তরুণের আহ্বান/আদর্শ সমাজের স্বপ্ন

আদর্শ সমাজের স্বপ্ন

পাঞ্জাবের ভ্রাতা ও ভগিনীগণ,

 পঞ্চনদের এই পুণ্য প্রদেশে আমার প্রথম আগমন উপলক্ষে আপনারা আমাকে যে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাইয়াছেন সেজন আমি আমার হৃদয়ের অন্তস্থল হইতে আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। আমি জানি আপনারা আমাকে যে সম্মান ও অভ্যর্থনা দান করিয়াছেন আমি তাহার উপযুক্ত নই। এখানে আমি যে সৌজন্য ও আতিথ্য লাভ করিয়াছি আমি যেন তাহার যোগ্য হইয়া উঠিতে পারি ইহাই আমার আজিকার কামনা।

 আপনারা আমাকে দূরে কলিকাতা হইতে এখানে আসিয়া আমার কথা বলিতে বলিয়াছেন। আজ আমি এখানে আপনাদের আহ্বানে সাড়া দিব বলিয়া আপনাদের সামনে দাঁড়াইয়াছি। কিন্তু এত লোকের মধ্যে আপনারা আমাকেই বা ডাকিয়াছেন কেন? ভারতবর্ষের সমস্যা সমাধানের জন্য পশ্চিম ভারত ও পূর্ব ভারতকে একত্রে মিলিত হইতে হইবে— এই বোধ হইতেই কি আপনারা আমাকে ডাক দিয়াছেন? বিদেশী শাসনের অধীন সর্বপ্রথম হইয়াছিল বাংলা, সর্বশেষ হইয়াছিল পাঞ্জাব। এই দুই প্রদেশের পারস্পরিক প্রয়োজন দেখা দিয়াছে বলিয়া কি আমার ডাক পড়িল? না কি, আপনারা এবং আমি একই ভাবনার শরিক, আমরা একই আশা-আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি— এই সমভাবের দরুনই কি আমাকে ডাকিয়াছেন?

 আর নিয়তির কী পরিহাস—যে আমি একদা ছাত্রাবস্থায় ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছিলাম—সেই আমাকেই লাহোরে ছাত্রসমাবেশে ভাষণ দিতে ডাকিয়া আনা হইয়াছে। প্রবীণেরা যদি বলেন যে বেয়াড়া সময় আসিয়াছে, এখন অদ্ভূত লোককে ও অভিনব ভাবধারাকে জগতের লোক সমাদর করিতেছে—তবে কি আপনারা তাহা অস্বীকার করিতে পারেন? আমার অতীত জীবনের কথা সব জানিয়া শুনিয়া যদি আপনারা আমাকে আমন্ত্রণ জানাইয়া থাকেন তবে তো আপনারা বুঝিয়াই লইয়াছেন যে আপনাদের কাছে আমি কী ধরনের কথা বলিব।

 বন্ধুগণ, আপনারা আমাকে ক্ষমা করিবেন যদি আরম্ভেই আমি পাঞ্জাব, বিশেষত পাঞ্জাবের যুবকদের প্রতি আমার অন্তরের উদ্বেল কৃতজ্ঞতা প্রকাশ্যে ঘোষণা করি। যতীন্দ্রনাথ দাস ও তাঁহার বাঙালী সহযাত্রীরা পাঞ্জাবের জেলে যখন অবস্থান করিতেছিলেন তখন তাঁহাদের জন্য আপনারা যাহা করিয়াছেন তাহার জন্যই আমার এই কৃতজ্ঞতা। তাঁহাদের পক্ষে মামলা চালাইবার ব্যবস্থা করা, যতদিন তাঁহারা অনশন ধর্মঘট চালাইয়াছিলেন ততদিন তাঁহাদের জন্য উদ্বেগ ও কাতরতা ভোগ করা, যতীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর যে সহানুভূতি, স্নেহ ও সম্মান আপনারা দেখাইয়াছেন তাহা বাঙালীর মর্মস্থলে আলোড়ন জাগাইয়াছে। লাহোরে বন্দী রক্ষা কমিটি যাহা করিয়াছেন তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া কমিটির সদস্যরা মহান শহীদের শবদেহ লইয়া কলিকাতা পর্যন্ত গিয়া আমাদের হাতে ঐ দেহ অর্পণ করিয়াছিলেন। আমরা আবেগপ্রবণ জাতি। আপনাদের হৃদয়ের বিশালতা দেখিয়া আমরা যে আপনাদের প্রতি কত দূর অনুরক্ত হইয়াছি তাহা বর্ণনা করিতে পারি না। বাংলার এক ঘন তমিস্রার দিনে পাঞ্জাব তাহার জন্য যাহা করিয়াছে বাংলা তাহা চিরদিন মনে রাখিবে।

