জ্ঞাতি-শত্রু/অষ্টম পরিচ্ছেদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ।
যখন শক্তিবাবুর বাড়ীর সদর দরজায় উপস্থিত হইলাম, তখন বেলা একটা। দ্বারের সম্মুখে একজন মুটে মস্তকে একটা বোঝা লইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। তাহার মস্তকে কতকগুলি মাটীর মাল্সা, পাঁকাটী, কলাপাতা ইত্যাদি হবিষ্যের উপযোগী দ্রব্যাদি ছিল।
আমি আর কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া সেই মুটেকেই জিজ্ঞাসা করিলাম, “এখানে দাঁড়াইয়া কি করিতেছ বাপু?”
আমার মিষ্ট কথা শুনিয়া মুটে সসম্ভ্রমে উত্তর করিল, “যে বাবুর সঙ্গে এই সমস্ত জিনির লইয়া আসিয়াছি, তিনি এই বাড়ীতে প্রবেশ করিয়াছেন। আমি তাঁহার জন্যই এখানে দাঁড়াইয়া আছি।”
আ। তিনি কতক্ষণ ভিতরে গিয়াছেন?
মু। অনেক ক্ষণ।
আ। তোমাকে কোথায় যাইতে হইবে
মু। বাগবাজারে।
কোথা হইতে এই সকল দ্রব্যাদি ক্রয় করা হইয়াছিল?
মু। শ্যামবাজারে।
আ। তবে বাগবাজারে না গিয়া এদিকে আসিলে কেন?
মু। বাবুর হুকুম—ইহার জন্য বাবু দুইটী পয়সা অধিক দিবেন বলিয়াছেন।
এই প্রকার কথাবার্ত্তা হইতেছে, এমন সময়ে শক্তিসাধন বাবু তথায় আসিলেন। আমি তাঁহাকে দেখিব মাত্র শশব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি মহাশয়! হরিসাধন বাবুর মৃতদেহের সৎকার করা হইয়াছে?
শক্তিসাধন অতি বিষণ্ণ বদনে উত্তর করিলেন, “আজ্ঞে হাঁ— বেলা এগারটার সময় আমরা দাহকার্য্য শেষ করিয়াছি।”
আ। এই মুটিয়ার মাথায় যে সকল দ্রব্যাদি রহিয়াছে, উহা কি আপনিই কিনিয়া আনিলেন?
শ। আজ্ঞে হাঁ।
আমি ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি জাতিচ্যুত হইয়াছেন,—সমাজ আপনাকে জাতিচ্যুত করিয়াছে। তবে আবার আপনি সামাজিক কার্য্য করিতেছেন কেন?”
শক্তিসাধনও ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলেন, “সত্য, কিন্তু দাদার স্ত্রীর অনুরোধ।”
আ। এ সকল দ্রব্যাদি কিনিতে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় হইয়াছে। এ সকল ব্যয়ভার কে বহন করিলেন?
“দাদার স্ত্রী।”
“আপনি ত নিজ বাড়ীতেই হবিষ্য করিবেন?”
“আজ্ঞে না, দাদার বাড়ীতে।”
“কেন? নিজ বাড়ীতে নয় কেন?”
“এখানে করিলে আমাকে ভয়ানক পরিশ্রম করিতে হইবে। দাদার বাড়ীতে দাদার স্ত্রী সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া দিবেন।”
“কেন? এখানে ত আপনার স্ত্রী আছেন?”
“আমার স্ত্রী নাই। স্ত্রী জীবিত থাকিলে কি আমার আজ এ দুর্দ্দশা হইত।”
“তবে এ বাড়ীতে আপনার কে আছে?”
শক্তিসাধন লজ্জায় মস্তক অবনত করিলেন। পরে অতি অস্পষ্ট ভাবে বলিলেন, “এখানে যাহার সহিত বসবাস করিতেছি, তিনি আমার বিবাহিতা পত্নী নহেন।”
আমার প্রশ্নে তিনি যথেষ্ট লজ্জিত হইয়াছিলেন। কাজেই কথাটা চাপ দিবার অভিপ্রায়ে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার দাদার উইল পড়া হইয়াছে?”
