জীবন-স্মৃতি (১৯৪১)/শিক্ষারম্ভ

শিক্ষারম্ভ

 আমরা তিনটি বালক একসঙ্গে মানুষ হইতেছিলাম। আমার সঙ্গী দুটি আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। তাহারা যখন গুরুমহাশয়ের কাছে পড়া আরম্ভ করিলেন আমারও শিক্ষা সেই সময়ে শুরু হইল কিন্তু সে-কথা আমার মনেও নাই।

 কেবল মনে পড়ে, “জল পড়ে পাতা নড়ে।” তখন “কর, খল” প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি, “জল পড়ে পাতা নড়ে।” আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা। সেদিনের আনন্দ আজও যখন মনে পড়ে তখন বুঝিতে পারি কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার এত প্রয়ােজন কেন। মিল আছে বলিয়াই কথাটা শেষ হইয়াও শেষ হয় না—তাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখনাে তাহার ঝংকারটা ফুরায় না— মিলটাকে লইয়া কানের সঙ্গে মনের সঙ্গে খেলা চলিতে থাকে। এমনি করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া সেদিন আমার সমস্ত চৈতন্যের মধ্যে জল পড়িতে ও পাতা নড়িতে লাগিল।

 এই শিশুকালের আর-একটা কথা মনের মধ্যে বাঁধা পড়িয়া গেছে। আমাদের একটি অনেক কালের খাজাঞ্চি ছিল, কৈলাস মুখুজ্যে তাহার নাম। সে আমাদের ঘরের আত্মীয়েরই মতো। লােকটি ভারি রসিক। সকলের সঙ্গেই তাহার হাসিতামাশা। বাড়িতে নূতনসমাগত জামাতাদিগকে সে বিদ্রুপে কৌতুকে বিপন্ন করিয়া তুলিত। মৃত্যুর পরেও তাহার কৌতুকপরতা কমে নাই এরূপ জনশ্রুতি আছে। একসময়ে আমার গুরুজনেরা প্ল্যাঞ্চেট-যােগে পরলােকের সহিত ডাক বসাইবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত ছিলেন। একদিন তাহাদের প্ল্যাঞ্চেটের পেন্সিলের রেখায় কৈলাস মুখুজ্যের নাম দেখা দিল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, তুমি যেখানে আছ সেখানকার ব্যবস্থাটা কিরূপ, বলো দেখি। উত্তর আসিল, আমি মরিয়া যাহা জানিয়াছি, আপনারা বাঁচিয়াই তাহা ফাঁকি দিয়া জানিতে চান? সেটি হইবে না।

 সেই কৈলাস মুখুজ্যে আমার শিশুকালে অতি দ্রুতবেগে মস্ত একটা ছড়ার মতো বলিয়া আমার মনােরঞ্জন করিত। সেই ছড়াটার প্রধান নায়ক ছিলাম আমি এবং তাহার মধ্যে একটি ভাবী নায়িকার নিঃসংশয় সমাগমের আশা অতিশয় উজ্জ্বল ভাবে বর্ণিত ছিল। এই যে ভুবনমােহিনী বধূটি ভবিতব্যতার কোল আলো করিয়া বিরাজ করিতেছিল ছড়া শুনিতে শুনিতে তাহার চিত্রটিতে মন ভারি উৎসুক হইয়া উঠিত। আপাদমস্তক তাহার যে বহুমূল্য অলংকারের তালিকা পাওয়া গিয়াছিল মিলনােৎসবের যে অভূতপূর্ব সমারােহের বর্ণনা শুনা যাইত তাহাতে অনেক প্রবীণবয়স্ক সুবিবেচক ব্যক্তির মন চঞ্চল হইতে পারিত—কিন্তু বালকের মন যে মাতিয়া উঠিত এবং চোখের সামনে নানাবর্ণে বিচিত্র আশ্চর্য সুখচ্ছবি দেখিতে পাইত তাহার মূল কারণ ছিল সেই দ্রুত-উচ্চারিত অনর্গল শব্দচ্ছটা এবং ছন্দের দোলা। শিশুকালের সাহিত্যরসভোগের এই দুটো স্মৃতি এখনো জাগিয়া আছে—আর মনে পড়ে, “বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান।” ঐ ছড়াটা যেন শৈশবের মেঘদূত।

