প্রথম সর্গ।

প্রাচীন মরালকুল সন্তরণরেখ,
অজ্ঞতা বশাৎ আমি অবহেলা করি,
বীররসসরোবরে কেলিতে আকাঙ্ক্ষী।
লিপ্তপদ যদি মোরে দিয়া থাকে বিধি,
অবশ্য সাধিব সাধ; নতুবা ডুবিয়া
অতল ভ্রমের তলে, হারাব জীবন!
হায়, মূঢ় আমি; নৈলে, বিস্তারিয়া ক্ষুদ্র
বাহুযুগ, আলিঙ্গনে বাঁধিবারে চাহি,
জগত বিস্তৃত সেই কবিকুল-যশ-
গিরি! অবোধ বালক প্রায়, বশ্মিরজ্জু
ধরি, চাহি উঠিবারে দূর সূর্য্য লোকে!
ক্ষুদ্র মতি-সেক্ত লয়ে সেচিতে উদ্যত
অকুল সাগরবারি লভিতে রতন!
এস গো কল্পনে, তবে এস একবার,
মম শিরে, হ্নদাসনে, ক্ষীণ বুদ্ধি যোগে,
কৌষেয় সূত্রের যোগে চঞ্চলা চপলা
সহাস্যে নাচিয়া যথা নামে ধরা হৃদে!

তোমার প্রসাদে, ক্ষুদ্রবুদ্ধিমানদণ্ড
প্রাদেশ প্রমাণ, লয়ে মাপিতে গো চাহি
আমি আকাশ উচ্চতা; কৃপাকর দাসে!
একদা প্রদোষে বিষ্ণু বসি শ্বেত দ্বীপে,
নারদের বীণা রবে মন মিলাইয়া,
আনন্দে আনন্দময় ভাসিতেছিলেন,
ভাবে গদ গদ; সুখ শিখা সচঞ্চল,
কুতুহল বায়ুপরি উঠিবার লাগি।
প্রফুল্ল পুণ্ডরীকাক্ষ, জ্যোতিরাশি পক্ষে
সম্বরিতে নারি যেন; হেন কালে সেথা
রঙ্গে দেখা দিলা আসি মন্মথজননী,
মন্মথেরে কোলে লয়ে; উথলিয়া মরি,
সুখসিন্ধু শ্রীপতির; উথলে যেমতি
অম্বুনিধিঅম্বুরাশি চন্দ্রমা আগমে!
উল্লাসে আমনি তাঁরে বাহু প্রসারিয়া
প্রেম আলিঙ্গনে হৃদে লইলা কেশব।
কৌস্তুভ রতন মুখ হইল মলিন;
দেখি রমার আদর, কিম্বা রূপ ছটা।
রজনীরে উন্মুখিনী দেখি হেন কালে
দেব ঋষি, প্রণমিয়া শ্রীপতির পদে
বিদায় লভিলা; বীণা বাদনের ভার
দিয়া ভৃঙ্গরাজে। চলি গেলা তবে কাম,



নক জননী কোলে খেলি ক্ষণ কাল।
প্রিয়ার অধর ধরি প্রিয় সম্ভাষণে,
কহিলা মাধব তবে;—"রমে, আজি কেন
সহসা পড়িল মনে তব প্রেম দাসে?—
চকোরেরে সুধাদানে এলো কেন চাঁদ?
হেন ভাগ্যোদয় মোর কেন বা নিরখি?
হাসিয়া কহিলা লক্ষ্মী;—"নাথ, তুমি মোর
হৃদয়আকাশরবি; যেখানে সেখানে
রৈই আমি; মন মোর, ঘুরে তোমা বেড়ি
প্রেমমাধ্যাকর্ষণেতে বদ্ধ হয়ে তব।
চঞ্চলা আমারে লোকে বলে তব লাগি—
থাকিতে না পারি আমি না হেরে তোমায়
ক্ষণ কাল কোন স্থানে; বিশেষতঃ মোরে
সদা জ্বালাতন করে অশান্ত মন্মথ,
তেঁই সে এলাম এবে শ্রীপদ ভেটিতে।
কিন্তু নিবেদন এক আছে প্রাণ নাথ
মোর, ওপদ রাজীবে—কত কাল আর
আবদ্ধ থাকিব বল শুম্ভের আবাসে?
নিজ ভুজ বলে বীর ত্রিলোক বিজয়ী,
শুনিলে তাহার নাম কাঁপে নাকপুরী;
কার সাধ্য ত্রিভুবনে কে বধে শুম্ভেরে?—
না মরিলে দৈত্যরাজ ছাড়িতে না পারি,

