জীবন-স্মৃতি (১৯৪১)/ভৃত্যরাজক তন্ত্র
ভৃত্যরাজক তন্ত্র
ভারতবর্ষের ইতিহাসে দাসরাজাদের রাজত্বকাল সুখের কাল ছিল না। আমার জীবনের ইতিহাসেও ভৃত্যদের শাসনকালটা যখন আলোচনা করিয়া দেখি তখন তাহার মধ্যে মহিমা বা আনন্দ কিছুই দেখিতে পাই না। সকল রাজাদের পরিবর্তন বারংবার ঘটিয়াছে কিন্তু আমাদের ভাগ্যে সকল তাতেই নিষেধ ও প্রহারের ব্যবস্থার বৈলক্ষণা ঘটে নাই। তখন এ-সম্বন্ধে তত্ত্বালোচনার অবসর পাই নাই~-পিঠে যাহা পড়িত তাহা পিঠে করিয়াই লইতাম এবং মনে জানিতাম সংসারের ধর্ম ই এই—বড়ো যে সে মারে, ছোটো যে সে মার খায়। ইহার বিপরীত কথাটা, অর্থাৎ, ছোটো যে সেই মারে, বড় যে সেই মার খায়—শিখিতে বিস্তর বিলম্ব হইয়াছে। কোনটা দুষ্ট এবং কোনটা শিষ্ট, ব্যাধ তাহা পাখির দিক হইতে দেখে না, নিজের দিক হইতেই দেখে। সেই জন্য গুলি খাইবার পূর্বেই যে সতর্ক পাখি চীৎকার করিয়া দল ভাগায় শিকারী তাহাকে গালি দেয়। মার খাইলে আমরা কাঁদিতাম, প্রহারকতা সেটাকে শিষ্টাচিত বলিয়া গণ্য করিত না। বস্তুত সেটা ভৃত্যরাজদের বিরুদ্ধে সিডিশন। আমার বেশ মনে আছে সেই সিডিশন সম্পূর্ণ দমন করিবার জন্য জল রাখিবার বড়ো বড়াে জালার মধ্যে আমাদের রােদনকে বিলুপ্ত করিয়া দিবার চেষ্টা করা হইত। রােদন জিনিসটা প্রহার-কারীর পক্ষে অত্যন্ত অপ্রিয় এবং অসুবিধাজনক এ-কথা কেহই অস্বীকার করিতে পারিবে না।
এখন এক-একবার ভাবি ভৃত্যদের হাত হইতে কেন এমন নির্মম ব্যবহার আমরা পাইতাম। মােটের উপরে আকার-প্রকারে আমরা যে স্নেহদয়ামায়ার অযােগ্য ছিলাম তাহা বলিতে পারি না। আসল কারণটা এই, ভৃত্যদের উপরে আমাদের সম্পূর্ণ ভার পড়িয়াছিল। সম্পূর্ণ ভার জিনিসটা বড় অসহ্য। পরমাত্মীয়ের পক্ষেও দুর্বহ। ছােটো ছেলেকে যদি ছোটো ছেলে হইতে দেওয়া যায়—সে যদি খেলিতে পায়, দৌড়িতে পায়, কৌতূহল মিটাইতে পারে তাহা হইলেই সে সহজ হয়। কিন্তু যদি মনে কর উহাকে বাহির হইতে দিব না, খেলায় বাধা দিব, ঠাণ্ডা করিয়া বসাইয়া রাখিব তাহা হইলে অত্যন্ত দুরূহ সমস্যার সৃষ্টি করা হয়। তাহা হইলে, ছেলেমানুষ ছেলেমানুষির দ্বারা নিজের যে-ভার নিজে অনায়াসেই বহন করে সেই ভার শাসনকর্তার উপরে পড়ে। তখন ঘােড়াকে মাটিতে চলিতে না দিয়া তাহাকে কাঁধে লইয়া বেড়ানো হয়। যে বেচারা কাঁধে করে তাহার মেজাজ ঠিক থাকে না। মজুরির লােভে কাঁধে করে বটে কিন্তু ঘােড়া-বেচারার উপর পদে পদে শােধ লইতে থাকে।
এই আমাদের শিশুকালের শাসনকর্তাদের মধ্যে অনেকেরই স্মৃতি কেবল কিল-চড় আকারেই মনে আছে—তাহার বেশি আর মনে পড়ে না। কেবল একজনের কথা খুব স্পষ্ট মনে জাগিতেছে।
