ঝাঁশির রাণী/সিপাহী-বিদ্রোহ
১৮৫৮ অব্দের সিপাহী-বিদ্রোহ বঙ্গদেশে সূত্রপাত হইয়া ক্রমশঃ সেই বিদ্রোহানল মিরট, দিল্লি প্রভৃতি স্থানে প্রসারিত হইল। মিরট ও দিল্লির বিদ্রোহ-সমাচার ঝাঁশিতে আসিয়া পৌছিল। এই সময়ে ঋশি-স্থিত সিপাহী-পণ্টনের অধিনায়ক কাপ্তেন ডক্লপ, এবং ঋত্রি কমিশনর ও সমস্ত রাষ্ট্রীয় বিভাগের কর্তা, কাপ্তেন আলেজাণ্ডার স্কীন ছিলেন। তাহাদিগের সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল, আর সকল স্থানের সৈন্য বিগড়াইলেও, ঝঁশির সৈন্য কখনই বিগড়াইবে না। বিশেষতঃ, ঝাশির রাণী অবলা রমণী, কঠোর বৈধব্য-ব্রতানুষ্ঠানে দিনপাত করিতেছেন। ঝঁশি খাস হইবার পরেও, রাণী কোন প্রকার দুরাগ্রহ বা জি প্রদর্শন করেন নাই; তিনি অতি সহিষ্ণু, উদার-বুদ্ধি ও রাজনিষ্ট;—অতএব তাহার অধিকারের মধ্যে রাজদ্রোহ হওয়া একপ্রকার অসম্ভব, ইহাই স্কীন সাহেবের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। অথচ এই সময়ে তলে-তলে, বিদ্রোহের যে গুপ্ত-পরামর্শ চলিতেছিল তাহা তিনি আদৌ জানিতে পারেন নাই। ২ জুন তারিখে ঝাঁশি-সিপাহীদিগের প্রকৃতি ভাব প্রকাশ হইয়া পড়িল। সেই দিন, একটা ঘরে আগুন লাগে। লোকে ভাবিল, উহা আকস্মিক ঘটনা মাত্র। তাহার পর, ৪ তারিখে, কালা-পদাতিক-পণ্টনের তৃতীয় দলের মধ্যে বিদ্রোহের প্রকাশ্য কার্য্য আরম্ভ হইল। গুরবকস্ নামক এই পণ্টনের হাওলদার কতকগুলি সিপাহী সঙ্গে লইয়া “ষ্টার ফোর্টের মধ্যে প্রবেশ করিল। এই ক্ষুদ্র ইমারতের মধ্যে, বন্দুক বারুদ গোলা, খাজনা-তহবিল সমস্তই রক্ষিত হইত। এই বিদ্রোহী সিপাহীরা তৎসমস্ত দখল করিয়া লইল। ইহা জানিতে পারিয়া, উপ সাহেব, দ্বাদশ পল্টনের বাকী লোকদিগকে একত্র করিয়া তাহাদিগের কাওয়াৎ (প্যারেড়) করাইলেন, এবং তাহাদিগকে প্রশমিত করিবারও বিবিধ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। এই সমস্ত ভয়-চিছু দেখিবামাত্র, সমস্ত য়ুরোপীয় লোক ছাউনী ত্যাগ করিয়া সহরের মধ্যে প্রবেশ করিল। কাপ্তেন স্কীন ও গর্ডন সাহেব কেল্লার মধ্যে যাইবার জন্য সমস্ত য়ুরোপীয়দিগকে গুপ্তভাবে পরামর্শ দিলেন। কাপ্তেন ডনলপ সাহেবও তাহার সাহায্যার্থে একদল সৈন্য পাঠাইতে নোগাঙ্গের সেনা-নায়ককে পত্র লিখিলেন। পর দিন সকালে, কাপ্তেন স্কীন ও গর্ডন, ইহারা সেনা-নায়ক ডপ সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য ছাউনী-স্থানে আসিলেন। তাঁহাদিগের মধ্যে গুপ্ত পরামর্শ হইয়া প্রতিবিধানের সমস্ত বন্দোবস্ত স্থির হইল। উলপ এন- সাইন্ টেলরকে সঙ্গে করিয়া, কাওয়াৎ-স্থানে কাওয়াৎ করাইবার জন্য আসিলেন। পণ্টনের বিদ্রোহী সিপাহীরা দুই জনকে গুলি করিয়া মারিল। ঝাঁশির প্রধান সেনানায়ক নিহত হওয়ায়, বিদ্রোহিদল বিজয়ানন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল এবং অন্যান্য য়ুরোপীয়দিগকে যম-সদনে পাঠাই- বার ব্যবস্থা করিতে লাগিল। এই সময়ে, স্ত্রীপুত্র-সহ স্কীন—কমিশনর সাহেব, গর্ডন ডেপুটি কমিশনর সাহেব ইত্যাদি প্রায় ৪৫ জন কেল্লার মধ্যে অবস্থিতি করিতেছিলেন। তাহারা সশস্ত্র হইয়া দুর্গরক্ষণের ব্যবস্থা করিতে লাগিলেন। কেল্লার প্রকাণ্ড সিংহদ্বার রুদ্ধ করিয়া স্থানে স্থানে প্রস্তর-রাশি পাকার করিয়া রাখিলেন। বিদ্রোহিগণ ছাউনী-স্থিত য়ুরোপীয়দিগকে নিহত করিয়া কেল্লার অভিমুখে অগ্রসর হইল। কেল্লার অভ্যন্তরস্থ য়ুরোপীয়েরা প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়া বিদ্রোহীদিগকে হটাইবার চেষ্টা করিল, এবং পর দিবস রাণী ঠাকুরাণীর নিকট সাহায্য প্রার্থনায় তিন জন য়ুরোপীয়কে রাজবাটীতে প্রেরণ করিল। কিন্তু বিদ্রোহীরা তাহ- দিগকে পথে ধৃত করিয়া নিহত করিল। এবং কতকগুলা পুরাতন তোপ তৈয়ার করিয়া কেল্লার উপর গোলা বর্ষণের উদ্যোগ করিল। কিন্তু সেই তোপগুলা বেমেরামৎ অবস্থায় থাকায়, কোন ফল হইল না। এদিকে, কেল্লার লোকেরাও বিদ্রোহীদিগের উপর গোলা-গুলি বর্ষণ করিতে লাগিল। তাহাতে অনেক বিদ্রোহী পিছু হাঁটিতে বাধ্য হইল। কিন্তু তাহাদের লোকসংখ্যা অধিক থাকায় তাহারা পুনঃ পুনঃ আক্রমণ করিতে লাগিল। অবশেষে তাহারা কেল্লার গুপ্তদ্বারের সন্ধান পাইয়া কেল্লার মধ্যে হল্লা করিয়া প্রবেশ করিল। এবং কেল্লার দরজা ভাঙ্গিতে প্রবৃত্ত হইল। য়ুরোপীয়েরা গুলিবর্ষণ করিয়া প্রাণপণে যুদ্ধ করিতে লাগিল। য়ুরোপীয় মহিলারাও