জোড়াসাঁকোর ধারে/৪
৪
সেদিন কে যেন আমায় বললে, আপনি বুঝি ছেলেবেলায় খুব গান আর ছবি-আঁকার আবহাওয়ায় বড় হয়েছেন? বললুম, মোটেও তা নয়। কি আবহাওয়ার ভিতর দিয়ে বড় হয়েছি জানতে চাইছ? শোনো তবে।
ছবি গান ছিল বইকি বাড়িতে। বাবামশায়ের শখ ছিল ছবি আঁকার; জ্যোতিকাকামশায়ও ছবি আঁকতেন, পোর্ট্রেট আঁকবার ঝোঁক ছিল তার; কিন্তু ছবি দেখা তো দূরের কথা, আমরা কি তাঁদের ঘরে ঢুকতে পেরেছি কখনও?
গানবাজনাও হত। তখনকার দিনে মাইনে-করা গাইয়ে থাকত বাড়িতে। কেষ্ট বিষ্ণু ছিল দুই মাইনে-করা গাইয়ে। দুর্গাপুজোয় আগমনী বিজয়া তখন গাইত তারা—শোননি কখনও? ভারি মিষ্টি সেসব গান। ওস্তাদি গানের মজলিশও বসত বৈঠকখানায় রোজ সন্ধ্যেবেলা। তখনকার নিয়মই ছিল ওই। পাড়াপড়শি বন্ধুবান্ধব আসতেন বৈঠকি গান শুনতে। নটার তোপও পড়ত, মজলিশও ভেঙে যে যার ঘরে যেতেন। দূর থেকে যেটুকু শুনতুম কিছুই বুঝতুম না তার।
তবে হ্যাঁ, গান হত ও-বাড়িতে, তেতলার ছাদে নতুনকাকিমার ঘরে। একদিকে জ্যোতিকাকামশায় পিয়ানো বাজাচ্ছেন, আর একদিকে রবিকা গাইছেন। সেই অল্পবয়সের রবিকার গলা, সে যেমন সুর তেমনি গান। মাত করে দিতেন চারদিক। এ-বাড়ি থেকে শুনতুম আমি কান পেতে। তাই বলি, গান তবু শুনেছি আমি ছেলেবেলায়; কিন্তু ছবি দেখিনি মোটেও।
ছবি যা দেখেছি তা আমার ছোটপিসিমার ঘরে। ছুটির দিন দুপুরবেলা ছোটপিসিমার ঘরের দরজায় একটু উঁকিঝুঁকি মারতেই ছোটপিসিমার নজরে পড়ি, তিনি ডাকেন, ‘কে রে অবা? আয় আয় ঘরে আয়।’ কি সুন্দর ঘরটি তাঁর। কতরকমের ছবি, দেশী ধরনের অয়েল-পেটিং, শ্রীকৃষ্ণের পায়েস ভক্ষণ— সামনে নৈবেদ্য সাজিয়ে মুনি চোখ বুজে ধ্যানে বসে আছেন, চুপি চুপি কৃষ্ণ হাত ডুবিয়ে পায়েসটুকু তুলে মুখে দিচ্ছেন, হুবহু কথকঠাকুরের গল্পের ছবি; শকুন্তলার ছবি—তিনটি মেয়ে বনের ভিতর দিয়ে চলেছে, শকুন্তলা বলে বুঝতুম না, তবে ভালো লাগত দেখতে; মদনভস্মের ছবি—মহাদেবের কপাল ফুঁড়ে ঝাঁটার মতো আগুন ছুটে বের হচ্ছে; সরোজিনী নাটকের ছবি; কাদম্বরীর ছবি—রাজপুত্তুর পুকুরধারে গাছতলায় ঘোড়া বেঁধে শিবমন্দিরের দাওয়ায় বসে আছে। কে জানে তখন, সেটা কাদম্বরীর ছবি। এমনি কত সব ছবি। কেষ্টনগরের পুতুলই বা কত রকমের ছিল সেই ঘরে। চেয়ে চেয়ে দেখতে বেলা কাটে। মেঝেতে ঢালা-বিছানায় বুকে বালিশ দিয়ে বসে ছোটপিসিমা পান খান, সেলাই করেন। ও-বাড়িতে বেলা তিনটের ঘণ্টা পড়ে। গুপীদাসী চুল বাঁধার বাক্স, মাদুর নিয়ে আসে। ছোটপিসিমা উঠে উঁচু-পাঁচিল-ঘেরা ছাদে গিয়ে চুল বাঁধতে বসেন, পোষা পায়রাগুলো খোপ থেকে বেরিয়ে এসে ছোটপিসিমাকে ঘিরে ঘাড় নেড়ে বকম বকম বকে বকে নাচ দেখায়। ছোটপিসি আমার হাতে মুঠো মুঠো দানা দেন; ছড়িয়ে দিই, তারা চক্কর বেঁধে কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেয়ে উড়ে বসে ছাদের কার্নিশে সারি সারি। পড়ন্ত রোদ তাদের ডানায় ডানায় ঝকমক করে। কোনো কোনো দিন বা দেখি ঘূর্নি হাওয়ায় লাল ধুলো পাক খেয়ে খেয়ে উড়ে গেল। বাইরের ছবিও দেখি। আবার খেলাধুলোর শেষে ঘরের কোণায় সন্ধ্যেবেলা পিতলের পিলসুজের উপর পিদিম জলে, তারই কাছে টিকটিকি নড়েচড়ে পোকা ধরে, তাও দেখি চেয়ে চেয়ে অনেকক্ষণ। এইরকম ঘর-বাইরের কত কি ছবি দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছি।
