ডিটেক্‌টিভ পুলিস (প্রথম কাণ্ড)/ডাক্তার বাবু বক্তা/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।

 এইরূপ চারি পাঁচ দিবস গত হইলে এক দিবস আমি লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর সাহেবের সেক্রেটরির নিজ-কথা-স্বরূপ একখানি পত্র লিখিলাম। ঐ পত্রের মর্ম্ম এই যে, ছোট লাট বাহাদুর জমীদার মহাশয়ের দরখাস্ত পাইয়াছেন, যে প্রকার আদেশ হয়, পরে জানিতে পারিবেন। এই পত্র, একখানি সরকারী খামের ভিতর বন্ধ করিয়া, তাহার উপর দুইটী পোষ্টাফিসের মোহর জাল করিলাম; এবং নিজহস্তে উহা লইয়া জমীদার মহাশয়ের বাটীতে গিয়া বলিলাম, “একজন ডাক পিয়ন এই পত্রখানি এখনই দিয়া গেল।” তিনি পত্রখানি খুলিলেন, ও পড়িয়া তাহার মর্ম্ম অবগত হইলেন। সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “এখন আমি জানিতে পারিলাম যে, ডাক্তার সাহেব আমার নিমিত্ত একান্তই পরিশ্রম করিতেছেন।” সেইদিবস অবশিষ্ট সহস্র মুদ্রা তাঁহার নিকট হইতে লইয়া ইচ্ছানুযায়ী খরচ করিয়া ফেলিলাম। কিন্তু পরদিবস জাল রসিদ আনিয়া দিতে ভুলিলাম না।

 ইতিমধ্যে আরও একখানি পত্র জাল করিলাম; এখানি মহামান্য ষ্টেট্ সেক্রেটরীর নাম-স্বাক্ষরিত। ইহাতে উল্লেখ রহিল, “আপনার বিষয় বিশেষরূপে বিবেচিত হইবে ও তাহার ফল পরে জানিতে পারিবেন।” পত্রখানি পূর্ব্বোক্ত উপায়ে জমীদার মহাশয়কে আনিয়া দিলাম; আমার উপর তাঁহার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হইল। এইরূপে পাঁচ সহস্র টাকা আত্মসাৎ করিয়া নিজ নিকৃষ্টবৃত্তি চরিতার্থ করিলাম সত্য; কিন্তু মনে মনে ভাবিলাম, এখন কোন উপায় অবলম্বন করিয়া, জমীদার মহাশয়কে বুঝাইব যে, তাঁহার মনোস্কামনা পূর্ণ হইয়াছে। যাহা হউক এইরূপে কিয়দ্দিবস গত হইল। জমীদার মহাশয় মধ্যে মধ্যে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, “কৈ ডাক্তার! এখন পর্য্যন্ত গবর্ণমেণ্ট হইতে আর কোন সংবাদ আসিল না, আর কত দিবস এরূপ কষ্টভোগ করিতে হইবে?” আমি বলিলাম, “মহাশয়! গবর্ণমেণ্টের কার্য্যের গতিকই এইরূপ, কোন কার্য্য সহজে ও শীঘ্র সম্পন্ন হয় না। যাহা হউক, আমি অদ্যই নিজে যাইয়া অনুসন্ধান লইব। সেই আফিসে আমার একজন বন্ধু কর্ম্ম করেন, তাঁহার নিকট সমস্ত সংবাদ পাইব।” এই বলিয়া সে দিবস চলিয়া আসিলাম।

 পরদিন পুনরায় জমীদার মহাশয়ের নিকট গমন করিলাম, ও তাঁহাকে বলিলাম, “মহাশয়! কল্য আমি আফিসে যাইয়া সমস্ত বিষয় জানিয়া আসিয়াছি। আপনাকে কখন আর কোন দেওয়ানী আদালতে উপস্থিত হইতে হইবেক না। তাহার আজ্ঞাপত্র লেখাপড়া শেষ হইয়াছে, কেবলমাত্র সেক্রেটরী সাহেবের স্বাক্ষর বাকি আছে। তাহাও বোধ হয় চারি পাঁচদিবসের মধ্যেই সম্পন্ন হইবে। আপনি সেস্থান হইতে আর কোন পত্রাদি পাইবেন না, কেবলমাত্র ঐ আজ্ঞাপত্র ডাকযোগে আপনার নিকট প্রেরিত হইবে।” জমীদার মহাশয় সেইদিবস আমার কথা শুনিয়া অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন এবং বলিলেন, “এখন বোধ হইতেছে যে, পাঁচ সাত দিবসের, মধ্যেই তোমার অনুগ্রহে আমি ঐ বিপদ হইতে রক্ষা পাইব।”