যুদ্ধে সাহায্য করিতে লাগিল। কাপ্তেন স্কীন সাহেব চিতাবাঘের ন্যায় ইতস্ততঃ ঘুরিয়া ফিরিয়া সমস্ত তত্ত্বাবধান করিতে- ছিলেন। ইতিমধ্যে বিদ্রোহীদিগের মধ্যে একজন তীরন্দাজ লক্ষ্য সন্ধান করিয়া তাহার প্রাণসংহার করিল। ক্রমে য়ুরোপীয়দিগের গোলা-বারুদও নিঃশেষ হওয়ায়, বিদ্রোহীরা কেল্লার অনেক স্থান অধিকার করিল। ইহাতে য়ুরোপীয়েরা হতবীর্য্য ও হতাশ হইয়া সন্ধির নিশান প্রদর্শন করিল। বিদ্রোহীরা স্কীন সাহেবকে বলিয়া পাঠাইল, যদি তোমরা অস্ত্রত্যাগ করিয়া, কেল্লার দ্বার উদঘাটন পূর্বক বাহিরে আইস তাহা হইলে তোমাদিগের একটী কেশও স্পর্শ করিব না। কিন্তু এই কথা অনুসারে য়ুরোপীয়ের দ্বার উদ্ঘাটন পূর্বক যেমন বাহিরে আসিল, অমনি বিদ্রোহীরা হল্লা করিয়া তাহাদিগকে আক্রমণ করিল এবং তাহাদিগের সকলকে পীঠমোড়া করিয়া ফেলিল এবং এই ভাবে তাহাদিগকে সহরের মধ্য দিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। ইতিমধ্যে, বকশিস আলী নামক এক সোয়ার আসিয়া বলিল, উহাদের প্রাণবধের হুকুম হইয়াছে, এই বলিয়া সে তলোয়ারের এক ঘায়ে স্কীন সাহেবের মস্তক উড়াইয়া দিল এবং তাহার অধীনস্থ লোকেরা, স্ত্রীপুত্রসহ বাকী য়ুরোপীয়দিগের প্রাণ নাশ করিল।
ইংরাজদিগের বিশ্বাস, এই সমস্ত নৃশংস কার্যে রাণী ঠাকুরাণীর সম্পূর্ণ অনুমোদন ও সহায়তা ছিল। কিন্তু আমাদের গ্রন্থকার বলেন, তিনি এ সম্বন্ধে বিশ্বস্ত সূত্র হইতে যে প্রকৃত বৃত্তান্ত সংগ্রহ করিয়াছেন তাহাতে স্পষ্টরূপে দেখা যায়, ইহাতে রাণী সাহেবের কোন হাত ছিল না।
জুন মাসের প্রারম্ভেই, ঝাপির সৈন্য মধ্যে একটু বিদ্রোহভাবের সূচনা দেখিয়াই, ডেপুটি কমিশনর কাপ্তেন গর্ডন সাহেব ও ছাউনীস্থিত আর আর য়ুরোপীয়ের রাণীঠাকুরাণীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে আইসেন ও তাহার সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাহাতে রাণী এইরূপ বলেন, তোমাদিগকে আশ্রয় দান করিলে বিদ্রোহী সিপাহীরা আমার সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়া লইবে আমি জানি, তথাপি আমি তোমাদিগের যথাসাধ্য সাহায্য করিব। তৎকালে, রাণীর খাস-সৈন্যের মধ্যে দেড় দুই শত জন মাত্র ছিল, ইংরাজ-দিগের সাহায্য করিবার জন্য আরও বেশি লোক রাখিতে গর্ডন সাহেব রাণীকে অনুরোধ করিলেন। তাহার পর দিবস, গর্ডন সাহেব একক রাজবাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং রাণীঠাকুরাণীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন, আমাদিগের যাহাই হউক, তাহাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু আমাদিগের মহিলাদিগের সংরক্ষণভার আপনাকে লইতেই হইবে। তাহা- দিগকে আপনার রাজবাটীতে আশ্রয় দিউন, ইহাই আমাদের বিনীত প্রার্থনা। রাণীঠাকুরাণী উত্তর করিলেন, আমার যতদুর সাধ্য আমি করিব, তোমাদিগের কোন চিন্তা নাই। তাহার পর দিবস, য়ুরোপীয় মহিলারা রাজবাটীতে প্রবেশ করিলেন। তাহাদিগের থাকিবার জন্য একটা প্রশস্তস্থান নির্দিষ্ট হইল এবং তাহাদিগের রক্ষার জন্য প্রহরী নিযুক্ত হইল। কিন্তু ছাউনী মধ্যে বিদ্রোহীরা যখন হত্যাকাণ্ড আরম্ভ করিল, তখন তত্রস্থ য়ুরোপীয়েরা ভীত হইয়া কেল্লার মধ্যে প্রবেশ করিল এবং তাহাদিগের মহিলাদিগকেও রাজবাটী হইতে উঠাইয়া আনিয়া কেল্লার মধ্যে স্থাপন করিল! কেল্লার মধ্যে চলিয়া যাইবার পরেও, রাণীঠাকুরাণী য়ুরোপীয়দিগকে বারম্বার ভরসা দিলেন এবং দুই তিন দিবস পর্যন্ত গোপনে রাত্রিকালে তিন মণ করিয়া গমের রুটি তাহাদের আহারের জন্য পাঠাইতে লাগিলেন। এদিকে, কর্ণেল ম্যালিসন সাহেব বলেন, “রাণীঠাকুরাণী মুখ্য-মণ্ডলী-সমভিব্যাহারে দুই নিশান উড়াইয়া মহাসমারোহে ছাউনীর মধ্যে উপস্থিত হইলেন। সেইখানে হাসন-আলী নামক এক মোর্লা, সকল মুসলমানকে নিমাজ পড়িতে ডাকিয়া তাহাদিগকে বিদ্রোহী হইতে উত্তেজিত করিল এবং সেই উত্তেজনাবাক্যে সকল লোকে অস্ত্রশস্ত্র লইয়া প্রস্তুত হইল।” কিন্তু আমাদের লেখক বলেন, ইহা ম্যালিসন সাহেবের বুঝিবার ভুল। কারণ, রাণীঠাকুরাণীর সপত্নীমাতা বলেন, সে সময়ে তিনি রাজবাটী হইতে আদৌ বাহির হন নাই। বোধ হয়, বিদ্রোহীরা একটা মিথ্যা ঠাট সাজাইয়া লোকদিগকে উৎসাহিত করিবার জন্যই এইরূপে বাহির হইয়া থাকিবে।
