জীবন-স্মৃতি (১৯৪১)/কবিতা রচনারম্ভ
কবিতা রচনারম্ভ
আমার বয়স তখন সাত-আট বছরের বেশি হইবে না। আমার এক ভাগিনেয় শ্রীযুক্ত জ্যোতিপ্রকাশ আমার চেয়ে বয়সে বেশ একটু বড়ো। তিনি তখন ইংরেজি সাহিত্যে প্রবেশ করিয়া খুব উৎসাহের সঙ্গে হ্যামলেটের স্বগত উক্তি আওড়াইতেছেন। আমার মতো শিশুকে কবিতা লেখাইবার জন্য তাঁহার হঠাৎ কেন যে উৎসাহ হইল তাহা আমি বলতে পারি না। একদিন দুপুরবেলা তাহার ঘরে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, তোমাকে পদ্য লিখিতে হইবে। বলিয়া পয়ার ছন্দে চৌদ্দ অক্ষর যোগাযোগের রীতিপদ্ধতি আমাকে বুঝাইয়া দিলেন।
পদ্য জিনিসটিকে এ-পর্যন্ত কেবল ছাপার বহিতেই দেখিয়াছি। কাটাকুটি নাই, ভাবচিন্তা নাই, কোনোখানে মর্ত্যজনোচিত দুর্বলতার কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। এই পদ্য যে নিজে চেষ্টা করিয়া লেখা যাইতে পারে এ-কথা কল্পনা করিতেও সাহস হইত না। একদিন আমাদের বাড়িতে চোর ধরা পড়িয়াছিল। অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে অথচ নিরতিশয় কৌতূহলের সঙ্গে তাহাকে দেখিতে গেলাম। দেখিলাম নিতান্তই সে সাধারণ মানুষের মতো। এমন অবস্থায় দরােয়ান যখন তাহাকে মারিতে শুরু করিল আমার মনে অত্যন্ত ব্যথা লাগিল। পদ্যসম্বন্ধেও আমার সেই দশা হইল। গােটাকয়েক শব্দ নিজের হাতে জোড়াতাড়া দিতেই যখন তাহা পয়ার হইয়া উঠিল তখন পদ্যরচনার মহিমাসম্বন্ধে মােহ আর টিকিল না। এখন দেখিতেছি পদ্য বেচারার উপরেও মার সয় না। অনেক সময় দয়াও হয়, কিন্তু মারও ঠেকানো যায় না, হাত নিসপিস করে। চোরের পিঠেও এত লোকের এত বাড়ি পড়ে নাই।
ভয় যখন একবার ভাঙিল তখন আর ঠেকাইয়া রাখে কে। কোনো একটি কর্মচারীর কৃপায় একখানি নীল-কাগজের খাতা জোগাড় করিলাম। তাহাতে স্বহস্তে পেনসিল দিয়া কতকগুলা অসমান লাইন কাটিয়া বড়ো বড়াে কাঁচা অক্ষরে পদ্য লিখিতে শুরু করিয়া দিলাম।
হরিণ-শিশুর নূতন শিং বাহির হইবার সময় সে যেমন যেখানে-সেখানে গুতা মারিয়া বেড়ায়, নূতন কাব্যোগম লইয়া আমি সেইরকম উৎপাত আরম্ভ করিলাম। বিশেষত আমার দাদা আমার এই সকল রচনায় গর্ব অনুভব করিয়া শ্রোতাসংগ্রহের উৎসাহে সংসারকে একেবারে অতিষ্ট করিয়া তুলিলেন। মনে আছে একদিন একতলায় আমাদের জমিদারি কাছারির আমলাদের কাছে কবিত্ব ঘােষণা করিয়া আমরা দুই ভাই বাহির হইয়া আসিতেছি এমন সময় তখনকার “ন্যাশানাল পেপার” পত্রের এডিটার শ্রীযুক্ত নবগােপাল মিত্র সবেমাত্র আমাদের বাড়িতে পদার্পণ করিয়াছেন। তৎক্ষণাৎ দাদা তাহাকে গ্রেফতার করিয়া কহিলেন “নব-গোপালবাবু, রবি একটা কবিতা লিখিয়াছে, শুনুন না।” শুনাইতে বিলম্ব হইল না। কাব্যগ্রন্থাবলীর বােঝ তখন ভারি হয় নাই। কবিকীর্তি কবির জামার পকেটে পকেটেই তখন অনায়াসে ফেরে। নিজেই তখন লেখক, মুদ্রাকর, প্রকাশক এই তিনে-এক একে-তিন হইয়া ছিলাম। কেবল বিজ্ঞাপন দিবার কাজে আমার দাদা আমার সহযােগী ছিলেন। পদ্মের উপরে একটা কবিতা লিখিয়াছিলাম সেটা দেউড়ির সামনে দাড়াইয়াই উৎসাহিত উচ্চকণ্ঠে নবগােপালবাবুকে শুনাইয়া দিলাম। তিনি একটু হাসিয়া বলিলেন, বেশ হইয়াছে, কিন্তু ওই “দ্বিরেফ” শব্দটার মানে কী।
“দ্বিরেফ” এবং “ভ্রমর” দুটোই তিন অক্ষরের কথা। ভ্রমর শব্দটা ব্যবহার করিলে ছন্দের কোনাে অনিষ্ট হইত না। ওই দুরূহ কথাটা কোথা হইতে সংগ্রহ করিয়াছিলাম, মনে নাই। সমস্ত কবিতাটার মধ্যে ওই শব্দটার উপরেই আমার আশা-ভরসা সব চেয়ে বেশি ছিল। দফতরখানার আমলা-মহলে নিশ্চয়ই ওই কথাটাতে বিশেষ ফল পাইয়াছিলাম। কিন্তু নবগােপালবাবুকে ইহাতেও লেশমাত্র দুর্বল করিতে পারিল না। এমন কি, তিনি হাসিয়া উঠিলেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হইল নবগোপালবাবু সমজদার লোক নহেন। তাঁহাকে আর কখনো কবিতা শুনাই নাই। তাহার পরে আমার বয়স অনেক হইয়াছে কিন্তু কে সমজদার, কে নয়, তাহা পরখ করিবার প্রণালীর বিশেষ পরিবর্তন হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। যাই হোক্ নবগোপালবাবু হাসিলেন বটে কিন্তু “দ্বিরেফ” শব্দটা মধুপানমত্ত ভ্রমরেরই মতো স্বস্থানে অবিচলিত রহিয়া গেল।