ডাকঘর/২
২
দইওয়ালা
দই—দই—ভাল দই।
অমল
দইওয়ালা, দইওয়ালা, ও দইওয়ালা!
দইওয়ালা
ডাকছ কেন? দই কিন্বে?
অমল
কেমন করে কিন্ব? আমার ত পয়সা নেই।
দইওয়ালা
কেমন ছেলে তুমি! কিন্বে না ত আমার বেলা বইয়ে দাও কেন?
অমল
আমি যদি তোমার সঙ্গে চলে যেতে পারতুম ত যেতুম।
দইওয়ালা
আমার সঙ্গে?
অমল
হাঁ। তুমি যে কতদূর থেকে হাঁক্তে হাঁক্তে চলে যাচ্চ শুনে আমার মন কেমন করচে।
দইওয়ালা
(দধির বাঁক নামাইয়া) বাবা তুমি এখানে বসে কী করচ?
অমল
কবিরাজ আমাকে বেরতে বারণ করেচে, তাই আমি সারাদিন এইখেনেই বসে থাকি।
দইওয়ালা
আহা, বাছা তোমার কী হয়েছে!
অমল
আমি জানিনে। আমি ত কিচ্ছু পড়িনি তাই আমি জানিনে আমার কী হয়েছে। দইওয়ালা, তুমি কোথা থেকে আস্চ?
দইওয়ালা
আমাদের গ্রাম থেকে আস্চি।
অমল
তোমাদের গ্রাম? অনে—ক দূরে তোমাদের গ্রাম?
দইওয়ালা
আমাদের গ্রাম সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায়। শামলী নদীর ধারে।
অমল
পাঁচমুড়া পাহাড়—শামলী নদী—কি জানি,—হয়ত তোমাদের গ্রাম দেখেছি—কবে সে আমার মনে পড়ে না।
দইওয়ালা
তুমি দেখেছ? পাহাড়তলায় কোনোদিন গিয়েছিলে না কি?
অমল
{{gap}না, কোনোদিন যাইনি। কিন্তু আমার মনে হয় যেন আমি দেখেছি। অনেক পুরণো কালের খুব বড় বড় গাছের তলায় তোমাদের গ্রাম—একটি লাল রঙের রাস্তার ধারে। না?
দইওয়ালা
ঠিক বলেছ বাবা।
অমল
সেখানে পাহাড়ের গায়ে সব গোরু চরে বেড়াচ্চে।
দইওয়ালা
কি আশ্চর্য্য! ঠিক বল্চ। আমাদের গ্রামে গোরু চরে বই কি, খুব চরে!
অমল
মেয়েরা সব নদী থেকে জল তুলে মাথায় কল্সি করে নিয়ে যায়—তাদের লাল সাড়ি পরা!
দইওয়ালা
বা! বা! ঠিক কথা! আমাদের সব গয়লাপাড়ার মেয়েরা নদী থেকে জল তুলে ত নিয়ে যায়ই! তবে কি না, তারা সবাই যে লাল সাড়ি পরে তা নয়—কিন্তু বাবা, তুমি নিশ্চয় কোনোদিন সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলে।
অমল
সত্যি বলচি দইওয়ালা আমি একদিন ও যাইনি। কবিরাজ যেদিন আমাকে বাইরে যেতে বলবে সেদিন তুমি নিয়ে যাবে তোমাদের গ্রামে?
দইওয়ালা
অমল
আমাকে তোমার মত ঐ রকম দই বেচ্তে শিখিয়ে দিয়ো। ঐ রকম বাঁক কাঁধে নিয়ে—ঐ রকম খুব দূরের রাস্তা দিয়ে।
দইওয়ালা
মরে যাই! দই বেচতে যাবে কেন বাবা? এত এত পুঁথি পড়ে তুমি পণ্ডিত হয়ে উঠ্বে।
অমল
না, না, আমি কক্খনো পণ্ডিত হব না। আমি তোমাদের রাঙা রাস্তার ধারে তোমাদের বুড়ো বটের তলায় গোয়ালপাড়া থেকে দই নিয়ে এসে দূরে দূরে গ্রামে গ্রামে বেচে বেচে বেড়াব। কি রকম করে তুমি বল, দই, দই, দই―ভাল দই! আমাকে সুরটা শিখিয়ে দাও!