ভিতর দিকটা দেখবার কৌতুহল আমার ছেলেবেলা থেকে আছে। বন্ধ ঘরের ভিতরটা, ঘেরা বাগানের ভিতরটা, দেখতে হবে কি আছে ওখানে। খেলনা, দম দিলে চলে চাকা ঘোরে; দেখতে চাই ভিতরে কি আছে। এই সেদিন পর্যন্তও ছেলেদের খেলনা নিয়ে খুলে খুলে আবার মেরামত করেছি। ছেলেদের খেলনা হাতে নিলেই মা বলতেন, “ওই রে এবার গেল জিনিসটা, ভিতর দেখতে গিয়ে ভাঙবে ওটি।’ তা ছেলেবেলায় একবার ভিতর দেখতে গিয়ে কী কাণ্ডই হয়েছিল শোনো।
বড়মা থাকেন তেতলার একটি ঘরে। তাঁরও নানারকম পাখি পোষার শখ। পোষা টিয়ে, পোষা লালমোহন হীরেমোহন; লালমোহনের দাঁড়টি আগাগোড়া ঝকঝক তকতক করছে সোনালি রঙে। ঘরের একপাশে এক আলমারি বোঝাই খেলনা; সে-সব তাঁর শখের খেলনা, কাউকে ধরতে ছুঁতে দেন না। অনেক ক’রে বললে কখনও একটা-দুটো খেলনা বের করে নিজের হাতে দম দিয়ে চালিয়ে দেন মেঝেতে; আবার তুলে রাখেন। সেই বড়মার ঘরে যেতে হত একটি মেটে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে। বরাবর তেতলার চিলে-ছাদ অবধি উঠে গেছে সেই গোল সিঁড়ি। তারই মাঝামাঝি এক জায়গায় মাটির একটি হাতদেড়েক কেষ্টমূর্তি, তাকের উপর ধরা। আমার লোভ সেই মাটির কেষ্টটির উপর। একদিন দুপুরে সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে বড়মার কাছে দরবার করলুম, “আমাকে মাটির কেষ্টটি দেবে? বড়মা খানিক ভেবে বললেন, ‘চাস? তা নিয়ে যা। ভাঙিসনে।’ বুড়ী দাসী তাক থেকে কেষ্টটি পেড়ে আমার হাতে দিলে। আমি সেটি বগলদাবা করে তরতর করে নিচে নেমে এলুম। দাদাদেরও নজর ছিল মূর্তিটির উপর, কেউ পাননি। তাদের দেখালুম। ‘দেখো, তোমরা তো পেলে না; আমি কেমন পেয়ে গেছি।’ দাদারা বললেন, ‘হুঃ, ওর ভিতরে কি আছে জানিসনে তো? এই টেবিলটির উপরে চড়ে মূর্তিটি ফেলে দে নিচে, দেখবি, আশ্চর্য জিনিস বের হবে এর ভিতর থেকে।’ দাদাদের অবিশ্বাস করতে পারলেম না। মূর্তির ভিতরের ‘আশ্চর্য’ দেখবার লোভে তাড়াতাড়ি উঁচু টেবিলটায় উঠে দিলেম কেষ্টকে মাটিতে এক আছাড়। ‘আশ্চর্য’ তো দেখা দিল না; মাটির পুতুল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ঘরময়। তথন আমার কান্না, দাদার হো-হো করে হেসে হাততালি দিয়ে চম্পট।
সেই ভিতর দেখার কৌতুহল আজও আমার ঘুচল না। ছবি, তার ভিতরে কি আছে খুঁজি। নোড়ানুড়িতে খুঁজি, কাঠকুট্রোতে খুঁজি। নিজের আর অন্যের মনের ভিতরে খুঁজি, কি আছে না-আছে। খুজি, কিছু পাই না-পাই, এই রকম খোঁজাতেই মজা পাই। হাত আমার তখন ভালো করে পেনসিল ধরতে পারে না, ছবি আঁকা কাকে বলে জানিনে; কিন্তু ছবি দেখতে ভাবতে শিখি সেই পিসিমার ঘরে বসে।