 আপনাদের একজন বিশিষ্ট নেতা ডা. আলম একদিন কলিকাতায় যতীন্দ্রনাথের কথা বলিতে গিয়া আমাদের বলিয়াছিলেন যে সূর্য পূর্ব দিগন্তে উদিত হইয়া পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যায় এবং সূর্যাস্তের পর চন্দ্র পশ্চিম দিগন্তে উদিত হইয়া পূর্ব দিগন্তের দিকে অগ্রসর হয়। যতীনের জীবন ও মৃত্যুকে ইহার সঙ্গে তুলনা করা চলে। তিনি জীবিতকালে কলিকাতা হইতে লাহোর গিয়াছিলেন। মৃত্যুর পর কলিকাতায় তাঁহার মৃতদেহ আবার নীত হয়। মৃত মৃৎভাণ্ড রূপে নয়। পবিত্রতা, মহত্ত্ব ও দিব্যতার প্রতীকরূপেই তাঁহার দেহ কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়াছিল। যতীন আজ মৃত নয়। অনাগত কালের গতি-নির্দেশক রূপে আকাশপটে শুভ্র শুকতারা রূপে তিনি বিরাজ করিতেছেন। তিনি জীবিত আছেন তাঁহার অমর আত্মত্যাগ ও অনৈসর্গিক দুঃখবরণে। তিনি বাঁচিয়া আছেন স্বপ্ন রূপে, আদর্শ রূপে, মানবতার মধ্যে যাহা পবিত্রতম ও মহত্তম তাহার প্রতীক রূপে। আমি বিশ্বাস করি, তিনি তাঁহার আত্মাহুতির মধ্য দিয়া শুধু ভারতের আত্মাকে উদ্বোধিত করেন নাই—যে প্রদেশে তিনি জন্মিয়াছিলেন ও যে প্রদেশে তিনি মৃত্যু বরণ করিয়াছিলেন এই দুই প্রদেশকে তিনি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। আধুনিক যুগের এই দধীচির তপস্যাক্ষেত্র আপনাদের এই মহান নগরী; আমি তাই আপনাদের ঈর্ষা করি।

ক্রমে ক্রমে মুক্তির উষালগ্ন যত আসন্ন হইয়া উঠিতেছে আমাদের দুঃখ ও বেদনার পাত্র ততই ভরিয়া উঠিতেছে। আমাদের শাসকরা যত দেখিতেছেন যে ক্ষমতা তাঁহাদের হাত হইতে ক্রমেই চলিয়া যাইতেছে ততই তাঁহারা অন্যান্য স্থানের স্বৈরতন্ত্রীদের মতোই কঠোর হইতে কঠোরতর হইয়া উঠিতেছেন। ইহা খুবই স্বাভাবিক। যদি তাঁহারা ক্রমশ সভ্যতার সব ভণিতা পরিহার করেন, দ্বিধাহীনভাবে পীড়ন চালাইতে ভদ্রতার মুখোশ খলিয়া ফেলেন— তবে কেহ যেন বিস্মিত না হন। পাঞ্জাব ও বাংলা বর্তমান মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন ভোগ করিতেছে। প্রকৃতপক্ষে ইহা অভিনন্দনযোগ্য এই কারণে যে আমরা স্বরাজ লাভের জন্য এইভাবে নিজেদের যোগ্য করিয়া তুলিতেছি। ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্তের মতো বীরদের অনুপ্রেরণা দমননীতির সাহায্যে দাবাইয়া দেওয়া যাইবে না; বরং নিপীড়ন ও ক্লেশ, অপমান ও দুঃখবরণের ভিতর দিয়াই বীরচরিত্র গড়িয়া উঠিবে। তাই আসুন, আমরা সর্বান্তঃকরণে দমন-নিপীড়নকে স্বাগত জানাই। যখন উহা আসিবে তখন আমরা উহার পূর্ণে সদ্ব্যবহার করিব।

 আপনারা হয়তো জানেন না পাঞ্জাবের অতীত ইতিহাস হইতে কত কাহিনী লইয়া বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করা হইয়াছে। পাঠকদের এইভাবে মনোরঞ্জন করা হইয়াছে। আপনাদের বীরদের কাহিনী লইয়া কবিরা কবিতা রচনা করিয়াছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাহা করিয়াছেন। প্রত্যেক বাঙালীর গৃহে সেই-সব কবিতা আজ সুপরিচিত। আপনাদের সন্তদের বাণী ললিত বাংলায় অনূদিত হইয়াছে। বাংলার অগণিত মানুষ সেই-সব বাণীতে সান্ত্বনা ও প্রেরণা খুঁজিয়া পায়। এই সাংস্কৃতিক ভাব-বিনিময়ের অনুরূপ ঘটনা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ঘটিয়াছে। শুধু ভারতের জেলে নয়, সুদূর ব্রহ্মদেশের জেলে ও সমুদ্রপারে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বাংলার ও পাঞ্জাবের রাজনৈতিক তীর্থযাত্রীরা পরস্পর মিলিত হইয়াছেন।

