াল, কড়ি, বরগা, জানালা, দরজা, যতদূর পরিমিত হতে পারে, তাই। অর্থাৎ বাড়িটা মানুষকে ছাড়িয়ে যায় নি, সম্পূর্ণ তার আয়ত্তের মধ্যে। এ’কে মাজা ঘষা ধোওয়া মোছা দুঃসাধ্য নয়।
তারপরে, ঘরে যেটুকু দরকার, তা ছাড়া আর কিছু নেই। ঘরের দেয়াল মেঝে সমস্ত যেমন পরিষ্কার, তেমনি ঘরের ফাঁকটুকুও যেন তক্তক্ করছে, তার মধ্যে বাজে জিনিষের চিহ্ণমাত্র পড়ে নি। মস্ত সুবিধে এই যে, এদের মধ্যে যাদের সাবেক চাল আছে, তারা চৌকি টেবিল একেবারে ব্যবহার করে না। সকলেই জানে চৌকি টেবিলগুলো জীব নয় বটে, কিন্তু তারআ হাত-পা-ওয়ালা। যখন তাদের কোনো দরকার নেই, তখনো তারা দরকারের অপেক্ষায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে। অতিথিরা আস্চে যাচ্চে, কিন্তু অতিথিদের এই খাপগুলি জায়গা জুড়েই আছে। এখানে ঘরের মেজের উপরে মানুষ বসে, সুতরাং যখন তারা চলে যায়, তখন ঘরের আকাশে তারা কোনো বাধা রেখে যায় না। ঘরের একধারে মাদুর নেই, সেখানে পালিশ করা কাষ্ঠখণ্ড ঝক্ঝক্ কর্চে, সেই দিকের দেয়ালে একটি ছবি ঝুলচে, এবং সেই ছবির সামনে সেই তক্তাটির উপর একটি ফুলদানীর উপরে ফুল সাজানো। ঐ যে ছবিটি আছে, এটা আড়ম্বরের জন্যে নয়, এটা দেখবার জন্যে। সেইজন্যে যাতে ওর গা ঘেঁসে কেউ না বসতে পারে, যাতে ওর সাম্নে যথেষ্ট পরিমাণে অব্যাহত অবকাশ থাকে, তারি ব্যবস্থা রয়েচে। সুন্দর জিনিষকে যে এরা কত শ্রদ্ধা করে, এর থেকেই তা বোঝা যায়। ফুল সাজানোও তেমনি। অন্যত্র নানা ফুল ও পাতাকে ঠেসে একটা তোড়ার মধ্যে বেঁধে ফেলে—ঠিক যেমন করে বারুণীযোগের সময় তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীদের এক গাড়িতে ভর্ত্তি করে দেওয়া হয়, তেমনি,― কিন্তু এখানে ফুলের প্রতি সে অত্যাচার হবার জো নেই—ওদের জন্যে থার্ডক্লাসের গাড়ি নয়, ওদের জন্যে রিজার্ভ-করা সেলুন। ফুলের সঙ্গে ব্যবহারে এদের না আছে দড়াদড়ি, না আছে ঠেলাঠেলি, না আছে হট্টগোল।