তারে আমি, বিনা দোষে কেমনে ছাড়িব?
কত সমাদরে মোরে পূজে দৈত্যপতি,
কেমনে বর্ণিব দেব? আমার পূজার
উপচার লাগি বীর স্বপনে ধেয়ানে।
কিন্তু এক স্থানে তবু থাকিতে না পারি
বদ্ধ হয়ে; মধুকর ভাবয়ে কি সুখ
শতদল দলমাঝে আবদ্ধ হইলে?—
অচলা করেছে শুম্ভ চঞ্চলা আমারে।
উপায় বিধান এর কর প্রাণনাথ,
কারাগার মুক্ত মোর কর দয়া করি,
স্বাধীনতা পক্ষ দাও উড়িতে সংসারে,—
আশ্রয়িতে নব নব পাদব পল্লবে,
নূতন নূতনে মন সদা অভিলাষী!"
নীরবিল সুধা বর্ষি কমলবাসিনী।
শুনিয়া রমার বাণী কহিলা রমেশ;—
"প্রিয়ে সত্য, যা বলিলে দুর্ম্মদ দানব
বীর দর্পে ত্রিভুবন করিয়া বিজয়,
আবদ্ধ রেখেছে তোমা বহু দিন হতে;
পরাণ থাকিতে কভু ছাড়িবে না আর।
নিরীহ অমরগণ স্বাধীনতা ধন,
লইয়াছে কাড়ি, যোরে; সহস্র লোচন
মুদিয়াছে ইন্দ্র, লাজে, মেলে নাক আর।

দেব গণ দুখে আমি সদাই কাতর।
কিন্তু কিবা করি বল? হাত নাহি মোর—
সংসার পালন আমি করি রজ গুণে;
কেমনে হইব বল প্রাণী নাশ হেতু?
না মরিলে দৈত্যরাজ নাহিক নিস্তার
তব, নাহিক নিস্তার অমর গণের।
বিরূপাক্ষ প্রিয় সেই দৈত্যকুল পতি;
তম গুণী রুদ্রেশ্বর না বধিলে তারে,
কার সাধ্য কেবা বধে?—যাও তুমি তবে
ইন্দ্রালয়ে একবার; বলগে ইন্দ্রেরে,
তিনি, অগ্নি, বরুণাদি দেবগণে লয়ে,
তুযুণ কৈলাসে গিয়া গিরীশ গৌরীরে।
রণ প্রিয় গিরিবালা অবশ্য তখনি,
দিবেন তাঁহার বাক্যে অনুকূল কাণ।
করবার করে দেবী ধরিবেন ত্বরা।
ভকত জনের নাশে যদ্যপি ত্রিশূলী
না হন প্রিয়ার পক্ষ, অবশ্য বিপদে,
রক্ষিবেন তাঁরে, রোষ অবশ্য জন্মিবে,
হেরিলে গৌরীর তনু ক্ষত শুম্ভ বাণে।
রোষিলে ধূর্জ্জটি, রণে, মরিবে নিশ্চয়
দুর্ম্মদ দানব;—দেবগণ রক্ষা পাবে;
মুক্ত হবে তুমি চির কারাগার হতে।”