রাণীঠাকুরাণী, প্রথমে বিদ্রোহীদিগকে যে সাহায্য করেন নাই তাহার বিশেষরূপ প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে, তাহার অধীনে সুচতুর বুদ্ধিমান লোক ও সৈন্য সামন্ত অধিক না থাকায় এবং বিদ্রোহিদল প্রবল হইয়া উঠায়, তিনি ইংরাজদিগকে সমুচিত সাহায্য করতে পারেন নাই। তথাপি, বিদ্রোহীরা দিল্লি অভিমুখে চলিয়া গেলে, নিহত য়ুরোপীয়দিগের শব, তিনি আপনার লোকজনের দ্বারা উঠাইয়া অনিয়| তাহাদিগের রীতিমত সমাধি সৎকার করাইয়াছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে যে দুই একজন ইংরাজপুরুষ ও স্ত্রীলোেক লুকাইয়া আপনাদিগের প্রাণ বাঁচাইয়াছিল, রাণীঠাকুরাণী তাহাদিগের অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগের জন্য উত্তম ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে মার্টিন নামক এক সাহেব আগ্রাতে এখনও জীবিত আছেন। তিনি, রাণীঠাকুরাণীর দত্তকপুত্র দামোদর রাওকে ২০ আগষ্ট, ১৮৮৯ অব্দে যে পত্র লেখেন, তাহাতে এই কথার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। তিনি বলেন:—অপনার মাতা বেচারার প্রতি অত্যন্ত অন্যায় ও নৃশংস ব্যবহার করা হইয়াছে এবং তাঁহার আসল। বৃত্তান্ত আমি যেমন জানি এমন আর কেহই জানে না। ১৮৫৭ অব্দের। জুন মাসে ঝশিনিবাসী য়ুরোপীষদিগের যে হত্যাকাণ্ড হয়, তাহাতে রাণী আদৌ যোগ দেন নাই। তদ্বিপরীতে বরং তিনি, য়ুরোপীয়েরা। কেল্লার মধ্যে যাইবার পরে, দুই দিবস ধরিয়া তাহাদিগের আহারের যোগান দিয়াছিলেন—একশত জন বন্দুকধারী লোক “করার” হইতে আনাইয়া আমাদিগের সাহায্যের জন্য পাঠাইয়াছিলেন। কিন্তু একদিন কেল্লার মধ্যে রাখিয়া, সন্ধ্যার সময়ে তাহাদিগকে বিদায় করিয়া দেওয়া হয়। তৎপরে রাণীঠাকুরাণী, মেজর স্কীন ও কাপ্তেন গর্ডনকে,—“দত্তিয়।” নামক স্থানে পলায়ন করিয়া তত্রস্থ রাজার আশ্রয়ে থাকিতে পরামর্শ দেন, কিন্তু এ কথাতেও তাহারা কর্ণপাত করিলেন না এবং অবশেষে। তঁহারা আপনাদিগের নিজের সৈন্যের দ্বারাই নিহত হইলেন।”
সুপ্রসিদ্ধ ইতিহাসকার কে-সাহেবও এইরূপ বলেন:—“আমি বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হইয়াছি, হত্যাকাণ্ডের সময় রাণীর কোন ভৃত্যই উপস্থিত ছিল না। ইহা প্রধানতঃ আমাদের নিজের অনুচরবর্গেরই কাণ্ড বলিয়া বোধ হয়। অনিয়মিত দলের অশ্বারোহী সিপাহীরাই এই রক্তময় ভীষণ আদেশ প্রচার করে এবং দারোগাই এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান সর্দার।”
সে যাহাই হউক, ধারাবাহিক ঘটনার সূত্রটা আবার ধরা যাউক। ঝঁশির বিদ্রোহীরা য়ুরোপীয়দিগকে নিহত করিয়া রাজবাটার অভিমুখে যাত্রা করিল এবং রাণীঠাকুরাণীকে এই কথা বলিয়া পাঠাইলঃ—আমাদিগের দিল্লি যাইতে হইবে, ইহার দরুণ তিন লক্ষ টাকা আবশ্যক। এই টাকা যদি আপনি না দেন, তাহা হইলে আপনার রাজবাটী তোপের দ্বারা এখনই উড়াইয়া দিব। রাণীর পিতা মৌরপন্ত ও দেওয়ান লক্ষ্মণ-রাও, রাণীর নিকট আসিলেন এবং এই সঙ্কট হইতে মুক্তিলাভের উপায় জিজ্ঞাসা করিলেন। রাণী অবলা স্ত্রীলোক হইলেও তাহার অপরিসীম সাহস ও উপস্থিতবুদ্ধি ছিল। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় না হইয়া রাজ্যরক্ষণের ব্যবস্থা করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন এবং বিদ্রোহের নেতাদিগের নিকট এইরূপ বলিয়া পাঠাইলেন; “আমার সমস্ত রাজ্য ইংরাজ-সরকার খাস করিয়া লওয়ায় আমি অর্থহীন হইয়াছি—এক্ষণে আমার নিতান্ত দৈন্যদশা উপস্থিত। এই সময়ে আমার ন্যায় গরিব অবলাকে কষ্ট দেওয়া তোমাদের উচিত নহে।” বিদ্রোহীরা ইহার প্রত্যুত্তরে এইরূপ বলিয়া পাঠাইল; “তোমার নিকট হইতে যদি খর্চার হিসাবে কিছু টাকা না পাওয়া যায়, তবে তোমার প্রাসাদ দখল করিয়া, আমাদের অধিকৃত কঁশির রাজ্য তোমার স্বসম্পর্কীয় সদাশিব-রাও-নারায়ণকে দেওয়া যাইবে।” রাণী এই কথা শুনিয়া নিরুপায় হইয়া আপনার নিজ সম্পত্তি হইতে এক লক্ষ টাকা বিদ্রোহীদিগের হস্তে অৰ্পণ করিলেন; তখন, বিদ্রোহীরা রাজবাটী ছাড়িয়া দিয়া, আপনাদিগের সমস্ত সৈন্যমধ্যে এই দোহাই-বাক্য প্রচার করিল “খোদার মুলুক, বাদশার মুলুক, রাণী লক্ষ্মীবাইর আমল,” এই দোহাই দিয়া বিদ্রোহীরা দিল্লি, নৌগাঙ্গ প্রভৃতি স্থানাভিমুখে যাত্রা করিল।
