দায়ে খুন/প্রথম পরিচ্ছেদ
দায়ে খুন।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
একদিবস প্রাতঃকালে কেবলমাত্র আমি আমার আফিসে আসিয়া বসিয়াছি, এরূপ সময়ে একজন মাড়োয়ারী আসিয়া আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। ইহার বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের অনধিক। ইহাকে দেখিয়া, বেশ একজন চালাক ব্যবসায়ী লোক বলিয়া অনুমান হয়। আমাকে দেখিয়া তিনি কহিলেন, “মহাশয়! আমি আপনার সহিত একটী সবিশেষ পরামর্শ করিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছি। যে বিষয় জিজ্ঞাসা করিবার নিমিত্ত আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি, তাহা অতি সামান্য বিষয় হইলেও, আমি তাহার কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না বলিয়া, আমি আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। যদি অনুগ্রহ-পূর্ব্বক আপনি আমার কথাগুলি শ্রবণ করেন, এবং আমার কি করা কর্তব্য, সে সম্বন্ধে একটু পরামর্শ প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি সবিশেষরূপ বাধিত হইব।”
মাড়োয়ারীর কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “আপনি যাহা বলিতে চাহেন, অনায়াসেই তাহা আমাকে বলিতে পারেন। আপনার সমস্ত কথা শ্রবণ করিয়া, যদি বুঝিতে পারি, আমার দ্বারা কোনরূপে আপনার উপকার হইবার সম্ভাবনা, তাহা আমি করিতে প্রস্তুত আছি।”
আমার কথা শুনিয়া সেই মাড়োয়ারী বলিতে আরম্ভ করিল, “মহাশয়! আমার নাম বালমুকুন্। আমি বাল্যকাল হইতে ব্যবসা-কার্য্য ব্যতীত অপর কোন কার্য্য শিক্ষা করি নাই। এ পর্যন্ত ব্যবসা-কার্য্যেই নিজের দিন অতিবাহিত করিয়া আসিতেছি; কিন্তু আপন দুরদৃষ্ট বশতঃ এ পর্য্যন্ত নিজে কোনরূপ কারবার করিতে সমর্থ হই নাই, চিরকালই পরের অধীনেই কার্য্য করিয়া আসিয়াছি। এই কলিকাতা সহরে অনেক দিবস হইতে অবস্থিতি করিয়া কোন একটী প্রধান মাড়োয়ারীর সমস্ত কার্য্য আমি নিজে নির্ব্বাহ করিয়া আসিতেছিলাম। আমি যতদিন পর্য্যন্ত তাঁহার কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছি, সেই পর্য্যন্ত কোনরূপেই তাঁহার একটামাত্র পয়সাও লোকসান হয় নাই; বরং দিন দিন আমি তাঁহার কার্য্যের উন্নতি করিয়াই আসিতেছিলাম। আমি কলিকাতায় থাকিতাম সত্য; কিন্তু ভারতবর্ষের নানাস্থানে তাঁহার এক একটা ফারম ছিল। আমি কলিকাতায় থাকিয়া, সেই সমস্ত ফারমের কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া আসিতেছিলাম। এই সকল ফারম হইতে আমার মনিব যথেষ্ট অর্থ সংগ্রহ করিয়া তাঁহার দেশে তিনি এখন একজন বড়মানুষের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছেন। তিনি অর্থের যথেষ্ট সংস্থান করিয়াছেন সত্য; কিন্তু তাঁহার অবর্ত্তমানে সেই অর্থ ভোগ করিতে পারিবে, তাঁহার এরূপ আর কেহই নাই। একমাত্র পুত্র