ল্যাবরেটরি


নন্দকিশোর ছিলেন লণ্ডন য়ুনিভার্সিটি থেকে পাস করা এঞ্জিনিয়র। যাকে সাধুভাষায় বলা যেতে পারে দেদীপ্যমান ছাত্র অর্থাৎ ব্রিলিয়াণ্ট, তিনি ছিলেন তাই। স্কুল থেকে আরম্ভ করে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার তোরণে তোরণে ছিলেন পয়লা শ্রেণীর সওয়ারী।

 ওঁর বুদ্ধি ছিল ফলাও, ওঁর প্রয়োজন ছিল দরাজ, কিন্তু ওঁর অর্থসম্বল ছিল আঁঁটমাপের।

 রেলোয়ে কোম্পানির দুটো বড়ো ব্রিজ তৈরি করার কাজের মধ্যে উনি ঢুকে পড়তে পেরেছিলেন। ও কাজের আয়ব্যয়ের বাড়তিপড়তি বিস্তর, কিন্তু দৃষ্টান্তটা সাধু নয়। এই ব্যাপারে যখন তিনি ডান হাত বাঁ হাত দুই হাতই জোরের সঙ্গে চালনা করেছিলেন তখন তাঁর মন খুঁতখুঁত করে নি। এসব কাজের দেনাপাওনা নাকি কোম্পানি নামক একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট সত্তার সঙ্গে জড়িত, সেইজন্যে কোনো ব্যক্তিগত লাভলোকসানের তহবিলে এর পীড়া পৌঁছয় না।

 ওঁর নিজের কাজে কর্তারা ওঁকে জিনিয়স বলত, নিখুঁত হিসাবের মাথা ছিল তাঁর। বাঙালি বলেই তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক তাঁর জোটে নি। নীচের দরের বিলিতি কর্মচারী প্যাণ্টের দুই ভরা পকেটে হাত গুঁজে যখন পা ফাঁক করে ‘হ্যালো মিস্টার মল্লিক’ বলে ওঁর পিঠথাবড়া দিয়ে কর্তাত্বি করত তখন ওঁর ভালো লাগত না। বিশেষত যখন কাজের বেলা ছিলেন উনি, আর দামের বেলা আর নামের বেলা ওরা। এর ফল হয়েছিল এই যে নিজের ন্যায্য প্রাপ্য টাকার একটা প্রাইভেট হিসেব ওঁর মনের মধ্যে ছিল, সেটা পুষিয়ে নেবার ফন্দি জানতেন ভাল করেই।

 পাওনা এবং অপাওনার টাকা নিয়ে নন্দকিশোর কোনোদিন বাবুগিরি করেন নি। থাকতেন শিকদারপাড়া গলির একটা দেড়তলা বাড়িতে। কারখানা ঘরের দাগ-দেওয়া কাপড় বদলাবার ওঁর সময় ছিল না। কেউ ঠাট্টা করলে বলতেন, ‘মজুর মহারাজের তকমা-পরা আমার এই সাজ।’

 কিন্তু বৈজ্ঞানিক সংগ্রহ ও পরীক্ষার জন্যে বিশেষ করে তিনি বাড়ি বানিয়ে ছিলেন খুব মস্ত। এমন মশগুল ছিলেন নিজের শখ নিয়ে যে, কানে উঠত না লোকেরা বলাবলি করছে, এত বড়ো ইমারতটা যে আকাশ ফুঁড়ে উঠল— আলাদিনের প্রদীপটা ছিল কোথায়।

 একরকমের শখ মানুষকে পেয়ে বসে সেটা মাতলামির মতো, হুঁশ থাকে না যে লোকে সন্দেহ করছে। লোকটা ছিল সৃষ্টিছাড়া, ওঁর ছিল বিজ্ঞানের পাগলামি। ক্যাটালগের তালিকা ওলটাতে ওলটাতে ওঁর সমস্ত মনপ্রাণ চৌকির দুই হাতা আঁকড়ে ধরে উঠত ঝেঁকে ঝেঁকে। জর্মনি থেকে আমেরিকা থেকে এমন-সব দামী দামী যন্ত্র আনাতেন যা ভারতবর্ষের বড়ো বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়ে মেলে না। এই বিদ্যালোভীর মনে সেই তো ছিল বেদনা। এই পোড়া দেশে জ্ঞানের ভোজের উচ্ছিষ্ট নিয়ে সস্তা দরের পাত পাড়া হয়। ওদের দেশে বড়ো বড়ো যন্ত্র ব্যবহারের যে সুযোগ আছে আমাদের দেশে না থাকাতেই ছেলেরা টেক্সট্‌ বুকের শুকনো পাতা থেকে কেবল এ এঁটোকাঁটা হাতড়িয়ে বেড়ায়। উনি হেঁকে উঠে বলতেন, ক্ষমতা আছে আমাদের মগজে, অক্ষমতা আমাদের পকেটে। ছেলেদের জন্যে বিজ্ঞানের বড়ো রাস্তাটা খুলে দিতে হবে বেশ চওড়া করে, এই হল ওঁর পণ।

 দুর্মূল্য যন্ত্র যত সংগ্রহ হতে লাগল, ওঁর সহকর্মীদের ধর্মবোধ ততই অসহ্য হয়ে উঠল। এই সময়ে ওঁকে বিপদের মুখ থেকে বাঁচালেন বড়োসাহেব। নন্দকিশোরের দক্ষতার উপর তাঁর প্রচুর শ্রদ্ধা ছিল। তা ছাড়া রেলোয়ে কাজে মোটা মোটা মুঠোর অপসারণদক্ষতার দৃষ্টান্ত তাঁর জানা ছিল।

 চাকরি ছাড়তে হল। সাহেবের আনুকূল্যে রেল কোম্পানির পুরনো লোহালক্কড় সস্তা দামে কিনে নিয়ে কারখানা ফেঁদে বসলেন। তখন যুরোপের প্রথম যুদ্ধের বাজার সরগরম। লোকটা অসামান্য কৌশলী, সেই বাজারে নতুন নতুন খালে নালায় তাঁর মুনফার টাকায় বান ডেকে এল।

 এমন সময় আর-একটা শখ পেয়ে বসল ওঁকে।

 এক সময়ে নন্দকিশোর পাঞ্জাবে ছিলেন তাঁর ব্যাবসার তাগিদে। সেখানে জুটে গেল তাঁর এক সঙ্গিনী। সকালে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন, বিশ বছরের মেয়েটি ঘাগরা তুলিয়ে অসংকোচে তাঁর কাছে এসে উপস্থিত— জ্বলজ্বলে তার চোখ, ঠোঁটে একটি হাসি আছে— যেন শান-দেওয়া ছুরির মতো। সে ওঁর পায়ের কাছে ঘেঁষে এসে বললে, “বাবুজি, আমি কয়দিন ধরে এখানে এসে দুবেলা তোমাকে দেখছি। আমার তাজ্জব লেগে গেছে।”

 নন্দকিশোর হেসে বললেন, “কেন, এখানে তোমাদের চিড়িয়াখানা নেই নাকি।”

 সে বললে, “চিড়িয়াখানার কোনো দরকার নেই। যাদের ভিতরে রাখবার, তারা বাইরে সব ছাড়া আছে। আমি তাই মানুষ খুঁজছি।”

 “খুঁজে পেলে!”

 নন্দকিশোরকে দেখিয়ে বললে, “এই তো পেয়েছি।”

 নন্দকিশোর হেসে বললেন, “কী গুণ দেখলে বলে দেখি।”

 ও বললে, “এখানকার বড়ো বড়ো সব শেঠজি, গলায় মোট সোনার চেন, হাতে হীরার আংটি, তোমাকে ঘিরে এসেছিল— ভেবেছিল বিদেশী, বাঙালি, কারবার বোঝে না। শিকার জুটেছে ভালো। কিন্তু দেখলুম তাদের একজনেরও ফন্দি খাটল না। উলটে ওরা তোমারই ফাঁসকলে পড়েছে। কিন্তু তা ওরা এখনো বোঝে নি— আমি বুঝে নিয়েছি।”

 নন্দকিশোর চমকে গেল কথা শুনে। বুঝলে, একটি চিজ বটে— সহজ নয়।

 মেয়েটি বললে, “আমার কথা তোমাকে বলি— তুমি শুনে রাখো। আমাদের পাড়ায় একজন ডাকসাইটে জ্যোতিষী আছে। সে আমার কুষ্টি গণনা করে বলেছিল, একদিন দুনিয়ায় আমার নাম জাহির হবে বলেছিল আমার জন্মস্থানে শয়তানের দৃষ্টি আছে।”

 নন্দকিশোর বললে, “বলো কী। শয়তানের?”

 মেয়েটি বললে, “জানো তো বাবুজি— জগতে সবচেয়ে বড়ো নাম হচ্ছে ঐ শয়তানের। তাকে যে নিন্দে করে করুক, কিন্তু সে খুব খাঁটি। আমাদের বাবা বোম্-ভোলানাথ ভোঁ হয়ে থাকেন। তাঁর কর্ম নয় সংসার চালানো। দেখো-না, সরকার বাহাদুর শয়তানির জোরে দুনিয়া জিতে নিয়েছে, খৃস্টানির জোরে নয়। কিন্তু ওরা খাঁটি, তাই রাজ্য রক্ষা করতে পেরেছে। যেদিন কথার খেলাপ করবে, সেদিন ঐ শয়তানেরই কাছে কানমলা খেয়ে মরবে।”

 নন্দকিশোর আশ্চর্য হয়ে গেল।

 মেয়েটি বললে, “বাবু, রাগ কোরো না। তোমার মধ্যে ঐ শয়তানের মন্তর আছে। তাই তোমারই হবে জিত। অনেক পুরুষকেই আমি ভুলিয়েছি, কিন্তু আমার উপরেও টেক্কা দিতে পারে এমন পুরুষ আজ দেখলুম। আমাকে তুমি ছেড়ে না বাবু—তা হলে তুমি ঠকবে।”

 নন্দকিশোর হেসে বললে, “কী করতে হবে।”

 “দেনার দায়ে আমার আইমার বাড়িঘর বিক্রি হয়ে যাচ্ছে— তোমাকে সেই দেনা শোধ করে দিতে হবে।”

 “কত টাকা দেনা তোমার।”

 “সাত হাজার টাকা।”

 নন্দকিশোরের চমক লাগল— ওর দাবির সাহস দেখে। বললে, “আচ্ছা আমি দিয়ে দেব, কিন্তু তার পরে?”

 “তার পরে আমি তোমার সঙ্গ কখনো ছাড়ব না।”

 “কী করবে তুমি।”

 “দেখব— যেন কেউ তোমায় ঠকাতে না পারে আমি ছাড়া।”

 নন্দকিশোর হেসে বললেন, “আচ্ছা বেশ— রইল কথা— এই পরো আমার আংটি।”

 কষ্টিপাথর আছে ওঁর মনে, তার উপরে দাগ পড়ল একটা দামী ধাতুর। দেখতে পেলেন মেয়েটির ভিতর থেকে ঝক্‌ ঝক্‌ করছে ক্যারেকটরের তেজ— বোঝা গেল ও নিজের দাম নিজে জানে, তাতে একটুমাত্র সংশয় নেই। নন্দকিশোর অনায়াসে বললে ‘দেব টাকা’— দিলে সাত হাজার বুড়ি আইমাকে।

 মেয়েটিকে ডাকত সবাই সোহিনী বলে। পশ্চিমী ছাঁদের সুকঠোর এবং সুন্দর তার চেহারা। কিন্তু চেহারায় মন টলাবে, নন্দকিশোর সে জাতের লোক ছিলেন না। যৌবনের হাটে মন নিয়ে জুয়ো খেলবার সময়ই ছিল না তাঁর।

 নন্দকিশোর ওকে যে-দশা থেকে নিয়ে এসেছিলেন সেটা খুব নির্মল নয়, এবং নিভৃত নয়। কিন্তু ঐ একরোখা একগুঁয়ে মানুষ সাংসারিক প্রয়োজন বা প্রথাগত বিচারকে গ্রাহ্য করতেন না। বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করত, বিয়ে করেছ কি। উত্তরে শুনত, বিয়েটা খুব বেশি মাত্রায় নয়, সহ্যমত। লোকে হাসত যখন দেখত উনি স্ত্রীকে নিজের বিদ্যের ছাঁচে গড়ে তুলতে উঠে পড়ে লেগে গিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করত, “ও কি প্রোফেসারি করতে যাবে নাকি।” নন্দ বলতেন, “না, ওকে নন্দকিশোরি করতে হবে, সেটা যে-সে মেয়ের কাজ নয়।” বলত, “আমি অসবর্ণ-বিবাহ পছন্দ করি নে।”

 “সে কী হে।”

 “স্বামী হবে এঞ্জিনিয়র আর স্ত্রী হবে কোটনা-কুটনী, এটা মানবধর্মশাস্ত্রে নিষিদ্ধ। ঘরে ঘরে দেখতে পাই তুই আলাদা আলাদা জাতে গাঁটছড়া বাঁধা, আমি জাত মিলিয়ে নিচ্ছি। পতিব্রতা স্ত্রী চাও যদি, আগে ব্রতের মিল করাও।”

নন্দকিশোর মারা গেলেন প্রৌঢ় বয়সে কোন্‌-এক দুঃসাহসিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার অপঘাতে।

 সোহিনী সমস্ত কারবার বন্ধ করে দিলে। বিধবা মেয়েদের ঠকিয়ে খাবার ব্যাবসাদার এসে পড়ল চার দিক থেকে। মামলার ফাঁদ ফাঁদলে আত্মীয়তার ছিটেফোঁটা আছে যাদের। সোহিনী স্বয়ং সমস্ত আইনের প্যাঁচ নিতে লাগল বুঝে। তার উপরে নারীর মোহজাল বিস্তার করে দিলে স্থান বুঝে উকিলপাড়ায়। সেটাতে তার অসংকোচ নৈপুণ্য ছিল, সংস্কার মানার কোনো বালাই ছিল না। মামলায় জিতে নিলে একে একে, দূর সম্পর্কের দেওর গেল জেলে দলিল জাল করার অপরাধে।

 ওদের একটি মেয়ে আছে, তার নামকরণ হয়েছিল নীলিমা। মেয়ে স্বয়ং সেটিকে বদল করে নিয়েছে— নীলা। কেউ না মনে করে, বাপ-মা মেয়ের কালো রঙ দেখে একটা মোলায়েম নামের তলায় সেই নিন্দেটি চাপা দিয়েছে। মেয়েটি একেবারে ফুটফুটে গৌরবর্ণ। মা বলত, ওদের পূর্বপুরুষ কাশ্মীর থেকে এসেছিল, মেয়ের দেহে ফুটেছে কাশ্মীরী শ্বেতপদ্মের আভা, চোখেতে নীলপদ্মের আভাস, আর চুলে চমক দেয় যাকে বলে পিঙ্গলবর্ণ।

 মেয়ের বিয়ের প্রসঙ্গে কুলশীল জাতগুষ্টির কথা বিচার করবার রাস্তা ছিল না। একমাত্র ছিল মন ভোলাবার পথ, শাস্ত্রকে ডিঙিয়ে গেল তার ভেলকি। অল্পবয়সের মাড়োয়ারি ছেলে, তার টাকা পৈতৃক, শিক্ষা একালের। অকস্মাৎ সে পড়ল এসে অনঙ্গের অলক্ষ্য ফাঁদে। নীলা একদিন গাড়ির অপেক্ষায় ইস্কুলের দরজার কাছে ছিল দাঁড়িয়ে। সেই সময় ছেলেটি দৈবাৎ তাকে দেখেছিল। তার পর থেকে আরো কিছুদিন ঐ রাস্তায় সে বায়ুসেবন করেছে। স্বাভাবিক স্ত্রী-বুদ্ধির প্রেরণায় মেয়েটি গাড়ি আসবার বেশ কিছুক্ষণ পূর্বেই গেটের কাছে দাঁড়াত। কেবল সেই মাড়োয়ারি ছেলে নয়, আরো দুচার সম্প্রদায়ের যুবক ঐখানটায় অকারণ পদচারণার চর্চা করত। তার মধ্যে ঐ ছেলেটিই চোখ বুজে দিল ঝাঁপ ওর জালের মধ্যে। আর ফিরল না। সিভিল মতে বিয়ে করলে সমাজের ওপারে। বেশি দিনের মেয়াদে নয়। তার ভাগ্যে বধূটি এল প্রথমে, তার পরে দাম্পত্যের মাঝখানটাতে দাঁড়ি টানলে টাইফয়েড, তার পরে মুক্তি।

 সৃষ্টিতে অনাসৃষ্টিতে মিশিয়ে উপদ্রব চলতে লাগল। মা দেখতে পায় তার মেয়ের ছটফটানি। মনে পড়ে নিজের প্রথম বয়সের জালামুখীর অগ্নিচাঞ্চল্য। মন উদ্‌বিগ্ন হয়। খুব নিবিড় করে পড়াশোনার বেড়া ফাঁদতে থাকে। পুরুষ শিক্ষক রাখল না। একজন বিদুষীকে লাগিয়ে দিল ওর শিক্ষকতায়। নীলার যৌবনের আঁচ লাগত তারও মনে, তুলত তাকে তাতিয়ে অনির্দেশ্য কামনার তপ্তবাষ্পে। মুগ্ধের দল ভিড় করে আসতে লাগল এ দিকে ও দিকে। কিন্তু দরওয়াজা বন্ধ। বন্ধুত্ব-প্রয়াসিনীরা নিমন্ত্রণ করে চায়ে টেনিসে সিনেমায়, নিমন্ত্রণ পৌঁছয় না কোনো ঠিকানায়। অনেক লোভী ফিরতে লাগল মধুগন্ধভরা আকাশে, কিন্তু কোনো অভাগ্য কাঙাল সোহিনীর ছাড়পত্র পায় না। এ দিকে দেখা যায় উৎকণ্ঠিত মেয়ে সুযোগ পেলে উঁকিঝুঁকি দিতে চায় অজায়গায়। বই পড়ে যে-বই টেক্সট্‌ বুক কমিটির অনুমোদিত নয়, ছবি গোপনে আনিয়ে নেয় যা আর্ট শিক্ষার আনুকূল্য করে বলে বিড়ম্বিত। ওর বিদুষী শিক্ষয়িত্রীকে পর্যন্ত অন্যমনস্ক করে দিলে। ডায়োশিসন থেকে বাড়ি ফেরবার পথে আলুথালুচুলওয়ালা গোঁফের-রেখামাত্র-দেওয়া সুন্দরহানো এক ছেলে ওর গাড়িতে চিঠি ফেলে দিয়েছিল। ওর রক্ত উঠেছিল ছম ছম করে। চিঠিখানা লুকিয়ে রেখেছিল জামার মধ্যে। ধরা পড়ল মায়ের কাছে। সমস্ত দিন ঘরে বন্ধ থেকে কাটল অনাহারে।