মার ঘরে আমরা ঢুকতে পাইনে। মার ঘর একেবারে আলাদা ধরনে সাজানো। মার শোবার ঘর তৈরি হচ্ছে। রাজমিস্ত্রি লেগে গেছে; বাবামশায়ের পছন্দমতো মেঝেতে নানা রঙের টালি পাথর বসানো হচ্ছে, আস্তে আস্তে যাই সেখানে। ঠুকঠাক, মিস্ত্রিরা নকশা মিলিয়ে পাথর বসায়; অবাক হয়ে দেখি। কখনো বা দু-একটা পাথর চেয়ে আনি। দেখতে দেখতে একদিন ঘর তৈরি হয়ে গেল। বাবামশায় নিজের হাতে সে ঘর সাজালেন। চমৎকার সব পালিশ-করা দামী কাঠের আসবাবপত্র, কাটা কাচের নানারকম ফুলদানি, একটি ফুলদানি মনে পড়ে ঠিক যেন পদ্মকোরকটি,—কাচের গোরু-হাতি, কত কি। দেয়ালে দামী দামী অয়েল-পেণ্টিং, চারিদিকে নানা জাতের অর্কিড, সে একেবারে অন্য রকমের সাজানো ঘর। আমার কিন্তু ভালো লাগে বেশি ছোটপিসিমার ঘরখানিই। বঙ্কিমবাবুর সূর্যমুখীর ঘরের যে বর্ণনা, যেখানে যে জিনিসটি, হুবহু আমার ছোটপিসিমার ঘরের সঙ্গে মিলে যায়। অত বড় বাড়ির মধ্যে আমার শিশুমনকে খুব টানত তেতলার উপর আকাশের কাছাকাছি ছোটপিসিমার ঘর।
আর একটি জায়গা, সেটি আমার পরীস্থান। দেখো, যেন শুনে হেসে না। আমার পরীস্থান আকাশের পারে ছিল না। ছিল একতলায় সিঁড়ির নিচে একটা এঁদো ঘরের মধ্যে। সেই ঘরে সারাদিনরাত বন্ধ থাকে দুয়োর, মস্ত তালা। ওত পেতে বসে থাকি সকাল থেকে, বড় সিঁড়ির তলায় দোরগোড়ায়। নন্দফরাশ আমাদের তেলবাতি করে, তার হাতে সেই তালাবন্ধ ঘরের চাবি। সে এসে সকালে তালা খোলে তবে আমি ঢুকতে পাই সেই পরীস্থানে। সেখানে কি দেখি, কাদের দেখি? দেখি কর্তাদের আমলের পুরোনো আসবাবপত্রে ঠাসা সে ঘর। কালে কালে ফ্যাশান বদল হচ্ছে, নতুন জিনিস ঢুকছে বাড়িতে, পুরনোরা স্থান পাচ্ছে আমার সেই পরীস্থানে। কত কালের কত রকমের পুরোনো ঝাড়লণ্ঠন, রঙবেরঙের চিনে মাটির বাতিদান, ফুলদানি, কাচের ফানুষ, আরও কত কি। তারা যেন পুরাকালের পরী—তাকের উপর সারি সারি চুপচাপ, ধুলো গায়ে, ঝুলমাকড়শার জাল মুড়ি দিয়ে বসে আছে; কেউ বা মাথার উপরে কড়ি থেকে ঝুলছে শিকল ধরে। ঘরের মধ্যেটা আবছা অন্ধকার। কাচমোড় ঘুলঘুলি থেকে বাইরের একটু হলদে আলো এসে পড়েছে ঘরে। সেই আলোয় তাদের গায়ে থেকে থেকে চমক দিচ্ছে রামধনুর সাত রঙ। আঙুল দিয়ে একটু ছুঁলেই টুং টাং শব্দে ঘর ভরে যায়। মনে হয়, যেন সাতরঙা সাত পরীর পায়ে ঘুঙুর বাজছে। সেই রঙবেরঙের পরীর রাজত্বে ঢুকে এটা ছুঁই ওটা ছুঁই, একে দেখি তাকে দেখি, কাউকে বা হাতে তুলে ধরি, এমন সময়ে নন্দফরাশ তার তেলবাতি সেরে হাঁক দেয়, ‘বেরিয়ে এসো এবারে, আর নয়, কাল হবে।’ তালাচাবি পড়ে যায় সেদিন রাতটার মতো আমার পরীরাজত্বের ফটকে।
সেই যেবার মুকুলের স্কুলে রবিকার ছবির এক্জিবিশন হয়, আমি দেখতে গছি; অমিয় বললে, “আমায় গুরুদেবের ছবি বুঝিয়ে দিন।’ বললুম, দেখে বাপু, খুড়ো-ভাইপোর কথা কাগজে যদি বের না করো তবে এসো আমার সঙ্গে।’ তাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি দেখাতে লাগলুম। তা ওইখানেই একটি ছবি দেখি; ছোট্ট ছবিখানা, কলম দিয়ে আঁকা; একটি ছেলে, পিছনে অনেকগুলো লাইনের আঁচড়। ছেলেটি লাইনের জালে আর জঙ্গলে আটকে পড়ে থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বললুম অমিয়কে, ‘দেখো, এ কি আর সবাই বুঝতে পারে?’ পরীস্থানে ঢুকলে আমার অবস্থা হত ঠিক তেমনি। এখন যখন দেখি ছোট ছেলেরা এসে আমার পুতুলের ঘরে কাচমোড়া আলমারির সামনে ঘুরঘুর করে, মনে পড়ে আমিও একদিন প্রায় এদেরই বয়েসে আমার পরীরাজত্বের দুয়োরে এমনিভাবে দাঁড়িয়ে থাকতুম।—ও অভিজিৎ, রঙ-টঙ নিয়ে অত ঘাঁটাঘাঁটি কোরো না,—বিপদ আছে। এই রঙ-করা নিয়ে আমার ছেলেবেলায় কি কাণ্ড হয়েছে জানো না তো?