দইওয়ালা
হায় পোড়াকপাল! এ সুরও কি শেখবার সুর!
অমল
না, না, ও আমার শুন্তে খুব ভাল লাগে। আকাশের খুব শেষ থেকে যেমন পাখীর ডাক শুনলে মন উদাস হয়ে যায়—তেমনি ঐ রাস্তার মোড় থেকে ঐ গাছের সারের মধ্যে দিয়ে যখন তোমার ডাক আস্ছিল, আমার মনে হচ্ছিল—কি জানি কি মনে হচ্ছিল।
দইওয়ালা
বাবা, এক ভাঁড় দই তুমি খাও!
অমল
দইওয়ালা
না না না না—পয়সার কথা বোলো না। তুমি আমার দই একটু খেলে আমি কত খুসি হব।
অমল
তোমার কি অনেক দেরি হয়ে গেল?
দইওয়ালা
কিচ্ছু দেরি হয়নি বাবা, আমার কোনো লোকসান হয়নি। দই বেচতে যে কত সুখ সে তোমার কাছে শিখে নিলুম।
অমল
(সুর করিয়া) দই, দই, দই, ভাল দই! সেই পাঁচমুড়া পাহাড়ের তলায় শামলী নদীর ধারে গয়লাদের বাড়ির দই। তারা ভোরের বেলায় গাছের তলার গোরু দাঁড় করিয়ে দুধ দোয়, সন্ধ্যাবেলায় মেয়েরা দই পাতে, সেই দই।
দই, দই, দই—ই ভাল দই!—এই যে রাস্তায় প্রহরী পায়চারি করে বেড়াচ্চে! প্রহরী, প্রহরী, একটিবার শুনে যাওনা প্রহরী।
প্রহরী
অমন করে ডাকাডাকি করচ কেন? আমাকে ভয় কর না তুমি?
অমল
কেন, তোমাকে কেন ভয় করব?
প্রহরী
অমল
কোথায় ধরে নিয়ে যাবে? অনেক দূরে? ঐ পাহাড় পেরিয়ে?
প্রহরী
একেবারে রাজার কাছে যদি নিয়ে যাই।
অমল
রাজার কাছে? নিয়ে যাওনা আমাকে! কিন্তু আমাকে যে কবিরাজ বাইরে যেতে বারণ করেছে। আমাকে কেউ কোথাও ধরে নিয়ে যেতে পারবে না—আমাকে কেবল দিন রাত্রি এই খানেই বসে থাক্তে হবে।
প্রহরী
কবিরাজ বারণ করেচে? আহা, তাই বটে—তোমার মুখ যেন শাদা হয়ে গেছে। চোখের কোলে কালী পড়েছে। তোমার হাত দুখানিতে শির গুলি দেখা যাচ্চে।
অমল
তুমি ঘণ্টা বাজাবে না প্রহরী?
প্রহরী
এখনো সময় হয়নি!
অমল
কেউ বলে সময় বয়ে যাচ্চে, কেউ বলে সময় হয়নি। আচ্ছা তুমি ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেইত সময় হবে।
প্রহরী
অমল
বেশ লাগে তোমার ঘণ্টা—আমার শুনতে ভারি ভাল লাগে। দুপুর বেলা আমাদের বাড়িতে যখন সকলেরই খাওয়া হয়ে যায় পিসেমশায় কোথায় কাজ করতে বেরিয়ে যান, পিসিমা রা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েন, আমাদের ক্ষুদে কুকুরটা উঠে ঐ কোণের ছায়ায় ল্যাজের মধ্যে মুখ গুজে ঘুমতে থাকে তখন তোমাব ঐ ঘণ্টা বাজে–ঢংঢংঢং, ঢংঢংঢং! তোমার কেন বাজে?
প্রহরী
ঘণ্টা এই কথা সবাইকে বলে, সময় বসে নেই, সময়চলে যাচ্চে।
অমল
কোথায় চলে যাচ্চে? কোন দেশে?
প্রহরী
সে কথা কেউ জানে না।
অমল
সে দেশ বুঝি কেউ দেখে আসেনি? আমার ইচ্ছে করচে ঐ সময়ের সঙ্গে চলে নাই—যে দেশের জানে না, সেই অনেক দূরে!