নীরবিলা নারায়ণ এতেক কহিয়া।
শুনিয়া পতির বাণী প্রফুল্ল অন্তরে,
কহিলা কমলা;—"তবে কি কাজ বিলম্বে
নাথ, দেহ আজ্ঞা যাই এখনি ত্রিদিবে!
পাঠাইগে দেবরাজে দেবগণ সহ
কৈলাস শেখরে; তব বাক্যে উত্তেজিত
করিগে তাদের আমি অবসন্ন তেজ;
জ্বলুক ত্যজিয়া ধূম বাতাসে অনল।”
এতেক কহিয়া লক্ষ্মী বিদায় মাঙিলা
ধরিয়া পতির কর;—স্নেহে হৃষীকেশ,
গাঢ় প্রেম আলিঙ্গনে বিদাইলা তাঁরে,
স্মরণার্থে গণ্ডে দিয়া চুম্বনের রেখ।
চলিলা বিমানে রমা; উড়ি চলে যেন,
কেশববাসনাযুড়ি মনরজ্জু লয়ে!
হেথা বৈজয়ন্ত ধামে বসি দেব রাজ,
দেবগণে লয়ে, মুখ ম্লান অবনত;
সহস্র লোচন অর্দ্ধ মুদিত বিষাদে;
পঙ্কজ নিকর যেন দিবা অবসানে!
বামে শচী, মনোরমা, ত্রিদিব ঐশ্বর্য্য,
বাসবের চিন্তা কূপ, সুখের সাগর,
ম্লান মুখী, স্মের মুখী, আহা মরি এবে,
প্রভাত চন্দ্রিকা সম, পতির দুখেতে!



নাচিছে অপ্সরীগণ দোলাইয়া হাত,
ভাবের হিল্লোলে যেন ভাসায়ে মৃণাল।
বাজায় বিপঞ্চী কেহ জলদ অভ্যাসে,
করতালী দিয়া কেহ তাহে দেয় তাল।
সুললিত তানে কেহ দ্রবিতেছে বায়ু,
ইন্দ্রিয়ে করিছে স্থির, মানসে চঞ্চল।
সুখসরে ভাসে সবে,—কি চিন্তা তাদের?
আপদ বিপদ আছে আছে দেবরাজ।
হেন কালে দেখা দিলা তথা পদ্মালয়া;
মধুর শিঞ্জন বোলে নীরবিয়া মরি,
অপ্সরী গণের সুখ বাদিক্র আতোদ্য!
বিস্ময়ে মেলিলা ইন্দ্র সহস্র লোচন;
ফুটিল কদম্ব যেন গাছ আলো করি।
সসম্ভ্রমে উঠি ত্বরা সিংহাসন ছাড়ি,
দূরে দাঁড়াইলা। লক্ষ্মী বসিলা আসনে,
বসিলা তাহার পরে স্বতন্ত্র আসনে,
সুরপতি; করযোড়ে, কহিলা বিনয়ে;—
“মাতঃ, কি হেতু আজি এত কৃপা দাসে
পুণ্য ফল কিছু মোর আছে নাহি জানি;—
স্বর্গ আধিপত্য এ ত বিড়ম্বনা মাত্র!
যে দুখে আছি জননি, কি বলিব তাহা;
অবিদিত কিছু নাহি ওপদ পল্লবে।



দিতিসুত অপমান সব আর কত,
অধীনতা ভার আর বহিতে না পারি!।”
দীর্ঘশ্বাসে দেবরাজ নামাইলা মুখ।
কহিতে লাগিলা রমা;—"সব জানি আমি;
কি আর বলিবে মোরে, শক্র! দেব দুখে,
সদা দহে মন মোর; কিন্তু কিবা করি?
ছাড়িতে না পারি শুম্ভে; কত সমাদরে
পূজে মোরে দৈত্যরাজ, কেমনে বলিব
হে অমর নাথ! কিন্তু সেই পূজা আর
ভাল নাহি লাগে; চিরবদ্ধ এক স্থানে
থাকিতে না পারি আর—চঞ্চলা চপলা,
দেখ, মেঘে মেঘে ফেরে—আমিও চঞ্চলা।
ছেড়েছি ত্রিদশালয় কত দিন হতে
বলিতে না পারি। সদা বাসনা অন্তরে,
খেলিতে কৌমুদী সম প্রমোদ হিল্লোলে,
সুখ সরোবর এই অমর নিবাসে।
তেকারণে আসি আজি শ্রীধর সমীপে,
শ্বেত দ্বীপে, মনোদুখ বিবরিয়া তাঁরে
বলিলাম, বলিলাম তোমা সব দুখ।
দেখিলাম দেবদুখে তিনিও কাতর।
তোমা সবা লাগি খেদ করিলেন কত।
পাঠালেন মোরে হরি তব সন্নিধানে।