ছিল, তিনি বড় হইয়া ইদানীং মধ্যে মধ্যে নিজের ব্যবসায়ের তত্ত্বাবধান করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। কিন্তু আজ কয়েকমাস হইল, হঠাৎ তাঁহারও মৃত্যু হইয়াছে। এই কারণে আমার মনিব মনের দুঃখে তাঁহার যে স্থানে যে কোন কারবার ছিল, তাহার সমস্ত কার্য্য উঠাইয়া দিয়াছেন। যখন আমার মনিব তাঁহার সমস্ত ব্যবসা বন্ধ করিয়া দিলেন, তখন আর আমার চাকরী থাকিবে কি প্রকারে? পারিতোষিক বলিয়া, আমাকে নগদ দুই সহস্র মুদ্রা প্রদান করিয়া আমাকে তাঁহার চাকরী হইতে জবাব দিলেন।
“নগদ দুই সহস্র মুদ্রা হস্তে পাইয়া আমি একবার মনে করিলাম, এতদিবস পরের নিকট চাকরী করিয়া দিন যাপন করিয়াছি, এখন আর কাহার নিকট পুনরায় উমেদারী করিয়া বেড়াইব? এই মূলধন অবলম্বন করিয়া কোন একটী কারবার আরম্ভ করি, তাহাতেই কোনরূপে আপনার দিন অতিবাহিত করিব। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, কারবারে প্রবৃত্ত হইবার উদ্যোগ করিতেছি, এরূপ সময় জানিতে পারিলাম যে, বোম্বাই সহরের কোন একটী প্রধান মাড়োয়ারী ফারমের মনিবগোমস্তার হঠাৎ মৃত্যু হওয়ায়, সেই চাকরী খালি হইয়াছে। বোম্বাই সহরের সেই ফারমের নাম আমি পূর্ব্ব হইতেই অবগত ছিলাম। আমার পূর্ব্বতন মনিবের ফারমের সহিত সেই ফারমের সর্ব্বদা কারবার চলিত; কিন্তু আমাদিগের পরস্পরের মধ্যে কাহারও সহিত কাহারও চাক্ষুষ দেখা-শুনা ছিল না। আমি জানিতাম, বোম্বায়ের সেই ফারম অতিশয় পুরাতন, কারবার বহু-বিস্তৃত ও সর্ব্বজন-বিদিত।
“সেই ফারমের মনিব-গোমস্তার পদ শূন্য হইয়াছে জানিতে পারিয়া, সেই পদ-প্রার্থী হইয়া, আমি সেই স্থানে একখানি দরখাস্ত করিলাম। আমি যে ফারমে কার্য্য করিতাম, এবং যে কারণে এখন আমার কর্ম্ম নাই, দরখাস্তে তাহারও সমস্ত অবস্থা আমি বিস্তৃতরূপে লিথিয়া দিলাম। যে পদের প্রার্থী হইয়া আমি দরখাস্ত করিলাম, সেই পদ যে আমি প্রাপ্ত হইব, সে আশা আমার অতি অল্পই ছিল। কারণ, বোম্বাই-প্রদেশে সেই কার্য্যের উপযোগী অনেক লোক বর্তমান থাকিতে তাঁহারা একজন অপরিচিত ব্যক্তিকে কেন সেই পদে নিযুক্ত করিবেন? সে যাহা হউক, আমার মনে যতদূর আশা ছিল, তাহার অধিক কার্য্যে পরিণত হইল। দরখাস্ত প্রেরণ করিবার এক সপ্তাহ পরেই আমি সেই ফারম হইতে একখানি পত্র পাইলাম। পত্রখানি পাঠ করিয়া আমি অতিশয় বিস্মিত হইলাম। দেখিলাম, আমার দরখাস্ত মঞ্জুর হইয়াছে, বাৎসরিক ছয়শত টাকা বেতনে আমাকে সেই কার্য্যে নিযুক্ত করা হইয়াছে। উহাতে আরও লেখা আছে যে, এই পত্র পাইবার পর দশদিবসের মধ্যেই সেই স্থানে গমন করিয়া আমাকে আমার নূতন কার্য্যে নিযুক্ত হইতে হইবে।
“সেই পত্র পাইয়া আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। ইতিপূর্ব্বে যাহার নিকট আমি কার্য্য করিতাম, তাঁহার নিকট হইতে আমি বাৎসরিক চারিশত আশী টাকা বেতন পাইতাম। এখন তাহা অপেক্ষা আমার একশত কুড়ি টাকা অধিক বেতন হইল। সুতরাং নূতন চাকরী সম্বন্ধে আমি আর কোনরূপ ইতস্ততঃ না করিয়া ব্যবসা করিবার যে ইচ্ছা করিতেছিলাম, তাহা পরিত্যাগ করিয়া বোম্বাই সহরে গমন করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলাম।