 বন্ধুগণ, আজ এই আলোচনার সূত্রে আমি যদি কিঞ্চিৎ বিশদভাবে রাজনৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করিয়া উহার উত্তর দিবার চেষ্টা করি তবে সেজন্য আমি ক্ষমা চাহিব না। আমি জানি এদেশে এমন লোক আছেন, এমন-কি কিছু প্রসিদ্ধ ব্যক্তিও আছেন, যাঁহারা মনে করেন যে “পরাধীন জাতির কোনো রাজনীতি নাই” এবং ছাত্রদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমার নিজস্ব মত হইল পরাধীন জাতির রাজনীতি ভিন্ন আর কিছুই নাই। পরাধীন দেশে যে-কোনো সমস্যার কথাই আমরা ভাবি-না কেন, ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে যে সব সমস্যারই মূলে আছে রাজনৈতিক সমস্যা। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বলিতেন জীবন পূর্ণাঙ্গ এবং অর্থনীতি বা শিক্ষানীতি হইতে রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। খণ্ড খণ্ড ভাবে ভাগ করা যায় না। জাতীয় জীবনের সকল দিক ও পর্যায় পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত। ফলত পরাধীন জাতির সকল দোষ ও ত্রুটির মূল খুঁজিলে আমরা দেখিব যে রাজনৈতিক হেতুই সকলের মঁলে—আর সেই হেতু হইল রাজনৈতিক দাসত্বের হেতু। ফলে ছাত্ররা, কিভাবে আমাদের রাজনৈতিক মুক্তিলাভ হইবে—এই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের প্রতি অন্ধ থাকিতে পারে না।

গ্রন্থকীটের প্রয়োজন নাই

সাধারণভাবে জাতীয় কাজের উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নাই; তাহা হইলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকিবে কেন তাহা আমরা বুঝি না। যদি সকল প্রকার জাতীয় কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকে তবে তাহা আমি বুঝিতে পারি, কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা অর্থহীন। যদি পরাধীন দেশের সকল সমস্যাই মূলত রাজনৈতিক সমস্যা হইয়া থাকে তবে সকল জাতীয় কর্মই প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক চরিত্রসম্পন্ন। কোনো স্বাধীন দেশেই রাজনীতিতে অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা নাই, বরং রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করিতে ছাত্রদের উৎসাহ দেওয়া হইয়া থাকে। এই উৎসাহ ইচ্ছা করিয়াই দেওয়া হয় কেননা ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্য হইতেই রাজনৈতিক চিন্তানায়ক ও নেতা গড়িয়া উঠেন। যদি ভারতে ছাত্ররা রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ না করে তবে আমরা কোথা হইতে রাজনৈতিক কর্মী সংগ্রহ করিব, কোথায় তাহাদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিব? তা ছাড়া ইহাও স্বীকার করিতে হইবে যে চরিত্র ও মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনের জন্য ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করা আবশ্যক। কর্মরহিত চিন্তা চরিত্রগঠনের পক্ষে যথেষ্ট নয়, এবং এইজন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, শৈল্পিক ইত্যাদি স্বাস্থ্যপ্রদ কর্মে অংশ গ্রহণ চরিত্র গঠনের পক্ষে একান্ত আবশ্যক। গ্রন্থকীট, স্বর্ণপদকধারী ও অফিস-কেরানী উৎপাদন করাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচেষ্টা সীমাবদ্ধ থাকিতে পারে না। বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়াসী হইবে চরিত্রবান মানুষ সৃষ্টি করিতে যাহারা দেশের জন্য জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহত্ত্ব অর্জন করিবে।

 বর্তমান সময়ের অন্যতম আশার কথা এই যে সারা ভারতে একটি খাঁটি ছাত্র আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছে। আমি মনে করি ইহা বৃহত্তর যুব-আন্দোলনেরই একটি পর্যায়। গত দশকের ছাত্র-সম্মেলনগুলির সঙ্গে বর্তমানের ছাত্র-সম্মেলনগুলির অনেক পার্থক্য হইয়াছে। পূর্বেকার ছাত্রসম্মেলনগুলি অনুষ্ঠিত হইত সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়। ঐ সম্মেলনগুলির প্রবেশদ্বারে উৎকীর্ণ থাকিত—রাজনীতির কথা মুখে আনিয়ো না।

 এই সম্মেলনগুলির সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বের অধিবেশনগুলির তুলনা করা যাইতে পারে। ঐ-সব অধিবেশনে প্রথম যে প্রস্তাব গৃহীত হইত তাহা হইল সম্রাটের প্রতি আমাদের আনুগত্য জ্ঞাপক প্রস্তাব। সৌভাগ্যবশত শুধু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেই পর্বই নয়, ছাত্রসম্মেলনের অনুরূপ পর্বও আমরা পার হইয়া আসিয়াছি। আজিকার ছাত্রসম্মেলনগুলি অপেক্ষাকৃত মুক্ত পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় এবং সম্মেলনে যাঁহারা যোগ দেন তাঁহারা ভারতীয় দণ্ডবিধি কর্তৃক আরোপিত শর্ত সাপেক্ষে ইচ্ছামতো চিন্তা করিয়াও কথা বলিয়া থাকেন।

