দায়ে খুন/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ॥
বালমুকুনের কথাগুলি আমি সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিলাম। তাহার কথাগুলি শেষ হইয়া গেলে, আমি সমস্ত অবস্থাগুলি একবার উত্তমরূপে ভাবিয়া দেখিলাম; কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। একবার ভাবিলাম, যে ব্যক্তি অগ্রিম বেতন একশত টাকা প্রদান করিয়াছে, অথচ বালমুকুনের নিকট হইতে একটামাত্র পয়সাও গ্রহণ করে নাই, সে যে উহার সহিত জুয়াচুরি করিতেছে, একথা কিরূপেই বা বিশ্বাস করিতে পারি? অথচ যে ব্যক্তি নিজ হইতে অগ্রিম বেতন দিয়া বালমুকুন্কে তাহার কার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহাকে কোন কার্য্যে নিযুক্ত না করিয়া সামান্য সামান্য কার্য্যের ভান করিয়া কেবলমাত্র সময় অতিবাহিত করিতেছেন, তাঁহার মনে একবারেই যে কোনরূপ দুরভিসন্ধি নাই, তাহাও সহজে বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা করে না। অথচ ইহার ভিতর একটী নূতন কথাও শুনিতেছি। এ পর্য্যন্ত আমি কখন শুনি নাই যে, সরকারী বা ব্যবসাদারী কোন আফিসে কি কোন ফারমে প্রত্যেকমাসে অগ্রিম বেতন দেওয়ার নিয়ম আছে। এরূপ অগ্রিম বেতন প্রদান করার অর্থই বা কি, তাহাও বুঝিয়া উঠা নিতান্ত সহজ নহে। যে ব্যক্তি মাণিকচাঁদ নামে আত্ম-পরিচয় প্রদান করিতেছে, সে লোকটাই বা কে, তাহা একবার দেখিলে কোন ক্ষতি নাই। তাহাকে স্বচক্ষে দেখিলে ও তাহার সহিত দুই চারিটী কথা কহিলেও, সে যে কি চরিত্রের লোক, অথবা ইহার মধ্যে তাহার কোন দুরভিসন্ধি আছে কি না, তাহাও বোধ হয়, অনেকটা অনুমান করিয়া লওয়া যাইতে পারিবে।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি বালমুকুন্কে কহিলাম, “আপনি যাহা যাহা কহিলেন, তাহার সমস্ত আমি শ্রবণ করিয়াছি। কিন্তু কি নিমিত্ত যে, এইরূপ বন্দোবস্ত হইতেছে, তাহার কিছুই আমি স্থির করিতে পারিতেছি না। আমার বোধ হয়, আমি যদি স্বচক্ষে তাহাকে একবার দেখিতে পাই, এবং তাহার সহিত দুই চারিটী কথাবার্ত্তা কহিতে পাই, তাহা হইলে তাহার সম্বন্ধে আমি অনেকটা মতামত প্রকাশ করিতে সমর্থ হইব।”
বালমুকুন্। আমি ত কল্য পুনরায় সেই স্থানে গমন করিব। আপনি কেন একবার সেই সময় আমার সহিত চলুন না? তাহা হইলে ত তাহার সহিত আপনার অনায়াসেই সাক্ষাৎ হইতে পারিবে?
আমি। আমি কি বলিয়া সেই স্থানে গমন করিব? আর যদি আমাকে তাহার সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে না দেয়?
বালমুকুন্। প্রবেশ করিতে না দিবার ত কোন কারণ দেখিতেছি না। আজকাল আমি বিনা-সংবাদে যেমন একবারে তাহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করি, কল্যও সেইরূপ ভাবে একবারে তাহার সেই ঘরের ভিতর চলিয়া যাইব। আপনিও কাহাকেও কিছু না বলিয়া, আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিবেন। তাহা হইলেই তাহার সেই ঘরে প্রবেশ করিবার নিমিত্ত নিষেধ করিতে সে আর কোনরূপে সময় পাইবে না। সুতরাং অনায়াসেই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে।
আমি। আচ্ছা, যেন তাহাই হইল, আমি আপনার পশ্চাৎ পশ্চাৎ মাণিকচাঁদের ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। তাহার পর, যখন সে জিজ্ঞাসা করিবে, আমি কে, এবং কি নিমিত্তই সেই স্থানে গমন করিয়াছি, তখন আমি তাহাকে কি উত্তর প্রদান করিব?
বালমুকুন্। উত্তর করিবার আর ভাবনা কি? আপনাকে কোন কথা কহিতে হইবে না, আমিই তাহার কথার উত্তর প্রদান করিব। আমি কহিব, “ইনি আমার একজন বিশ্বাসী বন্ধু। তাই ইনি আমার নূতন মনিবের সহিত আলাপ-পরিচয় করিবার মানসে আমার সহিত আগমন করিয়াছেন।”
আমি। এরূপ পরিচয় প্রদান করিলে চলিবে না। কারণ, তাহার মনে যদি প্রকৃতই কোনরূপ দুরভিসন্ধি থাকে, এবং আমার সহিত কথাবার্ত্তা কহিতে তাহার আন্তরিক ইচ্ছা না থাকে, তাহা হইলে এক কথাতেই তিনি আমাকে বিদায় করিয়া দিতে পারেন। তাহা হইলে আমরা কিরূপে আমাদিগের অভিসন্ধি পূর্ণ করিতে সমর্থ হইব?