আমাদের দোতলার বারান্দায় একটা জলভরতি বড় টবে থাকে কতকগুলো লাল মাছ, বাবামশায়ের বড় শখের সেগুলো। রোজ সেই টবে ভিস্তি দিয়ে পরিষ্কার জল ভরতি করা হয়। একদিন দুপুরে লাল মাছ দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার খেয়াল হল, লাল মাছ, তার জল লাল হওয়া দরকার। যেমন মনে হওয়া কোত্থেকে খানিকটে মেজেণ্ট না কি রঙ জোগাড় করে এনে দিলুম সেই মাছের টবে গুলে। দেখতে দেখতে আমার মতলব সিদ্ধি। লাল জলে লাল মাছ কিলবিল করতে থাকল। দেখে অন্য খেলা খেলতে চলে গেলাম। বিকেলে শুনি। মালীর চিৎকার। জলে লাল রঙ গুললে কে? মাছ যে মরে ভেসে উঠেছে। বাবামশাই বললেন, ‘কার এই কাজ?’ সারদা পিসেমশায় বলে উঠলেন, ‘এ আর কারো কাজ নয়, ঠিক ওই বোম্বেটের কাজ।’ বোম্বেটে কথাটি চীনে গিয়ে সারদা পিসেমশায় শিখে এসেছিলেন। চীনের খেতাব সেইবারই প্রথম পেলুম; তার পর থেকে সবার কাছে ওই নামেই বিখ্যাত হলুম। রঙ গুলে আমি ওইরূপ খেতাব পেয়েছিলেম। অভিজিৎ, বুঝে-শুনে আমার রঙের বাক্সে হাত দিও। না হলে খেতাব পেয়ে যাবে।
আঃ হাঃ, আবার আমার পুতুল গড়বার হাতুড়ি বাটালি নিয়ে টানাটানি কর কেন? স্থির হও, শোনো, আর একটা মজার কথা। ছেলেবেলায় তোমার বয়সে মিস্ত্রি হবার চেষ্টা করেছিলুম একবার। বাবামশায়ের পাখির খাঁচা তৈরি হচ্ছে। খাঁচা তো নয়, যেন মন্দির। বারান্দা জুড়ে সেই খাঁচা, ভিতরে নানারকম গাছ, পাখিদের ওড়বার যথেষ্ট জায়গা, জলখাবার সুন্দর ব্যবস্থা, সব আছে তাতে। চীনে মিস্ত্রিরা লেগে গেছে কাজে; নানারকম কারুকাজ হচ্ছে কাঠের গায়ে। সারাদিন কাজ করে তারা টুকটাক টুকটাক হাতুড়ি বাটালি চালিয়ে দুপুরে খানিকক্ষণের জন্যে টিফিন খেতে যায়; আবার এসে কাজে লাগে। আমি দেখি, শখ যায় অমনি করে বাটালি চালাতে। একদিন, মিস্ত্রিরা যেমন রোজ যায়, তেমনি খেতে গেছে বাইরে, এই ফাঁকে আমি বসে হাতুড়ি বাটালি নিয়ে যেই না মেরেছি কাঠের উপর এক ঠেলা, এই দেখো সেই দাগ, বাটালি একেবারে বাঁ হাতের বুড়ে আঙুলের মাঝ দিয়ে চলে গেল অনেকটা অবধি। তখনি আমি বুড়ো আঙুল চুষতে চুষতে দে ছুট সেখান থেকে। মিস্ত্রিরা এসে কাজ করতে যাবে দেখে, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত সে জায়গায় ছড়ানো। কি ব্যাপার, কে কি কাটল? জানা কথা, বোম্বেটে ছাড়া এ আর কারোর কাজ নয়। বাবামশায় ডেকে বললেন, ‘দেখি তোর আঙুল।’ আমি তো ভয়ে জড়োসড়ো, না জানি আজ কি ঘটে যায় আমার কপালে।
কতরকম দুষ্টবুদ্ধিই জগত তখন মাথায়। বাবামশায়ের আছে পোষা ক্যানারি, খাঁচাভরা। শখ গেল তাদের ছেড়ে দিয়ে দেখতে হবে কেমন করে ওড়ে। টুনিসাহেব, এক ফিরিঙ্গি ছোঁড়া, আসে প্রায়ই বাবামশায়ের কাছে শ্রীরামপুর থেকে। পাখির শখ ছিল তার। মাঝে মাঝে সুবিধেমতে দুয়েকটি দামী পাখিও সরায়। সেই সাহেব একদিন এসেছে; তাকে ধরে পড়লুম, ‘দাও না ক্যানারি পাখির খাঁচা খুলে। বেশ উড়বে পাখিগুলো। জাল আছে এখানে, আবার ওদের ধরা যাবে।’ অনেক বলাকওয়ার পর সাহেব তো দিলে খাঁচার দরজা খুলে। ফুর্ ফুর্ করে পাখিগুলো সব বেরিয়ে পড়ল—খাঁচা থেকে বাইরে, মহা আনন্দ। এবার তাদের ধরতে হবে, টুনিসাহেব জাল ফেলছে বারে বারে; কিছুতেই তারা ধরা দেয় না। শেষে সে তো জাল-টাল ফেলে দিয়ে চম্পট; ধরা পড়লুম আমি। এইরকম সব ইচ্ছে ছেলেবয়েসে হত। ইচ্ছে হল কাঠবেড়ালির চলা দেখব, খরগোশের লাফ দেখব, অমনি তাদের ঘরের দরজা খুলে নিতুম বাইরে বের করে। ইচ্ছে হত তো, করব কি, কি বল অভিজিৎ?