 সোহিনীর স্বামী যাদের বৃত্তি দিয়েছিলেন, সেই-সব ভালো ভালো ছাত্রমহলে সোহিনী পাত্র সন্ধান করেছে। সবাই প্রায় আড়ে আড়ে ওর টাকার থলির দিকে তাকায়। একজন তো তার থিসিস ওর নামে উৎসর্গ করে বসল। ও বললে, “হায় রে কপাল, লজ্জায় ফেললে আমাকে। তোমার পোস্টগ্রাজুয়েট মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে শুনলুম, অথচ মালাচন্দন দিলে অজায়গায়, হিসাব করে ভক্তি না করলে উন্নতি হবে না যে।” কিছুদিন থেকে একটি ছেলের দিকে সোহিনী দৃষ্টিপাত করছিল। ছেলেটি পছন্দসই বটে। তার নাম রেবতী ভট্টাচার্য। এরি মধ্যে সায়ান্সের ডাক্তার পদবীতে চড়ে বসেছে। ওর দুটো-একটা লেখার যাচাই হয়ে গেছে বিদেশে।

লোকের সঙ্গে মেলামেশা করবার কলাকৌশল সোহিনীর ভালো করেই জানা আছে। মন্মথ চৌধুরী রেবতীর প্রথম দিককার অধ্যাপক। তাঁকে নিলে বশ করে। কিছুদিন চায়ের সঙ্গে রুটিটোস্ট, অমলেট, কখনো বা ইলিশমাছের ডিমের বড় খাইয়ে কথাটা পাড়লে। বললে, “আপনি হয়তো ভাবছেন আমি আপনাকে বারে বারে চা খেতে ডাকি কেন।”

 “মিসেস মল্লিক, আমি তোমাকে নিশ্চয় বলতে পারি, সেটা আমার দুর্ভাবনার বিষয় নয়।”

 সোহিনী বললে, “লোকে ভাবে, আমরা বন্ধুত্ব করে থাকি স্বার্থের গরজে।”

 “দেখো মিসেস মল্লিক, আমার মত হচ্ছে এই— গরজটা যারই হোক, বন্ধুত্বটাই তো লাভ। আর এই বা কম কথা কী, আমার মতো অধ্যাপককে দিয়েও কারো স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে। এ জাতটার বুদ্ধি কেতাবের বাইরে হাওয়া খেতে পায় না বলে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আমার কথা শুনে তোমার হাসি পাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। দেখো, যদিও আমি মাস্টারি করি তবু ঠাট্টা করতেও পারি। দ্বিতীয়বার চা খেতে ডাকবার পূর্বে এটা জেনে রাখা ভালো।”

 “জেনে রাখলুম, বাঁচলুম। অনেক অধ্যাপক দেখেছি, তাঁদের মুখ থেকে হাসি বের করতে ডাক্তার ডাকতে হয়।”

 “বাহবা, আমারই দলের লোক দেখছি তুমি। তা হলে এবার আসল কথাটা পাড়া হোক।”

 “জানেন বোধ হয়, জীবনে আমার স্বামীর ল্যাবরেটরিই ছিল একমাত্র আনন্দ। আমার ছেলে নেই, ঐ ল্যাবরেটরিতে বসিয়ে দেব বলে ছেলে খুঁজছি। কানে এসেছে রেবতী ভট্টাচার্যের কথা।”

 অধ্যাপক বললেন, “যোগ্য ছেলেই বটে। তার যে-লাইনের বিদ্যে সেটাকে শেষ পর্যন্ত চালান করতে মালমসলা কম লাগবে না।”

 সোহিনী বললে, “আমার রাশকরা টাকায় ছাতা পড়ে যাচ্ছে। আমার বয়সের বিধবা মেয়ের ঠাকুরদেবতার দালালদের দালালি দিয়ে পরকালের দরজা ফাঁক করে নিতে চায়। আপনি শুনে হয়তো রাগ করবেন, আমি ও-সব কিছুই বিশ্বাস করি নে।”

 চৌধুরী দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে বললেন, “তুমি তবে কী মানো।”

 “মানুষের মতো মানুষ যদি পাই, তবে তার সব পাওনা শোধ করে দিতে চাই যতদূর আমার সাধ্য আছে। এই আমার ধর্মকর্ম।”

 চৌধুরী বললেন, “হুররে। শিলা ভাসে জলে। মেয়েদের মধ্যেও দৈবাৎ কোথাও কোথাও বুদ্ধির প্রমাণ মেলে দেখছি। আমার একটি বি. এস্‌সি. বোকা আছে, সেদিন হঠাৎ দেখি, গুরুর পা ছুঁয়ে সে উলটো ডিগবাজি খেলতে লেগেছে, মগজ থেকে বুদ্ধি যাচ্ছে উড়ে ফাটা শিমুলের তুলোর মতো। তা তোমার বাড়িতেই ওকে ল্যাবরেটরিতে বসিয়ে দিতে চাও? তফাতে আর কোথাও হলে হয় না?”

 “চৌধুরীমশায়, আপনি ভুল করবেন না, আমি মেয়েমানুষ। এইখানেই এই ল্যাবরেটরিতেই হয়েছে আমার স্বামীর সাধনা। তাঁর ঐ বেদির তলায় কোনো একজন যোগ্য লোককে বাতি জ্বালিয়ে রাখবার জন্যে যদি বসিয়ে দিতে পারি, তা হলে যেখানে থাকুন তাঁর মন খুশি হবে।”

 চৌধুরী বললেন, “বাই জোভ, এতক্ষণে মেয়েমানুষের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শুনতে খারাপ লাগল না। একটা কথা জেনে রেখো, রেবতীকে যদি শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি সাহায্য করতে চাও তা হলে লাখটাকারও লাইন পেরিয়ে যাবে।”

 “গেলেও আমার খুদকুঁড়ো কিছু বাকি থাকবে।”

 “কিন্তু পরলোকে যাঁকে খুশি করতে চাও তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে না তো? শুনেছি তাঁরা ইচ্ছা করলে ঘাড়ে চড়ে লাফালাফি করতে পারেন।”

 “আপনি খবরের কাগজ পড়েন তো। মানুষ মারা গেলেই তার গুণাবলী প্যারাগ্রাফে প্যারাগ্রাফে ছাপিয়ে পড়তে থাকে। সেই মৃত মানুষের বদান্যতার ’পরে ভরসা করলে তো দোষ নেই। টাকা যে মানুষ জমিয়েছে অনেক পাপ জমিয়েছে সে তার সঙ্গে, আমরা কী করতে আছি, যদি থলি ঝেড়ে স্বামীর পাপ হালকা করতে না পারি। যাক্‌গে টাকা, আমার টাকায় দরকার নেই।”

 অধ্যাপক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, “কী আর বলব তোমাকে। খনি থেকে সোনা ওঠে, সে খাঁটি সোনা, যদিও তাতে মিশোল থাকে অনেক কিছু। তুমি সেই ছদ্মবেশী সোনার ঢেলা। চিনেছি তোমাকে। এখন কী করতে হবে বলো।”

 “ঐ ছেলেটিকে রাজী করিয়ে দিন।”

 “চেষ্টা করব, কিন্তু কাজটা খুব সহজ নয়। আর-কেউ হলে তোমার দান লাফিয়ে নিত।”

 “কোথায় বাধছে বলুন।”

 “শিশুকাল থেকে একটি মেয়ে-গ্রহ ওর কুষ্টি দখল করে বসেছে। রাস্তা আগলে রয়েছে অটল অবুদ্ধি।”

 “বলেন কী। পুরুষমানুষ—”  “দেখো মিসেস মল্লিক, রাগ করবে কাকে নিয়ে। জানো মেট্রিয়ার্কাল সমাজ কাকে বলে? যে সমাজের মেয়েরাই হচ্ছে পুরুষের সেরা। এক সময়ে সেই দ্রাবিড়ি সমাজের ঢেউ বাংলাদেশে খেলত।”

 সোহিনী বললে, “সে সুদিন তো গেছে। তলায় তলায় ঢেউ খেলে হয়তো, ঘুলিয়ে দেয় বুদ্ধিসুদ্ধি, কিন্তু হাল যে একলা পুরুষের হাতে। কানে মন্ত্র দেন তাঁরাই, আর জোরে দেন কানমলা। কান ছিঁড়ে যাবার জো হয়।”

 “আহা হা, কথা কইতে জানো তুমি। তোমার মতো মেয়েদের যুগ যদি আসে তা হলে মেট্রিয়ার্কাল সমাজে ধোবার বাড়ির ফর্দ রাখি মেয়েদের শাড়ির, আর আমাদের কলেজের প্রিন্সিপল্‌কে পাঠিয়ে দিই ঢেঁকি কুটতে। মনোবিজ্ঞান বলে, বাংলাদেশে মেট্রিয়ার্কি বাইরে নেই, আছে নাড়ীতে। মা মা শব্দে হাম্বাধ্বনি আর-কোনো দেশের পুরুষমহলে শুনেছ কি। তোমাকে খবর দিচ্ছি, রেবতীর বুদ্ধির ডগার উপরে চড়ে বসে আছে একটি রীতিমত মেয়ে।”

 “কাউকে ভালোবাসে নাকি।”

 “আহা, সেটা হলে তো বুঝতুম, ওর শিরায় প্রাণ করছে ধুকধুক। যুবতীর হাতে বুদ্ধি খোয়াবার বায়না নিয়েই তো এসেছে, এই তো সেই বয়েস। তা না হয়ে এই কাঁচা বয়সে ও যে এক মালা-জপকারিণীর হাতে মালার গুটি বনে গেছে। ওকে বাঁচাবে কিসে— না যৌবন, না বুদ্ধি, না বিজ্ঞান।”

 “আচ্ছা, একদিন ওঁকে এখানে চা খেতে ডাকতে পারি কি। আমাদের মতো অশুচির ঘরে খাবেন তো?”

 “অশুচি! না খায় তো ওকে আছড়ে আছড়ে এমনি শুচি করে নেব যে বামনাইয়ের দাগ থাকবে না ওর মজ্জায়। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তোমার নাকি একটি সুন্দরী মেয়ে আছে।”

 “আছে। পোড়াকপালী সুন্দরীও বটে। তা কী করব বলুন।”

 “না না, আমাকে ভুল কোরো না। আমার কথা যদি বলো, সুন্দরী মেয়ে আমি পছন্দই করি। ওটা আমার একটা রোগ বললেই হয়। কিন্তু ওর আত্মীয়েরা বেরসিক, ভয় পেয়ে যাবে।”

 “ভয় নেই, আমি নিজের জাতেই মেয়ের বিয়ে দেব ঠিক করেছি।”

 এটা একেবারে বানানো কথা।

 “তুমি নিজে তো বেজাতে বিয়ে করেছ।”

 “নাকাল হয়েছি কম নয়। বিষয়ের দখল নিয়ে মামলা করতে হয়েছে বিস্তর। যে করে জিতেছি সেটা বলবার কথা নয়।”

 “শুনেছি কিছু কিছু। বিপক্ষ পক্ষের আর্টিকেল্‌ড ক্লার্ককে নিয়ে তোমার নামে গুজব রটেছিল। মকদ্দমায় জিতে তুমি তো সরে পড়লে, সে লোকটা গলায় দড়ি দিয়ে মরতে যায় আর কি।”

 “এত যুগ ধরে মেয়েমানুষ টিঁকে আছে কী ক’রে। ছল করার কম কৌশল লাগে না, লড়াইয়ের তাগবাগের সমানই সে, তবে কিনা তাতে মধুও কিছু খরচ করতে হয়। এ হল নারীর স্বভাবদত্ত লড়াইয়ের রীতি।”

 “ঐ দেখো, আবার তুমি আমাকে ভুল করছ। আমরা বিজ্ঞানী, আমরা বিচারক নই, স্বভাবের খেলা আমরা নিষ্কাম ভাবে দেখে যাই। সে খেলায় যা ফল হবার তা ফলতে থাকে। তোমার বেলায় ফলটা বেশ হিসেবমতই ফলেছিল, বলেছিলুম, ধন্য মেয়ে তুমি। এ কথাটাও ভেবেছি, আমি যে তখন প্রোফেসর ছিলুম, আর্টিকেল্‌ড ক্লার্ক ছিলুম না, সেটা আমার বাঁচোয়া। মার্করি সূর্যের কাছ থেকে যতটুকু দূরে আছে ততটুকু দূরে থেকেই বেঁচে গেল। ওটা গণিতের হিসাবের কথা, ওতে ভালো নেই মন্দ নেই। এসব কথা বোধ হয় তুমি বুঝতে শিখেছ।”

 “ত শিখেছি। গ্রহগুলো টান মেনে চলে আবার টান এড়িয়ে চলে— এটা একটা শিখে নেবার তত্ত্ব বৈকি।”

 “আর-একটা কথা কবুল করছি। এইমাত্র তোমার সঙ্গে কথা কইতে কইতে একটা হিসেব মনে মনে কষছিলুম, সেও অঙ্কের হিসেব। ভেবে দেখো, বয়সটা যদি অন্তত দশটা বছর কম হত তা হলে খামকা আজ একটা বিপদ ঘটত। কোলিশন ঐটুকু পাশ কাটিয়ে গেল আর কি। তবু বাষ্পের জোয়ার উঠছে বুকের মধ্যে। ভেবে দেখো, সৃষ্টিটা আগাগোড়াই কেবল অঙ্ককষার খেলা।”

 এই বলে চৌধুরী দুই হাঁটু চাপড়িয়ে হা হা করে হেসে উঠলেন। একটা কথা তাঁর হুঁশ ছিল না যে, তাঁর সঙ্গে দেখা করবার আগে সোহিনী দু ঘণ্টা ধরে রঙেচঙে এমন করে বয়স বদল করেছে যে সৃষ্টিকর্তাকে আগাগোড়াই দিয়েছে ঠকিয়ে।

8

পরের দিন অধ্যাপক এসে দেখলেন সোহিনী রোঁয়াওঠা হাড়-বের-করা একটা কুকুরকে স্নান করিয়ে তোয়ালে দিয়ে তার গা মুছিয়ে দিচ্ছে।

 চৌধুরী জিগ্‌গেসা করলেন, “এই অপয়মন্তটাকে এত সম্মান কেন।”

 “ওকে বাঁচিয়েছি বলে। পা ভেঙেছিল মোটরের তলায় পড়ে, আমি সারিয়ে তুলেছি ব্যাণ্ডেজ বেঁধে। এখন ওর প্রাণটার মধ্যে আমারও শেয়ার আছে।”

 “রোজ রোজ ঐ অলুক্ষুনের চেহারা দেখে মন খারাপ হয়ে যাবে না?”

 “চেহারা দেখবার জন্যে ওকে তো রাখি নি। মরতে মরতে এই যে ও সেরে উঠেছে, এটা দেখতে আমার ভালো লাগে। ঐ প্রাণীর বেঁচে থাকবার দরকারটা যখন দিনে দিনে মিটিয়ে দিই, তখন ধর্মকর্ম করতে ছাগলছানার গলায় দড়ি বেঁধে আমাকে কালীতলায় দৌড়তে হয় না। তোমাদের বায়োলজির ল্যাবরেটরির কানাখোড়া কুকুরখরগোশগুলোর জন্যে আমি একটা হাসপাতাল বানাব স্থির করেছি।”  “মিসেস মল্লিক, তোমাকে যতই দেখছি তাক লাগছে।”

 “আরো বেশি দেখলে ওটার উপশম হবে। রেবতীবাবুর খবর দেবেন বলেছিলেন, সেটা আরম্ভ করে দিন।”

 “আমার সঙ্গে দূর সম্পর্কে ওদের যোগ আছে। তাই ওদের ঘরের খবর জানি। রেবতীকে জন্ম দিয়েই ওর মা যান মারা। বরাবর ও পিসির হাতে মানুষ। ওর পিসির আচারনিষ্ঠা একেবারে নিরেট। এতটুকু খুঁত নিয়ে ওঁর খুঁতখুঁতুনি সংসারকে অতিষ্ঠ করে তুলত। তাঁকে ভয় না করত এমন লোক ছিল না পরিবারে। ওঁর হাতে রেবতীর পৌরুষ গেল ছাতু হয়ে। স্কুল থেকে ফিরতে পাঁচ মিনিট দেরি হলে পঁচিশ মিনিট লাগত তার জবাবদিহি করতে।”

 সোহিনী বললে, “আমি তো জানি পুরুষরা করবে শাসন, মেয়েরা দেবে আদর, তবেই ওজন ঠিক থাকে।”

 অধ্যাপক বললেন, “ওজন ঠিক রেখে চলা মরালগামিনীদের ধাতে নেই। ওরা এ দিকে ঝুঁকবে ও দিকে ঝুঁকবে। কিছু মনে কোরো না মিসেস মল্লিক, ওদের মধ্যেও দৈবাৎ মেলে যারা খাড়া রাখে মাথা, চলে সোজা চালে। যেমন—”

 “আর বলতে হবে না। কিন্তু আমার মধ্যেও শিকড়ের দিকে মেয়েমানুষ যথেষ্ট আছে। কী ঝোঁকে পেয়েছে দেখছেন না! ছেলেধরা ঝোঁক। নইলে আপনাকে বিরক্ত করতেম কি।”

 “দেখো, বার বার ঐ কথাটা বোলো না। জেনে রেখে আজ ক্লাসের জন্যে তৈরি না হয়েই চলে এসেছি। কর্তব্যের গাফেলি এতই ভালো লাগছে।”

 “বোধ হয় মেয়েজাতটার ’পরেই আপনার বিশেষ একটু কৃপা আছে।”

 “একটুও অসম্ভব নয়। কিন্তু তার মধ্যেও তো ইতরবিশেষ আছে। যা হোক, সে কথাটা পরে হবে।”

 সোহিনী হেসে বললে, “পরে না হলেও চলবে। আপাতত যেকথাটা উঠেছে শেষ করে দিন। রেবতীবাবুর এত উন্নতি হল কী করে।”

 “যা হতে পারত তার তুলনায় কিছুই হয় নি। একটা রিসার্চের কাজে ওর বিশেষ দরকার হয়েছিল উঁচু পাহাড়ে যাবার। ঠিক করেছিল যাবে বদরিকাশ্রমে। আরে সর্বনাশ। পিসিরও ছিল এক পিসি, সে বুড়ি মরবে তো মরুক ঐ বদরিকারই রাস্তায়। পিসি বললে, ‘আমি যতদিন বেঁচে আছি পাহাড় পর্বত চলবে না।’ কাজেই তখন থেকে একমনে যা কামনা করছি সে মুখ ফুটে বলবার নয়। থাক্‌ সে কথা।”

 “কিন্তু শুধু পিসিমাদের দোষ দিলে চলবে কেন। মায়ের দুলাল ভাইপোদের হাড় বুঝি কোনো কালে পাকবে না?”