ভােরের বেলা উঠে জানালার কাছে আসন পেতে যখন বসলুম, তখন বুঝলুম জাপানীরা কেবল যে শিল্পকলায় ওস্তাদ, তা নয়, ―মানুষের জীবনযাত্রাকে এরা একটি কলাবিদ্যার মত আয়ত্ত করেছে। এরা এটুকু জানে, যে-জিনিষের মূল্য আছে গৌরব আছে, তার জন্য যথেষ্ট জায়গা ছেড়ে দেওয়া চাই। পূর্ণতার জন্যে রিক্ততা সব চেয়ে দরকারী। বস্তুবাহুল্য জীবনবিকাশের প্রধান বাধা। এই সমস্ত বাড়িটির মধ্যে কোথাও একটি কোণেও একটু অনাদর নেই, অনাবশ্যকতা নেই। চোখকে মিছিমিছি কোন জিনিষ আঘাত করচে না, কানকে বাজে কোন শব্দ বিরক্ত করচে না,― মানুষের মন নিজেকে যতখানি ছড়াতে চায় ততখানি ছড়াতে পারে, পদে পদে জিনিষপত্রের উপরে ঠোকর খেয়ে পড়ে না।
যেখানে চারিদিকে এলােমেলাে, ছড়াছড়ি নানা জঞ্জাল, নানা আওয়াজ,―সেখানে যে প্রতিমুহূর্ত্তেই আমাদের জীবনের এবং মনের শক্তিক্ষয় হচ্ছে, সে আমরা অভ্যাসবশত বুঝতে পারি নে। আমাদের চারিদিকে যা কিছু আছে, সমস্তই আমাদের প্রাণ-মনের কাছে কিছু-না-কিছু আদায় করচেই। যে সব জিনিষ অদরকারী এবং অসুন্দর, তারা আমাদের কিছুই দেয় না—কেবল আমাদের কাছ থেকে নিতে থাকে। এমনি করে নিশিদিন আমাদের যা ক্ষয় হচ্চে, সেটাতে আমাদের শক্তির কম অপব্যয় হচ্চে না।
সেদিন সকালবেলায় মনে হল আমার মন কেন কানায় কানায় ভরে উঠেচে। এতদিন যেরকম করে মনের শক্তি বহন করেচি, সে যেন চালুনিতে জল ধরা, কেবল গোলমালের ছিদ্র দিয়ে সমস্তবেরিয়ে গেছে; আর এখানে এ যেন ঘটের ব্যবস্থা। আমাদের দেশের ক্রিয়াকর্ম্মের কথা মনে হল। কি প্রচুর অপব্যয়! কেবলমাত্র জিনিষপত্রের গণ্ডগোল নয়, মানুষের কি চেঁচামেচি, ছুটোছুটি, গলা-ভাঙাভাঙি! আমাদের নিজের বাড়ির কথা মনে হল। বাঁকাচোরা উঁচুনীচু রাস্তার উপর দিয়ে গোরুর গাড়ি চলার মত সেখানকার জীবনযাত্রা। যতটা চল্ছে তার চেয়ে আওয়াজ হচ্ছে ঢের বেশী। দরোয়ান হাঁক দিচ্চে, বেহারাদের ছেলেরা চেঁচামেচি কর্চে, মেথরদের মহলে ঘোরতর ঝগড়া বেধে গেছে, মাড়োয়াড়ি প্রতিবেশিনীরা চীৎকার শব্দে একঘেয়ে গান ধরেচে, তার আর অন্তই নেই। আর ঘরের ভিতরে নানা জিনিসপত্রের ব্যবস্থা এবং অব্যবস্থা, তার বোঝা কি কম! সেই বোঝা কি কেবল ঘরের মেঝে বহন কর্চে! তা নয়, প্রতিক্ষণেই আমাদের মন বহন কর্চে। যা গোছালো, তার বোঝা কম; যা অগোছালো, তার বোঝা আরো বেশী,―এই যা তফাৎ। যেখানে একটা দেশের সমস্ত লোকই কম চেঁচায়, কম জিনিষ ব্যবহার করে, ব্যবস্থাপূর্ব্বক কাজ কর্তে যাদের আশ্চর্য্য দক্ষতা,―সমস্ত দেশ জুড়ে তাদের যে কতখানি শক্তি জমে উঠচে, তার কি হিসেব আছে?