ও কি ও, স্যাঙাত, সোয়েটার এঁটে এসেছ এরই মধ্যে? আমাদের ছেলেবেলায় কার্তিক মাসের আগে গরম কাপড়ের সিন্দুকই খুলত না ম্যালেরিয়া হলেও। সাদাসিধে ভাবেই মানুষ হয়েছি আমরা। তখন এত উলের ফ্রক, শার্টমাট, সোয়েটার, গেঞ্জি, মোজা পরিয়ে তুলোর হাঁসের মতো সাজিয়ে রাখবার চাল ছিল না। খুব শীত পড়লে একটা জামার উপরে আর একটা সাদা জামা, তার উপরে বড় জোর একটা বনাতের ফতুয়া, এই পর্যন্ত। চীনে বাড়ির জুতে কখনো ক্বচিৎ তৈরি হয়ে আসত—তা সে কোন্ আলমারির চালে পড়ে থাকত খবরই হত না, খেলাতেই মত্ত।
রাত্রে ঘুমোবার আগে দাসীরা আমাদের খানিকটা দুধ খাইয়ে মশারির ভিতরে ঠেলে দিয়ে থাবড়ে থুবড়ে শুইয়ে চলে যেত। তাদেরও আবার নিজেদের একটা দল ছিল। রাত্তিরবেলা দাসীরা সব একসঙ্গে হয়ে, বারান্দায় একটা লম্বা দোলনা ছিল, তাতে বসে গল্পগুজব হাসিতামাসা করত। আন্দিবুড়ি আসত রাত্রে, সে যা চেহারা তার—কপালজোড়া সিঁদুর, লাল টকটক করছে, গোল এত্তো বড় মুখোশের মতো মুখ, যেন আহ্লাদী পুতুলকে কেউ কালি মাখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। দেখতে যদি তাকে রাত্তিরবেলা! সেই আন্দিবুড়ি দক্ষিণেশ্বর থেকে আসত মায়েদের শ্যামা-সংগীত শোনাতে, আর পয়সা নিতে। তার গলার স্বর ছিল চমৎকার। সে যখন চাঁদের আলোতে বারান্দার দোলনাতে চুল এলিয়ে বসে দাসীদের সঙ্গে গল্প করত, মশারির ভিতর থেকে ঝাপসা ঝাপসা দেখে মনে হত, যেন সব পেত্নী—গুজ্গুজ্ ফুস্ফুস্ করছে। তখন ওই একটা শব্দ ছিল দাসীদের কথাবার্তার—গুজ্গুজ্, ফুস্ফুস্। বেশ একটু স্পষ্ট স্পষ্ট কানে আসত। ঘুমই হত না। মাঝে মাঝে আমি কুঁই কুঁই করে উঠি, পদ্মদাসী ছুটে এসে মশারি তুলে মুখে একটা গুড় নারকেলের নাড়ু, তাদের নিজেদের খাবার জন্যেই করে রাখত, সেই একটি নাড়ু মুখে গুঁজে দেয়; বলে, ‘ঘুমো।’ নারকেল-নাড়ুটি চুষতে থাকি। পদ্মদাসী গুন গুন করে ছড়া কাটে আর পিঠ চাপড়ায়; এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ি। তার পরে এক ঘুমে রাত কাবার। তুমি তো অন্ধকার রাত্রে রাস্তায় ভূতের ভয় পাও; আমার পদ্মদাসী আর আন্দিবুড়িকে দেখলে তবে কি করতে জানিনে। দুজনের ঠিক এক চেহারা। আদিবুড়ি ছিল কালো রঙের আহ্লাদী পুতুল, আর আমার পদ্মদাসী ছিল যেন আগুনে ঝলসানো পদ্মফুল।
ভালো লাগত আমার দুজনকেই। তাই তাদের কথা এখনও মনে পড়ে। সেই আমাকে মানুষ করা পদ্মদাসীর শেষ কি হল শোনো। একদিন সকালে দাঁড়িয়ে আছি তেতলার সিড়ির রেলিং ধরে; সিঁড়ি বেয়ে তখনও নামতে পারিনে দোতলায়। আমি দাঁড়িয়ে দেখছি তো দেখছিই। মস্ত বড় সিঁড়ির ধাপ ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে অন্ধকার পাতালের দিকে। এমন সময়ে শুনি লেগেছে ঝুটোপুটি ঝগড়া পদ্মদাসীতে আর মা’র রসদাসীতে দোতলার সিঁড়ির চাতালে। এই হতে হতে দেখি রসদাসী আমার পদ্মদাসীর চুলের মুঠি ধরে দিলে দেয়ালে মাথাটা ঠুকে। ফটাস করে একটা শব্দ শুনলুম। তার পরেই দেখি পদ্মাসীর মাথা মুখ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। এই দেখেই আমার চিৎকার, ‘আমার দাসীকে মেরে ফেললে, মেরে ফেললে।’ পদ্মদাসী আমার কান্না শুনে মুখ তুলে তাকালে। আলুথালু চুল, রক্তমুখী চেহারা, চোখ দুটো কড়ির মতে সাদা। তার পর কি হল মনে নেই। খানিক পরে পদ্মদাসী এল, মাথায় পটি বাঁধা। আমায় কোলে নিয়ে দুধ খাইয়ে দিয়ে চলে গেল। সেই যে আমার কাছ থেকে গেল আর এল না। শুনলুম দেশে গেছে।
তখন গরমি কালটা অনেকেই গঙ্গার ধারে বাগানবাড়িতে গিয়ে কাটাতেন। কোন্নগরের বাগানে বাবামশায় যাবেন, ঠিক হল। মা পিসিমা সবাই যাবেন; সঙ্গে যাব আমি আর সমরদা। দাদা থাকবেন বাড়িতে; বড় হয়েছেন, স্কুলে যান রোজ, বাগানে গেলে পড়াশুনোর ক্ষতি হবে। আমার আনন্দ দেখে কে। কাল সকালবেলায় যাব, কিন্তু রাত পোহায় না। ঘুমোব কি! সারারাত ধরে ভাবছি, কখন ভোর হয়।
