ডিটেক্টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/ডাক্তার বাবু বক্তা/দশম পরিচ্ছেদ
দশম পরিচ্ছেদ।
এই সময় জমীদার মহাশয় দেশে যাইবার উদ্যোগ করিতেছেন দেখিয়া অতিশয় চিন্তিত হইলাম। ভাবিলাম, আমাকেও তাঁহার সহিত যাইতে হইবে। কি প্রকারে গোলাপকে না দেখিয়া থাকিব? না গেলেও,গোলাপের খরচের সংস্থান করিতে পারিব না। ইত্যাকার নানাপ্রকার চিন্তা মনে উদয় হইল। সমস্ত কথা গোলাপকে বলিলাম। গোলাপ শুনিবামাত্র অতিশয় দুঃখ প্রকাশ করিল, কিন্তু পরিশেষে সেই আমার মত লওয়াইল। আমার অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও জিদ করিয়া জমীদার মহাশয়ের সহিত আমাকে পাঠাইয়া দিল। যে আমাকে একদণ্ড কাল না দেখিলে থাকিতে পারিত না বলিত, তবে সে কেন এরূপ জিদ করিয়া আমাকে পাঠাইয়া দিল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না;— বুঝিয়াছি কিন্তু পরে। পাঠক মহাশয়দিগের মধ্যে যদি কেহ এরূপ অবস্থায় কখনও পড়িয়া থাকেন, তবে তিনি বুঝিতে পারিবেন। যাহা হউক, পিতা মাতার মত লইয়া, স্ত্রীকে একবার জিজ্ঞাসা করিয়া, ভ্রাতাদ্বয়কে সম্ভাষণ করিয়া, অল্পদিন মধ্যেই বঙ্গদেশ যাত্রা করিলাম।
কিছু দিবসের মধ্যেই সেখানে সকলে আমাকে ভালবাসিতে ও বিশ্বাস করিতে লাগিল। পনর দিবস অতীত হইতে না হইতেই গোলাপকে দেখিবার নিমিত্ত আমার মন অতিশয় ব্যস্ত হইল; সুতরাং জমীদার মহাশয়ের নিকট হইতে পনর দিবসের বিদায় লইয়া কলিকাতায় আসিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলাম। সে সময় আমার নিকট একশত টাকার অধিক ছিল না, কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় আমার ভাগ্য প্রসন্ন হইল।
আমি কলিকাতায় গমন করিতেছি, জানিতে পারিয়া সেই সময় সেইস্থানের অন্য একটা বড় লোক আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি একটা ঘড়ী ও একছড়া সোণার চেন খরিদ করিয়া আনিবার নিমিত্ত আমাকে এক সহস্র টাকা প্রদান করিলেন। আমি সমস্ত টাকা লইয়া কলিকাতায় আসিলাম। তাহার মধ্য হইতে ২০০৲ টাকামাত্র আমার স্ত্রীকে দিলাম, সে অতিশয় সন্তুষ্ট হইল। অবশিষ্ট টাকা গোলাপের পাদপদ্মে অর্পণ করিলাম। পনর দিন অনবরত সুরাপান ও আমোদ-প্রমোদে কাটাইলাম। দেখিতে দেখিতে আরও পনর দিন অতীত হইয়া গেল, সুতরাং পুনরায় বঙ্গদেশে যাইতে হইল। চেন বা ঘড়ী কিছুই খরিদ করিলাম না; সে কথা আমার একবার মনেও হয় নাই। মনে থাকিলেই বা কি করিতাম? যাইবার সময় গোলাপের নিকট হইতে অনেক কষ্টে ২৫টী টাকা ঋণ করিয়া লইয়া গেলাম। কার্য্যস্থানে প্রত্যাবৃত্ত হইতে অতিরিক্ত বিলম্ব হইবার জন্য জমীদার মহাশয় প্রথমে আমার প্রতি কিছু অসন্তোষভাব প্রকাশ করিলেন সত্য; কিন্তু মিষ্ট কথায় তাঁহাকে সন্তুষ্ট করিলাম।