জাপানীরা যে রাগ করেনা, তা নয়, কিন্তু সকলের কাছেই একবাক্যে শুনেছি, এরা ঝগড়া করে না। এদের গালাগালির অভিধানে একটিমাত্র কথা আছে—বোকা—তার ঊর্দ্ধে এদেয় ভাষা পৌঁছায় না! ঘোরতর রাগারাগি মনান্তর হয়ে গেল, পাশের ঘরে তার টুশব্দ পৌঁছল না,―এইটি হচ্চে জাপানী রীতি। শোকদুঃখ সম্বন্ধেও এই রকম স্তব্ধতা।
এদের জীবনযাত্রায় এই রিক্ততা, বিরলতা, মিতাচার কেবলমাত্র যদি অভাবাত্মক হত, তাহলে সেটাকে প্রশংসা করবার কোনো হেতু থাক্ত না। কিন্তু এইত দেখচি, এর ঝগড়া করে না বটে, অথচ প্রয়োজনের সময় প্রাণ দিতে প্রাণ নিতে এরা পিছপাও হয় না। জিনিসপত্রের ব্যবহারে এদের সংযম, কিন্তু জিনিসপত্রের প্রতি প্রভুত্ব এদের ত কম নয়। সকল বিষয়েই এদের যেমন শক্তি, তেমনি নৈপুণ্য, তেমনি সৌন্দর্য্য বোধ।
এ সম্বন্ধে যখন আমি এদের প্রশংসা করেচি, তখন এদের অনেকের কাছেই শুনেছি যে, “এটা আমরা বৌদ্ধধর্ম্মের প্রসাদে পেয়েচি। অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম্মের একদিকে সংযম আর একদিকে মৈত্রী, এই যে সামঞ্জস্যের সাধনা আছে, এতেই আমরা মিতাচারের দ্বারাই অমিত শক্তির অধিকার পাই। বৌদ্ধধর্ম্ম বে মধ্যপথের ধর্ম্ম।”
শুনে আমার লজ্জা বোধ হয়। বৌদ্ধধর্ম্ম ত আমাদের দেশেও ছিল, কিন্তু আমাদের জীবনযাত্রাকে ত এমন আশ্চর্য্য ও সুন্দর সামঞ্জস্যে বেঁধে তুল্তে পারে নি। আমাদের কল্পনার ও কাজে এমনতর প্রভূত আতিশয্য, ঔদাসীন্য, উচ্ছৃঙ্খলতা কোথা থেকে এল?
একদিন জাপানী নাচ দেখে এলুম। মনে হল এ যেন দেহভঙ্গীর সঙ্গীত। এই সঙ্গীত আমাদের দেশের বীণার আলাপ। অর্থাৎ পদে পদে মীড়। ভঙ্গীবৈচিত্র্যের পরস্পরের মাঝখানে কোনো ফাঁক নেই, কিম্বা কোথাও জোড়ের চিহ্ণ দেখা যায় না;—সমস্ত দেহ পুষ্পিত লতার মত একসঙ্গে দুল্তে দুল্তে সৌন্দর্য্যের পুষ্পবৃষ্টি কর্চে। খাঁটি য়ুরোপীয় নাচ অর্দ্ধনারীশ্বরের মত, আধখানা ব্যায়াম আধখানা নাচ; তার মধ্যে লম্ফঝম্প, ঘুরপাক, আকাশকে লক্ষ্য করে লাথি-ছোঁড়াছুঁড়ি আছে। জাপানী নাচ একেবারে পরিপূর্ণ নাচ। তার সজ্জার মধ্যেও লেশমাত্র উলঙ্গতা নেই। অন্য দেশের নাচে দেহের সৌন্দর্য্যলীলার সঙ্গে দেহের লালসা মিশ্রিত। এখানে নাচের কোনো ভঙ্গীর মধ্যে লালসার ইসারামাত্র দেখা গেল না। আমার কাছে তার প্রধান কারণ এই বোধ হয় যে, সৌন্দর্য্যপ্রিয়তা জাপানীর মনে এমন সত্য যে, তার মধ্যে কোননারকমের মিশল তাদের দরকার হয় না, এবং সহ্য হয় না।
কিন্তু এদের সঙ্গীতটা আমার মনে হল বড় বেশীদূর এগোয় নি। বোধ হয় চোক আর কান, এই দুইয়ের উৎকর্ষ একসঙ্গে ঘটে না। মনের শক্তিস্রোত যদি এর কোনো একটা রাস্তা দিয়ে অত্যন্ত বেশী আনাগোনা করে, তাহলে অন্য রাস্তাটায় তার ধারা অগভীর হয়। ছবি জিনিসটা হচ্ছে অবনীর, গান জিনিসটা গগনের। অসীম যেখানে সীমার মধ্যে, সেখানে ছবি; অসীম যেখানে সীমাহীনতায়, সেখানে গান। রূপরাজ্যের কলা ছবি অপরূপ রাজ্যের কলা গান। কবিতা উভচর, ছবির মধ্যেও চলে, গানের মধ্যেও ওড়ে। কেননা কবিতার উপকরণ হচ্ছে ভাষা। ভাষার একটা দিকে অর্থ, আর একটা দিকে সুর; এই অর্থের যোগে ছবি গড়ে ওঠে, সুরের যোগে গান।