এই সময়ে রাণীঠাকুরাণীর অধীনে, চতুর রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তি কেহই ছিল না। ঝাঁশি খাস হইয়া গেলে, অনেক ভাল ভাল লোক ঝাঁশি হইতে বিদায় হইয়া যায়। এক্ষণে, কোন গুরুতর রাষ্ট্রীয় কাজ উপস্থিত হইলে সুপরামর্শ দিবার কেহই ছিল না। রাণী স্বয়ং কুশগ্রবুদ্ধি ও চতুর ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি অন্তঃপুরবাসিনী হওয়ায় অনেক সময় অনেক কথা তাহার গোচর হইত না। তাহার অধীনস্থ অযোগ্য কর্মচারীরা তাহাকে না জানাইয়াই অনেক কাজের নিষ্পত্তি করিত। ইংরাজ সরকার হইতে কোন পত্রাদি আসিলে তাহারা তাহার রীতিমত জবাব দিত না; সুতরাং রাণীঠাকুরাণীর প্রকৃত উদ্দেশ্য ও মিত্রভাব ইংরাজদিগের গোচর হইত না। ইহা হইতে অনেক অনর্থের উৎপত্তি হইয়াছিল। একজন ইংরাজী-জানা শিরেস্তাদার পূর্বে ছিল, প্রধান কর্মচারীরা তাহাকে কর্ম্ম- চ্যুত করায় আরও গণ্ডগোল ও কাজের বেবন্দবস্ত আরম্ভ হইল। রাণী মনে করিতেন,তঁহার অভিপ্রায়-অনুসারে পত্রাদি লিখিত হইয়া ইংরাজ- সরকারের নিকট যাইতেছে, অথচ সেরূপ কিছুই হইত না। এই গণ্ড- গোলের মধ্যেও, দুই একটা পত্র বোধ হয় ইংরাজ-সরকারের নিকট পৌছিয়াছিল। কারণ, ঝুঁশির কমিশনর পিকূলে সাহেব স্পষ্ট লিখিয়া- ছেনঃ—“খুব বিশ্বস্ত সূত্র হইতে অবগত হওয়া গিয়াছে, রাণী আমাদিগের স্বদেশীয়দিগের হত্যাকাণ্ডে দুঃখ প্রকাশ করিয়া জব্বলপুরের কমিশনরকে পত্র লিখেন এবং এইরূপ পত্রাদি লিখিয়া তিনি ইংরাজ-সরকারের সহিত মিত্রভাব রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি আরও এইরূপ লেখেন যে, সেই হত্যাকাণ্ডে তাহার কোন হাত ছিল না এবং যাবৎ না ইংরাজ-সরকার ঝাঁশি পুনরধিকার করিবার বন্দবস্ত করিবেন, তাবৎ কঁশি রাজ্য রাণী তাঁহার নিজ দখলে রাখিবেন। এতদ্ব্যতীত, এই পত্র যিনি স্বহস্তে কমিশনর সাহেবের হাতে দিয়াছিলেন, সেই মার্টিন সাহেব এখনও জীবিত আছেন। তিনি রাণীঠাকুরাণীর দত্তকপুত্রকে যে পত্র লেখেন তাহার মধ্যে একস্থলে এইরূপ আছে —“তিনি (রাণী) একসিন সাহেবের নিকট জব্বলপুরে পত্র পাঠাইয়া দেন, আমি সেই পত্র নিজহস্তে কমিশনার সাহেবকে দেই—রাণীর কৈফিয়ৎ শুনিয়া তিনি কি বলেন, আমি জানিতে উৎসুক হইলাম—কিন্তু না!–ঝঁশির নাম খারাপ হইয়া গিয়াছে; কিছু না শুনিয়াই—কোন বিচার না করিয়াই, ঝাঁশি অপরাধী সাব্যস্ত হইল।”
অতএব দেখা যাইতেছে, প্রথমে রাণী ইংরাজের বিরুদ্ধে ছিলেন না, তাঁহাদিগের প্রতিনিধিস্বরূপ ঝুঁশি-রাজ্য শাসন করিতেছিলেন মাত্র।
এদিকে, আঁশি-রাজ্য ইংরাজের হস্তচ্যুত হইয়া আবার রাণীর হস্তগত হইয়াছে দেখিয়া, ঝাঁশিরাজ্যের একজন দাবীদার সদাশিব-দামোদর এই অবসরে কঁশির গদি অধিকার করিবার জন্য সচেষ্ট হইলেন। ঝুঁশির ৩০ মাইল দূরে, করেরা নামক একটি কেল্লা দখল করিয়া সদাশিব-রাও “ঝাঁশির মহারাজা” এই উপাধি ধারণ করিলেন। ঝঁশির রাণী এই কথা শুনিবামাত্র এক সহস্র সৈন্য তাহার বিরুদ্ধে প্রেরণ করিলেন। সেই সৈন্যমণ্ডলী করেরা অবরোধ করিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইলে, তিনি সিন্ধিয়ার রাজ্যে পলায়ন করিলেন এবং সেখান হইতে ঝাঁশি আক্রমণের উদ্যোগ করায়, রাণী তাহার বিরুদ্ধে পুনর্ব্বার সৈন্য প্রেরণ করিলেন। সৈন্যগণ সদাশিবকে এইবার বন্দী করিয়া আনিল।
একদল শত্রু পরাভূত না হইতে হইতেই ঝাশির নিকটস্থ বোছ। নামক রাজ্যের - দেওয়ান নথে-খ বিশ সহস্র সৈন্য সমভিব্যাহারে ঝঁশির বিরুদ্ধে যাত্রা করিল। এবং ঝঁশির নিকটস্থ বেত্রবতী নদীর তীরে আসিয়া উপস্থিত হইল। এই সময়ে রাণীর সৈন্য অতি অল্প ছিল। নথে-খা রাণীঠাকুরাণীকে বলিয়া পাঠাইলঃ—“ইংরাজ-সরকার তোমার ভরণ-পোষণের জন্য যে বৃত্তি নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, সেই বৃত্তি আমি দিতে প্রস্তুত আছি। তুমি ঝঁশির কেল্লা ও সহর আমাকে ছাড়িয়া দেও।” এই কথা শুনিবামাত্র রাণীর অত্যন্ত ক্রোধ উৎপন্ন হইল। তিনি এই বিষয়ের পরামর্শ করিবার জন্য আপনার দেওয়ান ও প্রধান-মণ্ডলীকে ডাকাইলেন। তাহারা বলিল, যদি আপনি বোছার রাণী লয়্যী বাইর নিকট হইতে বৃত্তি প্রাপ্ত হন, তবে আর তাহার সহিত যুদ্ধ করিবার প্রয়োজন কি? এই কথা শুনিয়া রাণীর অত্যন্ত কষ্ট হইল; এবং এই কাপুরুষোচিত পরামর্শ অগ্রাহ্ করিয়া সেই তেজস্বিনী মহিলা নথে-খার নিকট এইরূপ উত্তর পাঠাইয়া দিলেন –“আমি শিবরাঙ-ভাউর পুত্র- বধূ; তোমাদিগের ন্যায় বুলেখণ্ডের লোকদিগকে স্ত্রীলোক বানাইয়া ছাড়িয়া দিতে পারি, এরূপ সামর্থ্য আমার আছে—অতএব তুমি এই সমস্ত বিবেচনা করিয়া যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।” এই উত্তর প্রাপ্ত হইবা- মাত্র নথে-খার ক্রোধাগ্নি প্রজ্বলিত হইল এবং তিনি সসৈন্যে ঝঁশি-অভি- মুখে যাত্রা করিলেন। এদিকে রাণীঠাকুরাণী, ঝাঁশি-রাজ্যের অভিজাত ঠাকুর-মণ্ডলী ও বুলেখণ্ডের জাইগীরদারদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া দরবার। বসাইলেন এবং সেই দরবারে তাহাদিগকে বলিলেন, তোমরা আমার অধীনস্থ সর্দার—আমার আব্রু ও মান রক্ষা করা তোমাদিগের কর্তব্য। রাণীঠাকুরাণীর এই কথা শুনিয়া বুণ্ডেল-সর্দারেরা বলিল “ঝঁশির উপর ইংরাজদিগেরই সাৰ্বভৌম আধিপত্য। বোছা আমাদিগের সমান একটা খণ্ডরাজ্য মাত্র—বোছার হস্তে সার্বভৌম অধিকার ন্যস্ত করা। আমাদিগের কর্ত্তব্য নহে। যে পর্যন্ত আমাদিগের দেহে প্রাণ থাকিবে সে পর্যন্ত এই রাজ্য তাহাদিগকে অধিকার করিতে দিব না।” এই পণ- অনুযায়ী পত্র লিখিয়া নথে খার নিকট পাঠান হইল। এবং সেই সঙ্গে পাঁচটা গোল ও কিঞ্চিৎ বারুদ পাঠাইয়া এইরূপ ইঙ্গিত করা হইল যে “এই সমস্ত উপকরণ আমাদিগের নিকট আছে—অতএব তোমরা যদি মরণের মুখে আসিতে চাও, তো ঝাঁশিতে আসিবে।” যুদ্ধের আমন্ত্রণ পৌছিবামাত্র নথে-খা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইল। কিন্তু এদিকে রাণীর সৈন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না। কারণ, ইতিপূর্ব্বে, ইংরাজ-সরকার ঝুঁশির সৈন্য-সংখ্যা কমাইয়া দিয়াছিলেন এবং কেল্লার উপরিস্থিত তোপ ও তাহার গোলা-বারুদ নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছিলেন। এক্ষণে, রাণীঠাকুরাণী আবার সৈন্য সংগ্রহ করিতে লাগিলেন—গোলাবারুদ প্রস্তুত করিবার কারখানা খুলিলেন; কেল্লার মধ্যে পূর্ব্বেকার যে তিন তোপ পোঁতা ছিল এবং রাজবাড়ীর মধ্যে যে চারিটা তোপ লুকানো ছিল—এই সকল এক্ষণে বাহিরে আনাইয়া কেল্লার প্রকাণ্ড বুরুজের উপর তাহাদিগকে উঠানো হইল; ঝাঁশি-রাজ্যের সর্দার ও ঠাকুর-মণ্ডলীর নিকট গ্রামে গ্রামে নিমন্ত্রণ পাঠান হইল। তাহারা স্বীয় অধীনস্থ সশস্ত্র অনুচর লইয়া উপস্থিত হইল। রাতারাতি তোপ চালাইবার সুব্যবস্থা হইল, উৎকৃষ্ট গোলন্দাজ নিযুক্ত হইল এবং প্রাতঃকালে দেওয়ান জওহর সিংহের হস্তে রণকঙ্কণ পরাইয়া তাহাকে সেনাপতিত্বে বরণ করা হইল। সেনাপতি জওহর সিংহ দুর্গপ্রাচীরের উপর তোপ ও গোলন্দাজ সৈন্য সজ্জিত রাখিলেন এবং এক সহস্র বাছাবাছা শস্ত্রধারী পদাতিক, শত্রুর মোহরা আক্রমণ করিবার জন্য প্রস্তুত রাখিলেন। স্বয়ং রাণী সাহেব পাঠানী বেশ ধারণ করিয়া কেল্লার মুখ্য বুরুজের উপর উপস্থিত রহিলেন এবং সেইখানে পেশোয়া আমলের পুরাতন নিশান ও ইংরাজদত্ত “য়ুনিয়জ্যাক” পতাকা স্থাপিত করিলেন। এদিকে, নথে-খা, ভাবী বিজয়াশায় উৎফুল্ল হইয়া রাষ্ট্রীয় নিশান-পতাকা উড্ডীন করিয়া মহাসমারোহে ঝুঁশিতে আসিয়া উপস্থিত হইল। রানিঠাকুরাণী, কেল্লার দক্ষিণ-অভিমুখে তাহাদিগকে প্রবেশ করতে দিলেন—তাহাতে কোন বাধা দিলেন না; পরে, তোপের আন্দাজের মধ্যে আসিবামাত্র তাঁহার চতুর গোলন্দাজ গোলাম-গোশ-খাকে গোলাবর্ষণ করিতে আদেশ করিলেন। তদনুসারে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ হইতে লাগিল। নথে-খার লোকেরাও তীর ও বন্দুকের গুলি একসঙ্গে ছুড়িতে লাগিল। দুই প্রহর কাল পর্যন্ত ঘোরতর যুদ্ধ হইল। কেল্লার। উপরিস্থিত তোপের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে অস্থির হইয়া নথে-খার সৈন্য পিছু হটিল এবং কিঞ্চিৎ দুরে গিয়া কেল্লা অবরোধ করিয়া বসিয়া রহিল। প্রতিদিন উভয় সৈন্যের এক একবার সাক্ষাৎকার হইতে লাগিল। যুদ্ধের প্রথম আরম্ভেই, নথে-খরি ধ্বজপতাকা ধরাশায়ী হইল এবং বিস্তর সৈন্য বিনষ্ট হইল। ঝাশির অবল। বিধবা রাণীর সহিত যুদ্ধে তাঁহার ন্যায় বীরপুরুষের পরাস্ত হইয়া পলায়ন করিতে হইবে, ইহা অতি লজ্জার কথা বিবেচনা করিয়া নথে-খা, রাত্রিকালে, ঝুঁশি-কেল্লার “বোছ।” দরজার উপর লক্ষ্য সন্ধান করিয়া চারিটা তোপ বসাইলেন এবং সমস্ত সৈন্য চারিভাগে বিভক্ত করিয়া ঝাশি-সৈন্যকে আক্রমণ করিলেন। যদিও রাণীঠাকুরাণীর সৈন্য সুসজ্জিত ও প্রস্তুত ছিল, তথাপি “বোছা” দরজার উপর, চারিটা তোপের গোলা বর্ষিত হওয়ায়, দরজা ভগ্নপ্রায় হইল। এই সংবাদ রাণীঠাকুরাণী জানিবামাত্রই, তাঞ্জামে আরোহণ করিয়া “বোছ।” দরজার উপরিস্থিত