বড়লোক বাবুটী চেন ঘড়ীর কথা জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহাকে বলিলাম, “মহাশয়! উৎকৃষ্ট চেন ও ঘড়ী, যাহার মূল্য প্রায় ১৫০০৲ টাকা হইবেক, তাহা আমি কেবলমাত্র ১১০০ শত টাকায় খরিদ করিয়াছি; কিন্তু নানাপ্রকার সাংসারিক গোলযোগে বিলম্ব হওয়া প্রযুক্ত তাড়াতাড়ি আসিবার কালে উহা বাটীতে ভুলিয়া আসিয়াছি। পরে এখানে আসিয়া চেন ঘড়ী ডাকে পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত পত্র লিখিয়াছি, চারি পাঁচদিবসের মধ্যেই বোধ হয়, উহা পাইতে পারিবেন।” বাবু অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, সেই দিবসেই বক্রী ১০০৲ শত টাকা আমাকে পাঠাইয়া দিলেন। বলা বাহুল্য, যে, ঐ টাকা আমি সেই দিবসেই গোলাপের ২৫৲ টাকা ঋণের পরিবর্ত্তে পাঠাইয়া দিলাম।
আমি দুষ্কর্মের আরও একপদ উর্দ্ধে উত্থিত হইয়া যে কার্য্য করিলাম, তাহা শ্রবণ করিলে মনুষ্যমাত্রেরই ঘৃণার উদ্রেক হয়। সেই সময় যে বাবু আমাকে চেন ঘড়ী খরিদ করিতে দিয়াছিলেন, তাঁহার শরীর একটু অসুস্থ বোধ হওয়ায়, আমাকে ডাকাইয়া একটী ঔষধ দিতে বলিলেন। আমি ভাবিলাম, এখন আমি যে সুযোগ পাইয়াছি, তদনুসারে কার্য্য করিলে আর আমাকে ঐ ১১০০৲ শত টাকা দিতে হইবেক না। এই ভাবিয়া তাঁহাকে একটী ঔষধ দিলাম। বলিয়া দিলাম, “আপনাকে এই ঔষধ ভিন্ন অন্য কোন ঔষধ আর সেবন করিতে হইবেক না, এই ঔষধেই আপনার নিদ্রা আসিবে ও সমস্ত অসুখ দূর হইবেক।” এই বলিয়া রাত্রি ১০টার সময় চলিয়া আসিলাম। রাত্রি ১২টার সময় আমার ঔষধের ফল ফলিল; বাবুর হঠাৎ মৃত্যু হইল। ঐ টাকার বিষয় আর কেহই জানিত না, সুতরাং সে কথা আর কাহারও নিকট শুনিতে পাইলাম না। আমি অতিশয় কপট দুঃখ প্রকাশ করিয়া যাহাতে তাঁহার শীঘ্র সৎকার-কার্য্য সমাধা হয়, তাহার বন্দোবস্ত করিয়া দিলাম।
এই সময়ে আমার মনে অতিশয় অনুতাপ হইয়াছিল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, এরূপ দুষ্কর্ম্ম আর কখনও করিব না; কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা অনেকদিবস রাখিতে পারি নাই।
ইহার এক মাস পরেই বঙ্গদেশীয় জমীদার মহাশয় অতিশয় পীড়িত হইয়া কলিকাতায় আসিলেন; আমি তাঁহার সহিত আসিয়া তাঁহার চিকিৎসা করিতে লাগিলাম। কিন্তু তাহাতে পীড়ার কিছুমাত্র হ্রাস না হইয়া দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তখন আমি অন্য কোন উপায় না দেখিয়া জমীদার মহাশয়ের মত লইয়া এইস্থানের একজন প্রধান ইংরাজ ডাক্তারকে চিকিৎসার্থ নিযুক্ত করিলাম। তিনি চিকিৎসা করিতে লাগিলেন। আমি জমীদার মহাশয়ের নিকট হইতে নিত্য নিত্য ইংরাজ ডাক্তারকে দিবার নিমিত্ত দ্বিগুণ পরিমাণ টাকা লইতে লাগিলাম। কিন্তু বলা বাহুল্য যে, ডাক্তারকে ন্যায্য প্রাপ্য টাকা দেওয়া বাদে বক্রী আমার নিজ ব্যয়ে খরচ হইতে লাগিল। ক্রমে জমীদার মহাশয় সুস্থ হইতে লাগিলেন। তাঁহার পীড়া দিন দিন কমিতে লাগিল, কিন্তু একেবারে আরােগ্যলাভ করিলেন না।
সেই সময়ে তাঁহার জমীদারির মধ্যে অনেক দেওয়ানী মােকদ্দমা উপস্থিত হওয়ায় বিপক্ষগণ তাঁহাকে প্রত্যেক মােকদ্দমায় সাক্ষী-মান্য করিতে লাগিল। সেই অসুস্থ শরীরে তাঁহাকে পুনঃ পুনঃ মফঃস্বল যাইতে হওয়ায় তিনি পুনরায় অসুস্থ হইলেন।