শক্তিসাধন হাসিয়া বলিলেন, “উইল আছে কি না তাহাই জানি না।”
এই সময়ে সেই মুটে বলিয়া উঠিল, “বাবু, আরও কত দেরি।”
আমি বিষম ফাঁপরে পড়িলাম। যে কার্য্যে গমন করিতেছি, তাহাতে শক্তিসাধনকে গ্রেপ্তার করাই উচিত। কিন্তু তখন ভদ্রলোকের সঙ্গে অপরের কতগুলি আবশ্যকীয় দ্রব্য থাকায়, তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে ইচ্ছা হইল না।
মুটের তাড়নায় শক্তিসাধন আমার নিকট বিদায় লইয়া তাঁহার দাদার বাড়ীর দিকে গমন করিলেন। আমিও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিলাম। বলিলাম, চলুন, আমারও সেইদিকে প্রয়োজন আছে।
কোন প্রকার সন্দেহ না করিয়া সেই মুটের সঙ্গে শক্তিসাধন তাঁহার জ্যৈষ্ঠের বাড়ীর সদর দ্বারে উপস্থিত হইলেন, এবং মুটেকে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিতে বলিয়া যেমন তিনি প্রস্থান করিতে উদ্যত হইলেন, অমনই আমি পশ্চাৎ দিক হইতে তাঁহার হস্তধারণ করিলাম। বলিলাম, “হরিসাধন বাবুকে হত্যা করিবার অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করিলাম।”
যখন দেখিলাম, শক্তিসাধন বল প্রয়োগ করিতেছেন, তখন পকেট হইতে হাতকড়ি বাহির করিয়া ক্ষিপ্রহস্তে পরাইয়া দিলাম।
এই প্রকার গোলমালে হয়িসাধন বাবুর বাড়ীর দরজার সম্মুখে একটা জনতা হইল। নানালোকে নানা কথা কহিতে লাগিল। এমন সময়ে দুইজন কনষ্টেবল তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। এবং জনতার মধ্যে আমাকে দেখিয়া তখনই উপস্থিত লোকদিগকে তাড়াইয়া দিল। পরে আমার নিকটে আসিয়া সুদীর্ঘ সেলাম করিল। আমি তখন তাহাদের উপর শক্তিসাধনার ভার অর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম।
শক্তিসাধন বাবুকে গ্রেপ্তার করিবার পর হরিসাধনের বাড়ীর ভিতর হইতে অনেক লোক বাহির হইলেন। কিন্তু কেহই আমার কার্য্যে কোন প্রকার বাধা দিলেন না।
শক্তিসাধনকে থানায় চালান দিবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময়ে এক প্রৌঢ় হরিসাধন বাবুর বাড়ীতে আগমন করিলেন। তিনি বাহিরে অনেক লোকসমাগম এবং শক্তিসাধনকে তদবস্থায় দেখিয়া কিছুমাত্র আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন না; বরং ঈষৎ হাসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! কোন্ অপরাধে শক্তিসাধন ধৃত হইয়াছে জানিতে পারি কি?”
আমি বলিলাম, “হরিসাধন বাবুকে হত্যা করিয়াছেন, এই অপরাধে গ্রেপ্তার হইয়াছেন।”
আমার কথা শুনিয়া তিনি বিস্মিত হইলেন না বরং আপনাআপনিই বলিয়া উঠিলেন, “আমিও ঠিক ঐ সন্দেহ করিয়াছিলাম।”
অনন্তর একখানি গাড়ী ডাকিতে আদেশ করিলাম। শকট আনীত হইলে পূর্ব্বোক্ত কনষ্টেবল দুইজনকে বন্দীর সহিত আরোহণ করিতে আদেশ করিলাম।
তিন জনে শকটে আরোহণ করিলে আমি কনষ্টেবলদ্বয়কে যথাযথ পরামর্শ দিয়া থানায় পাঠাইয়া দিলাম।
কোচমান শকট চালনা করিবা মাত্র হরিসাধন বাবুর বাড়ীর অন্দর হইতে স্ত্রীলোকের ক্রন্দনধ্বনি আমার কর্ণগোচর হইল। প্রথমে যখন এই বাড়ীতে আসিয়াছিলাম, তখন যাঁহার কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইয়াছিলাম, আজও তাঁহারই রোদনধ্বনি বলিয়া বোধ হইল। শক্তিসাধন অনেকবার বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার জ্যেষ্ঠের স্ত্রী তাঁহাকে পুত্রবৎ স্নেহ করিয়া থাকেন। এখন তিনিই যে শক্তিসাধনের জন্যই ক্রন্দন করিতেছেন তাহা বুঝিতে পারিলাম।
আর বৃথা সময় নষ্ট না করিয়া আমি তখনই থানায় প্রত্যাগমন করিলাম। নানা কার্য্যে অত্যন্ত ক্লান্ত হওয়ায় সে দিন আমি আর কোন কর্ম্মে হস্তক্ষেপ করিলাম না।
পরদিন প্রাতঃকালে শক্তিসাধনের সহিত দেখা করিলাম। ভাবিয়াছিলাম, তাঁহাকে হত্যাকারী প্রমাণ করিতে কষ্ট পাইতে হইবে। কিন্তু বাস্তবিক সেরূপ হইল না। শক্তিসাধন সকল কথা স্বীকার করিলেন। হরিসাধন বাবুর জন্যই তাহাকে জাতিচ্যুত হইতে হইয়াছিল বলিয়া তাঁহার উপরেই শক্তির আক্রোশ ছিল; এবং আহারের পর যখন হরিসাধন পান করিবার জল চাহিয়াছিলেন, তখন শক্তিসাধন কৌশলে সেই জলের সহিত আর্শেনিক মিশ্রিত করিয়া জ্যেষ্ঠকে পান করিতে দেন। যে উপায়ে তিনি আর্শেনিক সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহাও গােপন করিলেন না। কেদার ডাক্তারের মুখে যাহা শুনিয়াছিলাম, তিনিও সেই কথা বলিলেন।
কিছুদিন পরে শক্তিসাধনের বিচার হইল। বিচারে তাঁহার ফাঁসিই ধার্য্য হইল।
সমাপ্ত।
ফাল্গুন মাসের সংখ্যা
“বিদায় ভোজ”
যন্ত্রস্থ