তোপ-শ্রেণীর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং প্রভূত আবেশভরে তত্রস্থ সৈন্যদিগকে সাবাশি দিয়া তাহাদিগকে আরও উত্তেজিত করিবার জন্য কিছু কিছু বক্শিসও দিলেন। তাহারা উৎসাহিত হইয়া প্রাণপণে যুদ্ধ করিতে লাগিল। ইতিমধ্যে, বীরচূড়ামণি সর্দার লাল-ভাউ-বশিকে হুকুম করিয়া, কড়ক বিজলী” নামক কেল্লার প্রসিদ্ধ প্রকাণ্ড তোপ বুরুজের উপর অনাইলেন এবং গোলন্দাজকে সুবর্ণ-বলয় বকশিস দিয়া তুমুল যুদ্ধে উৎসাহিত করিলেন। এই তোপের বর্ষণ শুরু হইবামাত্র শত্রুপক্ষের সমস্ত গোলন্দাজ ভয়চকিত হইয়া রণবিমুখ হইল। এবং উহাদিগের তোপ ঝশি-সৈন্যের হস্তগত হইল। রঘুনাথ সিংহ প্রভৃতি সর্দারগণ পলায়নোমুখ শত্রু-সৈন্যের অনুসরণ করিয়া তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করিল। রাণীঠাকুরাণী, রঘুনাথ সিংহের শৌর্য-বীর্যের স্তুতিবাদ করিয়া, তাঁহাকে বহুমুল্য বস্ত্রালঙ্কার প্রদান করিয়া তঁহির যথো- চিত সম্মান করিলেন। এইক্ষণে, বোছার পক্ষ হইতে সন্ধির প্রস্তাব আসিল। বোরছা-রাজ্য অতীব প্রাচীন ও ক্ষত্রিয়কুলমধ্যে' বোছার রাজবংশ সর্ব্বজন-বন্দ্য হওয়ায় রাণীঠাকুরাণী অতীব উদার বুদ্ধি-সহকারে যুদ্ধের খরচা প্রভৃতি লইয়া, বোছার রাণীর সহিত সখ্যমূলক সন্ধিস্থাপন করিলেন। শ্রীমতী চিমাবাই বলেন, “ঝাঁশির রাণী লক্ষ্মীবাই ও বোছার রাণী লঢ়য়ী বাই-ইহাদের মধ্যে সহোদর ভগিনীর ন্যায় মিলন হইল।”
এই প্রকারে, ঝাঁশির উপস্থিত বিপদ নিবারণ করিয়া, রাণী লক্ষ্মীবাই ঝাঁশি-প্রদেশের সুন্দর ব্যবস্থা করিলেন এবং পত্রের দ্বারা সমস্ত বৃত্তান্ত হ্যামিল্টন সাহেবের গোচর করিবার নিমিত্ত সচেষ্ট হইলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, নথে-খা পথিমধ্যে পত্রবাহককে ধৃত করিয়া, সে পত্র পৌছিতে দিল না। শুদ্ধ তাহা নহে, সে স্বয়ং হ্যামিল্টন সাহেবকে এই মর্মে একটা পত্র লিখিল যে, রাণী লক্ষ্মীবাই বিদ্রোহীর দলভুক্ত হইয়াছেন—সেই জন্য আমি তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। এই সকল কারণে, রাণী লক্ষ্মীবাই ইংরাজদিগের হইয়াই যে ঝাশির সুশাসন ও সুব্যবস্থা করিতেছিলেন, ইংরাজ কর্তৃপক্ষীয়েরা তাহা জানিতে পারিল না।
৯।১০ মাস যাবৎ ঝাঁশি ইংরাজের হস্তচ্যুত হইয়া রাণীর শাসনাধীনে ছিল। এই সময়ে তিনি রাজ্যশাসনকার্যে যেরূপ প্রবীণতা, দক্ষতা, প্রজাবৎসল্য, ন্যায়পরতা প্রভৃতি গুণের পরিচয় দিয়াছিলেন তাহা অতীব প্রশংসনীয়। তিনি কিরূপে সময় অতিবাহিত করিতেন, তৎসাময়িকএক ব্যক্তি এইরূপ বর্ণনা করেন:—প্রাতঃকালে ৫টার সময় উঠিয়া,উত্তম সুরভি-দ্রব্য-সহযোগে মঙ্গল-স্নান করিতেন। স্নানাদি করিয়া পরিস্কৃত শুভ্র বস্ত্র পরিধান করিয়া অসিনারূঢ় হইতেন। তদনন্তর, পতিবিয়য়াগের পর কেশ রাখিতে হইলে যে কৃচ্ছ প্রায়শ্চিত্তের আবশ্যক সেই প্রায়শ্চিত্ত সাধন করিয়া, রৌপ্যনির্মিত তুলসী-বৃন্দাবনে শ্রীতুলসীর পূজা করিতেন। তাহার পর মাটির শিব পূজা আরম্ভ হইত। সেই সময়ে সরকারী গায়ক গান করিত। ইহার পর, সর্দার ও আশ্রিত লোকের দরবার বসিত। যদি কোন দিবস, কোন ব্যক্তিবিশেষ না আসিত অমনি পরদিবস তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেন “কাল আপনি কেন আসেন নাই?” এইরূপে পূজার্চনা সমাপন করিয়া ভোজন করিতেন ও ভোজনান্তে একটু নিদ্রা যাইতেন কিম্বা অপর কোন কার্যে নিযুক্ত হইতেন।
প্রাতঃকালে যে নজরের টাকা জমা হইত তাহা রূপার থালায় রেশমি ৰস্ত্রে আচ্ছাদিত থাকিত। সেই টাকা হইতে ইচ্ছামত স্বয়ং কিছু গ্রহণ করিয়া, বাকী টাকা আশ্রিত-মণ্ডলীর জন্য কোষাধ্যক্ষের জিম্ম করিয়া দিতেন। তদনন্তর, প্রায় তিন ঘটিকার সময়ে কাছারী যাইতেন। সেই সময় প্রায়ই পুরুষ-বেশ ধারণ করিতেন। পায়ে পায়জামা, অঙ্গে বেগুণী রঙ্গের অঙ্গখা, মাথায় টুপী, তাহার উপর পাঠানী পাগড়ি, কোমরে জরির দোপাটা ও তাহাতে রত্নখচিত তলোয়ার ঝোলানো; এইরূপ বেশভূষায় সেই গৌরবর্ণ মুর্তি গৌরীর ন্যায় উপলব্ধি হইত। কখন কখন স্ত্রীলোকের উপযুক্ত বেশভূষা ধারণ করিতেন। পতিবিয়োগের পর নথ প্রভৃতি অলস্কার আদৌ ধারণ করিতেন না। হাতে হীরার বালা, গলায় মুক্তার মালা এবং অনামিকায় এক হীরার আংটি—ইহা ব্যতীত তাহার অঙ্গে আর কোন অলঙ্কার দেখা যাইত না। কেশ, প্রায় গ্রন্থি দিয়া বাঁধিয়া রাখিতেন। তিনি শাদা শাড়ি ও শাদা চেলি পরিতেন। এইরূপ কখন পুরুষবেশে ও কখন