প্রহরী
সে দেশে সবাইকে যেতে হবে বাবা!
অমল
প্রহরী
হবে বৈ কি।
অমল
কিন্তু কবিরাজ আমাকে যে বাইরে যেতে বারণ করেছে।
প্রহরী
কোন্দিন কবিরাজই হয়ত স্বয়ং হাতে ধরে নিয়ে যাবেন।
অমল
না, না, তুমি তাকে জান না, সে কেবলি ধরে রেখে দেয়।
প্রহরী
তার চেয়ে ভাল কবিরাজ যিনি আছেন তিনি এসে ছেড়ে দিয়ে যান।
অমল
আমার সেই ভাল কবিরাজ কবে আস্বেন? আমার যে আর বসে থাকতে ভাল লাগ্চে না।
প্রহরী
অমন কথা বল্তে নেই বাবা।
অমল
না—আমি ত বসেই আছি—যেখানে আমাকে বসিয়ে রেখেছে সেখান থেকে আমিত বেরই নে—কিন্তু তোমার ঐ ঘণ্টা বাজে ঢংঢংঢং-আর আমার মন কেমন করে! আচ্ছা প্রহরী!
প্রহরী
কি বাবা!
অমল
আচ্ছা, ঐ যে রাস্তার ওপারের বড় বাড়িতে নিশেন উড়িয়ে দিয়েছে, আর ওখানে সব লোকজন কেবলি আসচে যাচ্চে— ওখানে কী হয়েছে!
প্রহরী
ওখানে নতুন ডাকঘর বসেছে।
অমল
ডাকঘর? কার ডাকঘর?
প্রহরী
ডাকঘর আর কার হবে? রাজার ডাকঘর।—এ ছেলেটি ভারি মজার!
অমল
রাজার ডাকঘরে রাজার কাছ থেকে সব চিঠি আসে?
প্রহরী
আসে বই কি। দেখো একদিন তোমার নামেও চিঠি আসবে!
অমল
আমার নামেও চিঠি আসবে? আমি যে ছেলেমানুষ!
প্রহরী
ছেলেমানুষকে রাজা এতটুকুটুকু ছোট্ট ছোট্ট চিঠি লেখেন।
অমল
বেশ হবে! আমি কবে চিঠি পাব! আমাকেও তিনি চিঠি লিখবেন তুমি কেমন করে জানলে?
প্রহরী
তা নইলে তিনি ঠিক তোমার এই খোলা জানলাটার সামনেই অত বড় একটা সোনালি রঙের নিশেন উড়িয়ে ডাকঘর খুলতে যাবেন কেন?—ছেলেটাকে আমার বেশ লাগচে।
অমল
আচ্ছা, রাজার কাছ থেকে আমার চিঠি এলে আমাকে কে এনে দেবে?
প্রহরী
রাজার যে অনেক ডাকহরকরা আছে—দেখনি বুকে গোল গোল সোনার তকমা পরে তারা ঘুরে বেড়ায়।
অমল
আচ্ছা, কোথায় তার ঘোরে?
প্রহরী
ঘরে ঘরে, দেশে দেশে। –এর প্রশ্ন শুনলে হাসি পায়।
অমল
বড় হলে আমি রাজার ডাকহরকরা হব।
প্রহরী
হা হা হা হা! ডাকহরকরা! সে ভারি মস্ত কাজ! রোদ নেই, বৃষ্টি নেই, গরীব নেই বড়মানুষ নেই সকলের ঘরে ঘরে চিঠি বিলি করে বেড়ানো—সে খুব জবর কাজ!
অমল
তুমি হাস্চ কেন? আমার ঐ কাজটাই সকলের চেয়ে ভাল লাগচে। না না তোমার কাজও খুব ভাল—দুপুর বেলা যখন রোদ্দুর ঝাঁঝাঁ করে তখন ঘণ্টা বাজে ঢং ঢং ঢং-আবার একএকদিন রাত্রে হঠাৎ বিছানায় জেগে উঠে দেখি ঘরের প্রদীপ নিবে গেছে, বাহিরের কোন অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ঘণ্টা বাজচে ঢং ঢং ঢং!