বাবামশায় ওঠেন রোজ ভোর চারটের সময়ে। উঠে হাতমুখ ধুয়ে সিঁড়ির উপরে ঘড়ির ঘরে বসে কালীসিংহের মহাভারত পড়েন, সঙ্গে থাকেন ঈশ্বরবাবু। ওই একটি সময়ে আমরা বাবামশায়ের কাছে যেতে পেতুম। চাকররা আমাদের ভোর না হতে তুলে হাতমুখ ধুইয়ে নিয়ে আসত বাবামশায়ের কাছে। তিনি পড়তেন, আমাদের শুনতে হত। এই গল্প শোনা দিয়ে শিক্ষা শুরু করেছি তখন। কোনো-কোনোদিন ভালো লাগে গল্প শুনতে, কোনোদিন ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। মাঝে মাঝে বাবামশায় খানিকটা পড়ে সমরদাকে পড়তে দেন। বলেন, ‘নাও, এবার তুমি পড়ো।’ সমরদা সেই মস্ত মোটা মহাভারতের বই হাতে নিয়ে বেশ গড় গড় করে পড়ে যান। আমাকে কিন্তু বাবামশায় কোনোদিন বলতেন না পড়তে। বললে কি মুশকিলেই পড়তুম তখন বলো তো! এখন কোন্নগরে তো যাওয়া হবে—কত দেরি করেছিল সেদিন সকালটা আসতে। যেমন রামলাল ডাকা ‘ওঠো’, অমনি তড়িঘড়ি বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে ইজের কামিজ বদলে তৈরি হয়ে নিলুম। লোকজন আগেই চলে গেছে বাগানে। এবার আমরা যাব। সাদা জুড়িঘোড়া জোতা মস্ত ফিটন দাঁড়াল দেউড়িতে ভোর পাঁচটায়। আমরা উঠলুম তাতে।
বাবামশায় বসলেন পিছনের সিটে, আমাদের বসিয়ে দিলেন সামনেরটায়। দুপাশে বসলেন আরও দুজন, পাছে আমরা পড়ে যাই। সেকালের গাড়িগুলির দু-পাশ থাকত খোলা—একটুতেই পড়ে যাবার সম্ভাবনা। মা পিসিমা আগেই রওনা হয়েছেন বন্ধ আপিসগাড়িতে। আমাদের ফিটনের পিছনে দুই দুই সহিস হাঁকছে পঁইস, পঁইস; ঘোড়া পা ফেলছে টগ্বগ্ টগ্বগ্। গাড়ি চলতে লাগল জোড়াসাঁকোর গলির মোড়ে শিবমন্দির পেরিয়ে। বড় রাস্তার তেলের আলোগুলি তখনও জ্বলছে, চারদিক আবছা অন্ধকার। ঘুমন্ত শহরের মধ্যে দিয়ে গঙ্গার উপরে হাওড়ার পুলের মুখে এলুম। দূর থেকে দেখি পুলের উপরে উঁচু দুটো প্রকাণ্ড লোহার চাকা, তার আদ্ধেক দেখা যাচ্ছে। হাওড়ার পুল দেখি সেই প্রথম, আমি তো ভয়ে মরি। ওই চাকা দুটোর উপর দিয়েই গাড়ি যাবে নাকি? যদি গাড়ি পড়ে যায় গড়িয়ে গঙ্গায়? যতই গাড়ি এগোয় ততই ভয়ে দু-হাতে গাড়ির গদি শক্ত করে ধরে আঁটসাঁট হয়ে বসি, শেষে দেখি গাড়ি ওই চাকা দুটোর মাঝখান দিয়ে চলে গেল। চাকা দুটোর মাঝখানে যে অমনি সোজা রাস্ত আছে গাড়ি যাবার, তা ভাবতেই পারিনি আমি তখন। হাওড়ার পুলের অপর মুখে টোলঘর পেরিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলুম, বড় বড় গাছের নিচে দিয়ে, গাঁয়ের ভিতর দিয়ে—গাঁগুলি তখনো জাগেনি ভালো করে, মাকড়শার জালের মতো ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার মাঝ দিয়ে চলেছি আমরা। কখনও বা থেকে থেকে দেখা যায় গঙ্গার একটুখানি; ভাবি, এই বুঝি এসে গেলুম বাগানে। আবার বাঁক ঘুরতেই গঙ্গা ঢাকা পড়ে গাছের ঝোপে। শালকের কাছাকাছি এসে কি সুন্দর পোড়া মাটির গন্ধ পেলুম। এখনও মনে পড়ে কি ভালো লেগেছিল সেই সোঁদা গন্ধ। সেদিন গেলুম ওই রাস্তা দিয়েই বালিতে; কিন্তু সেই চমৎকার পল্লীগ্রামের সৌগন্ধ্য পেলুম না। সেই শালকে চিনতেই পারলুম না। শহর যেন পাড়াগাঁকে চেপে মেরেছে। আশেপাশে গলিঘুঁজি, নর্দমা। মাঝরাস্তায় ঘোড়া বদল করে আবার অনেকক্ষণ ধরে চলতে চলতে পৌঁছলুম সবাই কোন্নগরের বাগানে। তখন মোটরগাড়ি ছিল না যে এক ঘণ্টায় পৌছে দেবে শহর থেকে বাগানে। সে ভালো ছিল, ধীরে ধীরে কত কি দেখতে দেখতে যেতুম। গাঁয়ের মেয়েরা পুকুরঘাটে গা ধুতে নেমেছে, পাঠশালায় চলেছে ছেলেরা সরু সরু লাল রাস্তা বেয়ে, মাঝে মাঝে এক-একখানা হাটুরে গাড়ি চলে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি বাঁচিয়ে শহরের দিকে। কোনো এক বুড়োমানুষ ঘরের