যাও তুমি তবে ইন্দ্র, কৈলাশে বারেক
হরগৌরী পাশে—লয়ে দেবগণে সাথে।
জানাইয়া নিজ দুঃখ, তুষ গিয়া স্তবে
ভবেশ ভবানী দোহে। অবশ্য উদিবে
দয়া, তোমা সবা দুঃখে, করুণাময়ীর!—
জান ত তাঁহারে, তিনি, রণ-উন্মাদিনী।
অধীরা হবেন দেবী সমরের আশে,
শুনিলে তোমার বাণী; করবার করে
ধরিবেন ত্বরা ভীমা তোমাদের লাগি।
ভকত জনের নাশে যদি শূলপাণি
না দেন সমরে হাত, অবশ্য সঙ্কটে,
সহায় হবেন আসি নিজ জীবিতের।
বিরূপাক্ষ হলে বৈরি কে আর রক্ষিবে
দনুজঈশ্বরে রণে; মরিবে নিশ্চয়,
অসুর কুলের সহ দেবকুলঅরি।
বাঁচিবা তোমরা সবে মুক্ত হব আমি
চির কারাগার হতে।” নীরবিলা রমা।
শুনিয়া পদ্মার বাণী প্রফুল্ল নয়নে
সাহস বিস্ফীত মনে উঠিয়া বসিলা,
সহস্র লোচন; মরি বীজ গতাঙ্কুর,
চেতন হইলা যেন সুবৃষ্টি পাইয়া!
প্রেম গদ গদ ভাবে লাগিলা ভাষিতে;—

"মাতঃ! কি চিন্তা মোদের আর? যদি দয়া
হয়গো তোমার, দেব গরুড়ধ্বজের।
দুর্ব্বাশার কাল শাপ নিবাইলা যবে,
খনির আলোক সম স্বর্গালোক তোমা,
কত দুঃখ ভুঞ্জিলাম পড়ে অন্ধকূপে
কি আর বলিব মাতঃ, পশিলে গো তুমি,
অগাধ সলিল তলে; শ্রীভ্রষ্ট হইলা,
(এবে যথা) স্বর্গ-পুরী। সেবারো মোদের,
কৃপা করি নিস্তারিলা দেব চক্রপাণি;
ক্ষীরোদ সাগর মন্থি উদ্ধারি তোমায়,
স্থাপি স্বর্গ-পুরে; স্বর্গ, শোভে ছিল পুনঃ,
শারদ নভস্‌ সম সুখ মেঘ রাগে।
সদয় হইয়া যদি দেবগণ দুঃখে,
জননি, আইলা হেথা, অনুগ্রহ করি,
দয়ার উপরে দয়া করি আর বার,
চল লয়ে আমাসবে কৈলাস শেখরে;
তোমা সহ গেলে মাতঃ, পাইব প্রসাদ
হরগৌরী পাশে; মণি সহযোগে সূত্র
উঠে গলদেশে; এই নিবেদন মোর।”
কহিলা ক্ষীরোদ বালা মৃদু মধু হাসি;—
"আমি গেলে হয় যদি হে ত্রিদিব পতি,
যাই চল তবে! দেখা করে আসি গিয়ে,

জগতজননী সহ এই উছিলায়।
বিলম্বে কি ফল আর, সাজ ত্বরা করি;
ঊষার আগমে আমি থাকিতে নারিব
কোথা; প্রভাতে পূজিবে মোরে, দৈত্যপতি
"এই ত বিমান রথ প্রস্তুত জননি,
দেবগণ উপস্থিত;” (কহিলা বাসব);
"বরাঙ্গ তুলুন আগে; দেবগণে লয়ে,
অনুগামী হইতেছি আমি আপনার।”
কোমল মন্থর গতি উঠিলা বিমানে,
মাধব-মানস-ছবি; উদিলা প্রভাতি—
তারা ঊষার ললাটে যেন! চালাইলা
রথ, ঘর্ঘরে মাতলি; চক্রের রগড়ে,
বিদ্যুত ঝলিলা, অগ্নি; মৃদু আন্দোলনে,
দুলিতে লাগিল অঙ্গ, প্রেমের লহরী,
শিঞ্জীতে বাজিল ভূষা অঙ্গেতে রমার।
স্ব স্ব জানে চড়ি দেব চলিল পশ্চাদে।
নিশীথ এবে কৈলাসে; বিরাজে চন্দ্রমা,
সম্রাট কিরীট সম হিমাচল শিরে।
তোষিছেন আশুতোষ প্রেমজ কৌতুকে
গিরিজায়, ভাসিছেন পতির আদরে,
প্রেমের হিল্লোলে, গৌরী; নাহি নিদ্রা—বৃথা
প্রণয়ী জনের পাশে তাহার যতন!