অসন্তোষের অনুভূতি

আজিকার যুব-আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হইল অসন্তোষের অনুভূতি, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি অসহিষ্ণুতা, নতুন ও উন্নততর ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য তীব্র আকুতি। দায়িত্ববোধ ও আত্মনির্ভরতার ভাব এই আন্দোলনকে পরিব্যাপ্ত করিয়া আছে। বর্তমান কালের তরুণেরা বয়োজ্যেষ্ঠদের হাতে সকল দায়িত্বভার তুলিয়া দিয়া তৃপ্ত থাকিতে পারে না। বরং তাহারা মনে করে দেশ ও দেশের ভবিষ্যতে প্রবীণদের যতটা অধিকার তাহার চেয়ে তাহাদেরই অধিকার বেশি। তাই দেশের পূর্ণতম দায়িত্ব গ্রহণ করা ও সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের জন্য নিজেদের যোগ্য করিয়া তোলা তাহাদের পরম কর্তব্য। ছাত্র-আন্দোলন বৃহত্তর যুব-আন্দোলনেরই একটি পর্যায় ও অংশ। তাই যুব-আন্দোলনের যে দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা ও উদ্দেশ্য তাহা দ্বারাই ছাত্র আন্দোলনও অনুপ্রাণিত।

 আজিকার ছাত্র আন্দোলন দায়িত্বহীন বালক-বালিকাদের আন্দোলন নয়, সবচেয়ে ফলপ্রদ উপায়ে দেশের সেবার জন্য নিজেদের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গড়িয়া তোলার আদর্শে উদ্বুদ্ধ, পূর্ণ তৎপর ও দায়িত্বশীল নরনারী এই আন্দোলনে যোগ দিয়াছে। এই আন্দোলন দুই প্রকার কর্মসূচী গ্রহণ করিয়াছে। কিংবা দুই প্রকার কর্মসূচী গ্রহণ করা ইহার কর্তব্য। প্রথমত, ছাত্রদের বর্তমান সমস্যার সমাধান করিতে হইবে ও তাহাদের দৈহিক, মানসিক ও নৈতিক পুনরুজ্জীবন ঘটাইতে হইবে। দ্বিতীয়ত, ছাত্ররাই ভবিষ্যৎ নাগরিক— এই কথা মনে রাখিয়া, যাহাতে তাহারা জীবন-সংগ্রামের যোগ্য হয় সেইরূপে তাহাদের গড়িয়া তুলিতে হইবে। জীবন রণাঙ্গনে প্রবেশ করিলে তাহারা যেসকল সমস্যার সম্মুখীন হইবে, যে-সকল কর্মে তাহাদের লিপ্ত হইতে হইবে, তাহার পূর্বাস্বাদ তাহাদের দিতে হইবে।

বিশেষ প্রয়োজন

ছাত্র-আন্দোলনের প্রথম যে দিকটির কথা আমি বলিয়াছি ক্ষমতাসীনরা সাধারণত তাহা বিরূপভাবে গ্রহণ করিবেন না বলিয়া মনে হয়। কিন্তু আন্দোলনের অপর যে দিকটির কথা আমি বলিয়াছি তাহা নিরুৎসাহিত ও নিন্দিত করা হইবে, কখনো কখনো তাহা পণ্ড করিয়াও দেওয়া হইবে। প্রথমে কী করা আপনাদের কর্তব্য সে সম্পর্কে বিশদ কর্মসূচী দিবার চেষ্টা করা আমার পক্ষে বাঞ্ছনীয় নয়, তাহার প্রয়োজনও নাই। তাহা নির্ভর করিবে অংশত আপনাদের বিশেষ প্রয়োজন ও চাহিদার উপর, অংশত শিক্ষা-বিষয়ক কর্তৃপক্ষ ঐ-সব প্রয়োজন ও চাহিদা মিটাইবার কী ব্যবস্থা করেন তাহার উপর।

 প্রত্যেক ছাত্রকেই সুঠাম স্বাস্থ্যোজ্জল দেহ, উন্নত চরিত্র, প্রয়োজনীয় তথ্য জ্ঞান ও সুস্থ গতিশীল ভাবধারায় পূর্ণ মস্তিষ্কের অধিকারী হইতে হইবে। কর্তৃপক্ষ যে ব্যবস্থা করিবেন তাহাতে যদি ছাত্রদের দৈহিক, চারিত্রিক ও মানসিক বিকাশ যথাযথভাবে না হয় তবে সেই বিকাশ সম্ভব করিয়া তোলার উপযুক্ত ব্যবস্থা আপনাদেরই করিতে হইবে। কর্তৃপক্ষ যদি আপনাদের সেই প্রয়াসকে স্বাগত জানান উত্তম; যদি স্বাগত না জানান তবে তাঁহাদের অপেক্ষায় না থাকিয়া আপনারা আগাইয়া যান। আপনাদের জীবন আপনাদেরই, উহার বিকাশ সাধনের দায়িত্বও আপনাদের। অপর কাহারো অপেক্ষা এ বিষয়ে আপনাদেরই উদ্যোগী হইতে হইবে।

 এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলি। উহার প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। শুধুমাত্র ছাত্রসমাজেরই হিতার্থে ছাত্র-অ্যাসোসিয়েশন নিজ নিজ এলাকায় সমবায়মূলক স্বদেশী বিপণি খুলিতে পারে। ছাত্ররা যদি এই-সব বিপণি ভালোভাবে চালায় তবে একসঙ্গে দুইটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। একদিকে ছাত্ররা সুলভে স্বদেশী পণ্য পাইবেন ও তাহার ফলে আমাদের দেশী শিল্পের উপকার হইবে। অপর পক্ষে, ছাত্ররা সমবায় সমিতি চালাইবার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিতে পারিবে এবং লব্ধ মুনাফা ছাত্র সমাজের কল্যানসাধনে ব্যয় করা যাইবে।