“যে দিবস আমি কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া বোম্বাইয়ে গমন করিবার মনস্থ করিয়াছিলাম, তাহার তিন চারিদিবস পূর্ব্বে একটী লোক আসিয়া হঠাৎ আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। তিনি যে কি করিয়া আমার বাসা চিনিলেন, তাহা আমি বলিতে পারিলাম, বা বুঝিতেও পারিলাম না। ইতিপূর্ব্বে আর কখনও যে আমি তাঁহাকে দেখিয়াছি, তাহাও আমার বোধ হইল না। তিনি হঠাৎ আমার নিকট উপস্থিত হইয়াই কহিলেন, ‘মহাশয়ের নামই কি বালমুকুন্?
আমি। হাঁ মহাশয়! আমারই নাম বালমুকুন্।
আগন্তুক। আপনি যে ফারমে কার্য্য করিতেন, সেই ফারম এখন উঠিয়া গিয়াছে?
আমি। ধনী ইচ্ছা করিয়া তাঁহার দেনা-পাওনা মিটাইয়া দিয়া তাঁহার কারবার উঠাইয়া দিয়াছেন।
আগন্তুক। তাহা হইলে বোধ হয়, আপনি এখন বেকার বসিয়া আছেন?
আমি। বেকার বসিয়াছিলাম বটে; কিন্তু এখন বেকার বসিয়া আছি, তাহা আর বলিতে পারি না।
আগন্তুক। আপনার একথার অর্থ আমি বেশ বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।
আমি। চাকরী যাওয়ার পর, আমি কিছুদিবস বসিয়াছিলাম বটে; কিন্তু সম্প্রতি একটী চাকরীর যোগাড় হইয়াছে। এই নিমিত্তই আমি বলিতেছি, এখন আর আমি বেকার অবস্থায় বসিয়া নাই। কেন মহাশয়! আপনি আমাকে এ সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন?
আগন্তুক। জিজ্ঞাসা করিবার সবিশেষ কারণ আছে বলিয়াই, জিজ্ঞাসা করিতেছি। আপনাকে একটী চাকরীতে নিযুক্ত করিবার মানসেই আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছিলাম।
আমি। আমাকে একটী চাকরী প্রদান করিবার মানসেই আপনি আমার নিকট আগমন করিয়াছেন, একথার অর্থ আমি সবিশেষরূপে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
আগন্তুক। ইহার অর্থ এমন সবিশেষ কিছু নহে যে, আপনি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। আমি যে মহাজনের অধীনে কর্ম্ম করি, তিনি একজন প্রসিদ্ধ ধনী। তিনি জাতিতে মাড়োয়ারী ব্রাহ্মণ; কিন্তু কেবল বঙ্গদেশ ব্যতীত এমন কোন স্থান নাই যে, সেই সকল স্থানে তাঁহার ফারম বা কারবার নাই। মান্দ্রাজ হইতে হিমালয়, বোম্বাই, এবং গুজরাট হইতে বেনারস প্রভৃতি স্থানের মধ্যে যে যে স্থানে প্রধান প্রধান নগর আছে, সেই সেই স্থানেই তাঁহার একটী একটী শাখা ফারম আছে। আমার বোধ হয়, বঙ্গদেশ ব্যতীত এক ভারতবর্ষের মধ্যে অল্প-বিস্তর তিনশত স্থানে তাঁহার কারবার হইয়া থাকে। এখন তাহার নিতান্ত ইচ্ছা যে, তিনি বঙ্গদেশের মধ্যেও আপনার কারবার বিস্তৃত ভাবে স্থাপন করেন, এই নিমিত্তই আমি কলিকাতায় আসিয়াছি। কলিকাতার মধ্যে একটী প্রধান