সুষুপ্ত সংসার আর; নিস্তব্ধ জগৎ!—
কেবল পবন মাত্র একাকী প্রহরী,
চন্দ্রিকা আলোক করে ফেরে কুঞ্জে কুঞ্জে,
মকরন্দ করি সংখ্যা—কত বা লুটেছে,
দুষ্ট মধুকর দল, রবির সহায়ে,
কতবা মজুত এবে, কুসুম কোষেতে।
সরসে কুমুদ কুল হাসিছে নীরবে;
যুগল চাঁদেরে দেখি প্রেমে মুগ্ধ তার;—
বিস্মিত নয়নে এক, চাহে শূন্য হতে,
আবেশে চঞ্চল আর, তরল সলিলে।
কতক্ষণে দেখা দিলা কমল আলয়া
সেথা, দেবগণে লয়ে; সসম্ভ্রমে দ্বার
ছাড়িলা তাঁহারে নন্দী, রঙ্গে বিনোদিনী
চলিলা; দেখিলা তাঁরে দূরে হরজায়া—
অমনি উঠিয়া সতী বিস্তারিয়া বাহু,
আলিঙ্গিতে কমলারে আইলা ধাইয়া।
নমিলা গৌরীরে, লক্ষ্মী; সাদরে চুম্বিলা
গৌরী, হরিপ্রিয়, শির! মরি, সে চুম্বনে
প্রফুল্ল হইল মুখ সুখে কমলার;
কৌমদী চুম্বনে যেন কুমুদ কলিকা!
ভবেশের পদে গিয়া নমিলা ইন্দিরা;
নমিলা তাহার পরে হরগৌরীপদে,

ইন্দ্রাদি অমরগণ। আদেশিলা হর,
বসিতে সবারে। লক্ষ্মী বসিলা আসনে।
বসিলা বাসব, বায়ু, বরুণ সকলে;—
বসিলা চাঁদের হাট যেন সে কৈলাসে।
প্রিয় সম্ভাষণে গৌরী কহিলা রমায়;—
"এত রাতে কেন বাছা দেবগণে লয়ে?—
কি অসুখ হলো পুনঃ? সুখেতে অসুখ
তব, দেখি চিরকাল (চঞ্চলা স্বভাব)।”
"চঞ্চল স্বভাব মাতঃ, সুধু নহে মোর,”
(কহিলা কেশব জায়া) “স্বভাবই চঞ্চল!
সুখেতে অসুখ মোর কহিলে জননি,
কিন্তু দেখ নাক চেয়ে সে সুখ আমার
কি রকম; রৌদ্র তাপে যদিচ পীড়িত
নহে, কুপ বদ্ধ বারি, তবে কেন উহা
মলিন, দূষিত, ঘৃণ্য কীটের নিবাস?
পুনঃ দেখ সেই বারি আতপে তাপিত,
তথাপি বিমল, যদি ফেরে দেশে দেশে,
প্রবল প্রবাহভরে, রঙ্গে তরঙ্গিণী!
সুখেতে আছিগো সত্য, কিন্তু সেই সথে
মন নাহি ভেজে আর; থাকিতে না পারি
চিরকাল বদ্ধ আর শুম্ভের আবাসে।
রাতে না আসিয়া বল আসিই বা কখন?—