তাহার নাম ঈশ্বর। সে পূর্বে গ্রামে গুরুমশায়গিরি করিত। সে অত্যন্ত শুচিসংযত আচারনিষ্ঠ বিজ্ঞ এবং গম্ভীর প্রকৃতির লােক। পৃথিবীতে তাহার শুচিতারক্ষার উপযােগী মাটি-জলের বিশেষ অসদ্ভাব ছিল। এইজন্য এই মৃৎপিণ্ড মেদিনীর মলিনতার সঙ্গে সর্বদাই তাহাকে যেন লড়াই করিয়া চলিতে হইত। বিদ্যুৎবেগে ঘটি ডুবাইয়া পুষ্করিণীর তিন-চার হাত নিচেকার জল সে সংগ্রহ করিত। স্নানের সময় দুই হাত দিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া পুষ্করিণীর উপরিতলের জল কাটাইতে কাটাইতে অবশেষে হঠাৎ এক সময় দ্রুতগতিতে ডুব দিয়া লইত যেন পুষ্করিণীটিকে কোনােমতে অন্যমনস্ক করিয়া দিয়া ফাঁকি দিয়া মাথা ডুবাইয়া লওয়া তাহার অভিপ্রায়। চলিবার সময়ে তাহার দক্ষিণ হস্তটি এমন একটু বক্রভাবে দেহ হইতে স্বতন্ত্র হইয়া থাকিত যে বেশ বোঝা যাইত তাহার ডান হাতটা তাহার শরীরের কাপড়চোপড়-গুলাকে পর্যন্ত বিশ্বাস করিতেছে না। জলে স্থলে আকাশে এবং লােকব্যবহারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসংখ্য দোষ প্রবেশ করিয়া আছে, অহােরাত্র সেইগুলাকে কাটাইয়া চলা তাহার এক বিষম সাধনা ছিল। বিশ্বজগৎটা কোনাে দিক দিয়া তাহার গায়ের কাছে আসিয়া তাহার পক্ষে অসহ্য। অতলস্পর্শ তাহার গাম্ভীর্য ছিল। ঘাড় ঈষৎ বাঁকাইয়া মন্দ্রস্বরে চিবাইয়া চিবাইয়া সে কথা কহিত। তাহার সাধুভাষার প্রতি লক্ষ্য করিয়া গুরুজনেরা আড়ালে প্রায়ই হাসিতেন। তাহার সম্বন্ধে আমাদের বাড়িতে একটা প্রবাদ রটিয়া গিয়াছিল যে সে “বরানগর"কে “বরাহনগর” বলে। এটা জনশ্রুতি হইতে পারে কিন্তু আমি জানি “অমুক লােক বসে আছেন”—না বলিয়া সে বলিয়াছিল “অপেক্ষা করছেন। তাহার মুখের এই সাধুপ্রয়ােগ আমাদের পারিবারিক কৌতুকালাপের ভাণ্ডারে অনেকদিন পর্যন্ত সঞ্চিত ছিল। নিশ্চয়ই এখনকার দিনে ভদ্রঘরের কোনো ভৃত্যের মুখে “অপেক্ষা করছেন” কথাটা হাস্যকর নহে। ইহা হইতে দেখা যায় বাংলায় গ্রন্থের ভাষা ক্রমে চলিত ভাষার দিকে নামিতেছে এবং চলিত ভাষা গ্রন্থের ভাষার দিকে উঠিতেছে;—একদিন উভয়ের মধ্যে আকাশপাতাল ভেদ ছিল এখন তাহা প্রতিদিন ঘুচিয়া আসিতেছে।
এই ভূতপূর্ব গুরুমহাশয় সন্ধ্যাবেলায় আমাদিগকে সংযত রাখিবার জন্য একটি উপায় বাহির করিয়াছিল। সন্ধ্যাবেলায় রেড়ির তেলের ভাঙা সেজের চারিদিকে আমাদের বসাইয়া সে রামায়ণ-মহাভারত শােনাইত। চাকরদের মধ্যে আরাে দুই-চারিটি শ্রোতা আসিয়া জুটিত। ক্ষীণ আলােকে ঘরের কড়িকাঠ পর্যন্ত মস্ত মস্ত ছায়া পড়িত, টিকটিকি দেওয়ালে পােকা ধরিয়া যাইত, চামচিকে বাহিরের বারান্দায় উন্মত্ত দরবেশের মতাে ক্রমাগত চক্রাকারে ঘুরিত,আমরা স্থির হইয়া বসিয়া হাঁ করিয়া শুনিতাম। যেদিন কুশলবের কথা আসিল, বীরবালকেরা তাহাদের বাপখুড়াকে একেবারে মাটি করিয়া দিতে প্রবৃত্ত হইল, সেদিনকার সন্ধ্যাবেলার সেই অস্পষ্ট আলােকের সভা নিস্তব্ধ ঔৎসুক্যের নিবিড়তায় যে কিরূপ পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল তাহা এখনাে মনে পড়ে। এদিকে