 “সে তো পূর্বেই বলেছি। মেট্রিয়ার্কি রক্তের মধ্যে হাম্বাধ্বনি জাগিয়ে তোলে, হতবুদ্ধি হয়ে যায় বৎসরা। আফসোসের কথা কী আর বলব। এ তো হল নম্বর ওয়ান। তার পরে রেবতী যখন সরকারের বৃত্তি নিয়ে কেম্‌ব্রিজে যাবে স্থির হল, আবার এসে পড়ল সেই পিসিমা হাউ হাউ শব্দে। তার বিশ্বাস, ও চলেছে মেমসাহেব বিয়ে করতে। আমি বললুম, না-হয় করল বিয়ে। সর্বনাশ, কথাটা আন্দাজে ছিল, এবার যেন পাকা-দেখা হয়ে গেল। পিসি বললে, ‘ছেলে যদি বিলেতে যায় তা হলে গলায় দড়ি দিয়ে মরব।’ কোন্‌ দেবতার দোহাই পাড়লে পাকানো হবে দড়িটা নাস্তিক আমি জানি নে, তাই দড়িটা বাজারে মিলল না। রেবতীকে খুব খানিকটা গাল দিলুম, বললুম স্টুপিড, বললুম ডান্স, বললুম ইম্‌বেসীল ব্যস, ঐখানেই খতম। রেবু এখন ভারতীয় ঘানিতে ফোঁটা ফোঁটা তেল বের করছেন।”

 সোহিনী অস্থির হয়ে বলে উঠল, “দেয়ালে মাথা ঠুকে মরতে ইচ্ছে করছে। একটা মেয়ে রেবতীকে তলিয়ে দিয়েছে, আর-একটা মেয়ে তাকে টেনে তুলবে ডাঙায়, এই আমার পণ রইল।”

 “পষ্ট কথা বলি ম্যাডাম। জানোয়ারগুলোকে শিঙে ধরে তলিয়ে দেবার হাত তোমার পাকা— লেজে ধরে তাদের উপরে তোলবার হাত তেমন দুরন্ত হয় নি। তা এখন থেকে অভ্যাসটা শুরু হোক। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, সায়ান্সে এত উৎসাহ তোমার এল কোথা থেকে।”

 “সকলরকম সায়েন্সেই সারা জীবন আমার স্বামীর মন ছিল মেতে। তাঁর নেশা ছিল বর্মা চুরুট আর ল্যাবরেটরি। আমাকে চুরুট ধরিয়ে প্রায় বর্মিজ মেয়ে বানিয়ে তুলেছিলেন। ছেড়ে দিলুম, দেখলুম পুরুষদের চোখে খটকা লাগে। তাঁর আর-এক নেশা আমার উপর দিয়ে জমিয়েছিলেন। পুরুষরা মেয়েদের মজায় বোকা বানিয়ে, উনি আমাকে মজিয়েছিলেন বিদ্যে দিয়ে দিনরাত দেখুন চৌধুরীমশায়, স্বামীর দুর্বলতা স্ত্রীর কাছে ঢাকা থাকে না— কিন্তু আমি ওঁর মধ্যে কোনোখানে খাদ দেখতে পাই নি। কাছে থেকে যখন দেখতুম, দেখেছি উনি বড়ো; আজ দূরে থেকে দেখছি, দেখি উনি আরো বড়ো।”

 চৌধুরী জিগ্‌গেসা করলেন, “কোন্‌খানে সব চেয়ে তাঁকে বড়ো ঠেকেছে।”

 “বলব? উনি বিদ্বান বলে নয়। বিদ্যার ’পরে ওঁর নিষ্কাম ভক্তি ছিল বলে। উনি একটা পুজোর আলো পুজোর হাওয়ার মধ্যে ছিলেন। আমরা মেয়েরা দেখবার-ছোঁবার মতো জিনিস না পেলে পুজো করবার থই পাই নে। তাঁর এই ল্যাবরেটরি আমার পুজোর দেবতা হয়েছে। ইচ্ছে করে এখানে মাঝে মাঝে ধূপধুনো জ্বালিয়ে শাখঘণ্টা বাজাই। ভয় করি আমার স্বামীর ঘৃণাকে। তাঁর দৈনিক যখন পুজো ছিল, এই-সব যন্ত্রতন্ত্র ঘিরে জমত কলেজের ছাত্রেরা, শিক্ষা নিত তাঁর কাছ থেকে, আর আমিও বসে যেতুম।”

 “ছেলেগুলো সায়ান্সে মন দিতে পারত কি।”

 “যারা পারত তাদেরই বাছাই হয়ে যেত। এমন-সব ছেলে দেখেছি যারা সত্যকার বৈরাগী। আবার দেখেছি কেউ কেউ নোট নেবার ছলে একেবারে পাশের ঠিকানায় চিঠি লিখে সাহিত্যচর্চা করত।”  “কেমন লাগত?”

 “সত্যি কথা বলব? খারাপ লাগত না। স্বামী চলে যেতেন কাজে, ভাবুকদের মন আশেপাশে ঘুর ঘুর করত।”

 “কিছু মনে কোরো না, আমি সাইকলজি স্টাডি করে থাকি। জিগ্‌গেসা করি, ওরা কিছু ফল পেত কি।”

 “বলতে ইচ্ছে করে না, নোংরা আমি। দু-চারজনের সঙ্গে জানাশোনা হয়েছে যাদের কথা মনে পড়লে আজও মনের মধ্যে মুচড়িয়ে ধরে।”

 “দু-চারজন?”

 “মন যে লোভী, মাংসমজ্জার নীচে লোভের চাপা আগুন সে লুকিয়ে রেখে দেয়, খোঁচা পেলে জলে ওঠে। আমি তো গোড়াতেই নাম ডুবিয়েছি, সত্যি কথা বলতে আমার বাধে না। আজন্ম তপস্বিনী নই আমরা। ভড়ং করতে করতে প্রাণ বেরিয়ে গেল মেয়েদের। দ্রৌপদী কুন্তীদের সেজে বসতে হয় সীতা সাবিত্রী। একটা কথা বলি আপনাকে চৌধুরীমশায়, মনে রাখবেন— ছেলেবেলা থেকে ভালোমন্দ-বোধ আমার স্পষ্ট ছিল না। কোনো গুরু আমায় তা শিক্ষা দেন নি। তাই মন্দের মাঝে আমি ঝাঁপ দিয়েছি সহজে— পারও হয়ে গেছি সহজে। গায়ে আমার দাগ লেগেছে কিন্তু মনে ছাপ লাগে নি। কিছু আমাকে আঁকড়ে ধরতে পারে নি। যাই হোক, তিনি যাবার পথে তাঁর চিতার আগুনে আমার আসক্তিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন, জমা পাপ একে একে জলে যাচ্ছে। এই ল্যাবরেটরিতেই জলছে সেই হোমের আগুন।”

 “ব্র্যাভো, সত্যি কথা বলতে কী সাহস তোমার।”

 “সত্যি কথা বলিয়ে নেবার লোক থাকলে বলা সহজ হয়। আপনি যে খুব সহজ, খুব সত্যি।”

 “দেখো, ঐ যে চিঠিলিখিয়ে ছেলেগুলো তোমার প্রসাদ পেয়েছিল, তারা কি এখনো আনাগোনা করে।”  “সেই করেই তো তারা মুছে দিয়েছে আমার মনের ময়লা। দেখলুম, জুটছে তারা আমার চেকবইয়ের দিকে লক্ষ্য করে। ভেবেছিল মেয়েমানুষের মোহ মরতে চায় না, ভালোবাসার সিঁধের গর্ত দিয়ে পৌঁছবে তাদের হাত আমার টাকার সিন্দুকে। এত রস আমার নেই, তারা তা জানত না। আমার শুকনো পাঞ্জাবি মন। আমি সমাজের আইনকানুন ভাসিয়ে দিতে পারি দেহের টানে পড়ে, কিন্তু প্রাণ গেলেও বেইমানি করতে পারব না। আমার ল্যাবরেটরির এক পয়সাও তারা খসাতে পারে নি। আমার প্রাণ শক্ত পাথর হয়ে চেপে আছে আমার দেবতার ভাণ্ডারের দ্বার। ওদের সাধ্য নেই সে পাথর গলাবে। আমাকে যিনি বেছে এনেছিলেন তিনি ভুল করেন নি।”

 “তাঁকে আমি প্রণাম করি, আর পাই যদি সেই ছেলেগুলোর কান মলে দিই।”

 বিদায় নেবার আগে অধ্যাপক একবার ল্যাবরেটরিটা ঘুরে এলেন সোহিনীকে সঙ্গে নিয়ে। বললেন, “এইখানেই মেয়েলিবুদ্ধির চোলাই হয়ে গেছে, অপদেবতার গাদ গেছে নেমে, বেরিয়ে এসেছে খাঁটি স্পিরিট।”

 সোহিনী বললে, “যা বলুন, মন থেকে ভয় যায় না। মেয়েলিবুদ্ধি বিধাতার আদি সৃষ্টি। যখন বয়স অল্প থাকে, মনের জোর থাকে, তখন সে লুকিয়ে থাকে ঝোপেঝাপে, যেই রক্ত আসে ঠাণ্ডা হয়ে, বেরিয়ে আসেন সনাতনী পিসিমা। তার আগেই আমার মরবার ইচ্ছে রইল।”

 অধ্যাপক বললেন, “ভয় নেই তোমার, আমি বলছি তুমি সজ্ঞানে মরবে।”


সাদা শাড়ি পরে মাথায় কাঁচাপাকা চুলে পাউডার মেখে সোহিনী মুখের উপর একটা শুচি সাত্ত্বিক আভা মেজে তুললে। মেয়েকে নিয়ে মোটরলঞ্চে করে উপস্থিত হল বোটানিকালে। তাকে পরিয়েছে নীলচে সবুজ বেনারসী শাড়ি, ভিতর থেকে দেখা যায় বসন্তী রঙের কাঁচুলি। কপালে তার কুঙ্কুমের ফোঁটা, সূক্ষ্ম একটু কাজলের রেখা চোখে, কাঁধের কাছে ঝুলেপড়া গুচ্ছকরা খোঁপা, পায়ে কালো চামড়ার ’পরে লাল মখমলের কাজকরা স্যাণ্ডেল।

 যে আকাশনিম-বীথিকার তলায় রেবতী রবিবার কাটায় আগে থাকতে সংবাদ নিয়ে সোহিনী সেইখানেই এসে তাকে ধরলে। প্রণাম করলে একেবারে তার পায়ে মাথা রেখে। বিষম ব্যস্ত হয়ে উঠল রেবতী।

 সোহিনী বললে, “কিছু মনে কোরো না বাবা, তুমি ব্রাহ্মণের ছেলে, আমি ছত্রির মেয়ে। চৌধুরীমশায়ের কাছে আমার কথা শুনে থাকবে।”

 “শুনেছি। কিন্তু এখানে আপনাকে বসাব কোথায়।”

 “এই-যে রয়েছে সবুজ তাজা ঘাস, এমন আসন কোথায় পাওয়া যায়। ভাবছ বোধ হয়, এখানে আমি কী করতে এসেছি। এসেছি আমার ব্রত উদ্‌যাপন করতে। তোমার মতো ব্রাহ্মণ তো খুঁজে পাব না।”

 রেবতী আশ্চর্য হয়ে বললে, “আমার মতো ব্রাহ্মণ!”

 “তা না তো কী। আমার গুরু বলেছেন, এখনকার কালের সব-সেরা যে-বিদ্যা তাতেই যাঁর দখল তিনিই সেরা ব্রাহ্মণ।”

 রেবতী অপ্রস্তুত হয়ে বললে, “আমার বাবা করতেন যজন-যাজন, আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানি নে।”

 “বলো কী, তুমি যে-মন্ত্র শিখেছ সেই মন্ত্রে সমস্ত জগৎ হয়েছে মানুষের বশ। তুমি ভাবছ মেয়েমানুষের মুখে এ-সব কথা এল কোথা থেকে। পেয়েছি পুরুষের মতো পুরুষের মুখ থেকে। তিনি আমার স্বামী। যেখানে তাঁর সাধনার পীঠস্থান ছিল, কথা দাও বাবা, সেখানে তোমাকে যেতে হবে।”  “কাল সকালে আমার ছুটি আছে, যাব।”

 “তোমার দেখছি গাছপালার শখ। বড়ো আনন্দ হল। গাছপালার খোঁজে আমার স্বামী গিয়েছিলেন বর্মায়, আমি তাঁর সঙ্গ ছাড়ি নি।”

 সঙ্গ ছাড়ে নি কিন্তু সায়ান্সের চর্চায় নয়। নিজের ভিতর থেকে যে গাদ উঠত ফুটে, স্বামীর চরিত্রের মধ্যেও সেটা অনুমান না করে থাকতে পারত না। সন্দেহের সংস্কার ছিল ওর আঁতে আঁতে। এক সময়ে নন্দকিশোরের যখন গুরুতর পীড়া হয়েছিল তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন, “মরবার একমাত্র আরাম এই যে, সেখান থেকে তুমি আমাকে খুঁজে বের করে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।”

 সোহিনী বললে, “সঙ্গে যেতে পারি তো।”

 নন্দকিশোর হেসে বললেন, “সর্বনাশ!”

 সোহিনী রেবতীকে বললে, “বর্মা থেকে আসবার সময় এনেছিলুম এক গাছের চারা। বর্মিজরা তাকে বলে ক্কোযাইটানিয়েঙ্গ্‌। চমৎকার ফুলের শোভা— কিন্তু কিছুতেই বাঁচাতে পারলুম না।”

 আজই সকালে স্বামীর লাইব্রেরি ঘেঁটে এ নাম সোহিনী প্রথম বের করেছে। গাছটা চোখেও দেখে নি। বিদ্যার জাল ফেলে বিদ্বানকে টানতে চায়।

 অবাক হল রেবতী। জিগ্‌গেসা করলে, “এর লাটিন নামটা কি জানেন।”

 সোহিনী অনায়াসে বলে দিলে, “তাকে বলে মিলেটিয়া।”

 বললে, “আমার স্বামী সহজে কিছু মানতেন না, তবু তাঁর একটা অন্ধবিশ্বাস ছিল ফলে ফুলে প্রকৃতির মধ্যে যা-কিছু আছে সুন্দর, মেয়েরা বিশেষ অবস্থায় তার দিকে একান্ত করে যদি মন রাখে তা হলে সন্তানরা মুন্দর হয়ে জন্মাবেই। এ কথা তুমি বিশ্বাস করো কি।”

 বলা বাহুল্য এটা নন্দকিশোরের মত নয়।

 রেবতী মাথা চুলকিয়ে বললে, “যথোচিত প্রমাণ তো এখনো জড়ো হয় নি।”  সোহিনী বললে, “অন্তত একটা প্রমাণ পেয়েছি আমার আপন ঘরেই। আমার মেয়ে এমন আশ্চর্য রূপ পেলে কোথা থেকে। বসন্তের নানা ফুলের যেন— থাক্‌— নিজের চোখে দেখলেই বুঝতে পারবে।”

 দেখবার জন্যে উৎসুক হয়ে উঠল রেবতী। নাট্যের কোনো সরঞ্জাম বাকি ছিল না।

 সোহিনী তার রাঁধুনী বামুনকে সাজিয়ে এনেছে পূজারী বামুনের বেশে। পরনে চেলি, কপালে ফোঁটাতিলক, টিকিতে ফুল বাঁধা, বেলের আঠায় মাজা মোটা পইতে গলায়। তাকে ডেকে বললে, “ঠাকুর, সময় তো হল, নীলুকে এবার ডেকে নিয়ে এসো।”

 নীলাকে তার মা বসিয়ে রেখেছিল স্টীমলঞ্চে। ঠিক ছিল ডালি হাতে সে উঠে আসবে, বেশ খানিকখন তাকে দেখা যাবে সকাল বেলার ছায়ায়-আলোয়।