জাপানী রূপরাজ্যের সমস্ত দখল করেচে। যা কিছু চোখে পড়ে, তার কোথাও জাপানীর আলস্য নেই, অনাদর নেই; তার সর্ব্বত্রই সে একেবারে পরিপূর্ণতার সাধন করেচে। অন্য দেশে গুণী এবং রসিকের মধ্যেই রূপ-রসের যে বোধ দেখতে পাওয়া যায়, এ দেশে সমস্ত জাতের মধ্যে তাই চড়িয়ে পড়েচে। য়ুরোপে সর্ব্বজনীন বিদ্যাশিক্ষা আছে, সর্ব্বজনীন সৈনিকতার চর্চ্চাও সেখানে অনেক জায়গায় প্রচলিত,―কিন্তু এমনতর সর্ব্বজনীন রসবোধের সাধনা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এখানে দেশের সমস্ত লোক সুন্দরের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
তাতে কি এরা বিলাসী হয়েচে? অকর্ম্মণ্য হয়েচে? জীবনের কঠিন সমস্যা ভেদ কর্তে এরা কি উদাসীন কিম্বা অক্ষম হয়েছে?—ঠিক তার উল্টো। এরা এই সৌন্দর্য্যসাধনা থেকেই মিতাচার শিখেচে; এই সৌন্দর্যসাধনা থেকেই এরা বীর্য্য এবং কর্ম্মনৈপুণ্য লাভ করেচে। আমাদের দেশে একদল লোক আছে, তারা মনে করে শুষ্কতাই বুঝি পৌরুষ। এবং কর্ত্তব্যের পথে চল্বার সদুপায় হচ্চে রসের উপবাস,―তারা জগতের আনন্দকে মুড়িয়ে ফেলাকেই জগতের ভাল করা মনে করে।
য়ুরোপে যখন গেছি, তখন তাদের কলকারখানা, তাদের কাজের ভিড়, তাদের ঐশ্বর্য্য এবং প্রতাপ খুব করে চোখে পড়েচে এবং মনকে অভিভূত করেচে। তবু “এহ বাহ্য।” কিন্তু জাপানে আধুনিকতার ছদ্মবেশ ভেদ করে যা চোখে পড়ে, সে হচ্চে মানুষের হৃদয়ের সৃষ্টি। সে অহঙ্কার নয়, আড়ম্বর নয়,—সে পূজা। প্রতাপ নিজেকে প্রচার করে; এই জন্যে যতদূর পারে বস্তুর আয়তনকে বাড়িয়ে তুলে’ আর-সমস্তকে তার কাছে নত কর্তে চায়। কিন্তু পূজা আপনার চেয়ে বড়কে প্রচার করে; এই জন্যে তার আয়োজন সুন্দর এবং খাঁটি, কেবলমাত্র মস্ত এবং অনেক নয়। জাপান আপনার ঘরে বাইরে সর্ব্বত্র সুন্দরের কাছে আপন অর্ঘ্য নিবেদন করে দিচ্চে। এদেশে আসবামাত্র সকলের চেয়ে বড় বাণী যা কানে এসে পৌঁছয় সে হচ্চে “আমার ভাল লাগ্ল, আমি ভাল বাসলুম।” এই কথাটি দেশসুদ্ধ সকলের মনে উদয় হওয়া সহজ নয়, এবং সকলের বাণীতে প্রকাশ হওয়া আরো শক্ত। এখানে কিন্তু প্রকাশ হয়েচে। প্রত্যেক ছোট জিনিষে, ছোট ব্যবহারে, সেই আনন্দের পরিচয় পাই। সেই আনন্দ, ভোগের আনন্দ নয়,—পূজার আনন্দ। সুন্দরের প্রতি এমন আন্তরিক সম্ভ্রম অন্য কোথাও দেখি নি। এমন সাবধানে যত্নে, এমন শুচিতা রক্ষা করে সৌন্দর্য্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে, অন্য কোনো জাতি শেখে নি। যা এদের ভাল লাগে, তার সামনে এরা শব্দ করে না। সংযমই প্রচুরতার পরিচয়, এবং স্তব্ধতাই গভীরতাকে প্রকাশ করে, এরা সেটা অন্তরের ভিতর থেকে বুঝেচে। এবং এরা বলে’সেই আন্তরিক বোধশক্তি এরা বৌদ্ধধর্ম্মের সাধনা থেকে পেয়েছে। এরা স্থির হয়ে শক্তিকে নিরোধ করতে পেয়েছে বলেই, সেই অক্ষুন্ন শক্তি এদের দৃষ্টিকে বিশুদ্ধ এবং বোধকে উজ্জ্বল করে তুলেচে।