প্রহরী
ঐ যে মোড়ল আসচে-আমি এবার পালাই। ও যদি দেখতে পায় তোমার সঙ্গে গল্প করচি তাহলেই মুস্কিল বাধাবে।
অমল
কই মোড়ল, কই, কই?
প্রহরী
ঐ যে অনেক দুরে। মাথায় একটা মস্ত গোলপাতার ছাতি।
অমল
ওকে বুঝি রাজা মোড়ল করে দিয়েছে?
প্রহরী
আরে না। ও আপনি মোড়লি করে। যে ওকে না মানতে চায় ও তার সঙ্গে দিনরাত এমনি লাগে যে ওকে সকলেই ভয় করে। কেবল সকলের সঙ্গে শক্রতা করেই ও আপনার ব্যবসা চালায়। আজ তবে যাই, আমার কাজ কামাই যাচ্চে। আমি আবার কাল সকালে এসে তোমাকে সমস্ত সহরের খবর শুনিয়ে যাব।
আমল
রাজার কাছ থেকে রোজ একটা করে চিঠি যদি পাই তাহলে বেশ হয়—এই জানলার কাছে বসে বসে পড়ি। কিন্তু আমি ত পড়তে পারিনে। কে পড়ে দেবে? পিসিমা ত রামায়ণ পড়ে! পিসিমা কি রাজার লেখা পড়তে পারে? কেউ যদি পড়তে না পারে জমিয়ে রেখে দেব, আমি বড় হলে পড়ব। কিন্তু ডাকহরকরা যদি আমাকে না চেনে! মোড়ল মশায়, ও মোড়ল মশায়—একটা কথা শুনে যাও!
মোড়ল
কে রে! রাস্তার মধ্যে আমাকে ডাকাডাকি করে! কোথাকার বাঁদর এটা!
অমল
তুমি মোড়ল মশায়, তোমাকে ত সবাই মানে!
মোড়ল
(খুসি হইয়া) হাঁ, হাঁ, মানে বই কি! খুব মানে!
অমল
রাজার ডাকহরকরা তোমার কথা শোনে!
মোড়ল
না শুনে তার প্রাণ বাঁচে! বাসরে! সাধ্য কি!
অমল
তুমি ডাকহরকরাকে বলে দেবে আমারি নাম অমল—আমি এই জানলার কাছটাতে বসে থাকি।
মোড়ল
কেন বল দেখি?
অমল
আমার নামে যদি চিঠি আসে—
মোড়ল
অমল
রাজা যদি চিঠি লেখে তাহলে-
মোড়ল
হা হা হা হা! এ ছেলেট ত কম নয়! হা হা হা হা! রাজা তোমাকে চিঠি লিথবে। ত লিখবে বই কি! তুমি যে তার পরম বন্ধু! ক’দিন তোমার সঙ্গে দেখা না হয়ে রাজা শুকিয়ে যাচ্চে, খবর পেয়েছি! আর বেশি দেরি নেই, চিঠি হয়ত আজই আসে কি কালই আসে!
অমল
মোড়লমশায়, তুমি অমন করে কথা কচ্চ কেন? তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?
মোড়ল
বাসরে! তোমার উপর রাগ করব! এত সাহস আমার! বাজার সঙ্গে তোমার চিঠি চলে!— মাধবদত্তর বড় বাড় হয়েছে দেখচি! দুপয়সা জমিয়েছে কি না, এখন তার ঘরে রাজা বাদশার কথা ছাড়া আর কথা নেই। রোসনা, ওকে মজা দেখাচ্চি! ওরে ছোড়া, বেশ, শীঘ্রই যাতে রাজার চিঠি তোদের বাড়িতে আসে আমি তার বন্দোবস্ত করচি।
অমল
না, না, তোমাকে কিছু করতে হবে না।
মোড়ল
কেনরে! তোর খবর আমি রাজাকে জানিয়ে দেব—তিনি তাহলে আর দেরি করতে পারবেন না- তোমাদের খবর নেওয়ার জন্যে এখনি পাইক পাঠিয়ে দেবেন! –না, মাধবদত্তর ভারি আস্পর্দ্ধা-রাজার কানে একবার উঠলে দুরস্ত হয়ে যাবে।
অমল
কে তুমি মল ঝম্ ঝম্ করতে করতে চলেছ একটু দাড়াও না ভাই।
(বালিকার প্রবেশ)
বালিকা
আমার কি দাড়াবার জো আছে! বেল বয়ে যায় যে।
অমল
তোমার দাঁড়াতে ইচ্ছা করচে না—আমারো এখানে আর বসে থাকতে ইচ্ছা করে না।
বালিকা
তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্চে যেন সকাল বেলাকার তারা—তোমার কি হয়েছে বল ত!