 ইতিমধ্যে রেবতীকে সোহিনী তন্ন তন্ন করে দেখে নিতে লাগল। রঙ মসৃণ শ্যামবর্ণ, একটু হলদের আভা আছে। কপাল চওড়া, চুলগুলো আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে উপরে তোলা। চোখ বড়ো নয় কিন্তু তাতে দৃষ্টিশক্তির স্বচ্ছ আলো জ্বল জ্বল করছে, মুখের মধ্যে সেইটেই সকলের চেয়ে চোখে পড়ে। নীচে মুখের বেড়টা মেয়েলী ধাঁচের মোলায়েম। রেবতীর সম্বন্ধে ও যত খবর জোগাড় করেছে তার মধ্যে ও বিশেষ লক্ষ করেছে একটা কথা। ছেলেবেলাকার বন্ধুদের ওর উপরে ছিল কান্নাকাটি-জড়ানো সেণ্টিমেণ্টাল ভালোবাসা। ওর মুখে যে একটা দুর্বল মাধুর্য ছিল, তাতে পুরুষ বালকদের মনে মোহ আনতে পারত।

 সোহিনীর মনে খটকা লাগল। ওর বিশ্বাস, মেয়েদের মনকে নোঙরের মতো শক্ত করে আঁকড়ে ধরার জন্যে পুরুষের ভালো দেখতে হওয়ার দরকারই করে না। বুদ্ধিবিদ্যেটাও গৌণ। আসল দরকার পৌরুষের ম্যাগ্‌নেটিজিম। সেটা তার স্বায়ুর পেশীর ভিতরকার বেতারবার্তার মতো। প্রকাশ পেতে থাকে কামনার অকথিত স্পর্ধারূপে।

 মনে পড়ল, নিজের প্রথম বয়সের রসোন্মত্ততার ইতিহাস। ও যাকে টেনেছিল কিংবা যে টেনেছিল ওকে, তার না ছিল রূপ, না ছিল বিদ্যা, না ছিল বংশগৌরব। কিন্তু কী একটা অদৃশ্য তাপের বিকিরণ ছিল যার অলক্ষ্য সংস্পর্শে সমস্ত দেহ মন দিয়ে ও তাকে অত্যন্ত করে অনুভব করেছিল পুরুষমানুষ বলে। নীলার জীবনে কখন এক সময়ে সেই অনিবার্য আলোড়নের আরম্ভ হবে এই ভাবনা তাকে স্থির থাকতে দিত না। যৌবনের শেষ দশাই সকলের চেয়ে বিপদের দশা, সেই সময়টাতে সোহিনীকে অনেকখানি ভুলিয়ে রেখেছিল নিরবকাশ জ্ঞানের চর্চায়। কিন্তু দৈবাৎ সোহিনীর মনের জমি ছিল স্বভাবত উর্বরা। কিন্তু যে-জ্ঞান নৈর্ব্যক্তিক, সব মেয়ের তার প্রতি টান থাকে না। নীলার মনে আলো পৌঁছয় না। নদীর ঘাট থেকে আস্তে আস্তে দেখা দিল নীলা। রোদ্দুর পড়েছে তার কপালে তার চুলে, বেনারসী শাড়ির উপরে জরির রশ্মি ঝলমল করে উঠছে। রেবতীর দৃষ্টি এক মুহুর্তের মধ্যে ওকে ব্যাপ্ত করে দেখে নিলে। চোখ নামিয়ে নিল পরক্ষণেই। ছেলেবেলা থেকে তার এই শিক্ষা। যে সুন্দরী মেয়ে মহামায়ার মনোহারিণী লীলা, তাকে আড়াল করে রেখেছে পিসির তর্জনী। তাই যখন সুযোগ ঘটে তখন দৃষ্টির অমৃত ওকে তাড়াতাড়ি এক চুমুকে গিলতে হয়।

 মনে মনে রেবতীকে ধিক্কার দিয়ে সোহিনী বললে, “দেখো দেখো, একবার চেয়ে দেখো।”

 রেবতী চমকে উঠে চোখ তুলে চাইলে।

 সোহিনী বললে, “দেখো তো ডক্টর অব সায়ান্স, ওর শাড়ির রঙের সঙ্গে পাতার রঙের কী চমৎকার মিল হয়েছে।”

 রেবতী সসংকোচে বললে, “চমৎকার।”

 সোহিনী মনে মনে বললে, ‘নাঃ, আর পারা গেল না।” আবার বললে, “ভিতরে বসন্তী রঙ উঁকি মারছে, উপরে সবজে নীল। কোন্‌ ফুলের সঙ্গে মেলে বলে দেখি।”

 উৎসাহ পেয়ে রেবতী ভালো করেই দেখলে। বললে, “একটা ফুল মনে পড়ছে কিন্তু উপরের আবরণটা ঠিক নীল নয়, ব্রাউন।”

 “কোন্‌ ফুল বলো তো।”

 রেবতী বললে, “মেলিনা।”

 “ও বুঝেছি। তার পাঁচটি পাপড়ি, একটি উজ্জ্বল হলদে, বাকি চারটে শ্যামবর্ণ।”

 রেবতী আশ্চর্য হয়ে গেল। বললে, “এত করে ফুলের পরিচয় জানলেন কী করে।”

 সোহিনী হেসে বললে, “জানা উচিত হয় নি বাবা। পুজোর সাজির বাইরের ফুল আমাদের কাছে পরপুরুষ বললেই হয়।”

 ডালি হাতে এল ধীরে ধীরে নীলা। মা বললে, “জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলি কেন। পা ছুঁয়ে প্রণাম কর।”

 ‘থাক্‌ থাক্‌’ বলে রেবতী অস্থির হয়ে উঠল। রেবতী আসন করে বসেছিল, পা খুঁজে বের করতে নীলাকে একটু হাতড়াতে হল। শিউরে উঠল রেবতীর সমস্ত শরীর। ডালিতে ছিল দুর্লভ-জাতীয় অর্কিডের মঞ্জরি, রুপোর থালায় ছিল বাদামের তক্তি, পেস্তার বরফি, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের ছাঁচ, মালাইয়ের বরফি, চৌকো করে কাটা কাটা ভাপা দই।

 বললে, “এ-সমস্ত তৈরি নীলার নিজের হাতে।”

 সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। এ-সব কাজে নীলার না ছিল হাত, না ছিল মন।

 সোহিনী বললে, “একটু মুখে দিতে হয় বাবা, ঘরে তৈরি তোমারই উদ্দেশে।”

 ফরমাশে তৈরি বড়োবাজারের এক চেনা দোকানে।

 রেবতী হাত জোড় করে বললে, “এ সময়ে খাওয়া আমার অভ্যাস নয়। বরং অনুমতি করেন যদি বাসায় নিয়ে যাই।”

 সোহিনী বললে, “সেই ভালো। অনুরোধ করে খাওয়ানো আমার স্বামীর আইনে বারণ। তিনি বলতেন, মানুষ তো অজগরের জাত নয়।”

 একটা বড়ো টিফিন ক্যারিয়ারে থাকে থাকে সোহিনী খাবার সাজিয়ে দিলে। নীলাকে বললে, “দে তো মা, সাজিতে ফুলগুলি ভালো করে সাজিয়ে। এক জাতের সঙ্গে আর-এক জাত মিশিয়ে দিস নে যেন। আর তোর খোঁপা ঘিরে ঐ যে সিল্কের রুমাল জড়িয়েছিস, ওটা পেতে দিস ফুলগুলির উপরে।”

 বিজ্ঞানীর চোখে আর্টপিপাসুর দৃষ্টি উঠল উৎসুক হয়ে। এ যে প্রাকৃত জগতের মাপ-ওজনের বাইরেকার জিনিস। নানা রঙের ফুলগুলির মধ্যে নীলার সুঠাম আঙুল সাজাবার লয় রেখে নানা ভঙ্গিতে চলছিল— রেবতীর চোখ ফেরানো দায় হল। মাঝে মাঝে নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে নিচ্ছিল। একদিকে সেই মুখের সীমানা দিয়েছে চুনি-মুক্তো-পান্নার-মিশোল-করা একহার হার জড়ানো চুলের ইন্দ্রধনু, আর একদিকে বসন্তীরঙা কাঁচুলির উচ্ছিত রাঙা পাড়টি। সোহিনী মিষ্টান্ন সাজাচ্ছিল কিন্তু ওর একটা তৃতীয় নেত্র আছে যেন। সামনে যে একটা জাদু চলছিল সে ওর লক্ষ এড়ায় নি।

 নিজের স্বামীর অভিজ্ঞতা অনুসারে সোহিনীর ধারণা ছিল বিদ্যা-সাধনার বেড়াদেওয়া খেত যে-সে গোরুর চরবার খেত নয়। আজ আভাস পেল বেড়া সকলের পক্ষে সমান ঘন নয়। সেটা ভালো লাগল না।


পরের দিন সোহিনী অধ্যাপককে ডেকে পাঠালে। বললে, “নিজের গরজে আপনাকে ডেকে এনে মিছিমিছি কষ্ট দিই। হয়তো কাজের ক্ষতিও করি।”

 “দোহাই তোমার, আরো-একটু ঘন ঘন ডেকো। দরকার থাকে তো ভালো, না থাকে তো আরো ভালো।”

 “আপনি জানেন, দামী যন্ত্র সংগ্রহের নেশায় আমার স্বামীর কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকত না। মনিবদের ফাঁকি দিতেন এই নিষ্কাম লোভে। সমস্ত এশিয়ার মধ্যে এমন ল্যাবরেটরি কোথাও পাওয়া যাবে না, এই জেদ তাঁর মতো আমাকেও পেয়ে বসেছিল। এই জেদেই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল, নইলে আমার ম’দো রক্ত গাঁজিয়ে উঠে উপচিয়ে পড়ত চারি দিকে। দেখুন চৌধুরীমশায়, নিজের স্বভাবের মধ্যে মন্দটা যা লেপটিয়ে থাকে সেটা যাঁর কাছে অসংকোচে বলতে পারি আপনি আমার সেই বন্ধু। নিজের কলঙ্কের দিকটা দেখবার খোলসা দরজা পেলে মন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।”

 চৌধুরী বললেন, “যারা সম্পূর্ণটা দেখতে পায় তাদের কাছে সত্যকে চাপা দেবার দরকার করে না। আধা সত্যই লজ্জার জিনিস। পুরোপুরি দেখার ধাত আমাদের, আমরা বিজ্ঞানী।”

 “তিনি বলতেন, মানুষ প্রাণপণে প্রাণ বাঁচাতে চায় কিন্তু প্রাণ তো বাঁচে না। সেইজন্যে বাঁচবার শখ মেটাবার জন্যে এমন-কিছুকে সে খুঁজে বেড়ায় যা প্রাণের চেয়ে অনেক বেশি। সেই দুর্লভ জিনিসকে তিনি পেয়েছেন তার এই ল্যাবরেটরিতে। একে যদি আমি বঁচিয়ে রাখতে না পারি তা হলেই তাকে চরম করে মারব স্বামীঘাতিনী হয়ে। আমি এর রক্ষক চাই, তাই খুঁজছিলুম রেবতীকে।”

 “চেষ্টা করে দেখলে?”

 “দেখেছি হাতে হাতে ফল পাবার আশা আছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিঁকবে না।”

 “কেন।”

 “ওঁর পিসিমা যেমনি শুনবেন রেবতীকে টেনেছি কাছে, অমনি তাঁকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবার জন্যে ছুটে আসবেন। ভাববেন, আমার মেয়ের সঙ্গে ওঁর বিয়ে দেবার ফাঁদ পেতেছি।”

 “দোষ কী, হলে তো ভালোই হত। কিন্তু তুমি যে বলেছিলে, বে-জাতে মেয়ের বিয়ে দেবে না।”

 “তখনো আপনার মন জানতুম না, তাই মিথ্যে কথা বলেছিলুম। খুবই চেয়েছিলুম। কিন্তু ছেড়েছি সেই মতলব।”

 “কেন।”

 “বুঝতে পেরেছি, ও ভাঙনধরানো মেয়ে। ওর হাতে যা পড়বে তা আস্ত থাকবে না।”

 “কিন্তু ও তো তোমারই মেয়ে।”

 “আমারই মেয়ে তো বটে, তাই তো ওকে আঁতের ভিতর থেকেই চিনি।”

 অধ্যাপক বললেন, “কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে কেন যে, মেয়েরা পুরুষের ইন্‌স্পিরেশন জাগাতে পারে।”

 “আমার সবই জানা আছে। পুরুষের খোরাকে আমিষ পর্যন্ত ভালোই চলে কিন্তু মদ ধরালেই সর্বনাশ। আমার মেয়েটি মদের পাত্র, কানায় কানায় ভরা।”

 “তা হলে কী করতে চাও বলো।”

 “আমার ল্যাবরেটরি দান করতে চাই পাবলিককে।”

 “তোমার একমাত্র মেয়েকে এড়িয়ে দিয়ে?”

 “মেয়েকে? ওকে দান করলে সে দান পৌঁছবে কোন্‌ রসাতলে কী করে জানব। আমার ট্রাস্ট-সম্পত্তির প্রেসিডেণ্ট করে দেব রেবতীকে। তাতে তো পিসির আপত্তি হতে পারবে না?”

 “মেয়েদের আপত্তির যুক্তি যদি ধরতেই পারব তা হলে পুরুষ হয়ে জন্মাতে গেলুম কেন। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি নে, ওকে যদি জামাই না করবে তা হলে প্রেসিডেণ্ট করতে চাও কেন।”

 “শুধু যন্ত্রগুলো নিয়ে কী হবে। মানুষ চাই ওদের প্রাণ দিতে। আর-একটা কথা এই, আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে একটাও নতুন যন্ত্র আনা হয় নি। টাকার অভাবে নয়। কিনতে হলে একটা লক্ষ্য ধরে কিনতে হয়। খবর জেনেছি, রেবতী ম্যাগনেটিজ্‌ম্‌ নিয়ে কাজ করছেন। সেই পথে সংগ্রহ এগিয়ে চলুক, যত দাম লাগে লাগুক-না।”

 “কী আর বলব, পুরুষমানুষ যদি হতে তোমাকে কাঁধে করে নিয়ে নেচে বেড়াতাম। তোমার স্বামী রেল কোম্পানির টাকা চুরি করেছিলেন, তুমি চুরি করে নিয়েছ তাঁর পুরুষের মনখানা। এমন অদ্ভুত কলমের জোড়লাগানো বুদ্ধি আমি কখনো দেখি নি। আমারও পরামর্শ নেওয়া তুমি যে দরকার বোধ করো, এই আশ্চর্য।”

 “তার কারণ আপনি যে খুব খাঁটি, ঠিক কথা বলতে জানেন।”

 “হাসালে তুমি। তোমাকে বেঠিক কথা বলে ধরা পড়ব, এত বড়ো নিরেট বোকা আমি নই—তা হলে লাগা যাক এবার জিনিসপত্র ফর্দ করা, দর যাচাই করা, ভালো উকিল ডেকে তোমার স্বত্ব বিচার করা, আইনকানুন বেঁধে দেওয়া ইত্যাদি অনেক হাঙ্গামা আছে।”

 “এ-সব দায় কিন্তু আপনারই।”

 “সেটা হবে নামমাত্র’। বেশ ভালো করেই জানো, যা তুমি বলাবে তাই বলব, যা করাবে তাই করব। আমার লাভটা এই যে দুবেলা দেখা হবে তোমার সঙ্গে। তোমাকে যে কী চক্ষে দেখেছি তুমি তো জানো না।”

 সোহিনী চৌকি থেকে উঠে এসে ধাঁ করে এক হাতে চৌধুরীর গলা জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে চট করে সরে গেল, ভালোমানুষের মতো বসল গিয়ে চৌকিতে।

 “ঐ রে, সর্বনাশের শুরু হল দেখছি।”

 “সে ভয় যদি একটুও থাকত তা হলে কাছেও এগতুম না। এ বরাদ্দ আপনার জুটবে মাঝে মাঝে।”

 “ঠিক বলছ?”