পূর্ব্বেই বলেছি, প্রতাপের পরিচয়ে মন অভিভূত হয়—কিন্তু এখানে যে পূজার পরিচয় দেখি, তাতে মন অতিভবের অপমান অনুভব করে না। মন, অনিন্দিত হয়, ঈর্ষান্বিত হয় না। কেননা, পূজা যে আপনার চেয়ে বড়কে প্রকাশ করে, সেই বড়র কাছে সকলেই আনন্দমনে নত হতে পারে, মনে কোথাও বাজে না। দিল্লিতে যেখানে প্রাচীন হিন্দু রাজার কীর্ত্তিকলার বুকের মাঝখানে কুতুবমিনার অহঙ্কারের মুষলের মত খাড়া হয়ে আছে, সেখানে সেই ঔদ্ধত্য মানুষের মনকে পীড়া দেয়, কিম্বা কাশীতে যেখানে হিন্দুর পূজাকে অপমানিত করবার জন্যে আরঙজীব মসজিদ স্থাপন করেছে, সেখানে না দেখি শ্রীকে, না দেখি কল্যাণকে। কিন্তু যখন তাজমহলের সাম্নে গিয়ে দাঁড়াই, তখন এ তর্ক মনে আসে না যে, এটা হিন্দুর কীর্ত্তি, না মুসলমানের কীর্ত্তি। তখন এ’কে মানুষের কীর্ত্তি বলেই হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করি।
জাপানের যেটা শ্রেষ্ঠ প্রকাশ, সেটা অহঙ্কারের প্রকাশ নয়,―আত্মনিবেদনের প্রকাশ; সেই জন্যে এই প্রকাশ মানুষকে আহ্বান করে, আঘাত করে না। এই জন্যে জাপানে যেখানে এই ভাবের বিরোধ দেখি, সেখানে মনের মধ্যে বিশেষ পীড়া বোধ করি। চীনের সঙ্গে নৌযুদ্ধে জাপান জয়লাভ করেছিল—সেই জয়ের চিহ্নগুলিকে কাঁটার মত দেশের চারদিকে পুঁতে রাখা যে বর্ব্বরতা, সেটা যে অসুন্দর, সে কথা জাপানের বোঝা উচিত ছিল। প্রয়োজনের খাতিরে অনেক ক্রুর কর্ম্ম মানুষকে করতে হয়, কিন্তু সেগুলোকে ভুলতে পারাই মনুষ্যত্ব। মানুষের যা চিরস্মরণীয়, যার জন্যে মানুষ মন্দির করে, মঠ করে,―সেত হিংসা নয়।
আমরা অনেক আচার, অনেক আসবাব য়ুরোপের কাছ থেকে নিয়েচি―সব সময়ে প্রয়োজনের খাতিরে নয়—কেবল মাত্র সেগুলো য়ুরোপীয় বলেই। য়ুরোপের কাছে আমাদের মনের এই যে পরাভব ঘটেচে, অভ্যাসবশত সেজন্যে আমরা লজ্জা করতেও ভুলে গেচি। য়ুরোপের যত বিদ্যা আছে, সবই আমাদের শেখবার―এ কথা মানি; কিন্তু যত ব্যবহার আছে, সবই যে আমাদের নেবার—এ কথা আমি মানি নে। তবু, যা নেবার যোগ্য জিনিষ, তা সব দেশ থেকেই নিতে হবে—এ কথা বল্তে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু সেই জন্যেই, জাপানে যে সব ভারতবাসী এসেছে, তাদের সম্বন্ধে একটা কথা আমি বুঝতে পারি নে। দেখতে পাই তারা ত য়ুরোপের নানা অনাবশ্যক, নানা কুশ্রী জিনিষও নকল করেচে; কিন্তু তারা কি জাপানের কোনো জিনিষই চোখে দেখতে পায় না? তারা এখান থেকে যে সব বিদ্যা শেখে, সেও য়ুরোপের বিদ্যা—এবং যাদের কিছুমাত্র আর্থিক বা অন্যরকম সুবিধা আছে, তারা কোনোমতে এখান থেকে আমেরিকায় দৌড় দিতে চায়। কিন্তু যে সব বিদ্যা এবং আচার ও আসবাব জাপানের সম্পূর্ণ নিজের, তার মধ্যে কি আমরা গ্রহণ করবার জিনিস কিছুই দেখি নে?