অবকাশ নাহি মোর;—সারা দিন পূজে
দনুজ ঈশ্বর মোরে—তেঁইসে এলাম
রাতে; না হোতে প্রত্যূষ, যেতে হবে পুনঃ।
এইত আমার সুখ, কারাবাসী প্রায়—
মরুক আমার ভাগ্যে যা থাকে তা হোক,
দেবগণদুঃখ আর দেখিতে না পারি।
একেত অসুররাজ প্রবল প্রতাপ,
রণব্যস্ত, রণ ভিন্ন থাকিতে না পারে,
তাহাতে আবার আছে শিবের সোহাগ;
মরণের ভয় এক তাও নাহি তার,
কাযে কাযে। দেবগণে দলিছে দানব
অপমানে সদা। দেখ সে প্রফুল্ল মুখ,
নাহি আর কার; মরি, ম্লান অবনত
ঘোর দুঃখ ভারে; নব তেজী তরু যেন,
জীর্ণ জড় সড়, মহা বিষবল্লী চাপে!
মুখে কি বলিব মাতঃ, দেখ বিদ্যমান
দেবগণদুখ; মনে উচ্ছ্বসিত হয়ে,
বহিতেছে যাহা সদা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা।
তোমারই রক্ষিত এই অমর নিকর,
তোমারই হেলায় এরা ভুঞ্জে এত দুঃখ!"
নীরবিলা পদ্মালয়া এতেক কহিয়া।
আরম্ভিলা তবে ইন্দ্র বিনীত বচনে;—

"কি আর বলিব মাতঃ, যে দুঃখেতে আছি,
বলিতে না সরে বাক্‌; কেমনে সরিবে?—
দুখের অর্গলে সদা রুদ্ধ বাকদ্বার!
মরমে মরিয়া মোরা আছিগো জননি।
দেখ বরুণেরে, বায়ু, অগ্নি আদি সবে,
তেজোহীন; অহি যেন হীমের প্রভাবে;
দুর্দ্দান্ত দানব ডরে জড় সড় সবে!
মেলিতে না পারি গাত্র অসীম সংসারে
মোরা; সঙ্কুচিত হয়ে রব কত কাল?
অমর না হলে মাতঃ, তেজিয়া পরাণ
এড়াতাম এ যন্ত্রণা! করিলে আমর
কেন? কেন বা ইন্দ্রত্ব দিয়া স্বর্গরাজ্যে,
এবে এ লাঞ্ছনা? দিতে বিষম আঘাত,
উচ্চদেশে তুলি কিগো দিলা শেষে ফেলি?
ইহাই কি ছিল মনে জগতজননি?
উগ্রচণ্ডা তুমি মাতঃ, দানবদলনী;
মহাকাল বিশ্বম্ভর; কোথা সে নামের
গুণ? তেজেছ কি দোহে নিজঽ ধর্ম্ম,
মোদের দুর্ভাগ্য লাগি? কোথা সেই শক্তি?
(শক্তি তুমি,) কোথা সেই তেজ? মন্দীভূত
এবে কি তা, সে শুম্ভের সোভাগ্যের তেজে?
মোদের লাঞ্ছিছে দৈত্য তোমা বিদ্যমানে;

তব অনুগত মোরা; আজন্ম সেবিয়া,
ও কমল পদ, শেষে, এই হলো ফল?
ভাসাইলে দুঃখনীরে, অকূল অপার?
তোমার আশ্রয় তবু লইলাম শেষে—
দেখি কি তোমার ধর্ম্ম; বাঁচি কি না বাচি
হেজল বৃক্ষেতে নৌকা বাঁধিয়া তুফানে।”
নীরবিলা ইন্দ্র; আর দেবগণ, তারা
কি আর বলিবে মুখে, ইন্দ্রিয়ের দ্বার
খুলি দেখাইল সবে, মনের যাতনা।
চঞ্চল হইলা চণ্ডী ইন্দ্রের কথায়।
ক্রোধে উলাঙ্গিয়া অসি অমনি উঠিলা।
বক্ষে করাঘাত করি কহিলা সরোষে;—
"কার সাধ্য, কেবা স্পর্শে মমরক্ষ জনে—
হেন সাধ্য কার?—অসি ধরিলাম এই
দৈত্যকুল কালরূপে। কে নিবারে আমা?
এখনি যাইব যুদ্ধে, এখনি সদর্পে
দৈত্যপতি গর্ব্ব খর্ব্ব করিব আহবে।
দেখিব তাহার বক্ষে কতই সাহস,
বাহুদ্বয় কত বল ধরে বা তাহার।”
কহিলা রুদ্রেরে সতী;—"দেহ অনুমতি
নাথ, যাইব সমরে; বিনাশি শুম্ভেরে
নিবারি দেবের দুখ সুস্থিরি জগত!