 “ঠিকই বলছি। আমার এতে খরচ নেই, আপনারও যে বেশি কিছু পাওনা আছে, মুখের ভাব দেখে তা বোধ হচ্ছে না।”

 “অর্থাৎ বলতে চাও, এ হচ্ছে মরা কাঠে কাঠঠোকরার ঠোকর দেওয়া।—চললুম উকিলবাড়িতে।”  “কাল একবার আসবেন এ পাড়াতে”

 “কেন, কী করতে।”

 “রেবতীর মনে দম দিতে।”

 “আর নিজের মনটা খুইয়ে বসতে।”

 “মন কি আপনার একলারই আছে।”

 “তোমার মনের কিছু বাকি আছে নাকি।”

 “উচ্ছিষ্ট অনেক পড়ে আছে।”

 “তাতে এখনো অনেক বাঁদর নাচানো চলবে।”


তার পরদিনে রেবতী ল্যাবরেটরিতে নির্দিষ্ট সময়ের অন্তত বিশ মিনিট আগে এসেই উপস্থিত। সোহিনী প্রস্তুত ছিল না, আটপৌরে কাপড়েই তাড়াতাড়ি চলে এল ঘরে। রেবতী বুঝতে পারলে গলদ হয়েছে। বললে, “আমার ঘড়িটা ঠিক চলছে না দেখছি।” সোহিনী সংক্ষেপে বললে, “নিশ্চয়।” এক সময়ে একটু কী শব্দ শুনে রেবতী মনে মনে চমকে উঠে দরজার দিকে তাকালে। সুখন বেহারাটা গ্লাসকেসের চাবি নিয়ে এল ঘরে।

 সোহিনী জিগ্‌গেস করলে, “এক পেয়ালা চা আনিয়ে দেব কি।”

 রেবতী ভাবলে বলা উচিত, হাঁ। বললে, “দোষ কী।”

 ও বেচারার চা অভ্যাস নেই, সর্দির আভাস দিলে বেলপাতাসিদ্ধ গরম জল খেয়ে থাকে। মনে মনে বিশ্বাস ছিল স্বয়ং নীলা আসবে পেয়ালা হাতে।

 সোহিনী জিগ্‌গেসা করলে, “তুমি কি কড়া চা খাও।”

 ও ফস্‌ করে বলে বসল, “হাঁ”

 ভাবলে এ ক্ষেত্রে হাঁ বলাটাই পাকা দস্তুর। এল চা, সেটা কড়া সন্দেহ নেই। কালির মতো রঙ, নিমের মতো তিতে। চা আনলে মুসলমান খানসামা। এটাও ওকে পরীক্ষা করবার জন্যে। আপত্তি করতে ওর মুখে কথা সরল না। এই সংকোচ ভালো লাগল না সোহিনীর। খানসামাকে বললে, “চা-টা ঢেলে দাও-না মোবারক, ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে।”

 খানসামার হাতের পরিবেশন-প্রত্যাশায় রেবতী বিশ মিনিট আগে এখানে আসে নি।

 কী দুঃখে যে মুখে চামচ উঠছিল অন্তর্যামীই জানছিলেন, আর জানছিল সোহিনী। হাজার হোক মেয়েমানুষ, দুর্গতি দেখে বললে, “ও পেয়ালাটা থাক্‌। দুধ ঢেলে দিচ্ছি, তার সঙ্গে কিছু ফল খেয়ে নাও। সকাল সকাল এসেছ, বোধ হয় কিছু খেয়ে আসা হয় নি।” কথাটা সত্য। রেবতী ভেবেছিল আজও সেই বোটানিকালের পুনরাবৃত্তি হবে। কাছ দিয়েও গেল না, মুখে রয়ে গেল কড়া চায়ের তিতো স্বাদ আর মনে রয়েছে আশাভঙ্গের তিতো অভিজ্ঞতা।

 এমন সময় প্রবেশ করলেন অধ্যাপক। ঘরে ঢুকেই রেবতীর পিঠ চাপড়িয়ে বললেন, “কীরে হল কী, সব যে একেবারে ঠাণ্ডা হিম। খুকুর মতো বসে বসে দুধ খাচ্ছিস ঢকে ঢক। চারি দিকে যা দেখছিস একি খোকাবাবুর খেলনার দোকান। যাদের চোখ আছে তারা দেখেছে, মহাকালের চেলারা এইখানে আসে তাণ্ডবনৃত্য করতে।”

 “আহা কেন বকছেন। না খেয়েই ও বেরিয়েছিল আজ সকালে। এল যখন, তখন দেখলুম মুখ যেন শুকনো।”

 “ঐরে পিসিমা দি সেকেণ্ড। এক পিসিমা দেবে এক গালে চাপড়, আর-এক পিসিমা দেবে অন্য গালে চুমো। মাঝখানে পড়ে ছেলেটা যাবে ভিজে কাদা হয়ে। আসল কথা কী জানো, লক্ষ্মী যখন আপনি সেধে আসেন চোখে পড়েন না; যারা সাত মুল্লুক ঘুরে তাঁকে খুঁজে বের করে, ধরা দেন তিনি তাদেরই কাছে। না-চেয়ে পাওয়ার মতো না-পাওয়ার আর রাস্তা নেই। আচ্ছা বলে দেখি মিসেস— দূর হোকগে ছাই মিসেস— আমি ডাকবই তোমাকে সোহিনী বলে, এতে তুমি রাগই করো আর যাই করো।”

 “মরণ আমার, রাগ করতে যাব কেন। ডাকুন আমাকে সোহিনী বলে, সুহি বললে আমার কান জুড়িয়ে যাবে।”

 “গোপন কথাটা প্রকাশ করেই বলি। তোমার ঐ সোহিনী নামটির সঙ্গে আর-একটি শব্দের মিল আছে, বড়ো খাঁটি তার অর্থ। সকালে ঘুম থেকে উঠেই হিনি হিনি কিনি কিনি রবে ঐ ছটি শব্দ মিলিয়ে মনে মনে খঞ্জনি বাজাতে থাকি।”

 “কেমিস্ট্রির রিসর্চে মিল করা আপনার অভ্যাস আছে, ওটা তারই একটা ফেঁকড়া।”

 “মিল করতে গিয়ে মরেও অনেক লোক। বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে নেই— ঘোরতর দাহ্য পদার্থ।”

 এই বলে হাঃ হাঃ শব্দে উচ্চহাস্য করে উঠলেন।

 “নাঃ, ঐ ছোকরাটার সামনে এ-সব কথার আলোচনা করতে নেই। বারুদের কারখানায় আজ পর্যন্ত ও অ্যাপ্রেণ্টিসি শুরু করে নি। পিসিমার আঁচল ওকে আগলে আছে, সে আঁচল নন্‌কম্‌বাস্টিবল।”

 রেবতীর মেয়েলী মুখ লাল হয়ে উঠছিল।

 “সোহিনী, আমি তোমাকে জিগ্‌গেসা করতে যাচ্ছিলুম, আজ সকালে তুমি কি ওকে আফিম খাইয়ে দিয়েছিলে। অমন ঝিমিয়ে পড়ছে কেন।”

 “খাইয়ে যদি থাকি সেটা না জেনে।”

 “রেবু, ওঠ্‌ বলছি ওঠ্‌। মেয়েদের কাছে অমন মুখচোরা হয়ে থাকতে নেই। ওতে ওদের আস্পর্ধা বেড়ে যায়। ওরা তো ব্যামোর মতো পুরুষের দুর্বলতা খুঁজে বেড়ায়, ছিদ্র পেলেই টেম্পেরেচর চড়িয়ে দেয় হু হু ক’রে। সাবজেক্টটা জানা আছে, ছেলেগুলোকে সাবধান করতে হয়। আমার মতো যারা ঘা খেয়েছে, মরে নি, তাদের কাছ থেকেই পাঠ নিতে হয়। রেবু, কিছু মনে করিস নে বাবা। যারা কথা কয় না, চুপ করে থাকে, তারাই সব চেয়ে ভয়ংকর। চল্‌ দেখি, তোকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। ঐ দেখ্‌ দুটো গ্যালভানোমিটর, একেবারে হাল কায়দার। এই দেখ্‌ হাই ভ্যাকুয়ম পম্প, আর এটা মাইক্রোফোটোমিটর, এ ছেলে-পাসকরাবার কলার ভেলা নয়। একবার এখানে আসন গেড়ে বোস্ দেখি। সেই তোমার টাকপড়া মাথার প্রোফেসর— নাম করতে চাই নে, দেখি, কেমন তার মুখ চুন হয়ে না যায়। আমার ছাত্র হয়ে যখন তুই বিদ্যে শুরু করলি আমি তোকে বলি নি কি, তোর নাকের সামনে ঝুলছে যাকে কথায় বলে ভবিষ্যৎ। হেলাফেলা করে সেটাকে ফোঁপরা করে দিস নে যেন। তোর জীবনীর প্রথম চ্যাপ্‌টারের এক কোণে আমার নামটাও ছোটো অক্ষরে লেখা যদি থাকে, সেটা হবে আমার মস্ত গুরুদক্ষিণা।”

 দেখতে দেখতে বিজ্ঞানী জেগে উঠল। জ্বলে উঠল তার দুই চোখ। চেহারাটা একেবারে ভিতর থেকে গেল বদলে। মুগ্ধ হয়ে সোহিনী বললে, “তোমাকে যে-কেউ জানে তারা সকলেই তোমার এত বড়ো উন্নতির আশা করে যা প্রতিদিনের জিনিস নয়, যা চিরদিনের। কিন্তু আশা যতই বড়ো ততই বড়ো তার বাধা ভিতরে বাইরে।”

 অধ্যাপক রেবতীর পিঠে আর-একবার দিলে একটা মস্ত চাপড়। ঝনঝন করে উঠল তার শিরদাঁড়া। চৌধুরী তার মস্ত ভারী গলায় বললেন, “দেখ্‌ রেবু, যে মহৎ ভবিষ্যতের বাহন হওয়া উচিত ছিল ঐরাবত, কৃপণ বর্তমান চাপিয়ে দেয় তাকে গোরুর গাড়িতে, কাদায় পড়ে থাকে সে অচল হয়ে। শুনছ, সোহিনী, সুহি?— না না ভয় নেই, পিঠে চাপড় মারব না। বলো সত্যি করে, কথাটা আমি কেমন গুছিয়ে বলেছি।”

 “চমৎকার।”

 “ওটা লিখে রেখে তোমার ডায়ারিতে।”

 “তা রাখব।”

 “কথাটার মানেটা বুঝেছিস তো রেবি?”  “বোধ হয় বুঝেছি।”

 “মনে রাখিস মস্ত প্রতিভার মস্ত দায়িত্ব। ও তো কারো নিজের জিনিস নয়। ওর জবাবদিহি অনন্তকালের কাছে। শুনছ সুহি, শুনছ? কথাটা কেমন বলেছি বলো তো ভাই।”

 “খুব ভালো বলেছেন। আগেকার দিনের রাজা থাকলে গলা থেকে মালা খুলে—”

 “তারা তো মরেছে সব, কিন্তু—”

 “ঐ কিন্তুটুকু মরে নি, মনে থাকবে।” রেবতী বললে, “ভয় নেই, কিছুতে আমাকে দুর্বল করবে না।”

 সোহিনীকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেল। সোহিনী তাড়াতাড়ি আটকিয়ে দিলে।

 চৌধুরী বললেন, “আরে করলে কী। পুণ্যকর্ম না করার দোষ আছে, পুণ্যকর্মে বাধা দেওয়ার দোষ আরো বেশি।”

 সোহিনী বললে, “প্রণাম যদি করতে হয় তো ঐখানে।”— ব’লে বেদীর উপরে বসানো নন্দকিশোরের একটি মূর্তি দেখিয়ে দিলে। ধূপধুনা জ্বলছে, ফুলে ভরে আছে থালা।

 বললে, “পাতকীকে উদ্ধার করার কথা পুরাণে পড়েছি। আমাকে উদ্ধার করেছেন ঐ মহাপুরুষ। অনেক নীচে নামতে হয়েছিল, শেষকালে তুলে বসাতে পেরেছেন— পাশে বললে মিথ্যে হবে— তাঁর পায়ের তলায়। বিদ্যার পথে মানুষকে উদ্ধার করবার দীক্ষা তিনি আমাকে দিয়ে গেছেন। বলে গিয়েছেন যেন মেয়েজামাইয়ের গুমর বাড়াবার জন্যে তাঁর জীবনের খনিখোঁঁড়া রত্ব ছাইয়ের গাদায় হারিয়ে না ফেলি। বললেন, ‘ঐখানে রেখে গেলেম আমার সদ্‌গতি, আর সদ্‌গতি আমার দেশের’।”

 অধ্যাপক বললেন, “শুনলি তো রেবু। এটা হবে ট্রাস্ট-সম্পত্তি, তোকে দেওয়া হবে তার কর্তৃত্ব।”

 রেবতী ব্যস্ত হয়ে বললে, “কর্তৃত্ব নেবার যোগ্য আমি নই। আমি পারব না।”

 সোহিনী বললে, “পারবে না! ছি, এ কি পুরুষের মতো কথা।”

 রেবতী বললে, “আমি চিরদিন পড়াশুনো করে এসেছি, এরকম কাজের ভার কখনো নিই নি।”

 চৌধুরী বললেন, “ডিম ফোটবার আগে কখনো হাঁস সাঁতার দেয় নি। আজ তোমার ডিমের খোলা ভাঙবে।”

 সোহিনী বললে, “ভয় নেই তোমার, আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকব।”

 রেবতী আশ্বস্ত হয়ে চলে গেল।

 সোহিনী অধ্যাপকের মুখের দিকে চেয়ে রইল। চৌধুরী বললেন, “জগতে বোকা অনেকরকম আছে, পুরুষ বোকা সকল বোকার সেরা। কিন্তু মনে রেখো, দায়িত্ব হাতে না পেলে দায়িত্বের যোগ্যতা জন্মায় না। একজোড়া হাত পেয়েছে মানুষ তাই সে হয়েছে মানুষ, একজোড়া খুর পেলেই তার সঙ্গে সঙ্গে মলবার যোগ্য লেজ আপনি গজিয়ে উঠত। তুমি কি রেবতীর হাতের বদলে খুর দেখতে পেয়েছ না কি।”

 “না, আমার ভালো লাগছে না। মেয়ের হাতেই যারা মানুষ কোনোকালে তাদের দুধে-দাঁত ভাঙে না। কপাল আমার। আপনি থাকতে আমি আর-কারো কথা কেন ভাবতে গেলুম।”

 “খুশি হলুম শুনে। একটুখানি বুঝিয়ে দাও কী গুণ আছে আমার।”

 “লোভ নেই আপনার একটুও।”

 “এত বড়ো নিন্দের কথা! লোভের মতো জিনিসকে লোভ করি নে?— খুবই করি—”

 মুখের কথা কেড়ে নিয়ে তাঁর দুই গালে দুই চুমো দিয়ে সোহিনী সরে গেল।

 “কোন্‌ খাতায় জমা হল এটা, সোহিনী।”  “আপনার কাছে যে ঋণ পেয়েছি সে তো শোধ করতে পারি নে, তারই সুদ দিচ্ছি।”

 “প্রথম দিন পেয়েছি একটি, আজ পেলুম দুটি। কেবলি বেড়ে চলবে না কি।”

 “বাড়বে বৈকি, চক্রবৃদ্ধির নিয়মে।”


চৌধুরী বললেন, “সোহিনী, তোমার স্বামীর শ্রাদ্ধে শেষকালে আমাকে পুরুত বানিয়ে দিলে? সর্বনাশ, এ কি কম দায়িত্ব। যার অস্তিত্ব হাতড়িয়ে পাওয়া যায় না তাকে খুশি করা! এ তো বাঁধাদস্তুরের দান-দক্ষিনে নয় যে—”

 “আপনিও তো বাঁধাদস্তুরের গুরুঠাকুর নন, আপনি যা করবেন সেটাই হবে পদ্ধতি। দানের ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছেন তো?”

 “কদিন ধরে ঐ কাজই করেছি— দোকানবাজার কম ঘুরি নি। দানসামগ্রী সাজানো হয়ে গেছে নীচের বড়ো ঘরটাতে। ইহলোকস্থিত আত্মা যারা এগুলো আত্মসাৎ করবে তারা পেট ভরে খুশি হবে, সন্দেহ নেই।”

 চৌধুরীর সঙ্গে নীচে গিয়ে সোহিনী দেখলে, সায়ান্স-পড়ুয়া ছেলেদের জন্যে নানা যন্ত্র, নানা মডেল, নানা দামী বই, নানা মাইক্রোস্‌কোপের স্নাইড্‌স্‌, নানা বায়োলজির নমুনা। প্রত্যেক সামগ্রীর সঙ্গে নাম ও ঠিকানা -লেখা কার্ড। আড়াইশো ছেলের জন্যে চেক লেখা হয়েছে একবৎসরের বৃত্তির। খরচের জন্যে কিছুমাত্র সংকোচ করা হয় নি। বড়ো বড়ো ধনীদের শ্রাদ্ধে যে ব্রাহ্মণবিদায় হয় তার চেয়ে এর ব্যয়ের প্রসর অনেক বেশি, অথচ বিশেষ করে চোখে পড়ে না এর সমারোহ।

 “পুরুতবিদায়ের কী দক্ষিণা দিতে হবে, সেটা তে আপনি ধরে দেন নি।”

 “আমার দক্ষিণা তোমার খুশি।”

 “খুশির সঙ্গে সঙ্গে আপনার জন্যে রেখেছি এই ক্রনোমিটর। জর্মনি থেকে আমার স্বামী এটা কিনেছিলেন, বরাবর তাঁর রিসর্চের কাজে লেগেছিল।”

 চৌধুরী বললেন, “যা মনে আসছে তার ভাষা নেই। বাজে কথা বলতে চাই নে, আমার পুরুতের কাজ সার্থক হল।”

 “আর-একটি লোক আছে, আজ তাকে ভুলতে পারি নে, সে আমাদের মানিকের বিধবা বউ।”

 “মানিক বলতে কাকে বোঝায়।”

 “সে ছিল ওঁর ল্যাবরেটরির হেডমিস্ত্রি। আশ্চর্য তার হাত ছিল। অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাজে একচুল তার নড়চড় হত না, কলকব্‌জার তত্ত্ব বুঝে নিতে তার বুদ্ধি ছিল অভ্রান্ত। তাকে উনি অতিনিকট বন্ধুর মতো দেখতেন। গাড়ি করে নিয়ে যেতেন বড়ো বড়ো কারখানার কাজ দেখাতে। এ দিকে সে ছিল মাতাল, ওঁর অ্যাসিস্টেণ্টরা তাকে ছোটোলোক বলে অবজ্ঞা করত। উনি বলতেন, ও যে গুণী, তার সে গুণ বানিয়ে তোলা যায় না, সে গুণ খুঁজে মিলবে না। ওঁর কাছে তার সম্মান পুরোমাত্রায় ছিল। এর থেকে বুঝবেন কেন যে উনি আমাকে শেষ পর্যন্ত এত মান দিয়েছিলেন। আমার মধ্যে যে মূল্য তিনি দেখেছিলেন তার তুলনায় দোষের ওজন ওঁর কাছে ছিল খুব সামান্য। যে জায়গায় আমার মতো কুড়িয়ে-পাওয়া মেয়েকে তিনি অসম্ভব রকম বিশ্বাস করেছিলেন, সে জায়গায় সে বিশ্বাস আমি কোনোদিন একটুমাত্র নষ্ট করি নি। আজও মনপ্রাণ দিয়ে রক্ষা করছি। এতটা তিনি আর-কারো কাছে পেতেন না। যেখানে আমি ছিলেম ছোটো সেখানে আমি তার চোখে পড়ি নি, যেখানে আমি ছিলুম বড়ো সেখানে তিনি আমাকে পুরো সম্মান দিয়েছেন। আমার মূল্য যদি তাঁর চোখে না পড়ত তা হলে আমি কোথায় তলিয়ে যেতুম বলুন আমি খুব খারাপ, কিন্তু আমি নিজেই বলছি আমি খুব ভালো, নইলে তিনি আমাকে কখনো সহ্য করতে পারতেন না।”