 ছাত্রদের কল্যাণসাধনের জন্য আপনাদের কর্মসূচীতে— শারীরচর্চা সমিতি, ব্যায়ামাগার, পাঠচক্র, বিতর্ক সভা, পত্রিকা, সংগীতচর্চা, লাইব্রেরি, ও রীডিং রুমে, সমাজ-সেবা লীগ ইত্যাদি বিষয়গুলিরও স্থান হইতে পারে।

আদর্শ সমাজের স্বপ্ন

ছাত্র-আন্দোলনের আর একটি দিক—এবং সেইটাই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দিক—হইল ভবিষ্যৎ নাগরিকরূপে গড়িয়া তোলার জন্য ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দান। এই প্রশিক্ষণ হইবে একই সঙ্গে বুদ্ধিগত বৌদ্ধিক ও বাস্তবধর্মী। ছাত্রদের সামনে আদর্শ সমাজের একটি স্বপ্ন রাখিতে হইবে। ছাত্রদের নিজ জীবনেই ঐ স্বপ্ন রূপায়িত করিতে হইবে। তাহাদের নিজেদেরই একটি কর্মসূচী নির্ণয় করিতে হইবে ও সাধ্যমতো সেই কর্মসূচী অনুসরণ করিতে হইবে। ছাত্ররূপে তাহাদের কর্তব্য পালনের সময় ছাত্র-পরবর্তী জীবনের জন্যও নিজেদের প্রস্তুত করিতে হইবে। কাজের এই ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষ দেখা দিবার সম্ভাবনা। কিন্তু সত্যই সংঘর্ষ দেখা দিবে কিনা তাহা অনেকাংশে নির্ভর করিবে শিক্ষা-পরিচালক কর্তৃপক্ষের মনোভাবের উপর। দুর্ভাগ্যবশত সংঘর্ষ যদি দেখা দেয়ই তবে করিবার কিছুই নাই এবং ছাত্রদের চিরতরে মনস্থির করিয়া ফেলিতে হইবে যে শিক্ষা-পরবর্তী উত্তর জীবনের জন্য চিন্তা ও কর্মের মাধ্যমে নিজেদের প্রস্তুত করিয়া তোলার বিষয়ে সম্পর্ক নিঃশঙ্ক ও আত্মনির্ভর তাহারা হইবে কি না।

 যে আদর্শ আমাদের সকলের গ্রহণযোগ্য সে আদর্শ কী তাহা বলিবার আগে আপনাদের অনুমতি লইয়া আর একটি বিষয়ে বলিব—যাহা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। বর্তমানে এমন কোনো এশিয়াবাসী নাই, ইউরোপের পদতলে শায়িত এশিয়াকে দেখিয়া যিনি ব্যথা ও অপমান অনুভব না করেন। কিন্তু এশিয়া যে চিরদিন এমন হতমান অবস্থায় ছিল এ-হেন ধারণা আপনারা চিরতরে পরিহার করুন। আজ ইউরোপ সভ্যতার শীর্ষদেশে রহিয়াছে— কিন্তু এমন দিন ছিল যখন এশিয়াই ছিল সভ্যতার চূড়ায়। ইতিহাস বলিতেছে অতীত যুগে এশিয়া ইউরোপের বিরাট অংশ দখল করিয়া লইয়াছিল, সে সময় এশিয়ার নামে ইউরোপ ছিল আতঙ্কগ্রস্ত। এখন অবস্থা পালটাইয়াছে। কিন্তু নিয়তিচক্র আবার ঘুরিতেছে। তাই নৈরাশ্যের কোনো কারণ নাই। বর্তমান মুহূর্তে এশিয়া দাসত্বের নিগড় ভাঙিবার কাজে নিযুক্ত হইয়াছে। সেদিন দূরে নাই যখন নবজাগ্রত এশিয়া অতীতের তমিস্রালোক হইতে শক্তি ও গৌরবে সমুদ্‌ভাসিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইবে, স্বাধীন জাতিসমূহের সভামধ্যে তাহার সংগত স্থান গ্রহণ করিবে।

 পশ্চিমী বাগ্‌বিশারদেরা অমর প্রাচীকে “পরিবর্তনহীন” বলিয়া দোষ দিতেছে:— একসময় যেমন তুরষ্ককে তাহারা বলিত ইউরোপের রুগ্‌ণলোক। কিন্তু তুরষ্ক সম্পর্কে আর এ কথা যেমন খাটে না, এশিয়া সম্পর্কেও ঐরকম সাধারণ মন্তব্য আর করা চলে না। জাপান হইতে তুরস্ক পর্যন্ত এবং সাইবেরিয়া হইতে সিংহল পর্যন্ত সমগ্র প্রাচী আলোড়িত হইতেছে। সর্বত্রই দেখা যাইতেছে পরিবর্তন, প্রগতি, প্রথা কর্তৃপক্ষ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সংঘাত। প্রাচী যতদিন পরিবর্তন কামনা না করে ততদিনই তাহার পরিবর্তন ঘটিবে না। কিন্তু সে যখন চলিষ্ণু হইবার সংকল্প করিবে তখন পাশ্চাত্য জাতিগুলির চেয়ে দ্রুততর গতিতে সে আাগাইয়া চলিবে। বর্তমানে এশিয়ায় তাহাই ঘটিতেছে।