 তাহার পরে যে-কথাটা মনে পড়িতেছে, তাহা ইস্কুলে যাওয়ার সূচনা। একদিন দেখিলাম দাদা এবং আমার বয়ােজ্যেষ্ঠ ভাগিনেয় সত্য, ইস্কুলে গেলেন, কিন্তু আমি ইস্কুলে যাইবার যােগ্য বলিয়া গণ্য হইলাম না। উচ্চৈঃস্বরে কান্না ছাড়া যােগ্যতা প্রচার করার আর কোনাে উপায় আমার হাতে ছিল না। ইহার পূর্বে কোনােদিন গাড়িও চড়ি নাই, বাড়ির বাহিরও হই নাই, তাই সত্য যখন ইস্কুল-পথের ভ্রমণ-বৃত্তান্তটিকে অতিশয়ােক্তি-অলংকারে প্রত্যহই অত্যুজ্জ্বল করিয়া তুলিতে লাগিল তখন ঘরে আর মন কিছুতেই টিঁকিতে চাহিল না। যিনি আমাদের শিক্ষক ছিলেন তিনি আমার মােহ বিনাশ করিবার জন্য প্রবল চপেটাঘাতসহ এই সারগর্ভ কথাটি বলিয়াছিলেন: “এখন ইস্কুলে যাবার জন্য যেমন কাঁদিতেছ, না যাবার জন্য ইহার চেয়ে অনেক বেশি কাঁদিতে হইবে।” সেই শিক্ষকের নামধাম আকৃতিপ্রকৃতি আমার কিছুই মনে নাই—কিন্তু সেই গুরুবাক্য ও গুরুতর চপেটাঘাত স্পষ্ট মনে জাগিতেছে। এতবড়াে অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী জীবনে আর কোনােদিন কর্ণগােচর হয় নাই।

 কান্নার জোরে ওরিয়েণ্টাল সেমিনারিতে অকালে ভর্তি হইলাম। সেখানে কী শিক্ষালাভ করিলাম মনে নাই কিন্তু একটা শাসনপ্রণালীর কথা মনে আছে। পড়া বলিতে না পারিলে ছেলেকে বেঞ্চে দাঁড় করাইয়া তাহার দুই প্রসারিত হাতের উপর ক্লাসের অনেকগুলি শ্লেট একত্র করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইত। এরূপে ধারণাশক্তির অভ্যাস বাহির হইতে অন্তরে সঞ্চারিত হইতে পারে কি না তাহা মনস্তত্ত্ববিদিগের আলােচ্য।

 এমনি করিয়া নিতান্ত শিশুবয়সেই আমার পড়া আরম্ভ হইল। চাকরদের মহলে যে-সকল বই প্রচলিত ছিল তাহা লইয়াই আমার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত হয়। তাহার মধ্যে চাণক্যশ্লোকের বাংলা অনুবাদ ও কৃত্তিবাস রামায়ণই প্রধান। সেই রামায়ণ পড়ার একটা দিনের ছবি মনে স্পষ্ট জাগিতেছে।

 সেদিন মেঘলা করিয়াছে; বাহিরবাড়িতে রাস্তার ধারের লম্বা বারান্দাটাতে খেলিতেছি। মনে নাই সত্য কী কারণে আমাকে ভয় দেখাইবার জন্য হঠাৎ “পুলিসম্যান” “পুলিসম্যান” করিয়া ডাকিতে লাগিল। পুলিসম্যানের কর্তব্য সম্বন্ধে অত্যন্ত মােটামুটি রকমের একটা ধারণা আমার ছিল। আমি জানিতাম একটা লােককে অপরাধী বলিয়া তাহাদের হাতে দিবামাত্রই, কুমীর যেমন খাঁজকাটা দাঁতের মধ্যে শিকারকে বিদ্ধ করিয়া জলের তলে অদৃশ্য হইয়া যায় তেমনি করিয়া হতভাগ্যকে চাপিয়া ধরিয়া অতলস্পর্শ থানার মধ্যে অন্তাহত হওয়াই পুলিশ কর্মচারীর স্বাভাবিক ধর্ম। এরূপ নির্মম শাসনবিধি হইতে নিরপরাধ বালকের পরিত্রাণ কোথায় তাহা ভাবিয়া না পাইয়া একেবারে অন্তঃপুরে দৌড় দিলাম;—পশ্চাতে তাহারা অনুসরণ করিতেছে এই অন্ধভয় আমার সমস্ত পৃষ্ঠদেশকে কুণ্ঠিত করিয়া তুলিল। মাকে গিয়া আমার আসন্ন বিপদের সংবাদ জানাইলাম; তাহাতে তাহার বিশেষ উৎকণ্ঠার লক্ষণ প্রকাশ পাইল না। কিন্তু আমি বাহিরে যাওয়া নিরাপদ বােধ করিলাম না। দিদিমা—আমার মাতার কোনাে এক সম্পর্কে খুড়ি—যে কৃত্তিবাসের রামায়ণ পড়িতেন সেই মার্বেলকাগজমণ্ডিত কোণ্-ছেঁড়া-মলাটওয়ালা মলিন বইখানি কোলে লইয়া মায়ের ঘরের দ্বারের কাছে পড়িতে বসিয়া গেলাম। সম্মুখে অন্তঃপুরের আঙিনা ঘেরিয়া চৌকোণ বারান্দা; সেই বারান্দায় মেঘাচ্ছন্ন আকাশ হইতে অপরাহ্নের ম্লান আলাে আসিয়া পড়িয়াছে। রামায়ণের কোনো একটা করুণ বর্ণনায় আমার চোখ দিয়া জল পড়িতেছে দেখিয়া দিদিমা জোর করিয়া আমার হাত হইতে বইটা কাড়িয়া লইয়া গেলেন।