ফারম স্থাপন করিয়া, ক্রমে বঙ্গদেশের প্রধান প্রধান সমস্ত নগরীতে তাহার এক একটী শাখা ফারম স্থাপন করিয়া আমি আমার স্থানে অর্থাৎ মান্দ্রাজ সহরে গমন করিব। কলিকাতার ফারমের অধীনে অনেকগুলি শাখা ফারম থাকিবে; সুতরাং কলিকাতার নিমিত্ত একজন অতি উপযুক্ত লোকের প্রয়োজন। আমি আমার একজন বন্ধুর পত্রে অবগত হইতে পারিয়াছি যে, যেরূপ কার্য্যের নিমিত্ত আমি উপযুক্ত লোকের অনুসন্ধান করিতেছি, আপনি সেই কার্য্যের ঠিক উপযুক্ত লোক।
“তাঁহার এই কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আমার সম্বন্ধে আপনাকে কে বলিয়াছে, তাহা আমি জানিতে পারি কি?’
“উত্তরে তিনি আমাদিগের দেশস্থ এক ব্যক্তির নাম করিলেন। দেখিলাম, তাঁহার সহিত আমার সবিশেষরূপ আলাপ-পরিচয় না থাকিলেও, তিনি যে একবারে আমার নিকট অপরিচিত, তাহা নহে। সুতরাং আমি মনে ভাবিয়াছিলাম, তাহা হইলে হয় ত প্রকৃতই তিনি আমার কথা বলিয়া থাকিবেন।
“তাহার পর তিনি কহিলেন, ‘মহাশয়! এখন আমি আপনার নিকট কি নিমিত্ত আগমন করিয়াছি, তাহা এখন বোধ হয়, বেশ বুঝিতে পারিলেন?
আমি। তাহা ত বুঝিয়াছি, কিন্তু আপনি যে প্রকার কার্য্যের কথা আমাকে কহিলেন, সেই সকল কার্য্য আমার দ্বারা কোন প্রকারেই সম্পন্ন হওয়া সম্ভবপর নহে। সমস্ত বঙ্গদেশের প্রধান প্রধান নগরীতে এক একটা কার্য্যস্থান স্থাপন করিয়া, সেই সকল কার্য্যের উত্তমরূপে তত্ত্বাবধান করিতে হইলে, আমাদিগের সদৃশ বুদ্ধি-জীবি লোকের দ্বারা সে কার্য্য হইবার সম্ভাবনা নিতান্ত অল্প। আপনি যদি আমার পরামর্শ শ্রবণ করেন, তাহা হইলে আমা-অপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমান্ ও কার্যক্ষম অপর কোন ব্যক্তির অনুসন্ধান করুন।
আগন্তুক। সে অনুসন্ধান করিবার আমার আর কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। যদি আমার বিশ্বাস না হইত, বা অপরের নিকট হইতে আমি উত্তমরূপে অবগত হইতে না পারিতাম যে, আপনার দ্বারা আমাদিগের প্রস্তাবিত কার্য্য সকল সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা নাই, তাহা হইলে বোধ হয়, আমি কখনই আপনার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইতাম না। সেই কার্য্য আপনার দ্বারা নির্ব্বাহ হইবে না, একথা আপনি ত বলিবেনই। কারণ, যে ব্যক্তির কোন কার্য্যে উত্তমরূপে পারদর্শিতা থাকে, তিনি কখনই আপনার গুণ আপন মুখে স্বীকার করেন না; অধিকাংশ সময়ে বরং তিনি তাহার বিপরীতই বলিয়া থাকেন। সে যাহা হউক, সেই কার্য্য আপনার দ্বারা সুচারুরূপে নির্ব্বাহ হইতে পারুক আর না পারুক, তাহা আমরা বুঝিতে পারিব। আপনি কোন্ সময় হইতে আমাদিগের কার্য্যে নিযুক্ত হইবেন, তাহা এখন আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিউন।
আমি। আমি যদি আপনাদিগের কার্য্য সম্পন্ন করিয়া উঠিতে না পারি, তাহা হইলেও কি আপনি সেই কার্য্যে আমাকে নিযুক্ত করিতে চাহেন?