 আমাদের মাঝে মাঝে প্রশ্ন করা হয়, এশিয়ায় বিশেষত ভারতবর্ষে আমরা যে কর্মচাঞ্চল্য ও উত্তেজনা দেখিতেছি তাহা কি প্রকৃত জীবনের লক্ষণ, নাকি বহিরাগত প্রেরণার প্রতিক্রিয়া মাত্র। মৃত জীবনকোষও বহিরাগত প্রেরণায় সাড়া দেয়। মৃত মাংসপেশীর সংকোচন-প্রসাবণের মতোই আমাদের আন্দোলনও উত্তেজনামাত্র কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া দরকার। আমার বিশ্বাস জীবনের লক্ষণ সৃষ্টিশীলতায়। এবং যখন আমরা দেখিতেছি বর্তমানকালের আন্দোলনগুলির মধ্যে মৌলিকতার ও সৃজনশীল প্রতিভার স্বাক্ষর বর্তমান, তখন আমরা নিশ্চিত হইতে পারি জাতি হিসাবে সত্যই আমরা বাঁচিয়া আছি জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে আমাদের নবজাগরণ যথার্থই আত্মার জাগরণ।

ভাবাবর্ত

বর্তমানে ভারতে আমরা ভাবধারার ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে বাস করিতেছি। চারিদিক হইতে বিচিত্র বিরুদ্ধ ও অন্তঃসলিলা স্রোত বহিয়া আসিতেছে। এক বিচিত্র মিলন-মিশ্রণ চলিতেছে। ভাবধারার যে বিভ্রান্তি উপস্থিত হইয়াছে তাহার মধ্যে বসিয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে ভালো ও মন্দ, ন্যায় ও অন্যায় স্থির করা সম্ভব নয়। আমরা যদি ইতিহাসের রায় অগ্রাহ্য না করি, স্যার ফ্ল্যাণ্ডার্স পেত্রির মতো চিন্তাবিদের সুবিবেচিত মত উপেক্ষা না করি, তবে আমাদের স্বীকার করিতে হইবে যে পুরাতন ও জীর্ণ সভ্যতাগুলিরও পুনরুজ্জীবন ঘটানো সম্ভব। আপনারা যদি আমার এই মত সমর্থন না করেন তবে সভ্যতার উত্থান ও পতনের পিছনে কোন নিয়ম বর্তমান তাহা আপনাদেরই অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে। এই নিয়ম আবিষ্কার করিতে পারিলে তবেই আমরা দেশবাসীকে বলিতে পারিব, দেখুন, আমাদের এই প্রাচীন দেশে নূতন, স্বাস্থ্যবান ও প্রগতিশীল জাতি সৃষ্টি করিতে হইলে আমাদের কী করিতে হইবে।

 যদি আমাদের ভাবজগতে আমরা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনিতে চাই তবে আমাদের সম্মুখে এমন অদর্শ স্থাপন করিতে হইবে যাহা আমাদের সমগ্র জীবনকে প্রাণচঞ্চল করিয়া তুলিবে। স্বাধীনতাই সেই আদর্শ। কিন্তু স্বাধীনতা কথাটির বিচিত্র অর্থ আছে, আমাদের দেশেও স্বাধীনতার ধারণা ক্রমবিবর্তিত হইয়াছে। স্বাধীনতা বলিতে আমি বুঝি সর্বাঙ্গীণ মুক্তি—ব্যক্তির মুক্তি ও সমাজের মুক্তি; পুরুষের মুক্তি ও নারীর মুক্তি; ধনীর মুক্তি ও দরিদ্রের মুক্তি; সকল ব্যক্তির মুক্তি ও সকল শ্রেণীর মুক্তি। স্বাধীনতা বলিতে শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা বুঝায় না। ধনের সম-বণ্টন, জাতিপ্রথা ও সামাজিক অন্যায়ের, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার অবসানও বুঝায়। কঠোর বাস্তবপরায়ণ পুরুষ ও নারীর কাছে এই আদর্শ হয়তো স্বপ্ন বলিয়া বিবেচিত হইবে— কিন্তু একমাত্র এই আদর্শই আত্মার ক্ষুধা মিটাইতে পারে।

 আমাদের জাতীয় জীবনের যত দিক আছে স্বাধীনতারও তত দিক আছে। এমন অনেকে আছেন যাঁহারা স্বাধীনতার কথা যখন বলেন তখন স্বাধীনতার একটি বিশেষ দিকের কথাই বলেন। স্বাধীনতা সম্পর্কে সংকীর্ণ ধারণা কাটাইয়া উঠিয়া উহার পূর্ণাঙ্গ ও সর্বাঙ্গীণ ধারণা গ্রহণ করিতে আমাদের কয়েক দশক সময় লাগিয়াছে। যদি সত্যই আমরা স্বাধীনতার পূজারী হই এবং কোনো স্বার্থসাধনের উদ্দেশ্যে নয়, স্বাধীনতার জনাই স্বাধীনতা ভালোবাসি, তাহা হইলে আমাদের এ কথা বুঝিবার সময় আসিয়াছে যে প্রকৃত স্বাধীনতা বলিতে সর্বপ্রকার বন্ধন হইতে মুক্তি বুঝায় এবং শুধু ব্যক্তির স্বাধীনতা নয়, সমগ্র সমাজের স্বাধীনতাও বুঝায়। ইহাই এ যুগের আদর্শ এবং যে স্বপ্ন আমার আত্মাকে অধিকার করিয়াছে তাহা হইল পূর্ণ, স্বাধীন ও মুক্ত ভারতের আদর্শ।