 সেইদিবস রাত্রিকালে শয়ন করিবার সময় মনে মনে একটু ভাবনা হইল। ভাবিলাম, এখন কোন্ উপায় অবলম্বন করি; অব্যবহিত পরে উপায় আসিয়া আমার চিন্তাপথে প্রবেশ করিল। এক টুক্‌রা কাগজ ও একটী পেন্সিল লইয়া তাহাতে ভাবিয়া ভাবিয়া এই মর্ম্মে ইংরাজীতেও একটী মুশাবিদা করিলাম যে, “লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর বাহাদুর তোমাকে অদ্য হইতে এই আজ্ঞাপত্র প্রদান করিতেছেন যে, তুমি যতদিবস পর্য্যন্ত জীবিত থাকিবে, ততদিবস পর্য্যন্ত তোমাকে কোন দেওয়ানী আদালতে উপস্থিত হইয়া সাক্ষ্য দিতে হইবেক না। যে মোকদ্দমায় তোমার সাক্ষা নিতান্ত আবশ্যক বলিয়া বিবেচিত হইবে, সে মোকদ্দমায় কমিশন দ্বারা তোমার সাক্ষ্য গৃহীত হইবে।”

 পরদিন বেলা ১০টার পর রাধাবাজার হইতে দুইখানা পার্চমেণ্ট কাগজ ক্রয় করিয়া লইয়া একটী নূতন এদেশীয় ছাপাখানায় যাইয়া উপস্থিত হইলাম। ছাপাখানার অধ্যক্ষকে বলিলাম, “গবর্ণমেণ্ট অফিসের নিমিত্ত কতকগুলি ফরম ছাপাইবার আবশ্যক হইয়াছে। যদি আপনি ভালরূপ কার্য্য করিতে পারেন, তাহা হইলে আপনাকে আমি অনেক কার্য্য আনিয়া দিতে পারি। আপাততঃ একট ফরম আনিয়াছি যদি বলেন, আপনাকে দিতে পারি।” ছাপাখানার অধ্যক্ষ অতিশয় আগ্রহের সহিত বলিলেন, “মহাশয়! আমি অতি অল্প মূল্যে ও অল্প সময়ের মধ্যে ভালরূপ কার্য্য করিয়া দিতে পারিব; কারণ আপনি বোধ হয় জানেন যে, এটী আমার নূতন ছাপাখানা, অদ্যাবধি কর্ম্মের অতিশয় ভার পড়ে নাই।” আমি বলিলাম, “তবে এইটী এখনই করিয়া দিন, আমি বসিতেছি।” এই বলিয়া আমি যে মুশাবিদাটী সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম, তাহা তাঁহাকে দিলাম। যেখানে যেখানে যে যে প্রকার ছোট বড় বা অন্যান্য প্রকার অক্ষর দিতে বলিলাম, তিনি নিজেই বাছিয়া বাছিয়া সেই প্রকার অক্ষর লইয়া আমার সম্মুখে বসাইতে লাগিলেন। প্রায় এক ঘণ্টার মধ্যে কার্য্য সম্পন্ন করিয়া একখানি কাগজে তাহার ছাপা উঠাইলেন এবং বলিলেন,“দেখুন মহাশয়! কি প্রকার হইয়াছে।” আমি দেখিলাম, ও ২।১ স্থানে কিছু কিছু পরিবর্ত্তন করিয়া, তাঁহাকে ফিরাইয়া বলিলাম, “ইহা পার্চমেণ্ট কাগজে ছাপাইতে হইবে, সুতরাং আমার নিকট হইতে এই পার্চমেণ্ট কাগজ লইয়া উহার উপরে ছাপাইয়া দিউন।” তিনি তাহাই করিলেন, দুইখানি কাগজেই ছাপা উঠাইয়া আমাকে দিলেন। তিনি আমার ভিতরের অভিসন্ধি কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। তাঁহার মনে এমন কোনও সন্দেহ হইল না যে, আমি তাহাকে