বালমুকুন্। এক কথায় তিনি আমাদিগকে কিরূপে বিদায় করিবেন?
আমি। তিনি অনায়াসেই বলিতে পারেন, ‘এখন আমি নানানরূপ কার্যগতিতে অতিশয় ব্যস্ত; সুতরাং এই সময় আপনার বন্ধুর সহিত যে দুইদণ্ডকাল কথাবার্ত্তা কহিব, বা তাহার সহিত আলাপ-পরিচয় করিব, সে সময় ত এখন আমার নাই। আমার অবকাশমত সংবাদ পাঠাইয়া দিলে, তিনি যেন অনুগ্রহপূর্ব্বক একবার আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। সেই সময় আমি অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত ইহার সহিত আলাপ-পরিচয় করিতে সমর্থ হইব।’ এরূপ প্রথমেই যদি তিনি বলিয়া ফেলেন, তাহা হইলে বলুন দেখি, আমি আর কতক্ষণ সেই স্থানে দাঁড়াইতে পারিব? তখনই আমাকে তাহার সেই ঘর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতে হইবে।
বালমুকুন্। তাহা ত প্রকৃত। তাহা হইলে এখন অন্য কি উপায় অবলম্বন করিলে, আপনাকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে পারি? আপনি সে বিষয়ে কিরূপ পরামর্শ দেন?
আমি। আমার বোধ হয়, এক উপায় অবলম্বন করিলে, তাহার সহিত দুই চারিটী কথা হইলেও হইতে পারে।
বালমুকুন্। কি উপায়?
আমি। আপনি যেরূপ কহিলেন, সেইরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, আমি আপনার সহিত তাহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিব। আমি কে, জিজ্ঞাসা করিলে, আপনি তাহাকে এই বলিতে পারেন, ‘ইনি আমার একজন বন্ধু, এবং ব্যবসা-কার্য্যে ইনি অতিশয় পারদর্শী; কিন্তু আজকাল ইনিও বেকার অবস্থায় বসিয়া আছেন। বঙ্গদেশের নানাস্থানে যে সকল শাখা-কার্য্যালয় স্থাপন করিতে হইবে, তাহার নিমিত্ত যে অনেক লোকের প্রয়োজন হইবে, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাহারই নিমিত্ত আমি ইহাকে আপনার নিকট আনয়ন করিয়াছি, ইহাকে আপনি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখুন, এবং ইহার দ্বারা কার্য্য-নির্ব্বহ হইতে পারিবে, এরূপ যদি আপনি বিবেচনা করেন, তাহা হইলে ইহাকে আপনি অনায়াসেই নিযুক্ত করিতে পারেন। ইহাকে বিশ্বাস করা, বা ইহার হস্তে অর্থাদি প্রদান করা সম্বন্ধে কোনরূপ চিন্তা করিবার প্রয়োজন নাই, সে সম্বন্ধে আমি নিজেই উঁহার জামিন থাকিতে প্রস্তুত আছি।’
“আমার বিবেচনায় যদি আপনি তাহাকে এইরূপে আমার পরিচয় প্রদান করেন, তাহা হইলে হয় ত তিনি আমার সহিত দুই চারিটী কথা কহিলেও কহিতে পারেন। আর যদি ইহাতেও তিনি আমার সহিত কোনরূপ আলাপ-পরিচয় না করেন, তাহা হইলে তখন উপস্থিত মত যেরূপ বিবেচনা হয়, সেইরূপই করা যাইতে পারিবে।”
আমার কথা শুনিয়া বালমুকুন্ কহিল, “আচ্ছা মহাশয়? তাহাই হইবে; আপনি যেরূপ বলিলেন, আমি সেইরূপই করিব। এখন অনুগ্রহ করিয়া আপনাকে কল্য আমার সহিত গমন করিতেই হইবে। কল্য যে সময় আমি তাঁহার নিকট গমন করিব, তাহার পূর্ব্বে আমি আপনার নিকট আসিয়া, আপনাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব। আপনার ন্যায় কোন ব্যক্তি যদি এ বিষয়ে আমাকে সাহায্য না করেন, তাহা হইলে ইহার প্রকৃত অবস্থা বুঝিয়া লওয়া আমাদিগের ন্যায় ব্যক্তির কার্য্য নহে।”
এরূপ কার্য্য যদিও আমাদিগের কর্ত্তব্য কার্য্যের মধ্যে পরিগণিত নহে; তথাপি ইহার ভিতর কোন দুরভিসন্ধি আছে কি না, তাহা জানিয়া লইবার নিমিত্ত আমারও ইচ্ছা হইল। যাহা হউক, পরদিবস তাহার সহিত গমন করিয়া, তাহাকে যতদূর সম্ভব সাহায্য করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইলাম।