জাপান-যাত্রী/৮
৮
শুনেছিলুম, পারস্যের রাজা যখন ইংলণ্ডে গিয়াছিলেন, তখন হাতে-খাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি ইংরেজকে বলেছিলেন, কাঁটাচামচ দিয়ে খেতে গিয়ে তোমরা খাওয়ার একটা আনন্দ থেকে বঞ্চিত হও। যার ঘটকের হাত দিয়ে বিয়ে করে তারা কোর্টশিপের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। হাত দিয়ে স্পর্শ করেই খাবারের সঙ্গে কোর্টশিপ আরম্ভ হয়। আঙুলের ডগা দিয়েই স্বাদ গ্রহণের শুরু।
আমার তেমনি জাহাজ থেকেই জাপানের স্বাদ শুরু হয়েছে। যদি ফরাসী জাহাজে করে জাপানে যেতুম, তাহলে আঙুলের ডগা দিয়ে পরিচয় আরম্ভ হত না।
এর আগে অনেকবার বিলিতি জাহাজে করে সমুদ্র যাত্রা করেচি―তার সঙ্গে এই জাহাজের বিস্তর তফাৎ। সে সব জাহাজের কাপ্তেন ঘোরতর কাপ্তেন। যাত্রীদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া হাসি তামাসা যে তার বন্ধ—তা নয়; কিন্তু কাপ্তেনীটা খুব টক্টকে রাঙা। এত জাহাজে আমি ঘুরেচি, তার মধ্যে কোনো কাপ্তেনকেই আমার মনে পড়ে না। কেননা তারা কেবলমাত্র জাহাজের অঙ্গ। জাহাজ-চালানোর মাঝখান দিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ।
হতে পারে আমি যদি য়ুরোপীয় হতুম, তাহলে তারা যে কাপ্তেন ছাড়াও আর কিছু—তারা যে মানুষ—এটা আমার অনুভব কর্তে বিশেষ বাধা হত না। কিন্তু এ জাহাজেও আমি বিদেশী,― একজন য়ুরোপীয়ের পক্ষেও আমি যা, একজন জাপানীর পক্ষেও আমি তাই।
এ জাহাজে চড়ে অবধি দেখতে পাচ্ছি, আমাদের কাপ্তেনের কাপ্তেনীটা কিছুমাত্র লক্ষ্যগোচর নয়, একেবারেই সহজ মানুষ। যারা তাঁর নিম্নতর কর্ম্মচারী, তাঁদের সঙ্গে তাঁর কর্ম্মের সম্বন্ধ এবং দূরত্ব আছে, কিন্তু যাত্রীদের সঙ্গে কিছুমাত্র নেই। যোতর ঝড়ঝাপটের মধ্যেও তাঁর ঘরে গেছি,—দিব্যি সহজ ভাব। কথায় বার্ত্তায় ব্যবহারে তাঁর সঙ্গে আমাদের যে জমে গিয়েছে, সে কাপ্তেন-হিসাবে নয়, মানুষ হিসাবে। এ যাত্রা আমাদের শেষ হয়ে যাবে, তাঁর সঙ্গে জাহাজ-চলার সম্বন্ধ আমাদের ঘুচে যাবে, কিন্তু তাঁকে আমাদের মনে থাকবে।
আমাদের ক্যাবিনের যে স্টুয়ার্ড আছে, সেও দেখি তার কাজকর্ম্মের সীমাটুকুর মধ্যেই শক্ত হয়ে থাকে না। আমরা আপনাদের মধ্যে কথাবার্তা কচ্চি, তার মাঝখানে এসে সেও ভাঙা ইংরাজিতে যোগ দিতে বাধা বোধ করে না। মুকুল ছবি আঁকচে, সে এসে খাতা চেয়ে নিয়ে তার মধ্যে ছবি আঁকতে লেগে।