প্রতারণা করিতেছি। সেই নির্ব্বোধ ছাপাখানাধ্যক্ষ ইহাও ভাবিলেন না যে, গবর্ণমেণ্টের নিজের বৃহৎ ছাপাখানা থাকিতে কেনই বা অন্য ছাপাখানায় এই কার্য্য হইতেছে। যাহা হউক,আমি সেই কাগজ লইয়া তাঁহাকে বলিয়া চলিয়া আসিলাম, “আফিসের সাহেবের অনুমতি লইয়া দুই একঘণ্টার মধ্যে আসিয়া, কত ছাপিতে হইবে বলিয়া যাইব। যে হিসাবে আপনি মূল্য পাইবেন, তাহাও স্থির করিয়া আসিব।” দুই ঘণ্টার মধ্যেই আমি ফিরিয়া আসিয়া তাঁহাকে বলিলাম, “মহাশয়! আমি অতিশয় দুঃখিত হইলাম যে, আমার ইচ্ছা পূর্ণ করিতে পারিলাম না। আপনার ছাপা অতিশয় সুন্দর হইয়াছে,ইহা দেখিয়া আমাদিগের অধ্যক্ষ সাহেব অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছেন। কিন্তু আমি আফিসে ফিরিয়া যাইবার অর্দ্ধঘণ্টা পূর্ব্বে অন্য এক ব্যক্তির সহিত কথাবার্ত্তা স্থির হইয়া গিয়াছে, তিনি তাঁহাকে ছাপাইবার অনুমতি দিয়াছেন। এই জন্য সাহেব মহোদয় আপনাকে দিতে পারিলেন না, বলিয়া অতিশয় দুঃখিত হইলেন। তবে আসিবার সময় আমাকে বলিয়া দিলেন, ভবিষ্যতে আর যে কার্য্য হইবে, তাহা আপনাকে দেওয়া যাইবে; আর আপনার পরিশ্রমের নিমিত্ত এই ৫টী টাকা প্রদান করিয়াছেন, গ্রহণ করুন, এবং যে অক্ষর প্রভৃতি সাজান রহিয়াছে ও যে সকল কাগজে প্রথমে ছাপা উঠাইয়াছিলেন, তাহা এখনই আমার সম্মুখে নষ্ট করুন। যখন আপনার এখানে কার্য্য হইল না, তখন এখানে ইহার চিহ্ণমাত্রও রাখা উচিত নহে।” আমার কথায় সেই মূর্খ ছাপাখানাধ্যক্ষ তাহাই করিলেন।

 আমি সেইস্থান হইতে চলিয়া আসিয়া ঐ ছাপান পার্চমেণ্ট কাগজের একখানি লইয়া, তাহাতে যাহা যাহা হস্তের লেখা থাকা উচিত, তাহা নিজহস্তে লিখিলাম। অতঃপর লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর সাহেবের সেক্রেটরীর সহি জাল করিয়া একখানি সরকারী খামের ভিতর উহা বন্ধ করিলাম। পরে তাহাতে পূর্ব্বমত ডাকের মোহর জাল করিয়া নিয়মিত সময় মধ্যে নিজেই লইয়া গিয়া জমীদার মহাশয়কে দিলাম এবং বলিলাম, “আমি মহাশয়ের বাটীর ভিতর প্রবেশ করিবার সময় দরজায় একজন ডাকপিয়ন আমার হস্তে এই পত্রখানি অর্পণ করিয়া চলিয়া গেল।” জমীদার মহাশয় আমার হস্ত হইতে উহা লইয়া খুলিলেন, পড়িয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন এবং আমাকে আশীর্ব্বাদ করিলেন। তখনই বাক্স হইতে আরও একখানি ৫০০৲ টাকার নোট বাহির করিয়া আমাকে পারিতোষিক প্রদান করিলেন। বলা বাহুল্য যে, ঐ টাকা সুরাপান প্রভৃতি দুষ্কর্ম্মে ব্যয় করিলাম।