 “দেখো সোহিনী, আমি অহংকার করে বলব যে আমি প্রথম থেকেই জেনেছি তুমি খুব ভালো। সস্তা দরের ভালো হলে কলঙ্ক লাগলে দাগ উঠত না।”

 “যাকগে, আমাকে আর যে লোক যা মনে করুক-না, তিনি আমাকে যা মান দিয়েছেন সে আজ পর্যন্ত টিঁকে আছে, আমার শেষ দিন পর্যন্ত থাকবে।”

 “দেখো সোহিনী, তোমাকে যত দেখছি ততই জানছি, তুমি সে জাতের সহজ মেয়েমানুষ নও যারা স্বামী নামটা শুনলেই গ’লে পড়ে।”

 “না, তা নই, আমি দেখেছি ওঁর মধ্যে শক্তি, প্রথম দিন থেকে জেনেছি উনি মানুষ, আমি শাস্ত্র মিলিয়ে পতিব্রতাগিরি করতে বসি নি। আমি জাঁক করেই বলছি, আমার মধ্যে যে রত্ন আছে সে একা ওঁরই কণ্ঠহারে দোলবার মতো— আর কারো নয়।”

 এমন সময় নীলা ঘরে এসে ঢুকে পড়ল। বললে, “অধ্যাপকমশায়, কিছু মনে করবেন না, মায়ের সঙ্গে কিছু কথা আছে।”

 “কিছু না মা, আমি এখন যাচ্ছি ল্যাবরেটরিতে। রেবতী কী রকম কাজ করছে দেখে আসিগে।”

 নীলা বললে, “কোনো ভয় নেই। কাজ ভালোই চলছে। আমি এক-একদিন জানালার বাইরে থেকে দেখেছি, উনি মাথা গুঁজে লিখছেন, নোট নিচ্ছেন, কলম কামড়ে ধরে ভাবছেন। আমার প্রবেশনিষেধ, পাছে সার আইজাকের গ্রাভিটেশন যায় ন’ড়ে। সেদিন মা কাকে বলছিলেন উনি ম্যাগ্‌নেটিজ্‌ম্‌ নিয়ে কাজ করছেন— তাই পাশ দিয়ে কেউ গেলেই কাঁটা নড়ে যায়, বিশেষত মেয়েরা।”

 চৌধুরী হো হো করে হেসে উঠলেন, বললেন, “মা, ল্যাবরেটরি ভিতরেই আছে, ম্যাগ্‌নেটিজ্‌ম্‌ নিয়ে কাজ চলছেই, কাঁটা যাঁরা নড়িয়ে দেন তাঁদের ভয় করতেই হয়। দিগ্‌ভ্রম ঘটায় যে। তবে চললুম।”  নীলা মাকে বললে, “আমাকে আর কতদিন তোমার আঁচলের গাঁঠ দিয়ে বেঁধে রাখবে। পেরে উঠবে না, কেবল দুঃখ পাবে।”

 “তুই কী করতে চাস বল্‌।”

 নীলা বললে, “তুমি তো জানোই মেয়েদের জন্যে একটা Higher Study Movement খোলা হয়েছে, তুমি তাতে অনেক টাকা দিয়েছ। সেখানে আমাকে কেন কাজে লাগাও না।”

 “আমার ভয় আছে পাছে তুই ঠিকমত না চলিস।”

 “সব চলাই বন্ধ করে দেওয়াই কি ঠিক চলার রাস্তা।”

 “তা নয়, তা তো জানি, সেই তো আমার ভাবনা।”

 “তুমি না ভেবে একবার আমাকে ভাবতে দাও-না। সে তো দিতেই হবে। আমি তো এখন খুকি নই। তুমি ভাবছ সেই-সব পাবলিক জায়গায় নানা লোকের যাওয়া আসা আছে, সে একটা বিপদ। জগৎ সংসারে লোক-চলাচল তো বন্ধ হবে না তোমার খাতিরে। আর তাদের সঙ্গে আমার জানাশুনো একেবারেই ঠেকিয়ে রাখবে যে সে আইন তো তোমার হাতে নেই।”

 “জানি সব জানি, ভয় ক’রে ভয়ের কারণ ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। তা হলে তুই ওদের হাইয়র স্টাডি সার্কলে ভরতি হতে চাস?”

 “হ্যাঁ চাই।”

 “আচ্ছা তাই হবে। সেখানকার পুরুষ অধ্যাপকদের একে একে দিবি জাহান্নমে সে জানি। কেবল একটি কথা দিতে হবে আমাকে। কোনোমতেই তুই রেবতীর কাছে ঘেঁষতে পাবি নে। আর কোনো ছুতোতেই ঢুকবি নে তার ল্যাবরেটরিতে।”

 “মা, তুমি আমাকে কী মনে করো ভেবে পাই নে। কাছে ঘেঁষতে যাব তোমার ঐ খুদে সার আইজাক নিউটনের, এমন রুচি আমার?—মরে গেলেও না।”

 সংকোচ বোধ করলে রেবতী শরীরটাকে নিয়ে যে রকম আঁকুবাঁকু করে তারই নকল ক’রে নীলা বললে, “ঐ স্টাইলের পুরুষকে নিয়ে আমার চলবে না। যে-সব মেয়েরা ভালোবাসে বুড়ো খোকাদের মানুষ করতে, ওকে জিইয়ে রেখে দেওয়া ভালো তাদেরই জন্যে। ও মারবার যোগ্য শিকারই নয়।”

 “একটু বেশি বাড়িয়ে কথা বলছিস নীলা, তাই ভয় হচ্ছে ওটা ঠিক তোর মনের কথা নয়। তা হোক, ওর সম্বন্ধে তোর মনের ভাব যাই হোক, ওকে যদি মাটি করতে চাস তা হলে সে তোর পক্ষে ভালো হবে না।”

 “কখন তোমার কী মর্জি কিছুই বুঝতে পারি নে মা। ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দেবার জন্যে তুমি আমাকে সাজিয়ে পুতুল গড়ে তুলেছিলে, সে কি আমি বুঝতে পারি নি। সেইজন্যেই কি তুমি আমাকে ওর বেশি কাছে আনাগোনা করতে বারণ করছ, পাছে চেনাশোনার ঘেঁষ লেগে পালিশ নষ্ট হয়ে যায়।”

 “দেখ্‌ নীলা, আমি তোকে বলে দিচ্ছি তোর সঙ্গে ওর বিয়ে কিছুতেই হতে পারবে না।”

 “তা হলে আমি যদি মোতিগড়ের রাজকুমারকে বিয়ে করি?”

 “ইচ্ছা হয় তো করিস।”

 “সুবিধে আছে, তার তিনটে বিয়ে, আমার দায় অনেকটা হালকা হবে, আর সে মদ খেয়ে ঢলাঢলি করে নাইটক্লাবে— তখন আমি অনেকটা ছুটি পাব।”

 “আচ্ছা বেশ, সেই ভালো। রেবতীর সঙ্গে তোর বিয়ে হতে দেব না।”

 “কেন, তোমার সার আইজাক নিউটনের বুদ্ধি আমি ঘুলিয়ে দেব মনে করো?”

 “সে তর্ক থাক্‌, যা বললুম তা মনে রাখিস।”

 “উনি নিজেই যদি হ্যাংলাপনা করেন?”

 “তা হলে এ পাড়া তাকে ছাড়তে হবে—তোর অন্নে তাকে মানুষ করিস, তোর বাপের তহবিল থেকে এক কড়িও সে পাবে না।”  “সর্বনাশ! তা হলে নমস্কার সার আইজাক নিউটন।”  সেদিনকার পালা সংক্ষেপে এই পর্যন্ত।


“চৌধুরীমশায়, আর সবই চলছে ভালো কেবল আমার মেয়ের ভাবনায় সুস্থির হতে পারছি নে ও যে কোন্‌ দিকে তাক করতে শুরু করেছে বুঝতে পারছি নে।”

 চৌধুরী বললেন, “আবার ওর দিকে তাক করছে কারা সেটাও একটা ভাববার কথা। হয়েছে কি, এরই মধ্যে রটে গেছে ল্যাবরেটরি রক্ষার জন্যে তোমার স্বামী অগাধ টাকা রেখে গেছে। মুখে মুখে তার অঙ্কটা বেড়েই চলেছে। এখন রাজত্ব আর রাজকন্যা নিয়ে বাজারে একটা জুয়োখেলার সৃষ্টি হয়েছে।”

 “রাজকন্যাটি মাটির দরে বিকোবে তা জানি, কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে রাজত্ব সস্তায় বিকোবে না।”

 “কিন্তু লোকের আমদানি শুরু হয়েছে। সেদিন হঠাৎ দেখি, আমাদেরই অধ্যাপক মজুমদার ওরই হাত ধরে বেরিয়ে এল সিনেমা থেকে। আমাকে দেখেই ঘাড় বেঁকিয়ে নিল। ছেলেটা ভালো ভালো বিষয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়, দেশের মঙ্গলের দিকে ওর বুলি খুব সহজে খেলে। কিন্তু সেদিন ওর বাঁকা ঘাড় দেখে স্বদেশের জন্যে ভাবনা হল।”

 “চৌধুরীমশায়, আগল ভেঙেছে।”

 “ভেঙেছে বৈকি। এখন এই গরিবকেই নিজের ঘটি-বাটি সামলাতে হবে।”

 “মজুমদার-পাড়ায় মড়ক লাগে লাগুক, আমার ভয় রেবতীকে নিয়ে।”

 চৌধুরী বললেন, “আপাতত ভয় নেই। খুব ডুবে আছে। কাজ করছে খুব চমৎকার।”

 “চৌধুরীমশায়, ওর বিপদ হচ্ছে সায়ান্সে ও যত বড়ো ওস্তাদই হোক, তুমি যাকে মেট্রিয়ার্কি বলে সে রাজ্যের ও ঘোর আনাড়ি।”

 “সে কথা ঠিক। ওর একবারও টিকে দেওয়া হয় নি। ছোঁয়াচ লাগলে বাঁচানো শক্ত হবে।”

 “রোজ একবার কিন্তু ওকে আপনার দেখে যেতে হবে।”

 “কোথা থেকে ও আবার ছোঁয়াচ না নিয়ে আসে। শেষকালে এ বয়সে আমি না মরি। ভয় কোরো না, মেয়েমানুষ যদিও, তবুও আশা করি ঠাট্টা বুঝতে পারে। আমি পার হয়ে গেছি এপিডেমিকের পাড়াটা। এখন ছোঁওয়া লাগলেও ছোঁয়াচ লাগে না। কিন্তু একটা মুশকিল ঘটেছে। পরশু আমাকে যেতে হবে গুজরানওয়ালায়।”

 “এটাও ঠাট্টা নাকি। মেয়েমানুষকে দয়া করবেন।”

 “ঠাট্টা নয়, আমার সতীর্থ অমূল্য আড্ডি ছিলেন, সেখানকার ডাক্তার। বিশপঁচিশ বছর প্র্যাকটিস করেছেন। কিছু বিষয়সম্পত্তিও জমিয়েছেন। হঠাৎ বিধবা স্ত্রী আর ছেলে-মেয়ে রেখে মরেছেন হার্টফেল করে। দেনা-পাওনা চুকিয়ে জমিজমা বেচে তাদের উদ্ধার করে আনতে হবে আমাকে। কতদিন লাগবে ঠিক জানি নে।”

 “এর উপরে আর কথা নেই।”

 “এ সংসারে কথা কিছুরই উপরে নেই সোহিনী। নির্ভয়ে বলো, যা হবেই তা হোক। যারা অদৃষ্ট মানে তারা ভুল করে না। আমরা সায়াণ্টিস্টরাও বলি অনিবার্যের একচুল এদিক-ওদিক হবার জো নেই। যতক্ষণ কিছু করবার থাকে করে, যখন কোনোমতেই পারবে না, বোলো বাস্।”

 “আচ্ছা তাই ভালো।”

 “যে মজুমদারটির কথা বললুম, দলের মধ্যে সে তত বেশি মারাত্মক নয়। তাকে ওরা দলে টেনে রাখে মান বাঁচাবার জন্যে। আর-যাদের কথা শুনেছি, চাণক্যের মতে তাদের কাছ থেকে শত হস্ত দূরে থাকলেও ভাবনার কারণ থেকে যায়। অ্যাটর্নি আছে বঙ্কুবিহারী, তাকে আশ্রয় করা আর অক্টোপস্‌কে জড়িয়ে ধরা একই কথা। ধনী বিধবার তপ্ত রক্ত এই-সব লোক পছন্দ করে। খবরটা শুনে রাখো, যদি কিছু করবার থাকে কোরো। সবশেষে আমার ফিলজফিটা মনে রেখো।”

 “দেখুন চৌধুরীমশায়, রেখে দিন ফিলজফি। মানব না আপনার অদৃষ্ট, মানব না আপনার কার্যকারণের অমোঘ বিধান, যদি আমার ল্যাবরেটরির ’পরে কারো হাত পড়ে। আমি পাঞ্জাবের মেয়ে, আমার হাতে ছুরি খেলে সহজে। আমি খুন করতে পারি তা সে আমার নিজের মেয়ে হোক, আমার জামাইপদের উমেদার হোক।”

 ওর শাড়ির নীচে ছিল কোমরবন্ধ লুকোনো। তার থেকে ধাঁ করে এক ছুরি বের করে আলোয় ঝলক খেলিয়ে দিয়ে গেল। বললে, “তিনি আমাকে বেছে নিয়েছিলেন— আমি বাঙালির মেয়ে নই, ভালোবাসা নিয়ে কেবল চোখের জল ফেলে কান্নাকাটি করি নে। ভালোবাসার জন্যে প্রাণ দিতে পারি, প্রাণ নিতে পারি। আমার ল্যাবরেটরি আর আমার বুকের কলিজা, তার মাঝখানে রয়েছে এই ছুরি।”

 চৌধুরী বললেন, “একসময়ে কবিতা লিখতে পারতুম, আজ আবার মনে হচ্ছে হয়তো পারি লিখতে।”

 “কবিতা লিখতে হয় লিখবেন, কিন্তু আপনার ফিলজফি ফিরিয়ে নিন। যা না মানবার তাকে আমি শেষ পর্যন্ত মানব না। একলা দাঁড়িয়ে লড়ব। আর বুক ফুলিয়ে বলব, জিতবই, জিতবই, জিতবই।”

 “ব্র্যাভো, আমি ফিরিয়ে নিলুম আমার ফিলজফিটা। এখন থেকে লাগাব ঢাকে চাঁটি তোমার জয়যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে। আপাতত কিছুদিনের জন্যে বিদায় নিচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে না।”

 আশ্চর্যের কথা এই সোহিনীর চোখে জল ভরে এল। বললে, “কিছু মনে করবেন না।” জড়িয়ে ধরলে চৌধুরীর গলা। বললে, “সংসারে কোনো বন্ধনই টেঁকে না, এও মুহূর্তকালের জন্যে।”

 বলেই গলা ছেড়ে দিয়ে পায়ের কাছে প’ড়ে সোহিনী অধ্যাপককে প্রণাম করলে।


১০

খবরের কাগজে যাকে বলে পরিস্থিতি সেটা হঠাৎ এসে পড়ে, আর আসে দল বেঁধে। জীবনের কাহিনী সুখে দুঃখে বিলম্বিত হয়ে চলে। শেষ অধ্যায়ে কোলিশন লাগে অকস্মাৎ, ভেঙেচুরে স্তব্ধ হয়ে যায়। বিধাতা তাঁর গল্প গড়েন ধীরে ধীরে, গল্প ভাঙেন এক ঘায়ে।

 সোহিনীর আইমা থাকেন আম্বালায়। সোহিনী তাঁর কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেয়েছে, ‘যদি দেখা করতে চাও শীঘ্র এসো।’

 এই আইমা তার একমাত্র আত্মীয় যে বেঁচে আছে। এরই হাত থেকে নন্দকিশোর কিনে নিয়েছিলেন সোহিনীকে।

 নীলাকে তার মা বললে, “তুমিও আমার সঙ্গে এসো।”

 নীলা বললে, “সে তো কিছুতেই হতে পারে না।”

 “কেন পারে না।”

 “ওরা আমাকে অভিনন্দন দেবে তারই আয়োজন চলছে।”

 “ওরা কারা।”

 “জাগানী ক্লাবের মেম্বররা। ভয় পেয়ে না, খুব ভদ্র ক্লাব। মেম্বরদের নামের ফর্দ দেখলেই বুঝতে পারবে। খুবই বাছাই করা।”

 “তোমাদের উদেশ্য কী।”

 “স্পষ্ট বলা শক্ত। উদ্দেশ্যটা নামের মধ্যেই আছে। এই নামের তলায় আধ্যাত্মিক সাহিত্যিক আর্টিস্টিক সব মানেই খুব গভীরভাবে লুকোনো আছে। নবকুমারবাবু খুব চমৎকার ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলেন। ওরা ঠিক করেছে, তোমার কাছ থেকে চাঁদা নিতে আসবে।”  “কিন্তু চাঁদা দেখছি ওরা নিয়ে শেষ করেছে। তুমি ষোলো আনাই পড়েছ ওর হাতে। কিন্তু এই পর্যন্তই। আমার যেটা ত্যাজ্য সেটাই ওরা পেয়েছে। আমার কাছ থেকে আর কিছু পাবার নেই।”

 “মা, এত রাগ করছ কেন। ওঁরা নিঃস্বার্থভাবে দেশের উপকার করতে চান।”

 “আচ্ছা সে আলোচনা থাক্‌। এতক্ষণে তুমি বোধ হয় তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে খবর পেয়েছ যে তুমি স্বাধীন।”

 “হাঁ পেয়েছি।”

 “নিঃস্বার্থরা তোমাকে জানিয়েছেন যে তোমার স্বামীর দত্ত অংশে তোমার যে টাকা আছে সে তুমি যেমন খুশি ব্যবহার করতে পারো?”

 “হাঁ জেনেছি।”

 “আমার কানে এসেছে উইলের প্রোবেট নেবার জন্যে তোমরা প্রস্তুত হচ্ছ। কথাটা বোধ হয় সত্যি?”