স্ত্রীবেশে রাণীঠাকুরাণী দরবারে আসিতেন। তাহার বসিবার ঘর, দরবার-ঘরের সংলগ্ন ছিল। সেই ঘরের দ্বারে সোণালী “মেহেরাপ”, তাহার উপর জরির লতা-পাতা-কাটা চিকের পর্দা খাটানো হইত। সেই ঘরের ভিতরে গদির উপর তাকিয়া ঠেসান দিয়া বসিতেন। দ্বারের বাহিরে, দুই জন ভল্লধারী রূপা ও সোণার আসামোটা লইয়া হাজির থাকিত। সম্মুখে, রাজশ্রী লক্ষ্মণরাও দেওয়ানজী, কোমর বাঁধিয়া কাগজের তাড়া লইয়া দণ্ডায়মান ও তাহার কিঞ্চিৎদূরে হজুর-মুন্সি উপবিষ্ট থাকিত। কুশাগ্রবুদ্ধি রাণীঠাকুরাণী, উপস্থিতকার্য্যসম্বন্ধীয় বৃত্তান্ত তৎক্ষণাৎ বুঝিয়া লইয়া তাহার হুকুম মুখে-মুখে বলিয়া দিতেন, কিম্বা কখন কখন নিজ হস্তে লিখিয়া দিতেন। ফৌজদারী ও দেওয়ানী বিচার অতীব দক্ষতাসহকারে নিষ্পন্ন করিতেন।
শ্রীমহালক্ষ্মী দেবীর উপর রাণীর প্রগাঢ় ভক্তি ছিল। তিনি প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবারে, স্বীয় দত্তকপুত্রকে সঙ্গে লইয়া, সন্ধ্যাকালে সরোবর-মধ্যস্থিত মন্দিরে, মহালক্ষ্মী দর্শনে যাত্রা করিতেন। সরোবরে সুন্দর সুন্দর কমল ফুটিয়া থাকিত, তাহাতে সে স্থানের রমণীয় শোভ হইত। তিনি কখন পাল্কীতে চড়িয়া, কখন বা অশ্বপৃষ্ঠে, দেবীদর্শনে যাত্রা করিতেন। যে সময়ে তিনি পাল্কীতে আরোহণ করিতেন, কিস্তাব কাপড়ের জরির পর্দা দিয়া পাল্কী ঢাকিয়া দেওয়া হইত। রাণীঠাকুরাণী যখন অশ্বপৃষ্ঠে গমন করিতেন, তখন তাহার উষ্ণীয-বিলম্বিত জরির অঞ্চল পৃষ্ঠোপরি দোদুল্যমান হইয়া মনোহর শোভা বিকাশ করিত। যখন প'ল্কী-সোয়ারীতে যাইতেন, তখন পাল্কীর খুর ধরিয়া চার পাঁচ জন দাসী, মহা ধুমধামে চলিত। এই দাসীরা পরিচ্ছদাগারে প্রবেশ করিয়া সুবর্ণ রত্নের অলঙ্কার ও জরির চোলি অঙ্গে ধারণ করিত এবং সবুজ, লাল ও ছাই রঙের শাড়ি ও পায়ে চর্ম্মপাদুকা পরিধান করিত; এক হস্তে রৌপ্য কিম্বা স্বর্ণদণ্ডের চামর লইয়া ও আর এক হস্তে পাল্কী ধরিয়া, বাহকদের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়িয়া বাইত। সেই সময়ে, এই অবিবাহিত সৰ্বালঙ্কার-ভূষিত দাসীদিগকে অতি চমৎকার দেখিতে হইত। সোয়ারীর সম্মুখভাগে ডঙ্কা নিশান প্রভৃতি থাকায় রণবাদ্য বাজিতে থাকিত। নিশানের পশ্চাতে প্রায় দুই শত আফগান পদাতিক ও সোয়ারীর সম্মুখে ও পশ্চাতে প্রায় একশত ঘোড়শোয়ার যাইত। পাল্কীর সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের প্রধান কর্মচারী ও আশ্রিত- মণ্ডলী অশ্বপৃষ্ঠে কিম্বা পদব্রজে যাইতেন—তাহাদের সঙ্গে অনুচরবর্গও থাকিত। এইরূপ মহাসমারোহে শিঙ্গা প্রভৃতি নিনাদিত হইত—ভল্লদার, চোপদার প্রভৃতি হাঁক দিতে দিতে চলিত। রাণীঠাকুরাণীর সোয়ারী কেল্লার বাহির হইবামাত্র কেল্লার বুরুজ হইতে নহবৎ বাজিতে আরম্ভ হইত এবং ফিরিয়া আসা পর্যন্ত বাজিতে থাকিত। মন্দিরের নহবৎখানা হইতেও এই সময়ে নহবৎ বাজিত। যখন রাণী অশ্বপৃষ্ঠে যাইতেন, তখন তাঁহার সঙ্গে দাসীজন ও আশ্রিতবর্গ যাইত না। কেবল, ঘোড়শোয়ার ও পাঠান পদাতিক সঙ্গে থাকিত। শ্রীমহালক্ষ্মী ঝুঁশি-রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী—এই হেতু, তাঁহার সেবায় অনেক টাকা ব্যয় হইত। মঙ্গল দীপরক্ষণ, পূজার্চনা, মহানৈবেদ্য, নহবৎ বাদ্য, গায়ক, নর্তকী ও ধর্ম্মশালা প্রভৃতি বন্দবস্ত সমস্তই ছিল।
রাণীঠাকুরাণীর আশ্রিত-মণ্ডলীর উপর প্রভূত দয়া ছিল। যাহাতে তাহাদিগের ভাল খাওয়া-পরা হয়, তাহারা সর্ব্বপ্রকারে সুখে থাকে, সেই বিষয়ে তাহার বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তিনি সর্বপ্রকার গুণের মর্যাদা বুঝিতেন, এই জন্য তিনি গুণী লোকেরও প্রিয় ছিলেন। বড় বড় শাস্ত্রী,বিদ্বান্ ব্যক্তি, বৈদিক ও যাজ্ঞিক তাহার নিকট থাকিত। ঝুঁশির পুস্তক সংগ্রহও অতীব মূল্যবান্ ছিল। উত্তম পৌরাণিক, গান-বাদন-পটু সঙ্গীতশাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি, কুশল কারীগর ইত্যাদি অনেক প্রকারের গুণী লোক তাঁহার আশ্রয়ে থাকিত। এবং তাহার খ্যাতি শুনিয়া দুর-দুরান্তর প্রদেশ হইতে কীর্ত্তনকার, গায়ক, শাস্ত্রী প্রভৃতি তাহার দরবারে আসিয়া উপস্থিত হইত।