আমি নিজের কথা বল্তে পারি, আমাদের জীবনযাত্রার উপযোগী জিনিষ আমরা এখান থেকে যত নিতে পারি, এমন য়ুরোপ থেকে নয়। তা ছাড়া জীবনযাত্রার রীতি যদি আমরা অসঙ্কোচে জাপানের কাছ থেকে শিখে নিতে পারতুম, তাহলে আমাদের ঘর দুয়ার এবং ব্যবহার শুচি হত, সুন্দর হত, সংযত হত। জাপান ভারতবর্ষ থেকে যা পেয়েছে, তাতে আজ ভারতবর্ষকে লজ্জা দিচ্ছে; কিন্তু দুঃখ এই যে, সেই লজ্জা অনুভব করবার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের যত লজ্জা সমস্ত কেবল য়ুরোপের কাছে,তাই য়ুরোপের ছেঁড়া কাপড় কুড়িয়ে কুড়িয়ে তালি-দেওয়া অদ্ভুত আবরণে আমরা লজ্জা রক্ষা করতে চাই। এদিকে জাপান-প্রবাসী ভারতবাসীরা বলে, জাপান আমাদের এসিয়াবাসী বলে অবজ্ঞা করে; অথচ আমরাও জাপানকে এম্নি অবজ্ঞা করি যে, তার আতিথ্য গ্রহণ করেও প্রকৃত জাপানকে চক্ষেও দেখি নে, জাপানের ভিতর দিয়ে বিকৃত য়ুরোপকেই কেবল দেখি। জাপানকে, যদি দেখতে পেতুম, তাহলে আমাদের ঘর থেকে অনেক কুশ্রীতা, অশুচিতা অব্যবস্থা, অসংয়ম আজ দূরে চলে যেত।
বাঙলা দেশে আজ শিল্পকলার নূতন অভ্যুদয় হয়েচে, আমি সেই শিল্পীদের জাপানে আহ্বান করচি। নকল করবার জন্যে নয়, শিক্ষা করবার জন্যে। শিল্প জিনিষটা যে কত বড় জিনিষ, সমস্ত জাতির সেটা যে কত বড় সম্পদ, কেবলমাত্র সৌখিনতাকে সে যে কতদূর পর্য্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে― তার মধ্যে জ্ঞানীর জ্ঞান, ভক্তের ভক্তি, রসিকের রসবোধ যে কত গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে আপনাকে প্রকাশ করবার চেষ্টা করেচে, তা এখানে এলে তবে স্পষ্ট বোঝা যায়।
টোকিয়োতে আমি যে শিল্পীবন্ধুর বাড়ীতে ছিলুম, সেই টাইক্কানের নাম পূর্ব্বেই বলেছি, ছেলেমানুষের মত তাঁর সরলতা; তাঁর হাসি, তাঁর চারিদিককে হাসিয়ে রেখে দিয়েছে। প্রসন্ন তাঁর মুখ, উদার তাঁর হৃদয়, মধুর তাঁর স্বভাব। যত দিন তাঁর বাড়িতে ছিলুম, আমি জান্তেই পারি নি তিনি কত বড় শিল্পী। ইতিমধ্যে য়োকোহামায় একজন ধনী এবং রসজ্ঞ ব্যক্তির আমরা আতিথ্য লাভ করেচি। তাঁর এই বাগানটি নন্দনবনের মত এবং তিনিও সকল বিষয়ে এখানকারই যোগ্য। তাঁর নাম “হারা”। তাঁর কাছে শুনলুম, য়োকোহামায় টাইক্কান এবং তানজান