 “হাঁ সত্যি। বঙ্কুবাবু আমার সোলিসিটর।”

 “তিনি তোমাকে আরো কিছু আশা এবং মন্ত্রণা দিয়েছেন।”

 নীলা চুপ করে রইল।

 “তোমার বঙ্কুবাবুকে আমি সিধে করে দেব যদি আমার সীমানায় তিনি পা বাড়ান। আইনে না পারি বেআইনে। ফেরবার সময় আমি পেশোয়ার হয়ে আসব। আমার ল্যাবরেটরি রইল দিনরাত্রি চারজন শিখ সিপাইয়ের পাহারায়। আর যাবার সময় এই তোমাকে দেখিয়ে যাচ্ছি— আমি পঞ্জাবের মেয়ে।”

 বলে নিজের কোমরবন্ধ থেকে ছুরি বের করে বললে, “এ ছুরি না চেনে আমার মেয়েকে না চেনে আমার মেয়ের সোলিসিটরকে। এর স্মৃতি রইল তোমার জিন্মায়। ফিরে এসে যদি হিসেব নেবার সময় হয় তো হিসেব নেব।”

১১

ল্যাবরেটরির চার দিকে অনেকখানি জমি ফাঁকা আছে। কাঁপন বা শব্দ যাতে যথাসম্ভব কাজের মাঝখানে না পৌঁছয়। এই নিস্তব্ধতা কাজের অভিনিবেশে রেবতীকে সহায়তা করে। তাই ও প্রায়ই এখানে রাত্রে কাজ করতে আসে।

 নীচের ঘড়িতে দুটো বাজল। মুহূর্তের জন্য রেবতী তার চিন্তার বিষয় ভাবছিল জানালার বাইরে আকাশের দিকে চোখ মেলে।

 এমন সময়ে দেওয়ালে পড়ল ছায়া। চেয়ে দেখে ঘরের মধ্যে এসেছে নীলা। রাত-কাপড় পরা, পাতলা সিল্কের শেমিজ। ও চমকে চৌকি থেকে উঠে পড়তে যাচ্ছিল। নীলা এসে ওর কোলের উপর বসে গলা জড়িয়ে ধরল। রেবতীর সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপতে লাগল, বুক উঠতে পড়তে লাগল প্রবলবেগে। গদ্‌গদ কণ্ঠে বলতে লাগল, “তুমি যাও, এ ঘর থেকে তুমি যাও।”

 ও বললে, “কেন।”

 রেবতী বললে, “আমি সহ্য করতে পারছি নে। কেন এলে তুমি এ ঘরে।”

 নীল ওকে আরো দৃঢ় বলে চেপে ধরে বললে, “কেন, আমাকে কি তুমি ভালোবাসো না।”

 রেবতী বললে, “বাসি, বাসি, বাসি। কিন্তু এ ঘর থেকে তুমি যাও।”

 হঠাৎ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল পাঞ্জাবী প্রহরী। ভর্তসনার কণ্ঠে বললে, “মায়িজি, বহুত শরমকি বাৎ হ্যায়, আপ বাহার চলা যাইয়ে।”

 রেবতী চেতন-মনের অগোচরে ইলেকট্রিক ডাকঘড়িতে কখন চাপ দিয়েছিল।

 পাঞ্জাবী রেবতীকে বললে, “বাবুজি, বেইমানি মৎ করো।”

 রেবতী নীলাকে জোর করে ঠেলে দিয়ে চৌকি থেকে উঠে পড়ল। দারোয়ান ফের নীলাকে বললে, “আপ বাহার চলা যাইয়ে, নহি তো মনিবকো হুকুম তামিল করেগা।”

 অর্থাৎ জোর করে অপমান করে বের করে দেবে। বাইরে যেতে যেতে নীলা বললে, “শুনছেন সার আইজাক নিউটন?— কাল আমাদের বাড়িতে আপনার চায়ের নেমন্তন্ন, ঠিক চারটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সময়। শুনতে পাচ্ছেন না? অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন?” বলে একবার তার দিকে ফিরে দাঁড়ালে।

 বাষ্পার্দ্র কণ্ঠে উত্তর এল, “শুনেছি।”

 রাত-কাপড়ের ভিতর থেকে নীলার নিখুঁত দেহের গঠন ভাস্করের মূর্তির মতো অপরূপ হয়ে ফুটে উঠল, রেবতী মুগ্ধ চোখে না দেখে থাকতে পারল না। নীলা চলে গেল। রেবতী টেবিলের উপর মুখ রেখে পড়ে রইল। এমন আশ্চর্য সৌন্দর্য সে কল্পনা করতে পারে না। একটা কোন বৈদ্যুত বর্ষণ প্রবেশ করেছে ওর শিরার মধ্যে, চকিত হয়ে বেড়াচ্ছে অগ্নিধারায়। হাতের মুঠো শক্ত করে রেবতী কেবলই নিজেকে বলাতে লাগল, কাল চায়ের নিমন্ত্রণে যাবে না। খুব শক্ত শপথ করবার চেষ্টা করতে চায়, মুখ দিয়ে বেরয় না। ব্লটিঙের উপর লিখল, যাব না, যাব না, যাব না। হঠাৎ দেখলে তার টেবিলে একটা ঘন লাল রঙের রুমাল পড়ে আছে, কোণে নাম সেলাই করা ‘নীলা’। মুখের উপর চেপে ধরল রুমাল, গন্ধে মগজ উঠল ভরে, একটা নেশা সিরসির করে ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গে।

 নীলা আবার ঘরের মধ্যে এল। বললে, “একটা কাজ আছে ভুলে গিয়েছিলুম।”

 দরোয়ান রুখতে গেল। নীলা বললে, “ভয় নেই তোমার, চুরি করতে আসি নি। একটা কেবল সই চাই। জাগানী ক্লাবের প্রেসিডেণ্ট করব তোমাকে— তোমার নাম আছে দেশ জুড়ে।”

 অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে রেবতী বললে, “ও ক্লাবের আমি তো কিছুই জানি নে।”  “কিছুই তো জানবার দরকার নেই। এইটুকু জানলেই হবে ব্রজেন্দ্রবাবু এই ক্লাবের পেট্রন।”

 “আমি তো ব্রজেন্দ্রবাবুকে জানি নে।”

 “এইটুকু জানলেই হবে, মেট্রপলিটান ব্যাঙ্কের তিনি ডাইরেক্টর। লক্ষ্মী আমার, জাদু আমার, একটা সই বৈ তো নয়।” ব’লে ডান হাত দিয়ে তার কাঁধ ঘিরে তার হাতটা ধরে বললে, “সই করো।”

 সে স্বপ্নাবিষ্টের মতো সই করে দিলে।

 কাগজটা নিয়ে নীলা যখন মুড়ছে দরোয়ান বললে, “এ কাগজ আমাকে দেখতে হবে।”

 নীলা বললে, “এ তো তুমি বুঝতে পারবে না।”

 দরোয়ান বললে, “দরকার নেই বোঝবার।” বলে কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললে। বললে, “দলিল বানাতে হয় বাইরে গিয়ে বানিয়ো। এখানে নয়।”

 রেবতী মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। দরোয়ান নীলাকে বললে, “মাজি, এখন চলে তোমাকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়ে আসিগে।” বলে তাকে নিয়ে গেল।

 কিছুক্ষণ পরে আবার ঘরে ঢুকল পাঞ্জাবী। বললে, “চার দিকে আমি দরজা বন্ধ করে রাখি, তুমি ওকে ভিতর থেকে খুলে দিয়েছ।”

 এ কী সন্দেহ, কী অপমান। বারবার করে বললে, “আমি খুলি নি।”

 “তবে ও কী করে ঘরে এল।”

 সেও তো বটে। বিজ্ঞানী তখন সন্ধান করে বেড়াতে লাগল ঘরে ঘরে। অবশেষে দেখলে রাস্তার ধারের একটা বড়ো জানলা ভিতর থেকে আগল দেওয়া ছিল, কে সেই আগলটা দিনের বেলায় এক সময়ে খুলে রেখে গেছে।

 রেবতীর যে ধূর্ত বুদ্ধি আছে এতটা শ্রদ্ধা তার প্রতি দরোয়ানজির ছিল না। বোকা মানুষ, পড়াশুনো করে এই পর্যন্ত তার তাকত। অবশেষে কপাল চাপড়ে বললে, “আওরত! এ শয়তানি বিধিদত্ত।”

 যে অল্প একটু রাত বাকি ছিল রেবতী নিজেকে বারবার করে বলালে, চায়ের নিমন্ত্রণে যাবে না।

 কাক ডেকে উঠল। রেবতী চলে গেল বাড়িতে।


১২

পরের দিন সময়ের একটু ব্যতিক্রম হল না। চায়ের সভায় চারটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটেই রেবতী গিয়ে হাজির। ভেবেছিল এ সভা নিভৃতে দুজনকে নিয়ে। ফ্যাশনেবল সাজ ওর দখলে নেই। পরে এসেছে জামা আর ধুতি, ধোবার বাড়ি থেকে নতুন কাচিয়ে আনা, আর কাঁধে ঝুলছে একটা পাটকরা চাদর। এসে দেখে সভা বসেছে বাগানে। অজানা শৌখিন লোকের ভিড়। দমে গেল ওর সমস্ত মনটা, কোথাও লুকোতে পারলে বাঁচে। একটা কোণ নিয়ে বসবার চেষ্টা করতেই সবাই উঠে পড়ল। বললে, “আসুন আসুন ডক্টর ভট্টাচার্য, আপনার আসন এইখানে।”

 একটা পিঠ-উঁচু মখমলে-মোড়া চৌকি, মণ্ডলীর ঠিক মাঝখানেই। বুঝতে পারলে সমস্ত জনতার প্রধান লক্ষ্যই ও। নীলা এসে ওর গলায় মালা পরিয়ে দিলে, কপালে দিলে চন্দনের ফোঁটা। ব্রজেন্দ্রবাবু প্রস্তাব করলেন ওকে জাগানী সভার সভাপতি পদে বরণ করা হোক। সমর্থন করলেন বঙ্কুবাবু, চারি দিকে করতালির ধ্বনি উঠল। সাহিত্যিক হরিদাসবাবু ডক্টর ভট্টাচার্যের ইণ্টারন্যাশনাল খ্যাতির কথা ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, “রেবতীবাবুর নামের পালে হাওয়া লাগিয়ে আমাদের জাগানী ক্লাবের তরণী খেয়া দেবে পশ্চিম-মহাসমুদ্রের ঘাটে ঘাটে।”

 সভার ব্যবস্থাপকেরা রিপোর্টারদের কানে কানে গিয়ে বললে, “উপমাগুলোর কোনোটা যেন রিপোর্ট থেকে বাদ না যায়।”  বক্তারা একে একে উঠে যখন বলতে লাগল ‘এতদিন পরে ডক্টর ভট্টাচার্য সায়েন্সের জয়তিলক ভারতমাতার কপালে পরিয়ে দিলেন’ রেবতীর বুকটা ফুলে উঠল— নিজেকে প্রকাশমান দেখলে সভ্যজগতের মধ্যগগনে। জাগানী সভা সম্বন্ধে যে-সমস্ত দাগী রকমের জনশ্রুতি শুনেছিল মনে মনে তার প্রতিবাদ করলে। হরিদাসবাবু যখন বললে, ‘রেবতীবাবুর নামের কবচ রক্ষাকবচরূপে এ সভরা গলায় আজ ঝোলানো হল, এর থেকে বোঝা যাবে এ সভার উদ্দেশ্য কত মহোচ্চ’, তখন রেবতী নিজের নামের গৌরব ও দায়িত্ব খুব প্রবলরাপে অনুভব করলে। ওর মন থেকে সংকোচের খোলসটা খসে পড়ে গেল। মেয়েরা মুখের থেকে সিগারেট নামিয়ে ঝুঁকে পড়ল ওর চৌকির উপর, মধুর হাস্যে বললে, “বিরক্ত করছি আপনাকে, কিন্তু একটা অটোগ্রাফ দিতেই হবে।”

 রেবতীর মনে হল, এতদিন সে যেন একটা স্বপ্নের মধ্যে ছিল, স্বপ্নের গুটি গেছে খুলে, প্রজাপতি বেরিয়ে পড়েছে।

 একে একে লোক বিদায় হল। নীলা রেবতীর হাত চেপে ধরে বললে, “আপনি কিন্তু যাবেন না।”

 জ্বালাময় মদ ঢেলে দিলে ওর শিরার মধ্যে।

 দিনের আলো শেষ হয়ে আসছে, লতাবিতানের মধ্যে সবুজ প্রদোষের অন্ধকার।

 বেঞ্চির উপরে দুজনে কাছাকাছি বসল। নিজের হাতের উপরে রেবতীর হাত তুলে নিয়ে নীলা বললে, “ডক্টর ভট্টাচার্য, আপনি পুরুষমানুষ হয়ে মেয়েদের অত ভয় করেন কেন।”

 রেবর্তী স্পর্ধাভরে বললে, “ভয় করি? কখনো না।”

 “আমার মাকে আপনি ভয় করেন না?”

 “ভয় কেন করব, শ্রদ্ধা করি।”

 “আমাকে?”

 “নিশ্চয় ভয় করি।”  “সেটা ভালো খবর। মা বলেছেন, কিছুতে আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন না। তা হলে আমি আত্মহত্যা করব।”

 “কোনো বাধা আমি মানব না, আমাদের বিয়ে হবেই হবে।”

 কাঁধের উপর মাথা রেখে নীলা বললে, “তুমি হয়তো জানো না, তোমাকে কতখানি চাই।”

 নীলার মাথাটা আরো বুকের কাছে টেনে নিয়ে রেবতী বললে, “তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে এমন কোনো শক্তি নেই।”

 “জাত?”

 “ভাসিয়ে দেব জাত।”

 “তা হলে রেজিস্টারের কাছে কালই নোটিস দিতে হবে।”

 “কালই দেব, নিশ্চয় দেব।”

 রেবতী পুরুষের তেজ দেখাতে শুরু করেছে।

 পরিণামটা দ্রুতবেগে ঘনিয়ে আসতে লাগল।

 আইমার পক্ষাঘাতের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। মৃত্যুর আশঙ্কা আসন্ন। যে পর্যন্ত মৃত্যু না হয় সোহিনীকে তিনি কিছুতে ছাড়বেন না। এই সুযোগটাকে দুহাত দিয়ে আঁকড়িয়ে ধ’রে নীলার উন্মত্ত যৌবন আলোড়িত হয়ে উঠেছে।

 পাণ্ডিত্যের চাপে রেবতীর পৌরুষের স্বাদ ফিকে হয়ে গেছে— তাকে নীলার যথেষ্ট পছন্দ নয়। কিন্তু ওকে বিবাহ করা নিরাপদ, বিবাহোত্তর উচ্ছৃঙ্খলতায় বাধা দেবার জোর তার নেই। শুধু তাই নয়। ল্যাবরেটরির সঙ্গে যে লোভের বিষয় জড়ানো আছে তার পরিমাণ প্রভূত। ওর হিতৈষীরা বলে ল্যাবরেটরির ভার নেবার যোগ্যতর পাত্র কোথাও মিলবে না রেবতীর চেয়ে, সোহিনী কিছুতে ওকে হাতছাড়া করবে না, এই হচ্ছে বুদ্ধিমানদের অনুমান।

 এ দিকে সহযোগীদের ধিক্কার শিরোধার্য ক’রে রেবতী জাগানী ক্লাবের অধ্যক্ষতার সংবাদ ঘোষণা করতে দিলে সংবাদপত্রে। নীলা যখন বলত ‘ভয় লাগছে বুঝি’, ও বলত ‘আমি কেয়ার করি নে’। ওর পৌরুষ সম্বন্ধে সংশয়মাত্র না থাকে এই জেদ ওকে পেয়ে বসল। বললে ‘এডিংটনের সঙ্গে চিঠিপত্র আমার চলে, একদিন এই ক্লাবে আমি তাঁকে নিমন্ত্রিত করে আনব’, ক্লাবের মেম্বরর বললে ‘ধন্য’।

 রেবতীর আসল কাজ গেছে বন্ধ হয়ে। ছিন্ন হয়ে গেছে ওর সমস্ত চিন্তাসূত্র। মন কেবলই অপেক্ষা করছে নীলা কখন আসবে, হঠাৎ পিছন থেকে ধরবে ওর চোখ টিপে। চৌকির হাতার উপর বসে বাঁ হাতে ধরবে ওর গলা জড়িয়ে। নিজেকে এই বলে আশ্বাস দিচ্ছে, ওর কাজটা যে বাধা পেয়েছে সেটা ক্ষণিক, একটু সুস্থির হলেই ভাঙার মুখে আবার জোড়া লাগবে। সুস্থির হবার লক্ষণ আশু দেখা যাচ্ছে না। ওর কাজের ক্ষতিতে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হচ্ছে নীলার মনের এক কোণেও সে শঙ্কা নেই, সমস্তটাকে সে প্রহসন মনে করে।

 দিনের পর দিন জাল কেবলই জড়িয়ে যাচ্ছে। জাগানী সভা ওকে ছেঁকে ধরেছে, ওকে ঘোরতর পুরুষমানুষ বানিয়ে তুলছে। এখনো অকথ্য মুখ থেকে বেরয় না, কিন্তু অশ্রাব্য শুনলে জোর করে হাসতে থাকে। ডক্টর ভট্টাচার্য ওদের খুব একটা মজার জিনিস হয়ে উঠেছে।

 মাঝে মাঝে রেবতীকে ঈর্ষায় কামড়িয়ে ধরে। ব্যাঙ্কের ডাইরেক্টরের মুখের চুরট থেকে নীলা চুরট ধরায়। এর নকল করা রেবতীর অসাধ্য। চুরটের ধোয়া গলায় গেলে ওর মাথা ঘুরে পড়ে, কিন্তু এই দৃশ্যটা ওর শরীরমনকে আরো অসুস্থ করে তোলে। তা ছাড়া নানারকমের ঠেলাঠেলি টানাটানি যখন চলতে থাকে, ও আপত্তি না জানিয়ে থাকতে পারে না। নীলা বলে, ‘এই দেহটার ’পরে আমাদের তো কোনো মোহ নেই, আমাদের কাছে এর দাম কিসের— আসল দামী জিনিস ভালোবাসা, সেটা কি বিলিয়ে ছড়িয়ে দিতে পারি।’ ব’লে চেপে ধরে রেবতীর হাত। রেবতী তখন অন্যদের অভাজন বলেই মনে করে, ভাবে ওরা ছোবড়া নিয়েই খুশি, শাঁসটা পেল না।  ল্যাবরেটরির দ্বারের বাইরে দিনরাত পাহারা চলছে, ভিতরে ভাঙা কাজ পড়ে রয়েছে, কারো দেখা নেই।

১৩

ড্রয়িংরুমে সোফায় পা দুটো তুলে কুশনে হেলান দিয়ে নীলা, মেঝের উপরে নীলার পায়ের কাছে ঠেস দিয়ে বসে আছে রেবতী, হাতে রয়েছে লেখন ভরা ফুলস্ক্যাপ।

 রেবতী মাথা নেড়ে বললে, “ভাষায় কেমন যেন বেশি রঙ ফলানো হয়েছে, এতটা বাড়িয়ে-বলা লেখা পড়তে লজ্জা করবে আমার।”

 “ভাষার তুমি মস্ত সমজদার কিনা। এ তো কেমিস্ট্রি ফরমুলা নয়, খুঁত খুঁত কোরো না, মুখস্থ করে যাও। জানো এটা লিখেছেন আমাদের সাহিত্যিক প্রমদারঞ্জনবাবু?”