অমল
জানিনে কি হয়েছে, কবিরাজ আমাকে বেরতে বারণ করেছে।
বালিকা
আহা, তবে বেরিয়োনা—কবিরাজের কথা মেনে চলতে হয়— দুরন্তপনা করতে নেই, তা হলে লোকে দুষ্টু বলবে! বাইরের দিকে তাকিয়ে তোমার মন ছটফট করচে আমি বরঞ্চ তোমার এই আধখানা দরজা বন্ধ করে দিই।
অমল
না, না, বন্ধ কোরো না—এখানে আমার আর সব বন্ধ কেবল এইটুকু খোলা। তুমি কে বল না—আমি ত তোমাকে চিনিনে।
বালিকা
আমি সুধা।
অমল
সুধা!
সুধা
জাননা, আমি এখানকার মালিনীর মেয়ে।
অমল
তুমি কি কর?
সুধা
সাজি ভরে ফুল তুলে নিয়ে এসে মালা গাঁথি। এখন ফুল তুলতে চলেছি।
অমল
ফুল তুলতে চলেছ? তাই তোমার পা দুটি অমন খুসি হয়ে উঠেছে—যতই চলেছ মল বাজচে ঝম্ ঝম্ ঝম্। আমি যদি তোমার সঙ্গে যেতে পারতুম তাহলে উচু ডালে যেখানে দেখা যায় না সেইখান থেকে আমি তোমাকে ফুল পেড়ে দিতুম|
সুধা
তাই বই কি! ফুলের খবর আমার চেয়ে তুমি না কি বেশি জান!
অমল
জানি, আমি খুব জানি। আমি সাত ভাই চম্পার খবর জানি! আমার মনে হয় আমাকে যদি সবাই ছেড়ে দেয় তাহলে আমি চলে যেতে পারি—খুব ঘন বনের মধ্যে যেখানে রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না। সরু ডালের সব আগায় যেখানে মনুয়া পাখী বসে বসে দোল খায় সেইখানে আমি চাঁপা হয়ে ফুটতে পারি। তুমি আমার পারুল দিদি হবে?
সুধা
কি বুদ্ধি তোমার! পারুল দিদি আমি কি করে হব! আমি যে সুধা—আমি শশি মালিনীর মেয়ে। আমাকে রোজ এত এত মালা গাঁথতে হয়। আমি যদি তোমার মত এইখানে বসে থাকতে পারতুম তাহলে কেমন মজা হত!
অমল
তাহলে সমস্ত দিন কি করতে?
সুধা
আমার বেনে বউ পুতুল আছে তার বিয়ে দিতুম। আমার পুসি মেনি আছে, তাকে নিয়ে—যাই বেলা বয়ে যাচ্চে দেরি হলে ফুল আর থাকবে না।
অমল
আমার সঙ্গে আর একটু গল্প কর না, আমার খুব ভাল লাগচে।
সুধা
আচ্ছ বেশ, তুমি দুষ্টমি করোনা, লক্ষ্মী ছেলে হয়ে এইখানে স্থির হয়ে বসে থাক, আমি ফুল তুলে ফেরবার পথে তোমার সঙ্গে গল্প করে যাব।
অমল
আর আমাকে একটি ফুল দিয়ে যাবে?
সুধা
ফুল অমনি কেমন করে দেব? দাম দিতে হবে যে।
অমল
আমি যখন বড় হব তখন তোমাকে দাম দেব। আমি কাজ খুঁজতে চলে যাব ঐ ঝরনা পার হয়ে, তখন তোমাকে দাম দিয়ে যাব।
সুধা
আচ্ছা বেশ।
অমল
তুমি তাহলে ফুল তুলে আসবে?
সুধা
আসব।
অমল
আসবে?
সুধা
আসব।
অমল
আমাকে ভুলে যাবে না? আমার নাম অমল। মনে থাকবে তোমার?