দাওয়ায় উবু হয়ে হুঁকো টানছে। মুদির দোকানে মুদি ঝাঁপ তুলছে। বাঁশঝাড়ে সকালের আলো ঝিলমিল করছে; একটি দুটি দাঁড়কাক ডাকছে সেখানে। রথতলার রথটা খাড়া রয়েছে। এমনি কত কি সুন্দর সুন্দর দৃশ্য! হঠাৎ দেখা দিল ধানখেতের প্রকাণ্ড সবুজ, তার পরই কোতরঙের ইঁটখোলা—সেখানে পাহাড়ের মতো ইঁটের পাজায় আগুন ধরিয়েছে, তা থেকে ধোঁয়া উঠছে আস্তে আস্তে আকাশে। তার পরই কোন্নগরের বাগান আমাদের। দু-থাক ঢালুর উপরে সাদা ছোট্ট বাড়িখানি। উত্তর দিকে মস্ত ছাতার মতো নিচু একটি কাঁঠালগাছ। বাগানবাড়ির সামনে দাড়িয়ে বুড়ো চাটুজ্জেমশাই—সাদা লম্বা পাকা দাড়ি, মাথায় ঝুঁটি বাঁধা, হাতে একটি গেটেবাঁশের লাঠি, ধবধবে গায়ের রঙ, যেন মুনিঋষি। আমাদের কোলে করে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিলেন।
গঙ্গার পশ্চিম পারে আমাদের কোন্নগরের বাগান, ওপারে পেনিটির বাগান, জ্যোতিকাকা মশায় সেখানে আছেন। কোনোদিন এপার থেকে বাবামশায়ের পানসি যায়, কোনোদিন বা ওপার থেকে জ্যোতিকাকামশায়ের পানসি আসে; এমনি যাওয়া আসা। বন্দুকের আওয়াজ করে সিগ্নেলে কথা বলতেন তাঁরা। একবার আমায় দাড় করিয়ে আমার কাঁধের উপর বন্দুক রেখে বাবামশায় বন্দুক ছোঁড়েন, পেনিটির বাগান থেকে ওপারে। জ্যোতিকাকামশায় বন্দুকের আওয়াজে তার সাড়া দেন। কানের কাছে বন্দুকের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ—গুলি চলে যায় কানের পাশ দিয়ে, চোখ বুজে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে থাকি। বাবামশায়ের ভয়ে টুঁ শব্দটি করিনে। আসলে আমায় সাহসী করে তোলাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য; কিন্তু তা হতে পেল না।
বাবামশায়ের সাঁতারেও খুব আনন্দ। সাঁতরে তিনি গঙ্গা পার হতেন। আমাকেও সাঁতার শেখাবেন; চাকরদের হুকুম দিলেন, তারা আমার কোমরে গামছা বেঁধে জলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয়। সাঁতার দেব কি, ভয়েই অস্থির। কোনো রকম করে আঁচড়ে পাঁচড়ে পারে উঠে পড়ি।
একটি ভারি সুন্দর ছোট্ট টাটুঘোড়ার গাড়ি। সেটি ছিল ছোটলাট সাহেবের মেমের; নিলামে কিনেছিলেন বাবামশায়। সে কি আমাদের জন্যে? মোটেও তা নয়। কিনেছিলেন মেয়েদের জন্যে; সুনয়নী বিনয়িনী গাড়িতে চড়ে বেড়াবে। কোন্নগরে সেই গাড়িও যেত আমাদের জন্যে। ছোট্ট টাটুঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আমরা রোজ সকালে বেড়াতে যাই। বাগানের বাইরেই কুমোরবাড়ি—চাকা ঘুরছে, সঙ্গে সঙ্গে খুরি গেলাস তৈরি হচ্ছে। ভারি মজা লাগত দেখতে; ইচ্ছে হত, ওদের মতো চাকা ঘুরিয়ে অমনি খুরি গেলাস তৈরি করি। মাঝে মাঝে বড় জুড়িঘোড়া হাঁকিয়ে আসেন উত্তরপাড়ার রাজা। আমার টাটুঘোড়া ভয়ে চোখ বুজে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ায়। জুড়িগাড়ির ভিতরে বসে বৃদ্ধ ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কার গাড়ি যায়? কার ছেলে এরা?’ চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। সঙ্গে যারা থাকে তারা বলে দেয় পরিচয়। শুনে তিনি বলেন, ‘ও, আচ্ছা আচ্ছা, বেশ, এসেছ তা হলে এখানে। বোলো একদিন যাব আমি।’ তাঁর জুড়িঘোড়া টগবগ করতে করতে তীরের মতো পাশ কাটিয়ে চলে যায়—আমার ছোট্ট টাটুঘোড়া তার দাপটের পাশে খাটো হয়ে পড়ে। দেখে রাস্তার লোক হাসে। যেমন ছোট্ট বাবু তেমনি ছোট্ট গাড়ি, ছোট্ট ঘোড়াটি—সহিসটি খালি বড় ছিল, আর সঙ্গের রামলাল চাকরটি।