শিমোমুরা আধুনিক জাপানের দুই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী। তাঁরা আধুনিক যুরোপের নকল করেন না, প্রাচীন জাপানেরও না। তাঁরা প্রথার বন্ধন থেকে জাপানের শিল্পকে মুক্তি দিয়েচেন। হারার বাড়িতে টাইক্কানের ছবি যখন প্রথম দেখলুম, আশ্চর্য্য হয়ে গেলুম। তাতে না আছে বাহুল্য, না আছে সৌখিনতা। তাতে যেমন একটা জোর আছে, তেমনি সংযম। বিষয়টা এই; চীনের একজন প্রাচীন কালের কবি ভাবে ভোর হয়ে চলেচে―তার পিছনে একজন বালক্ একটি বীণাযন্ত্র বহু যত্নে বহন করে নিয়ে যাচ্চে, তাতে তার নেই; তার পিছনে একটি বাঁকা উইলো গাছ। জাপানে তিনভাগওয়ালা যে খাড়া পর্দ্দার প্রচলন আছে, সেই রেশমের পর্দ্দার উপর আঁকা। মস্ত পর্দ্দা এবং প্রকাণ্ড ছবি। প্রত্যেক রেখা প্রাণে ভরা। এর মধ্যে ছোটখাটো কিম্বা জবড়জঙ্গ কিছুই নেই—যেমন উদার, তেমনি গভীর, তেমনি আয়াসহীন। নৈপুণ্যের কথা একেবারে মনেই হয় না—নানা রং, নানা রেখার সমাবেশ নেই—দেখবামাত্র মনে হয় খুব বড় এবং খুব সত্য। তারপরে তাঁর ভূদৃশ্যচিত্র দেখ্লুম। একটি ছবি,—পটের উচ্চপ্রান্তে একখানি পূর্ণচাঁদ, মাঝখানে একটি নৌকা, নীচের প্রান্তে দুটো দেওদার গাছের ডাল দেখা যাচ্চে—আর কিছু না―জলের কোনো রেখা পর্য্যন্ত নেই। জ্যোৎস্নার আলোয় স্থির জল কেবলমাত্র বিস্তীর্ণ শুভ্রতা, ―এটা যে জল, সে কেবলমাত্র ঐ নৌকা আছে বলেই বোঝা যাচ্ছে,; আর এই সর্ব্বব্যাপী বিপুল জ্যোৎস্নাকে ফলিয়ে তোলবার জন্যে যত কিছু কালিমা,―সে কেবলি ঐ দুটো পাইন গাছের ডালে। ওস্তাদ এমন একটা জিনিসকে আঁক্তে চেয়েছেন, যার রূপ নেই, যা বৃহৎ এবং নিস্তব্ধ―জ্যোৎস্নারাত্রি,অতলস্পর্শ তার নিঃশব্দতা। কিন্তু আমি যদি তাঁর সব ছবির বিস্তারিত বর্ণনা করতে যাই, তাহলে আমার কাগজও ফুরােবে, সময়েও কুলবে না। হারা সান সবশেষে নিয়ে গেলেন একটি লম্বা সঙ্কীর্ণ ঘরে, সেখানে একদিকের প্রায় সমস্ত দেয়াল জুড়ে একটি খাড়া পর্দ্দা দাঁড়িয়ে। এই পর্দ্দায় শিমোমুরার আঁকা একটি প্রকাণ্ড ছবি। শীতের পরে প্রথম বসন্ত এসেছে—প্লাম গাছের ডালে একটাও পাতা নেই, শাদা শাদা ফুল ধরেচে—ফুলের পাপড়ি ঝরে ঝরে পড়চে;―বৃহৎ পর্দ্দার এক প্রান্তে দিগন্তের কাছে রক্তবর্ণ সূর্য্য দেখা দিয়েছে—পর্দ্দার