 “ঐ-সব মস্ত মস্ত সেণ্টেন্স আর বড়ো বড়ো শব্দগুলো মুখস্থ করা আমার পক্ষে ভারি শক্ত হবে।”

 “ভারি তো শক্ত। তোমার কানের কাছে আউড়ে আউড়ে আমার তো সমস্তটা মুখস্থ হয়ে গেছে— ‘আমার জীবনের সর্বোত্তম শুভ মুহূর্তে জাগানী সভা আমাকে যে অমরাবতীর মন্দারমাল্যে সমলংকৃত করিলেন’,— grand! তোমার ভয় নেই আমি তো তোমার কাছেই থাকব, আস্তে আস্তে তোমাকে বলে দেব।”

 “আমি বাংলাসাহিত্য ভালো জানি নে কিন্তু আমার কেমন মনে হচ্ছে, সমস্ত লেখাটা যেন আমাকে ঠাট্টা করছে। ইংরেজিতে যদি বলতে দাও কত সহজ হয়। Dear friends, allow me to offer you my heartiest thanks for the honour you have conferred upon me on behalf of the Jagani Club—the great Awakener ইত্যাদি- এমন দুটো sentence বললেই বাস্‌—”  “সে হচ্ছে না, তোমার মুখে বাংলা যে খুব মজার শোনাবে— ঐ যেখানটাতে আছে, ‘হে বাংলাদেশের তরুণসম্প্রদায়, হে স্বাতন্ত্রাসঞ্চালনরথের সারথি, হে ছিন্নশৃঙ্খলপরিকীর্ণ পথের অগ্রণীবৃন্দ’ —যাই বলো ইংরেজিতে এ কি হবার জো আছে। তোমার মতো বিজ্ঞানবিশারদের মুখে শুনলে তরুণ বাংলা সাপের মতো ফণা তুলিয়ে নাচবে। এখনো সময় আছে আমি পড়িয়ে নিচ্ছি।”

 গুরুভার দীর্ঘ দেহকে সিঁড়ির উপর দিয়ে সশব্দে বহন করে সাহেবী পোশাকে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ব্রজেন্দ্র হালদার মচমচ শব্দে এসে উপস্থিত। বললে, “নাঃ এ অসহ্য, যখনই আসি নীলাকে দখল করে বসে আছ। কাজ নেই কর্ম নেই, নীলিকে তফাত করে রেখেছ আমাদের কাছ থেকে কাঁটাগাছের বেড়ার মতো।”

 রেবতী সংকুচিত হয়ে বললে, “আজ আমার একটু বিশেষ কাজ আছে তাই—”

 “কাজ তো আছে, সেই ভরসাতেই তো এসেছিলুম, আজ তুমি মেম্বরদের নেমন্তন্ন করেছ, ব্যস্ত থাকবে মনে করে আপিসে যাবার আগে আধ ঘণ্টাটাক সময় করে নিয়ে তাড়াতাড়ি এসেছি। এসেই শুনছি এখানেই উনি পড়েছেন কাজে বাঁধা। আশ্চর্য। কাজ না থাকলে এখানেই ওঁর ছুটি, আবার কাজ থাকলে এইখানেই ওঁর কাজ। এমন নাছোড়বান্দার সঙ্গে আমরা কেজো লোকেরা পাল্লা দিই কী করে। নীলি, is it fair!”

 নীলা বললে, “ডক্টর ভট্‌চাজের দোষ হচ্ছে, উনি আসল কথাটা জোর করে বলতে পারেন না। উনি কাজ আছে বলে এসেছেন এটা বাজে কথা; না এসে থাকতে পারেন না বলেই এসেছেন, এটাই একটা শোনবার মতো কথা এবং সত্যি কথা। আমার সমস্ত সময় উনি দখল করেছেন ওঁর জেদের জোরে। এই তো ওঁর পৌরুষ। তোমাদের সবাইকে ঐ বাঙালের কাছে হার মানতে হল।”

 “আচ্ছা ভালো, তা হলে আমাদেরও পৌরুষ চালাতে হবে। এখন থেকে জাগানী-ক্লাব-মেম্বররা নারীহরণের চর্চা শুরু করবে। জেগে উঠবে পৌরাণিক যুগ।”

 নীলা বললে, “বেশ মজা লাগছে শুনতে। নারীহরণ, পাণিগ্রহণের চেয়ে ভালো। কিন্তু পদ্ধতিটা কী রকম।”

 হালদার বললে, “দেখিয়ে দিতে পারি।”

 “এখনই?”

 “হাঁ, এখনই।”

 বলেই সোফা থেকে নীলাকে আড়কোলা করে তুলে নিলে।

 নীলা চীৎকার করে হেসে ওর গলা জড়িয়ে ধরলে।

 রেবতীর মুখ অন্ধকার হয়ে উঠল, ওর মুশকিল এই যে অনুকরণ করবার কিংবা বাধা দেবার মতো গায়ের জোর নেই। ওর বেশি করে রাগ হতে লাগল নীলার ’পরে, এই-সব অসভ্য গোঁয়ারদের প্রশ্রয় দেয় কেন।

 হালদার বললে, “গাড়ি তৈরি আছে। তোমাকে নিয়ে চললুম ডায়মণ্ডহারবারে। আজ সন্ধের ভোজে ফিরিয়ে এনে দেব। ব্যাঙ্কে কাজ ছিল, সেটা যাকগে চুলোয়। একটা সৎকার্য করা হবে। ডাক্তার ভট্‌চাজকে নির্জনে কাজ করবার সুবিধে করে দিচ্ছি। তোমার মতো অতবড়ো ব্যাঘাতকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াই ভালো, এজন্যে উনি আমাকে ধন্যবাদ দেবেন।”

 রেবতী দেখলে, নীলার ছটফট করবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, নিজেকে সে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টামাত্র করলে না, বেশ যেন আরামে ওর বক্ষ আশ্রয় করে রইল। ওর গলা জড়িয়ে রইল বিশেষ একটা আসক্তভাবে। যেতে যেতে বললে, “ভয় নেই বিজ্ঞানী সাহেব, এটা নারীহরণের রিহর্সল মাত্র— লঙ্কাপারে যাচ্ছি নে, ফিরে আসব তোমার নেমন্তন্নে।”

 রেবতী ছিঁড়ে ফেললে সেই লেখাটা। হালদারের বাহুর জোর এবং অসংকুচিত অধিকার বিস্তারের তুলনায় নিজের বিদ্যাভিমান ওর কাছে আজ বৃথা হয়ে গেল।


 আজ সান্ধ্যভোজ একটা নামজাদা রেস্টোরাঁতে। নিমন্ত্রণকর্তা স্বয়ং রেবতী ভট্টাচার্য, তাঁর সম্মানিতা পার্শ্ববর্তিনী নীলা। সিনেমার বিখ্যাত নটী। এসেছে গান গাইতে। টোস্ট প্রোপোজ করতে উঠেছে বঙ্কুবিহারী, গুণগান হচ্ছে রেবতীর আর তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে নীলার। মেয়েরা খুব জোরের সঙ্গে সিগারেট টানছে প্রমাণ করতে যে তারা সম্পূর্ণ মেয়ে নয়। প্রৌঢ়া মেয়েরা যৌবনের মুখোশ পরে ইঙ্গিতে ভঙ্গিতে অট্টহাস্যে উচ্চকণ্ঠে পরস্পর গা টেপাটিপিতে যুবতীদের ছাড়িয়ে যাবার জন্যে মাতামাতির ঘোড়দৌড় চালিয়েছে।

 হঠাৎ ঘরে ঢুকল সোহিনী। স্তব্ধ হয়ে গেল ঘরসুদ্ধ সবাই। রেবতীর দিকে তাকিয়ে সোহিনী বললে, “চিনতে পারছি নে। ডক্টর ভট্টাচার্য বুঝি? খরচের টাকা চেয়ে পাঠিয়েছিলে, পাঠিয়ে দিয়েছি গেল শুক্রবারে; এই তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কিছু অকুলোন হচ্ছে না। এখন একবার উঠতে হচ্ছে, আজ রাত্রেই ল্যাবরেটরির ফর্দ অনুসারে জিনিসপত্র মিলিয়ে দেখব।”

 “আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন?”

 “এতদিন অবিশ্বাস তো করি নি। কিন্তু লজ্জাশরম যদি থাকে বিশ্বাসরক্ষার কথা তুমি আর মুখে এনো না।”

 রেবতী উঠতে যাচ্ছিল, নীলা তাকে কাপড় ধরে টেনে বসিয়ে দিলে। বললে, “আজ উনি বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন, সকলে যান আগে, তার পরে উনি যাবেন।”

 এর মধ্যে একটা নিষ্ঠুর ঠোকর ছিল। সার আইজাক মায়ের বড়ো পেয়ারের, ওর মতো এতবড়ো বিশ্বাসী আর কেউ নেই, তাই সকলকে ছাড়িয়ে ল্যাবরেটরির ভার ওর উপরেই। আরো একটু দেগে দেবার জন্যে বললে, “জানো মা?— অতিথি আজ, পঁয়ষট্টি জন, এ ঘরে সকলকে ধরে নি, একদল আছে পাশের ঘরে— ঐ শুনছ না হো হো লাগিয়েছে? মাথা-পিছু পঁচিশ টাকা ধরে নেয়, মদ না খেলেও মদের দাম ধরে দিতে হয়। খালি গেলাসের জরিমানা কম লাগল না। আর কেউ হলে মুখ চুপসে যেত। ওঁর দরাজ হাত দেখে ব্যাঙ্কের ডিরেক্টরের তাক লেগে গেছে। সিনেমার গাইয়েকে কত দিতে হয়েছে জানো?— তার এক রাত্তিরের পাওনা চারশো টাকা।”

 রেবতীর মনের ভিতরটা কাটা কইমাছের মতে ধড়ফড় করছে। শুকনো মুখে কথাটি নেই।

 সোহিনী জিজ্ঞাসা করলে, “আজকের সমারোহটা কিসের জন্যে।”

 “ত জানো না বুঝি? অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসে তো বেরিয়ে গেছে, উনি জাগানী ক্লাবের প্রেসিডেণ্ট হয়েছেন, তারই সম্মানে এই ভোজ। লাইফ মেম্বরশিপের ছশো টাকা সুবিধেমত পরে শুধে দেবেন।”

 “সুবিধে বোধ হয় শীঘ্র হবে না।”

 রেবতীর মনটার মধ্যে স্টীম-রোলার চলাচল করছিল।

 সোহিনী তাকে জিজ্ঞাসা করলে, “তা হলে এখন তোমার ওঠবার সুবিধে হবে না।”

 রেবতী নীলার মুখের দিকে তাকালে। তার কুটিল কটাক্ষের খোঁচায় পুরুষমানুষের অভিমান জেগে উঠল। বললে, “কেমন করে যাই, নিমন্ত্রিতেরা সব—”

 সোহিনী বললে, “আচ্ছা, আমি ততক্ষণ এখানে বসে রইলুম। নাসেরউল্লা, তুমি দরজার কাছে হাজির থাকো।”

 নীলা বললে, “সে হতে পারবে না, মা। আমাদের একটা গোপন পরামর্শ আছে, এখানে তোমার থাকা উচিত হবে না।”

 “দেখ্‌ নীলা, চাতুরীর পালা তুই সবে শুরু করেছিস, এখনো আমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবি নে। তোদের কিসের পরামর্শ সে খবর কি আমি পাই নি। বলে দিচ্ছি, তোদের সেই পরামর্শের জন্যে আমারই থাকা সব চেয়ে দরকার।”

 নীলা বললে, “তুমি কী শুনেছ, কার কাছে।”  “খবর নেবার ফন্দি থাকে গর্তর সাপের মতো টাকার থলির মধ্যে। এখানে তিনজন আইনওয়ালা মিলে দলিলপত্র ঘেঁটে বের করতে চাও ল্যাবরেটরি ফণ্ডে কোনো ছিদ্র আছে কিনা। তাই নয় কি, নীলু।”

 নীলা বললে, “তা সত্যি কথা বলব। বাবার অতখানি টাকায় তাঁর মেয়ের কোনো শেয়ার থাকবে না, এটা অস্বাভাবিক। তাই সবাই সন্দেহ করে—”

 সোহিনী চৌকি থেকে উঠে দাঁড়াল। বললে, “আসল সন্দেহের মূল আরো অনেক আগেকার দিনের। কে তোর বাপ, কার সম্পত্তির শেয়ার চাস। এমন লোকের তুই মেয়ে এ কথা মুখে আনতে তোর লজ্জা করে না?”

 নীলা লাফিয়ে উঠে বললে, “কী বলছ, মা।”

 “সত্যি কথা বলছি। তাঁর কাছে কিছুই গোপন ছিল না, তিনি জানতেন সব। আমার কাছে যা পাবার তা তিনি সম্পূর্ণ পেয়েছেন, আজও পাবেন তা, আর-কিছু তিনি গ্রাহ্য করেন নি।”

 ব্যারিস্টর ঘোষ বললে, “আপনার মুখের কথা তো প্রমাণ নয়।”

 “সে কথা তিনি জানতেন। সকল কথা খোলসা করে তিনি দলিল রেজিস্ট্রি করে গেছেন।”

 “ওহে বংকু, রাত হল যে, আর কেন। চলো।”

 পেশোয়ারীর ভঙ্গি দেখে পঁয়ষট্টি জন অন্তর্ধান করলে।

 এমন সময় সুটকেস হাতে এসে উপস্থিত চৌধুরী। বললেন, “তোমার টেলিগ্রাম পেয়ে ছুটে আসতে হল। কী রে রেবি, বেবি, মুখখানা যে পার্চমেণ্টের মতো সাদা হয়ে গেছে। ওরে, খোকার দুধের বাটি গেল কোথায়।”

 নীলাকে দেখিয়ে সোহিনী বললে, “যিনি জোগাবেন তিনি যে ঐ বসে আছেন।”

 “গয়লানীর ব্যাবসা ধরেছ নাকি, মা।”

 “গয়লা ধরার ব্যাবসা ধরেছে, ঐ যে বসে আছে শিকারটি।”  “কে, আমাদের রেবি নাকি।”

 “এইবার আমার মেয়ে আমার ল্যাবরেটরিকে বাঁচিয়েছে। আমি লোক চিনতে পারি নি; কিন্তু আমার মেয়ে ঠিক বুঝেছিল যে ল্যাবরেটরিতে গোয়ালঘর বসিয়ে দিয়েছিলুম— গোবরের কুণ্ডে আর-একটু হলেই ডুবত সমস্ত জিনিসটা।”

 অধ্যাপক বললেন, “মা, তুমি এই জীবটিকে আবিষ্কার করেছ যখন, তখন এই গোষ্ঠবিহারীর ভার তোমাকেই নিতে হবে। ওর আর সবই আছে কেবল বুদ্ধি নেই, তুমি কাছে থাকলে তার অভাবটা টের পাওয়া যাবে না। বোকা পুরুষদের নাকে দড়ি দিয়ে চালিয়ে নিয়ে বেড়ানো সহজ।”

 নীলা বললে, “কী গো সার আইজাক নিউটন, রেজেস্ট্রি আপিসে নোটিস তো দেওয়া হয়েছে, ফিরিয়ে নিতে চাও না কি।”

 বুক ফুলিয়ে রেবতী বললে, “মরে গেলেও না।”

 “বিয়েটা হবে তা হলে অশুভ লগ্নে।”

 “হবেই, নিশ্চয় হবে।”

 সোহিনী বললে, “কিন্তু ল্যাবরেটরি থেকে শত হস্ত দূরে।”

 অধ্যাপক বললেন, “মা নীলু, ও বোকা, কিন্তু অক্ষম নয়। ওর নেশাটা কেটে যাক, তার পরে ওর খোরাকের জন্যে বেশি ভাবতে হবে না।”

 “সার আইজাক, তা হলে কিন্তু তোমার কাপড়চোপড়গুলো একটু ভদ্র রকমের বানাতে হবে, নইলে তোমার সামনে আমাকে আবার ঘোমটা ধরতে হবে।”

 হঠাৎ আর-একটা ছায়া পড়ল দেয়ালে। পিসিমা এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “রেবি, চলে আয়।”

 সুড় সুড় করে রেবতী পিসিমার পিছন পিছন চলে গেল, একবার ফিরেও তাকাল না।