 স্বাধীনতা লাভের একমাত্র উপায় হইল স্বাধীন মানুষরূপে নিজেদের গণনা করা, অনুভব করা। আমাদের অন্তরে পূর্ণ বিপ্লব ঘটা চাই। মুক্তির মদে আমাদের মাতাল হইতে হইবে। মুক্তির মদে মাতাল নরনারীই মানবতার মুক্তি সাধন করিতে পারিবে। যখন “মুক্ত হইবার ইচ্ছা” আমাদের মধ্যে জাগিয়া উঠিবে তখনই আমরা কর্মসাগরে ঝাঁপ দিব। সাবধানী বাণী আর আমাদিগকে আটকাইয়া রাখিতে পারিবে না। সত্য ও গৌরবের আহ্বান প্রিয় লক্ষ্যের অভিমুখে আমাদের লইয়া চলিবে।

 বন্ধুগণ, আমার জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে আমি যাহা ভাবি, অনুভব করি, স্বপ্ন দেখি, আমার সকল কর্মের পিছনে যে উদ্দেশ্য ও প্রেরণা বর্তমান, তাহা আমি আপনাদের কাছে বুঝাইয়া বলিবার চেষ্টা করিয়াছি। জানি না ইহা আপনাদের ভালো লাগিল কিনা। কিন্তু একটি বিষয় আমার নিকট খুব স্পষ্ট— জীবনের একটিই উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য আছে— তাহা হইল সর্বপ্রকার বন্ধন হইতে মুক্তি। এই মুক্তির ক্ষুধাই হইল আত্মার সঙ্গীত। নবজাতকের প্রথম ক্রন্দনধ্বনি, যে বন্ধনের মধ্যে সে আসিয়া পড়িল উহার বিরুদ্ধে তাহার বিদ্রোহ ঘোষণা। আপনারা আপনাদের নিজেদের মধ্যে ও আপনাদের স্বদেশবাসীর মধ্যে মুক্তির এই তীব্র ইচ্ছা জাগাইয়া তুলন—আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, ভারত তাহা হইলে অচিরে স্বাধীন হইবে।

 ভারত স্বাধীন হইবেই— সে বিষয়ে তিলমাত্র সংশয় নাই। নিশাবসানে যেমন দিবসের আবির্ভাব অনিবার্য ইহাও তেমনি অনিবার্য। পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নাই যাহা ভারতকে আর বেশিদিন পরাধীন করিয়া রাখিতে পারে। কিন্তু আসুন, আমরা এমন এক ভারতের স্বপ্ন দেখি যাহার জন্য আমরা আমাদের সর্বস্ব— এমন-কি জীবনও—দান করিতে পারি। যাহার জন্য আমাদের প্রিয়জনদেরও ডালি দিতে হইতে পারে। স্বাধীনতা সম্পর্কে আমার কী ধারণা তাহা আমি আপনাদের বলিয়াছি এবং কোন ভারতবর্ষ আমি গড়িয়া তুলিতে চাই তাহাও আমি আপনাদের বলিয়াছি। পূর্ণ মুক্ত ভারত বিশ্ববাসীর কাছে মুক্তির নববাণী প্রচার করুক।

 আমাকে হয়তো উগ্র জাতীয়তাবাদী বলা হইবে, তবু আমি বলিব যে ভারতের একটি মিশন আছে যাহা তাকে উদ্‌যাপন করিতে হইবে, ঐ মিশনের জন্যই ভারত বাঁচিয়া আছে। এই ‘মিশন’ কথাটির মধ্যে কোনো রহস্য নাই। মানবজীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে বিশ্বের সংস্কৃতি ও সভ্যতায়, ভারতকে কিছু মৌলিক অবদান রাখিতে হইবে। তাহার বর্তমান অবনতি ও দাসত্বের মধ্যেও সে যে অবদান রাখিতেছে তাহাও তো কম নয়। একবার ভাবিয়া দেখুন আপন পথে ও আপন প্রয়োজনানুসারে বিকাশলাভের স্বাধীনতা যখন সে ফিরিয়া পাইবে তখন তাহার অবদান কত মহৎ হইবে।

 এ দেশে এমন লোক আছেন—তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই প্রসিদ্ধ ও সম্মানী ব্যক্তি—মুক্তির আদর্শের সর্বাঙ্গীণ প্রয়োগে তাঁহারা সম্মতি দিবেন না। তাঁহাদের খুশি করিতে না পারিলে আমরা দুঃখিত হইব; কিন্তু কোনো পরিস্থিতিতেই আমরা সত্য, ন্যায় ও সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আদর্শ পরিত্যাগ করিব না। অন্যেরা আমাদের সঙ্গে যোগ দিক বা না দিক আমরা আমাদের পথে চলিবই। আপনারা নিশ্চিন্ত হোন, যদি মুষ্টিমেয় কিছু লোক আমাদের পরিত্যাগও করে তবু হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক আমাদের মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিবে। বলুন, অন্যায় ও অসাম্যের সঙ্গে আমরা কোনোরকম আপস করিব না।