আগন্তুক। তাহা হইলেও চাহি।
আমি। এরূপ অবস্থাতেও যদি আপনি আপনাদিগের কার্য্যে নিযুক্ত করিতে চাহেন, তাহা হইলে আমাকে সবিশেষ দুঃখের সহিত বলিতে হইতেছে যে, এখন আমি অপর কোন স্থানে চাকরী গ্রহণ করিতে অসমর্থ।
আগন্তুক। কেন?
আমি। আমি ইতিপূর্ব্বে অপর আর এক স্থানে চাকরী স্বীকার করিয়াছি, এবং সেই স্থানে শীঘ্রই গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতেছি।
আগন্তুক। সে কোথায়?
আমি। বোম্বাই সহরে। এরূপ অবস্থায় বলুন দেখি মহাশয়! আমি কিরূপে আপনার চাকরী করিতে সম্মত হইতে পারি?
আগন্তুক। আপনি একটী কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছেন মাত্র; কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই স্থানে গমন বা সেই কার্য্য করিতে আরম্ভ করেন নাই। বাল্যকাল হইতে আরম্ভ করিয়া পরের নিকট চাকরী করিতে করিতে আপনি এখন এত বড় হইয়াছেন। বলুন দেখি, কোন লোক কোন স্থানে কর্ম্ম করিতে করিতে যদি অপর কোন স্থানে কিছু সুবিধা বিবেচনা করেন, তাহা হইলে তিনি সেই কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া অপর কোন কার্য্যে গমন করেন কি না? আমার বোধ হয়, আপনার পরিচিত যত লোক এইরূপ ভাবে এক স্থান হইতে কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া অপর স্থানে গমন করিয়াছেন, তাহার একটী দুইটী তালিকা আপনি এখন হঠাৎ প্রস্তুত করিয়া দিতে পারেন। মূল কথা, এরূপ লোকের সংখ্যা জগতে এত অধিক যে, তাহা ঠিক করা সহজ নহে। আপনি যখন অপর কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হন নাই, তখন সেই কার্য্যে আপনাকে যে গমন করিতেই হইবে, তাহার অর্থ নাই। যে স্থানে আপনি আপনার নূতন চাকরী প্রাপ্ত হইতেছেন, সেখানে তাঁহারা আপনাকে কিরূপ বেতন দিতে স্বীকার করিয়াছেন, তাহা আমি জানিতে পারি কি?
আমি। তাহা বলিতে আমার কিছুমাত্র প্রতিবন্ধক নাই। তাঁহারা আমাকে যে বেতন দিতে সম্মত হইয়াছেন, তাহা কিছু অধিক নহে; বরং একরূপ সামান্য। বাৎসরিক তাহারা আমাকে ছয়শত টাকা প্রদান করিবেন।
আগন্তুক। একথা আপনাকে আমার পূর্ব্বে বলা উচিত ছিল। কারণ, তাহা হইলে এতগুলি বাজে কথা লইয়া আমাদিগের সময় নষ্ট করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন হইত না। যখন চাকরীই আপনার উপজীবিকা, তখন আপনাকে চাকরী করিতেই হইবে। যখন চাকরীই করিতে হইল, তখন ভাল ঘরে অধিক বেতন পাইলে সে সুযোগ কে পরিত্যাগ করিতে চাহে?