সুধা
না, ভুলব না। দেখো, মনে থাকবে।
(ছেলের দলের প্রবেশ)
অমল
ভাই তোমরা সব কোথায় যাচ্চ ভাই। একবার একটুখানি এইখানে দাঁড়াও না!
ছেলেরা
আমরা খেলতে চলেছি।
অমল
কী খেলবে তোমরা ভাই?
ছেলেরা
আমরা চাষ খেলা খেলব।
১ ম
(লাঠি দেখাইয়া) এই যে আমাদের লাঙল।
২ য়
আমরা দুজনে দুই গোরু হব।
অমল
সমস্ত দিন খেলবে?
ছেলেরা
হাঁ সমস্ত দি—ন।
অমল
তার পরে সন্ধ্যার সময় নদীর ধার দিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসবে?
ছেলেরা
অমল
আমার এই ঘরের সামনে দিয়েই ফিরো ভাই।
ছেলেরা
তুমি বেরিয়ে এস না খেলবে চল!
অমল
কবিরাজ আমাকে বেরিয়ে যেতে মানা করেছে।
ছেলেরা
কবিরাজ! কবিরাজের মানা তুমি শোন বুঝি। চল ভাই চল্ আমাদের দেরি হয়ে যাচ্চে।
অমল
না ভাই, তোমরা আমার এই জানলার সামনে রাস্তায় দাড়িয়ে একটু খেলা কর—আমি একটু দেখি।
ছেলেরা
এখেনে কী নিয়ে খেলব!
অমল
এই যে আমার সব খেলনা পড়ে রয়েছে—এ সব তোমরাই নাও ভাই—ঘরের ভিতরে একলা খেলতে ভাল লাগে না—এ সব ধূলোয় ছড়ানো পড়েই থাকে—এ আমার কোনো কাজে লাগেড় না।
ছেলেরা
অমল
না, কিছু কষ্ট হচ্চে না, সব তোমাদের দিলুম!
ছেলেরা
আর কিন্তু ফিরিয়ে দেব না।
অমল
না, ফিরিয়ে দিতে হবে না।
ছেলেরা
কেউত বকবে না।
অমল
কেউ না, কেউ না! কিন্তু রোজ সকালে তোমরা এই খেলনাগুলো নিয়ে আমার এই দরজার সামনে থানিকক্ষণ ধরে খেলো। আবার এগুলো যখন পুরোণো হয়ে যাবে আমি নতুন খেলনা আনিয়ে দেব।
ছেলেরা
বেশ ভাই আমরা রোজ এখানে খেলে যাব। ও ভাই সেপাইগুলোকে এখানে সব সাজা—আমরা লড়াই লড়াই খেলি। বন্দুক কোথায় পাই?—ঐ যে একটা মস্ত শরকাঠি পড়ে আছে— ঐটেকে ভেঙে ভেঙে নিয়ে আমরা বন্দুক বানাই। কিন্তু ভাই, তুমি যে ঘুমিয়ে পড়চ!
অমল
ছেলেরা
এখন যে সবে এক প্রহর বেলা—এখনি তোমার ঘুম পায় কন? ঐ শোন এক প্রহরের ঘণ্টা বাজচে।
অমল
হাঁ, ঐ যে বাজচে ঢং ঢং ঢং—আমাকে ঘুমতে যেতে ডাক্চে।
ছেলেরা
তবে আমরা এখন যাই আবার কাল সকালে আসব।
অমল
যাবার আগে তোমাদের একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করি ভাই। তোমারা ত বাইরে থাক তোমরা ঐ রাজার ডাকঘরের ডাকহরকরাদের চেন?
ছেলেরা
হাঁ চিনি বই কি, খুব চিনি।
অমল
কে তারা, নাম কি?
ছেলেরা
একজন আছে বাদল হরকরা, একজন আছে শরৎ,—আরো কত আছে।
অমল
আচ্ছা আমার নামে যদি চিঠি আসে তারা কি আমাকে চিনতে পারবে?
ছেলেরা
অমল
কাল সকালে যখন আসবে তাদের একজনকে ডেকে এনে কে চিনিয়ে দিয়ে না!
ছেলেরা
আচ্ছা দেব।