অপর প্রান্তে প্লাম গাছের রিক্ত ডালের আড়ালে দেখা যাচ্চে একটী অন্ধ হাতজোড় করে সূর্য্যের বন্দনায় রত। একটি অন্ধ, এক গাছ, এক সূর্য্য, আর সােনায় ঢালা এক সুবৃহৎ আকাশ; এমন ছবি আমি কখনাে দেখি নি। উপনিষদের সেই প্রার্থনাবাণী যেন রূপ ধরে আমার কাছে দেখা দিলে,―তমসাে মা জ্যোতির্গময়। কেবল অন্ধ মানুষের নয়, অন্ধ প্রকৃতির এই প্রার্থনা—তমসো মা জ্যোতির্গময়—সেই প্লাম গাছের একাগ্র প্রসারিত শাখা প্রশাখার ভিতর দিয়ে জ্যোতির্লোকের দিকে উঠ্চে। অথচ আলােয় আলোময়―তারি মাঝখানে অন্ধের প্রার্থনা।
কাল শিমােমুরার আর একটা ছবি দেখ্লুম। পটের আয়তন ত ছােট, অথচ ছবির বিষয় বিচিত্র। সাধক তার ঘরের মধ্যে বসে ধ্যান করচে―তার সমস্ত রিপুগুলি তাকে চারদিকে আক্রমণ করেচে। অর্দ্ধেক মানুষ অর্দ্ধেক জন্তুর মত তাদের আকার, অত্যন্ত কুৎসিত―তাদের কেউ বা খুব সমারোহ করে আস্চে, কেউ বা আড়ালে আবডালে উঁকিঝুঁকি মারচে। কিন্তু তবু এরা সবাই বাইরেই আছে—ঘরের ভিতরে তার সাম্নে সকলের চেয়ে তার বড় রিপু বসে আছে—তার মূর্ত্তি ঠিক বুদ্ধের মত। কিন্ত লক্ষ্য করে দেখ্লেই দেখা যায়, সে সাঁচ্চা বুদ্ধ নয়,― স্থূল তার দেহ, মুখে তার বাঁকা হাসি। সে কপট আত্মম্ভরিতা, পবিত্র রূপ ধরে এই সাধককে বঞ্চিত করচে। এ হচ্চে আধ্যাত্মিক অহমিকা, শুচি এবং সুগম্ভীর মুক্তস্বরূপ বুদ্ধের ছদ্মবেশ ধরে আছে—একেই চেনা শক্ত—এই হচ্ছে অন্তরতম রিপু, অন্য কদর্য্য রিপুরা বাইরের। এইখানে দেবতাকে উপলক্ষ্য করে মানুষ আপনার প্রবৃত্তিকে পূজা করচে।
আমরা যাঁর আশ্রয়ে আছি, সেই হারা সান গুণী এবং গুণজ্ঞ। তিনি রসে হাস্যে ঔদার্য্যে পরিপূর্ণ। সমুদ্রের ধারে, পাহাড়ের গায়ে তাঁর এই পরম সুন্দর বাগানটি সর্ব্বসাধারণের জন্যে নিত্যই উদ্ঘাটিত। মাঝে মাঝে বিশ্রামগৃহ আছে,― যে খুসি সেখানে এসে চা খেতে পারে। একটা খুব লম্বা ঘর আছে, সেখানে যারা বনভোজন করতে চায় তাদের জন্যে ব্যবস্থা আছে। হারা সানের মধ্যে কৃপণতাও নেই, আড়ম্বরও নেই, অথচ তাঁর চারদিকে সমারোহ আছে। মূঢ় ধনাভিমানীর মত তিনি মূল্যবান জিনিষকে কেবলমাত্র সংগ্রহ করে রাখেন না,―তার মূল্য তিনি বুঝেন, তার মূল্য তিনি দেন, এবং তার কাছে তিনি সম্ভ্রমে আপনাকে নত করতে জানেন।