ছাড় সে দৈত্যের মায়া মোর অনুরোধে;
প্রকাশহ নিজগুণ, (তমগুণী তুমি)
ভুল না আপন কায হয়ে ভোলানাথ।
কি দোষে হইল দোষী অমর নিকর
তব পাশে?—কেন এত নিদয় তাদের?
একাকী কি শুম্ভ তোমা করে থাকে পূজা?
দেবগণ পূজে নাক?—এত দুখ, দেবে
কেন দেয় তবে দৈত্য, তোমার সোহাগে?
দেহ অনুমতি মোরে, বিলম্ব না সয়,
দেখিতে না পারি আর দিববাসী দুখ।”
সম্বরিলা জিহ্বা সতী; সম্বরিতে তবু
নারিলা মনের তেজ; আঁখিত্রয় দিয়া
ঝলিতে লাগিল উহা রশ্মি রেখা সম,
প্রফুল্ল কমলআঁখি সহস্র আঁখির।
স্তম্বিত হইয়া হর কহিলা উমারে;—
"যা ইচ্ছা তোমার কর গণেশজননি
আমি নাহি জানি কিছু; রক্ষণকর মোরে,
উভয় সঙ্কটে। সত্য, দুর্ম্মদ দানব,
আমার আদরে দলে নিরীহ দেবেরে।
দেবগণও প্রিয় মোর; কিন্তু কি বা করি,
ভক্তের বিনাশ হেতু কেমনে হইব?
নিজ ধর্ম্ম ভুলি আমি আছি সে কারণে;

যা ইচ্ছা তোমার কর—স্বাধীনতা আমি
দিলাম তোমারে, লতে মোর অনুমতি
হবে নাক আর; হও ইচ্ছার অধীনা।”
দেবগণ পানে চাহি তবে কৈলা সতী;—
"হে ত্রিদিববাসীগণ ত্রিদিবের শোভা,
যাও নিজ স্থানে, ত্যজি সে দৈত্যের ত্রাস।
ধরিলাম অসি আমি তোমাদের লাগি,
দৈত্যকুল বিনাশিতে, শান্তিতে সংসার।
মোহিনী মূরতি ধরি রব আমি গিয়া
শুম্ভের প্রমোদবনে। দূতগণ তার
অবশ্য হেরিবে মোরে সে মোহিনী বেশে,
জানাবে তখনি শুম্ভে মোর রূপ কথা,
আকুল পরাণ তার হইবে নিশ্চয়,
মোর লাগি। মোর তরে পাঠাইবে দূত।
করিব দূতের পাশে এই দৃঢ়পণ,
সমরে জিনিবে যেই বরিব তাহারে।
অবশ্য বিগ্রহহেতু ঘটিবে ইহাতে।
যাও, দেবগণ, তবে যাও নিজ স্থান,
ত্যজিয়া শুম্ভের ভয়, নাহি ভয় আর।”
নীরব হইলা চণ্ডী এতেক কহিয়া।
প্রেম গদগদ ভাবে, গৌরীপদে তবে
নমিলা অমরকুল; শোভিল চরণ,

রতন ঘুঙ্ঘুরে যেন দেব শিরমালে।
শঙ্করের পদে আসি নমিলা সকলে।
উঠিলা ক্ষীরোদবালা—মৃদু মধু হাসি
কহিলা উমারে;—"মাতঃ, দেহ অনুমতি
যাই শুম্ভালয়ে—দেখ, সচেতন ঊষা,
নয়নপ্রভাতিতারা মেলিয়া চাহিছে,
চারি দিক পানে, যেন আমায়খুঁজিতে।
থাকিতে না পারি আর; দেহ মা বিদায়।
সিদ্ধ যদি মনস্কাম হয় গো জননি,
ও পদ ছেরিব পুনঃ। নমিলা ইন্দিরা
শঙ্কর শঙ্করী পদে নমাইয়া শির;
দৃষ্টিব্যাপিকা রেখায়, মরি যেন নত
চাঁদ! বিদাইলা গৌরী চঞ্চলা বালারে,
প্রেম আলিঙ্গনে সুখে অধর চুম্বিয়া।
চলি গেলা দেবগণ নিজ নিজ স্থানে।

ইতি দানব দলন কাব্যে সংক্ষিপ্ত সূচনা

নামক প্রথম সর্গ।