 বন্ধুগণ, এখন সময় আসিয়াছে মুক্তিপ্রেমিক সকলের এক সুখী ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ হইয়া মুক্তি বাহিনী গড়িয়া তোলার।

 এই বাহিনী শুধু মুক্তিযুদ্ধে শামিল হইবার যোদ্ধৃদল পাঠাইবে না: মুক্তির নূতন আদর্শ প্রচারের জন্য প্রচারকও পাঠাইবে। আপনাদের মধ্য হইতেই এই প্রচারক ও যোদ্ধার দল গড়িয়া তুলিতে হইবে। আমাদের কর্মসূচীতে একদিকে ব্যাপক ও নিবিড় প্রচারের ব্যবস্থা থাকিবে, আর-এক দিকে দেশব্যাপী স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন গড়িয়া তোলা হইবে। আমাদের প্রচারকরা কৃষকদের মধ্যে ও কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে যাইবে ও তাহাদের কাছে মুক্তির নূতন বাণী প্রচার করিবে। তাহারা তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করিবে ও সারা দেশে যুবলীগ সংগঠিত করিবে। দেশের সমগ্র নারীশক্তিকে তাহাদের জাগাইয়া তুলিতে হইবে, কেননা সমাজে ও রাষ্ট্রে পুরুষের সমান সহযোগিণী রূপে স্থান লইবার জন্য এখন তাহাদের আগাইয়া আসিতে হইবে।

 বন্ধুগণ, আপনারা অনেকেই নিশ্চয়ই এখন ভারতীয় কংগ্রেসে যোগ দিবার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করিতেছেন। আপনাদের দেশে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসই নিঃসন্দেহে বৃহত্তম জাতীয় সংগঠন। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শক্তি, প্রভাব ও ক্ষমতা নির্ভর করে শ্রমিক আন্দোলন, যুব-আন্দোলন, কৃষক-আন্দোলন, নারী-আন্দোলন, ছাত্র-আন্দোলন ইত্যাদির উপর। যদি আমরা আমাদের শ্রমিক, কৃষক, অনুন্নত শ্রেণী, যুবগোষ্ঠী ছাত্রসমাজ ও নারী জাতিকে যুক্ত করিতে পারি তাহা হইলে আমরা এমন শক্তি জাগ্রত করিতে পারিব যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আমাদের স্বাধীনতা আনিয়া দিতে সক্ষম হইবে। অতএব, যদি আপনারা সকলে ফলপ্রদ উপায়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেবা করিতে চান, তবে আমি যে সংশ্লিষ্ট আন্দোলনগুলির কথা এইমাত্র বলিলাম সেগুলিকে আপনারা একসঙ্গে জোরদার করুন।

 চীন আমাদের পাশের দেশ। তাই সাম্প্রতিক চীনা ইতিহাস হইতে আমরা পাঠ নিব। চীনের ছাত্ররা তাহাদের মাতৃভূমির জন্য কী করিয়াছে তাহা লক্ষা করুন। আমরাও কি ভারতের জন্য ঐরূপ করিতে পারি না? আধুনিক চীনের নবজাগৃতি আনিয়াছে চীনের ছাত্রছাত্রীগণ। তাহারা একদিকে গ্রামে গ্লামে, শহরে শহরে, কলকারখানায় গিয়া নূতন মুক্তির বাণী প্রচার করিয়াছে, আর একদিকে এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সারা চীনকে সংগঠিত করিয়াছে। ভারতেরও আমাদের তাহাই করিতে হইবে। মুক্তি লাভের কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নাই। মুক্তির পথ নিঃসন্দেহেই কণ্টকাকীর্ণ, কিন্তু উহাই গৌরব ও অমরত্ব লাভেরও পথ। আসুন, আমরা অতীতের বন্ধন চূর্ণ করি, যুগ যুগ ধরিয়া যে-সকল বাধা আমাদের বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে সেগুলিকে ধ্বংস করি এবং যথার্থ তীর্থযাত্রীর মতো কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া মুক্তির লক্ষ্য অভিমূখে আগাইয়া চলি। স্বাধীনতাই জীবন, স্বাধীনতার জন্য মৃত্যু বরণ করিলে শাশ্বত গৌরব অর্জন করা যাইবে। সেজন্য আসুন আমরা স্বাধীন হইবার সংকল্প লই, স্বাধীনতা লাভের জন্য মৃত্যু বরণ করিতে প্রস্তুত হই। আমরা আমাদের আচরণ ও চরিত্রের দ্বারা এ কথা যেন প্রমাণ করিতে পারি যে আমরা মহান শহীদ যতীন্দ্রনাথ দাসের স্বদেশবাসী হইবার যোগ্য। বন্দেমাতরম্।

 অক্টোবর ১৯২৯