টমাস বাটার আত্মজীবনী

টমাস বাটার আত্মজীবনী


টমাস বাটার আত্মজীবনী

জান বাবোস কৃত ইংরেজী হইতে
শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
কর্তৃক অনুলিখিত

আচার্য স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়, কে-টি, ডি-এস্ সি
লিখিত ভূমিকা সংবলিত

জেনারেল প্রিণ্টার্স য়্যাণ্ড পাব্লিশার্স লিমিটেড্
১১৯ ধর্ম্মতলা ষ্ট্রীট্, কলিকাতা

প্রকাশক: শ্রীসুরেশচন্দ্র দাস, এম-এ
জেনারেল প্রিণ্টার্স য়্যাণ্ড পাব্লিশার্স লিঃ
১১৯, ধর্মতলা ষ্ট্রীট, কলিকাতা

মূল্য: চার টাকা

প্রথম সংস্করণ: জ্যৈষ্ঠ ১৩৫০

জেনারেল প্রিণ্টার্স য়্যাণ্ড পাব্লিশার্স লিমিটেডের
মুদ্রণ বিভাগে [অবিনাশ প্রেস—১১৯ ধর্মতলা ষ্ট্রীট,
কলিকাতা] শ্রীসুরেশচন্দ্র দাস এম-এ কর্ত্তৃক মুদ্রিত

ভুমিকা

টমাস বাটা পৃথিবীর প্রধান শিল্পপতিগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ। অসামান্য কর্মপ্রতিভা, অলৌকিক অন্তর্দৃষ্টি এবং সরল আদর্শনিষ্ঠার জেরে নগণ্য এক চর্ম ব্যবসায়ীর পুত্র আজ সমগ্র পৃথিবীতে যে সৌভাগ্য ও যশের অধিকারী হইয়াছেন তাহার সম্যক আলোচনা বিশেষ করিয়া এই অভিশপ্ত বাংলা দেশে হওয়া প্রয়োজন। টমাস বাটা যে আত্মচরিত লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন, নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে তাহা তিনি সমাপ্ত করিতে যাইতে পারেন নাই। তবুও যতটুকু তিনি লিখিয়া গিয়াছেন তাহা একদিকে যেমন তথ্যবহুল অন্য দিকে তেমনই মনোরম। বাটার আত্মজীবনীর ইংরাজী অনুবাদ How I Began পড়িতে পড়িতে বারংবার আমার এই কথাই মনে হইয়াছে যে বাংলা ভাষায় কেন ইহার অনুবাদ হয় না? বাঙ্গালী কেন নিজের মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে এই অদ্ভুত মণীষীর কম প্রতিভার সহিত পরিচিত হইবার সুযোগ পায় না?

 আজ এই দেখিয়া আমি অত্যন্ত আনন্দ বধ করিতেছি যে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী শ্রীযুক্ত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় টমাস বাটার আত্মজীবনীর বাংলা অনুবাদ শেষ করিয়াছেন। বিভূতিভূষণ লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যিক বাংলা দেশের পাঠক সমাজে তাঁহার আসন সুপ্রতিষ্ঠিত, সুতরাং তাঁহার পরিচয় দিবার উদ্দেশ্যে কোন ভূমিকা লেখার প্রয়োজন নাই। আবার টমাস বাটার জীবনীর সহিত যথেষ্ট পরিচয় না থাকিলেও বাংলা দেশের অধিকাংশ লোকই তাঁহার নাম জানে। এক্ষেত্রে বাটার জীবনী জানিবার জন্য জনসাধারণকে উৎসাহিত।করিতে যে বিশেষ কোন যুক্তিতর্কের অবতারণা করার প্রয়োজন আছে ইহাও মনে করি না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলা দেশের সকলেই, বিশেষ করিয়া যুব সমাজ এই পুস্তক আগ্রহ সহকারেই পাঠ করিবেন।

 টমাস বাটা কর্মজীবনের প্রারম্ভেই স্বপ্ন দেখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। সেই স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করিয়া তুলিতে তিনি আপ্রাণ সাধনা করিয়া গিয়াছেন এবং সে সাধনায় শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধিলাভও করিয়াছেন। বাটার জীবনী পাঠ করিয়া মাত্র এইটুকুই লক্ষ্য করিলেই চলিবে না। ইহার বাহিরেও অনেক কিছুই লক্ষ্য করিবার মত রহিয়াছে ইহা নিঃসংশয়ে বলিতে পারা যায়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে টমাস বাটা পিতার কারখানায় শিক্ষানবিশী শেষ করিয়া আপনার নিজের ব্যবসায় গড়িয়া তুলিতে সংকল্প করেন। তার পর হইতেই অসামান্য দুঃখ কষ্টকে বরণ করিয়া লইয়া তাঁহার পথ চলিতে হইয়াছে কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তিনি তাঁহার আদর্শকে ম্লান হইতে দেন নাই। ধোঁয়াটে আদর্শবাদ সম্বল করিয়া কতকগুলি চোখা চোখা বাঁধাবুলি আওড়াইযাই তিনি কর্তব্য শেষ করিতে যান নাই এবং তাহা চান নাই বলিয়াই তিনি সাফল্য লাভ করিয়াছেন। বাটা কোন দিন দুঃখ ও বাধাকে ভয় করেন নাই। দুঃখ ও বাধাকে নয় করিয়া চলাই তাঁহার সহজাত প্রেরণা। এই প্রেরণার পশ্চাতে তাঁহার এই বিশ্বাস চিরকালই বলবৎ ছিল যে "Bigger the impediments and difficulties, greater are the opportunities for men of strong hearts" অর্থাৎ বাধাবিপত্তি যতই প্রচণ্ড হইব, শক্তিমানের কাজ করিবার ততই সুযোগ আসিবে।