আমি। আপনারা আপনাদিগের প্রস্তাবিত কর্ম্মের নিমিত্ত যে লোক নিযুক্ত করিতে ইচ্ছা করিতে চাহিতেছেন, তাহার নিমিত্ত তাহাকে কিরূপ বেতন দিতে ইচ্ছা করিতেছেন?
আগন্তুক। আমি নিজে ধনী নহি, বা আমার নিজের কারবার নহে। আমার মনিব আছে, আমিও আমার মনিবের একজন বেতন-ভোগী চাকর। আমাদিগের মনিবের নিয়ম আছে, তিনি তাহার কোন লোকজনকে বাৎসরিক হিসাবে বেতন প্রদান করেন না। কারণ, তিনি বেশ জানেন, যিনি যেরূপ বেতনের চাকরই হউন না কেন, সেই বেতন হইতে তাঁহাকে তাঁহার পরিবার প্রতিপালন করিতে হয়। সুতরাং বৎসরান্তে বেতন পাইলে, কোন ব্যক্তিই তাঁহার পরিবারবর্গকে প্রতিপালন করিতে সমর্থ হন্ না। এই নিমিত্ত আমার মনিবের আদেশ যে, তাঁহার চাকরমাত্রেই মাসিক হিসাবে বেতন প্রত্যেক মাসের প্রথম সপ্তাহের ভিতরেই পাইবে। আপনার নিমিত্ত প্রথমেই আমার মনিবের সহিত কথা হইয়াছিল। তিনি আমাকে বলিয়া দিয়াছিলেন যে, সেই কার্য্যের নিমিত্ত যদি তিনি কোন একজন ভাল লোক প্রাপ্ত হন্, তাহা হইলে তাঁহার মাসিক বেতন তিনি তিনশত টাকা পর্যন্ত ক্রমে প্রদান করিবেন। এখন কিন্তু একশত টাকার অধিক দিবেন না। ভাল করিয়া তাহার মনোমত কার্য্য করিতে পারিলে, প্রত্যেক বৎসরে পঁচিশ টাকা হিসাবে বাড়াইয়া দিবেন। এইরূপে ক্রমে তাঁহার বেতন মাসিক তিনশত টাকায় আসিয়া উপস্থিত হইবে, তাহার পর তাঁহার বেতন আর অধিক বাড়িবে না। এখন মহাশয়! দেখুন দেখি, মাসিক একশত টাকা হিসাবে বেতন হইলেও, বাৎসরিক হিসাবে আপনার বেতন হইল—বারশত টাকা, অর্থাৎ যাহা এখন আপনি পাইবেন বলিয়া ঠিক হইয়াছিল, তাহার দ্বিগুণ। এরূপ অবস্থায়ও আপনি আমার প্রস্তাবিত বিষয়ে সম্মত হইতে পারিবেন কি না, সেই বিষয়ে একটু বিবেচনা করিয়া দেখুন।
তাহার এই কথা শুনিয়া আমি মনে করিলাম, এই ব্যক্তি যাহা বলিতেছে, তাহা ত প্রকৃতই। যখন পরাধীনতা স্বীকার করিয়া চাকরী করিতেই প্রবৃত্ত হইয়াছি, তখন যে স্থানে অধিক অর্থ পাওয়া যাইতেছে, সেই স্থান পরিত্যাগ করি কেন? বিশেষতঃ যে ব্যক্তি আমার বাড়ীতে আসিয়া আমাকে তোষামোদ করিয়া, অধিক বেতনে আমাকে একটী চাকরী প্রদান করিতেছে, তখন সেই চাকরীই বা আমি হেলায় পরিত্যাগ করি কেন? মাসিক পঞ্চাশ টাকার পরিবর্তে একশত টাকাই বা গ্রহণ না করি কেন? আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি যে, এরূপ অবস্থায় এরূপ সুযোগ পরিত্যাগ করা, কোন ক্রমেই যুক্তিসঙ্গত নহে।