রাত হইতেছে, আমাদের জাগরণকালের মেয়াদ ফুরাইয়া আসিতেছে, কিন্তু পরিণামের অনেক বাকি। এহেন সংকটের সময় হঠাৎ আমাদের পিতার অনুচর কিশােরী চাটুজ্যে আসিয়া দাশুরায়ের পাঁচালি গাহিয়া অতি দ্রুত গতিতে বাকি অংশটুকু পূরণ করিয়া গেল;—কৃত্তিবাসের সরল পয়ারের মৃদুমন্দ কলধ্বনি কোথায় বিলুপ্ত হইল— অনুপ্রাসের ঝকমকি ও ঝংকারে আমরা একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম।
কোনো-কোনােদিন পুরাণপাঠের প্রসঙ্গে শ্রোতৃসভায় শাস্ত্রঘটিত তর্ক উঠিত, ঈশ্বর সুগভীর বিজ্ঞতার সহিত তাহার মীমাংসা করিয়া দিত। যদিও ছােটো ছেলেদের চাকর বলিয়া ভৃত্যসমাজে পদমর্যাদায় সে অনেকের চেয়ে হীন ছিল, তবু, কুরুসভায় ভীষ্ম পিতামহের মতে, আপনার কনিষ্ঠদের চেয়ে নিম্ন আসনে বসিয়াও আপন গুরুগৌরব অবিচলিত রাখিয়াছিল।
এই আমাদের পরম প্রাজ্ঞ রক্ষকটির যে একটি দুর্বলতা ছিল তাহা ঐতিহাসিক সত্যের অনুরােধে অগত্যা প্রকাশ করিতে হইল সে আফিম খাইত। এই কারণে তাহার পুষ্টিকর আহারের বিশেষ প্রয়ােজন ছিল। এই জন্য আমাদের বরাদ্দ দুধ যখন সে আমাদের সামনে আনিয়া উপস্থিত করিত তখন সেই দুধ সম্বন্ধে বিপ্রকর্ষণ অপেক্ষা আকর্ষণ শক্তিটাই তাহার মনে বেশি প্রবল হইয়া উঠিত। আমরা দুধ খাইতে স্বভাবতই বিতৃষ্ণা প্রকাশ করিলে আমাদের স্বাস্থ্যোন্নতির দায়িত্বপালন উপলক্ষ্যেও সে কোনােদিন দ্বিতীয়বার অনুরােধ বা জবরদস্তি করিত না।
আমাদের জলখাবার সম্বন্ধেও তাহার অত্যন্ত সংকোচ আমরা খাইতে বসিতাম। লুচি আমাদের সামনে একটা মােটা কাঠের বারকোশে রাশ করা থাকিত। প্রথমে দুই-একখানি মাত্র লুচি যথেষ্ট উঁচু হইতে শুচিতা বাঁচাইয়া সে আমাদের পাতে বর্ষণ করিত। দেবলােকের অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিতান্ত তপস্যার জোরে যে বর মানুষ আদায় করিয়া লয় সেই বরের মতাে, লুচিকয়খানা আমাদের পাতে আসিয়া পড়িত; তাহাতে পরিবেষণকর্তার কুষ্ঠিত দক্ষিণ হস্তের দাক্ষিণ্য প্রকাশ পাইত না। তাহার পর ঈশ্বর প্রশ্ন করিত, ছিল। আরো দিতে হইবে কি না। আমি জানিতাম কোন্ উত্তরটি সর্বাপেক্ষা সদুত্তর বলিয়া তাহার কাছে গণ্য হইবে। তাহাকে বঞ্চিত করিয়া দ্বিতীয়বার লুচি চাহিতে আমার ইচ্ছা করিত না। বাজার হইতে আমাদের জন্য বরাদ্দমতো জল-খাবার কিনিবার পয়সা ঈশ্বর পাইত। আমরা কী খাইতে চাই প্রতিদিন সে তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া লইত। জানিতাম সস্তা জিনিস ফরমাশ করিলে সে খুশি হইবে। কখনো মুড়ি প্রভৃতি লঘুপথ্য, কখনো বা ছোলাসিদ্ধ চিনাবাদাম ভাজা প্রভৃতি অপথ্য আদেশ করিতাম। দেখিতাম শাস্ত্রবিধি আচারতত্ত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধে ঠিক সুক্ষ্ম বিচারে তাহার উৎসাহ যেমন প্রবল ছিল আমাদের পথ্যাপথ্য সম্বন্ধে ঠিক তেমনটি ছিল না।