 বাটা শিল্পপতিগণের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ পুরুষ হইলেও তাঁহার জীবনযাত্রার কোনদিন অনাবশ্যক আড়ম্বর প্রকাশ পায় নাই, অথবা পুঁজিবাদের ছোঁয়াচে তাঁহার মূল উদ্দেশ্যে কলঙ্কিত হয় নাই। এ সম্বন্ধে তিনি আত্মজীবনীতে ইহাই লিখিয়া গিয়াছেন যে:–"Capitaliat Society as now constituted was regarded by me as fit for bad people only, such as exploiters at one end and sluggards at the other. I kept on dreaming about the simple life as preached by Tolstoi" অর্থাৎ "পুঁজিবাদ সমাজ আজ যে ভাবে গঠিত তাতে আমি মনে করি উহা বদ লোকের একটা আড্ডা হওয়ারই যোগ্য। এর একদিকে অপহারক আর অন্যদিকে অপহৃতের দল। টলষ্টয় যে সরল জীবনযাত্রা প্রণালীর কথা বলিয়া গিয়েছেন আমি সেই জীবনযাপন প্রণালীর স্বপ্নই ক্রমাগত দেখিলাম।"

 টমাস বাটার জীবনী ও কার্যকলাপ সমগ্রভাবে আলোচনা করিয়া দেখিলে সকলেই তাঁহার দৃষ্টি ভঙ্গীর নূতনত্ব লক্ষ্য করিবেন।

 আধুনিক জগতে যন্ত্রশিল্প ও কুটিরশিল্প লইয়া একটা গুরুতর সমস্যা ক্রমশঃই আত্মপ্রকাশ করিতেছে। গতিবেগ ও প্রয়োজনের দিক হইতে বর্তমান সমাজ যন্ত্রকে ছাঁটিয়া ফেলিতে পারিবে না ইহা নিশ্চিত কিন্তু অন্যদিকে যন্ত্রের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নানাবিধ কুটিরশিল্পও বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছে এবং তাহার ফলে বহুলোক বেকার হইয়া পড়িতে বাধ্য হইতেছে। যন্ত্রগুলি প্রধানতঃ পুঁজিবাদীগণের নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত হওয়ায় এই যে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বেকার হইয়া যাইতেছে ইহার প্রতিকার কি ভাবে হইতে পারে তাহা চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের চিত্তে আলোড়নের সৃষ্টি করিতেছে, নিত্য নূতন নূতন ইজম এর আবির্ভাব ঘটিতেছে কিন্তু সমস্যার একটা সুষ্ঠু সমাধান মিলিতেছে না। বলা বাহুল্য বাটার ন্যায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এই সমস্যা সম্বন্ধে উদাসীন থাকিতে পারেন না। তিনি আপন কারখানায় একটি নূতন পরীক্ষা আরম্ভ করিয়াছিলেন। প্রথমতঃ তিনি কারখানার প্রত্যেকটি unitকে এক একটি স্বতন্ত্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বলিয়া গণ্য করিয়া লইয়াছেন। এই সকল unit এর কর্মিগণ প্রথমতঃ অন্য unit হইতে কাঁচামাল সংগ্রহ করিয়া নিজ নিজ কাজ করেন, তারপর তাহাদের তৈরী মল নির্ধারিত unit এ যোগ্যমূল্যে বিক্রয় করেন। ইহার ফলে প্রত্যেকটি unit স্বতন্ত্রভাবে গড়িয়া উঠিতে ও লাভ করিতে পারে। সমষ্টিগত ভাবে বাটার কারখানাকে ধরা যাইতে পারে একই ব্যবসায়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কুটিরশিল্পের যৌথ প্রতিষ্ঠান যাহা finished product বাজারে বিক্রয় করে। দেশের সমস্ত কুটিরশিল্প যদি এই পদ্ধতিতে সংঘবদ্ধ করিয়া তুলিতে পারে তাহা হইলে হয়ত অন্ততঃ যাহারা কুটিরশিল্পগুলির উপর জীবনধারণের জন্য নির্ভরশীল তাহাদের অনেকখানি উপকার হইত। এই দিক থেকে গোটা সমস্যাটা বিচার করিয়া দেখা যাইতে পারে বলিয়া আমার বিশ্বাস।

 অধিক উদাহরণের উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। টমাস বাটার আত্মজীবনী যাঁহারা একটু মনোযোগের সহিত পাঠ করিবেন তাঁহারাই বুঝিবেন যে বড় বড় সমস্যার সহজ সমাধান, অন্ততঃপক্ষে নিরুদ্বেগ কাজ চলিবার মত সমাধান করিয়া লইয়া সুকৌশলে আগাইয়া যাইতে না পারিলে কোন বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তোলা সম্ভব নয়। আত্মবিশ্বাস ও ধৈর্য না থাকিলে সাফল্য করতলগত হইব না।

 আমি আশা করি বাংলা দেশের পাঠক সমাজে এই পুস্তকখানি যথেষ্ট সমাদর পাইবে এবং বাংলা দেশের যুবকগণ ইহা হইতে ব্যবসায়ক্ষেত্রে ঝাঁপাইয়া পড়িবার প্রেরণা লাভ করিবে।

শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র রায়

পরিচ্ছেদসমূহ (মূল গ্রন্থে নেই)

সূচীপত্র

পরিচ্ছেদ 
 পৃষ্ঠা