কোন্নগরে কী আনন্দেই কাটাতুম। সেখানে কুলগাছ থেকে রেশমি গুটি জোগাড় করে বেড়াতুম দুপুরবেলা। প্রজাপতির পায়ে সুতো বেঁধে ওড়াতুম ঘুড়ির মতো। সন্ধ্যেবেলা বাবামশায়, মা, সবাই ঢালুর উপরে একটি চাতাল ছিল, তাতে বসতেন। আমরা বাগানবাড়ির বারান্দার সিঁড়ির ধাপে বসে থাকতুম গঙ্গার দিকে চেয়ে—সামনেই গঙ্গা। ঠিক ওপারটিতে একটি বাঁধানো ঘাট; তিনটি লাল রঙের দরজা-দেওয়া একতলা একটি পাকা ঘর। চোখের উপর স্পষ্ট ছবি ভাসছে; এখনও ঠিক তেমনিটিই এঁকে দেখাতে পারি। চেয়ে থাকি সেই ঘাটের দিকে। লোকেরা চান করতে আসে; কখনও বা একটি দুটি মেয়ের মুখ দরজা খুলে উঁকি মারে, আবার মুখ সরিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আর দেখি তর্তর্ করে গঙ্গা বয়ে চলেছে। নৌকো চলেছে পর পর—কোনোটা পাল তুলে, কোনোটা ধীরে, কোনোটা বা জোরে হু-হু করে। যেদিন গঙ্গার উপরে মেঘ করত দেখতে দেখতে আধখানা গঙ্গা কালো হয়ে যেত, আধখানা গঙ্গা সাদা ধবধব করত; সে কি যে শোভা! জেলেডিঙিগুলো সব তাড়াতাড়ি ঘাটে এসে লাগত ঝড় ওঠবার লক্ষণ দেখে। গঙ্গা হয়ে যেত খালি। যেন একখানা কালো সাদা কাপড় বিছানো রয়েছে। এই গঙ্গার দৃশ্য বড় চমৎকার লাগত। গঙ্গার আর এক দৃশ্য, সে স্নানযাত্রার দিনে। দলের পর দল নৌকো বজরা, তাতে কত লোক গান গাইতে গাইতে, হল্লা করতে করতে চলেছে। ভিতরে ঝাড়লণ্ঠন জ্বলছে; তার আলো পড়েছে রাতের কালো জলে। রাত জেগে খড়খড়ি টেনে দেখতুম, ঠিক যেন একখানি চলন্ত ছবি।
এমনি করে চলত আমার চোখের দেখা সারাদিন ধরে। রাত্রে যখন বিছানায় যেতুম তখনও চলত আমার কল্পনা। নানারকম কল্পনায় ডুবে থাকত মন; স্পষ্ট যেন দেখতে পেতুম সব চোখের সামনে। খড়খড়ির সামনে ছিল কঁঠালগাছ। জ্যোৎস্না রাত্তির, চাদের আলোয় কাঁঠালতলায় ছায়া পড়েছে ঘন অন্ধকার। দিনের বেলায় চাটুজ্যে মশায় বলেছিলেন, আজ রাত্তিরে কাঁঠালতলায় কাঠবেড়ালির বিয়ে হবে। রাত জেগে দেখছি চেয়ে, কাঁঠালতলায় যেন সত্যি কাঠবেড়ালির বিয়ে হচ্ছে, খুদে খুদে আলোর মশাল জ্বালিয়ে এল তাদের বরযাত্রী বরকে নিয়ে, মহা হৈ-চৈ, বাদ্যভাণ্ড, দৌড়োদৌড়ি, হুলুস্থুলু ব্যাপার। সব দেখছি কল্পনায়। কাঁঠালতলায় যে জোনাকি পোকা জ্বলছে তা তখন জ্ঞান নেই।
সেই সেবার কোন্নগরে আমি কুঁড়েঘর আঁকতে শিখি। তখন একটু আধটু পেনসিল নিয়ে নাড়াচাড়া করি, এটা ওটা দাগি। বাগান থেকে দেখা যেত কয়েকটি কুঁড়েঘর। কুঁড়েঘরের চালটা যে গোল হয়ে নেমে এসেছে, তা তখনই লক্ষ্য করি। এর আগে আঁকতুম কুঁড়েঘর—বিলিতি ড্রইং-বইএ যেমন কুঁড়েঘর আঁকে। দাদাদের কাছে শিখেছিলুম এক সময়ে। বাংলাদেশের কুঁড়েঘর কেমন তা সেইবারই জানলুম, আর এ পর্যন্ত ভুল হল না।
কোন্নগরে কতরকম লোক আসত। এক নাপিত ছিল, সে পোষা কাঠবেড়ালির ছানা এনে দিত; খালি বাবুইয়ের বাসা জোগাড় করে এনে দিত। কোনোদিন বহুরূপী এসে নাচ দেখাত। কত মজা। কিছু কিছু পড়াশুনোও করতে হত, শুধু খেলা নয়। গোকুলবাবু পড়া নিতেন আমাদের, বাংলার ইতিহাস মুখস্থ করাতেন। টেবিলের উপরে একটি কাচের গেলাসে আফিমের বড়ি ভিজছে, জলটা লাল হয়ে উঠেছে; ওদিকে মা, ওঁরা বারান্দার বাইরে ছোট চালাঘরে রান্না করছেন। বাবামশায়রা কাঁঠালতলায় গল্পগুজব করছেন, চৌকি পেতে বসে। আমরা মুখস্থ করছি বাংলার ইতিহাসে সিরাজদৌল্লার আমল। একদিন রীতিমত প্রশ্ন লিখে বাবামশায়ের সামনে আমাদের পরীক্ষা দিতে হল; সেই পরীক্ষায় জানো আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে গিয়েছিলুম সমরদাকে টেক্কা দিয়ে, চালাকি নয়। পেয়েছিলুম মস্ত একটা বিলিতি অর্গ্যান বাজনা, এখনও তা আছে আমার কাছে। গানও শিখেছিলুম তখন একটি ওই বুড়ো চাটুজ্যেমশায়ের কাছে।
হায় রে সাহেব বেলাকর
আমি গাই দেব তুই বাছুর ধর্।
ওটি শিষ্ট বাছুর, গুঁতোয় নাকো
কান দুটো ওর মুচড়ে ধর্।
হায় রে সাহেব বেলাকর॥
এই আমার প্রথম গান শেখা। ব্লাকইয়র সাহেব রোজ ঘোড়ায় চড়ে বেড়িয়ে ফেরবার সময় গয়লাবাড়ি গিয়ে গয়লানীর কাছে এক পো করে দুধ খেতেন পাড়ার লোকে এই দেখে তার নামে গান বেঁধেছিল।