আমাদের জাহাজের যিনি খাজাঞ্চি, তিনি একদিন এসে আমাকে বল্লেন,—আমার মনে অনেক বিষয়ে প্রশ্ন আসে, তোমার সঙ্গে তার বিচার করতে ইচ্ছে করি; কিন্তু আমি ইংরাজি এত কম জানি যে, মুখে মুখে আলোচনা করা খামার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি যদি কিছু না মনে কর, তবে আমি মাঝে মাঝে কাগজে আমার প্রশ্ন লিখে এনে দেব, তুমি অবসরমত সংক্ষেপে দু’চার কথায় তার উত্তর লিখে দিয়ো।—তারপর থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের সম্বন্ধ কি, এই নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার প্রশ্নোত্তর চল্চে।
অন্য কোন জাহাজের খাজাঞ্চি এই সব প্রশ্ন নিয়ে যে মাথা বকায়, কিম্বা নিজের কাজকর্ম্মের মাঝখানে এরকম উপসর্গের সৃষ্টি করে, এরকম আমি মনে কর্তে পারিনে। এদের দেখে আমার মনে হয় এরা নূতন-জাগ্রত জাতি,—এরা সমস্তই নূতন করে জান্তে, নূতন করে ভাবতে উৎসুক। ছেলেরা নতুন জিনিষ দেখ্লে যেমন ব্যগ্র হয়ে ওঠে, আইডিয়া সম্বন্ধে এদের যেন সেইরকম ভাব।
তা ছাড়া আর একটা বিশেষত্ব এই যে, একপক্ষে জাহাজের যাত্রী, আর এক পক্ষে জাহাজের কর্ম্মচারী, এর মাঝখানকার গণ্ডিটা তেমন শক্ত নয়। আমি যে এই খাজাঞ্চির প্রশ্নের উত্তর লিখ্তে বসব, এ কথা মনে কর্তে তার কিছু বাধেনি, আমি দুটো কথা শুনতে চাই, তুমি দুটো কথা বল্বে, এতে বিঘ্ন কি আছে? মানুষের উপর মানুষের যে একটি দাবী আছে, সেই দাবীটা সরলভাবে উপস্থিত কর্লে মনের মধ্যে আপনি সাড়া দেয়, তাই আমি খুসি হয়ে আমার সাধ্যমত এই আলোচনায় যোগ দিয়েচি।
আর একটা জিনিষ আমার বিশেষ করে চোখে লাগ্চে। মুকুল বালকমাত্র, সে ডেকের প্যাসেঞ্জার। কিন্তু জাহাজের কর্ম্মচারীরা তার সঙ্গে অবাধে বন্ধুত্ব কর্চে। কি করে জাহাজ চালায়, কি করে সমুদ্রে পথ নির্ণয় করে, কি করে গ্রহনক্ষত্র পর্য্যবেক্ষণ কর্তে হয়, কাজ কর্তে কর্তে তারা এই সমস্ত তাকে বোঝায়। তা ছাড়া নিজেদের কাজকর্ম্ম আশাভরসার কথাও ওর সঙ্গে হয়। মুকুলের সখ গেল, জাহাজের এঞ্জিনের ব্যাপার দেখ্বে। ওকে কাল রাত্রি এগারোটার সময় জাহাজের পাতালপুরীর মধ্যে নিয়ে গিয়ে, এক ঘণ্টা ধরে সমস্ত দেখিয়ে আন্লে।
কাজের সম্বন্ধের ভিতর দিয়েও মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্বন্ধ―এইটেই বোধ হয় আমাদের পূর্ব্বদেশের জিনিষ। পশ্চিমদেশ কাজকে খুব শক্ত করে খাড়া করে রাখে, সেখানে মানব-সম্বন্ধের দাবী ঘেঁষতে পারে না। তাতে কাজ খুব পাকা হয় সন্দেহ নেই। আমি ভেবেছিলুম জাপান ত য়ুরোপের কাছ থেকে কাজের দীক্ষা গ্রহণ করেচে, অতএব তার কাজের গণ্ডিও বোধ হয় পাকা। কিন্তু এই জাপানী জাহাজে কাজ দেখতে পাচ্চি, কাজের গণ্ডিগুলোকে দেখতে পাচ্চিনে। মনে হচ্চে যেন আপনার বাড়ীতে আছি—কোম্পানির জাহাজে নেই। অথচ ধোওয়া মাজা প্রভৃতি জাহাজের নিত্যকর্ম্মের কোন খুঁৎ নেই।