অশবপরীক্ষায় রাণীঠাকুরাণীর বিশেষ দক্ষতা ছিল। সেই সময়ে উত্তর হিন্দুস্থান-মধ্যে অশ্বপরীক্ষা-সম্বন্ধে তিন জনের খুব খ্যাতি ছিল। শ্রীমন্ত নানাসাহেব পেশোয়া; দ্বিতীয়, বাবাসাহেব আপটে গৃহেরীকর; এবং তৃতীয়, ঝাঁশির মহারাণী লক্ষ্মীবাই। ইনিই অশ্বপরীক্ষায় সকলের অগ্রগণ্য ছিলেন। তাহার অশ্বপরীক্ষার অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তাহার মধ্যে একটা গল্প এইঃ-এক দিবস এক সদাগর, ভাল-দেখিতে ও চটুল এইরূপ দুইটী ঘোড়া সঙ্গে করিয়া রাজবাড়ীতে বিক্রয়ের উদ্দেশে আইসে। রাণী সেই দুই অশ্বে আরোহণ করিয়া, তাহাদিগকে চক্রপথে দৌড় করাইতে লাগিলেন এবং এইরূপ পরীক্ষা করিয়া, একের মূল্য হাজার ও দ্বিতীয়টার মূল্য পঞ্চাশ টাকা স্থির করিলেন। ইহা শুনিয়া সকলে অত্যন্ত বিস্মিত হইল। দুই ঘোড়াই দেখিতে সতেজ ও সুন্দর তবে, উভয়ের মধ্যে মূল্যের এত প্রভেদ হইল কেন, কেহই বুঝিতে পারিতেছিল না। তখন, রাণীঠাকুরাণী বুঝাইয়া বলিলেন, এই উভয়ের মধ্যে একটী ঘোড়া সুন্দর ও আর একটা ঘোড়া সদ্গুণবিশিষ্ট ও চটুল হইলেও উহার ছাতি ফাটা, সেই জন্য একেবারে কাজের বাহির।”
রাণীঠাকুরাণীর দাতৃত্ব ও ঔদার্য্যগুণ অপরিসীম ছিল। তিনি কোন দরিদ্র কিম্বা ভিক্ষুককে কখনই বিমুখ করিতেন না। এক দিবস একজন কাশীনিবাসী বিদ্বান্ ৰাহ্মণ রাজবাটীর নিত্যদানের সময় উপস্থিত হন। রাণীর কোন সভাসদ রাণীর নিকট এই ব্রাহ্মণের কুলশীল ও বিদ্যা সম্বন্ধে স্তুতিবাদ করিয়া বলিলেন, এই ব্রাহ্মণের স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছে—পুনর্ব্বার দারপরিগ্রহ করিবার ইহার ইচ্ছা হইয়াছে। কিন্তু ইহা অতি ব্যয়সাধ্য বলিয়া উনি মনে মনে কষ্ট পাইতেছেন। এই কথা শুনিয়া রাণী প্রশ্ন করিলেন, টাকা দিলে কন্যাদান করিতে কেহ প্রস্তুত আছে কি? তাহাতে, ভট জী নম্রতা সহকারে বলিলেন “আমাদিগের স্বশ্রেণীর দেশস্থ ব্রাহ্মণ কাশীতে একজন আছেন। তাহার কন্যার বয়ঃক্রম প্রায় ১২ বৎসর। হইবে—দেখিতেও সুরূপা, রাশি প্রভৃতিরও মিল আছে। কিন্তু এই কন্যার দরুণ তাহাকে চারি শত টাকা দিতে হইবে—আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ অত টাকা কোথা হইতে দিব? এতদ্ব্যতীত, বিবাহব্যয়ের দরুণ একশত টাকা তত লাগিবেই” এই কথা শুনিবামাত্র রাণীঠাকুরাণী পাঁচ শত টাকা আনিয়া তাহার বস্ত্রাঞ্চলে ঢালিয়া দিলেন ও বলিলেন, “যখন বিবাহ হইবে, আমাদিগকে কুঙ্কুমপত্রিকা পাঠাইতে ভুলিবেন না” ব্রাহ্মণ কৃতকৃত্য হইয়া প্রস্থান করিল।
এক দিবস রাণী, মহালক্ষ্মীর মন্দির হইতে প্রত্যাগত হইবার সময়ে, অনেক ভিখারী জমা হইয়াছে দেখিতে পাইলেন। কারণ অনুসন্ধানে জানিলেন, তাহারা শীতের দরুণ কষ্ট পাইতেছে। তিনি হুকুম করিলেন, ভিখারীদিগকে জমা করিয়া প্রত্যেককে এক-একখানি ভূল-ভরা জামা, টুপি ও কম্বল দান করা হয়। রাণীঠাকুরাণীর দয়ার্দ্রতা ও পরোপকার- বুদ্ধি নথে-খার সহিত যুদ্ধে বিলক্ষণ প্রকাশ পাইয়াছিল। ঝাঁশি-সৈন্য-স্থিত আহত লোকদিগের ক্ষতস্থানে যখন মলম-পটি লাগানো হইত, তখন তাহারা রাণীঠাকুরাণীকে দেখিয়া নিজ কষ্ট আকার-ভঙ্গীতে প্রকাশ করিত—তখন তিনি তাহাদিগের গায়ে হাত বুলাইয়া সান্ত্বনা করিতেন। এই সকল সদ্গুণপ্রযুক্ত প্রজারা তাহাকে মাতার ন্যায় ভক্তি করিত।
রাণীঠাকুরাণী স্বীয় দত্তকপুত্র দামোদর রাওকে অত্যন্ত ভাল বাসিতেন। তাহার যখন যাহা সাধ হইত তখনই তাহা মিটাইবার যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেন। রাণী ১৮৫৭ অব্দের জুনমাসে ইংরাজদিগকে সাহায্য করেন, বহিঃশত্রু দমন করিয়া ঝাশি সংরক্ষণের উদ্যোগ করেন—এই সমস্ত বৃত্তান্ত ইংরাজ কর্তৃপক্ষীয়গণকে পত্রের দ্বারা জানাইবার চেষ্টা করেন —নিজ অধিকার পুনঃপ্রাপ্তির জন্য আন্দোলন করিতে ইংলণ্ডে মোক্তিয়ার পাঠান। এই সব কারণে তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ন্যায়পরায়ণ ইংরাজ-সরকার কখনই অন্যায় করিবেন না— তাহার অধিকার তিনি ফিরিয়া পাইবেন—ইংরাজ সরকার আঁশির গদিতে দামোদর রাওকেই পুনঃস্থাপন করিবেন। এই বিশ্বাসে ভর করিয়া তিনি সুখস্বপ্ন দেখিতেছিলেন এমন সময়, আঁশির রাণী বিদ্রোহী, এইরূপ ভুল বুঝিয়া, ইংরাজ সেনাপতি সর-হিউ-রোজ প্রবল সৈন্য সমভিব্যাহারে আঁশতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এবং নিম্নলিখিত শ্লোকের উক্তি-অনুসারে নলিনী ও নলিনী-মধুমত্ত দ্বিরেফ উভয়ই একসঙ্গে গজকবলে পতিত হইল।
“রাত্রির্গমিয্যতি ভবিষ্যতি সুপ্রভাত
ভাস্বানুদেষ্যতি হসিষ্যতি পদ্মজালং।
ইথং বিচিন্তয়তি কোশগতে দ্বিরেফে,
হা হন্ত হস্ত নলিনীং গজ উজ্জহার॥”