প্রাচ্যদেশে মানবসমাজের সম্বন্ধগুলি বিচিত্র এবং গভীর। পূর্ব্বপুরুষ যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গেও আমাদের সম্বন্ধ ছিন্ন হয় না। আমাদের আত্মীয়তার জাল বহুবিস্তৃত। এই নানা সম্বন্ধের নানা দাবী মেটানো আমাদের চিরাভ্যস্ত, সেই জন্যে তাতে আমাদের আনন্দ। আমাদের ভৃত্যেরাও কেবল বেতনের নয়, আত্মীয়তার দাবী করে। সেই জন্যে যেখানে আমাদের কোনো দাবী চলেনা, যেখানে কাজ অত্যন্ত খাড়া, সেখানে আমাদের প্রকৃতি কষ্ট পায়। অনেক সময়ে ইংরেজ মনিবের সঙ্গে বাঙালী কর্মচারীর যে বোঝাপড়ার অভাব ঘটে, তার কারণ এই,—ইংরেজি কর্ত্তা বাঙালী কর্ম্মচারীর দাবী বুঝতে পারে না, বাঙালী কর্ম্মচারী ইংরেজ কর্ত্তার কাজের কড়া শাসন বুঝতে পারে না। কর্ম্মশালার কর্ত্তা যে কেবলমাত্র কর্ত্তা হবে, তা নয়―মা বাপ হবে, বাঙালী কর্ম্মচারী চিরকালের অভ্যাস বশত এইটে প্রত্যাশা করে; যখন বাধা পায় তখন আশ্চর্য্য হয়, এবং মনে মনে মনিবকে দোষ না দিয়ে থাকতে পারে না। ইংরেজ কাজের দাবীকে মানতে অভ্যস্ত, বাঙালী মানুষের দাবীকে মান্তে অভ্যস্ত,―এই জন্যে উভয়পক্ষে ঠিকমত মিট্মাট্ হতে চায় না।
কিন্তু কাজের সম্বন্ধ এবং মানুষের সম্বন্ধ, এ দুইয়ের বিচ্ছেদ না হয়ে সামঞ্জস্য হওয়াটাই দরকার, এ কথা না মনে করে থাকা যায় না। কেমন করে সামঞ্জস্য হতে পারে, বাইরে থেকে তার কোনো বাঁধা নিয়ম ঠিক করে দেওয়া যায় না। সত্যকার সামঞ্জস্য প্রকৃতির ভিতর থেকে ঘটে। আমাদের দেশে প্রকৃতির এই ভিতরকার সামঞ্জস্য ঘটে ওঠা কঠিন কেননা যাঁরা আমাদের কাজের কর্ত্তা, তাদের নিয়ম অনুসারেই আমরা কাজ চালাতে বাধ্য।
জাপানে প্রাচ্যমন পাশ্চাত্যের কাছ থেকে কাজের শিক্ষালাভ করেছে, কিন্তু কাজের কর্ত্তা তারা নিজেই। এই জন্যে মনের ভিতরে একটা আশা হয় যে, জাপানে হয় ত পাশ্চাত্য কাজের সঙ্গে প্রাচ্যভাবের একটা সামঞ্জস্য ঘটে উঠ্তে পারে। যদি সেটা ঘটে, তবে সেইটেই পূর্ণতার আদর্শ হবে। শিক্ষার প্রথম অবস্থায় অনুকরণের ঝাঁজটা যখন কড়া থাকে, তখন বিধিবিধান সম্বন্ধে ছাত্র গুরুর চেয়ে আরো কড়া হয়; কিন্তু ভিতরকার প্রকৃতি আস্তে আস্তে আপনার কাজ কর্তে থাকে, এবং শিক্ষার কড়া অংশগুলোকে নিজের জারক রসে গলিয়ে আপন করে নেয়। এই জীর্ণ করে নেওয়ার কাজটা একটু সময়সাধ্য। এই জন্যেই পশ্চিমের শিক্ষা জাপানে কি আকার ধারণ কর্বে, সেটা স্পষ্ট করে দেখবার সময় এখনো হয় নি। সম্ভবত এখন আমরা প্রাচ্য পাশ্চাত্যের বিস্তর অসামঞ্জস্য দেখ্তে পাব, যেটা কুশ্রী। আমাদের দেশেও পদে পদে তা দেখ্তে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রকৃতির কাজই হচ্চে অসামঞ্জস্যগুলোকে মিটিয়ে দেওয়া। জাপানে সেই কাজ চল্চে সন্দেহ নেই। অন্ততঃ এই জাহাজ টুকুর মধ্যে আমি ত এই দুই ভাবের মিলনের চিহ্ণ দেখ্তে পাচ্চি।