দিল্লী চলো/আজাদ-হিন্দ গবর্নমেন্ট

আজাদ-হিন্দ গবর্নমেণ্ট

 স্বাধীনতা আসন্ন। আজ প্রত্যেক ভারতবাসীর কর্ত্তব্য, একটি অস্থায়ী গবর্নমেণ্ট গঠন করা এবং সেই গবর্নমেণ্টের পতাকাতলে সমবেত হয়ে স্বাধীনতা-সংগ্রামে ব্রতী হওয়া। কিন্তু ভারতের প্রত্যেকটি নেতা কারাগারে, জনসাধারণও সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। এ অবস্থায় ভারতে অস্থায়ী গবর্নমেণ্ট সংগঠন কিংবা সে গবর্নমেণ্টের অধীনে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা সম্ভব নয়। এই জন্য পূর্ব্ব এশিয়ার ভারতীয় স্বাধীনতা-লীগের কর্ত্তব্য, স্বদেশ ও বিদেশের সকল দেশপ্রেমিক ভারতীয়দের সমর্থনে স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী গবর্নমেণ্ট সংগঠন করা এবং আজাদ-হিন্দ ফৌজের সাহায্যে স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ সংগ্রাম পরিচালনা করা।

 ভারতবর্ষ থেকে বৃটেন এবং তার মিত্রদের বিতাড়িত করার জন্য অস্থায়ী গবর্নমেণ্টকে সংগ্রাম চালাতে হবে। তারপর অস্থায়ী গবর্ণমেণ্টের কর্ত্তব্য হবে, স্বাধীন ভারতে জনগণের ইচ্ছানুসারে এবং তাদের বিশ্বাস ভাজন একটি স্থায়ী জাতীয় গবর্নমেণ্ট সংস্থাপন। বৃটিশ এবং তার মিত্রদের বিতাড়িত করার পর স্বাধীন ভারতে স্থায়ী জাতীয় গবর্নমেণ্ট গড়ে না ওঠা পর্য্যন্ত অস্থায়ী গবর্নমেণ্ট ভারতের জনগণের বিশ্বাস-ভাজন রূপে দেশ শাসন করবে।

 ঈশ্বরের নামে, অতীত যুগে যাঁরা ভারতীয় জনগণকে সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন তাঁদের নামে, এবং যে সব পরলোকগত বীর আমাদের কাছে বীরত্ব ও আত্মত্যাগের আদর্শ স্থাপন করে গেছেন তাঁদের নামে, আমরা ভারতীয় জনসাধারণকে আমাদের পতাকাতলে সমবেত হতে এবং ভারতের স্বাধীনতালাভের উদ্দেশ্যে অস্ত্র ধারণ করতে আহ্বান করছি। বৃটিশের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সংগ্রাম আরম্ভ করার জন্য আমরা তাঁদের এবং তাঁদের মিত্রদের আহ্বান জানাচ্ছি। যতদিন ভারতভূমি থেকে তারা বহিষ্কৃত না হয় এবং যতদিন ভারতবাসী আবার স্বাধীন না হয়, ততদিন সাহস, অধ্যবসায় এবং চরম বিজয়ে আস্থা রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

 ১৭৫৭ অব্দে বাংলা দেশে বৃটিশের হাতে প্রথম পরাজয়ের পর থেকেই ভারতীয় জনসাধারণ এক বছর অবিশ্রান্তভাবে প্রচণ্ড সংগ্রাম চালিয়েছে। এই সময়ের ইতিহাস অসংখ্য অতুলনীয় বীরত্ব এবং আত্মত্যাগের আদর্শে পরিপূর্ণ। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় সিরাজদ্দৌলা, মোহনলাল, হায়দার আলী, টিপু সুলতান, দক্ষিণ ভারতের ভেলু তাম্পি, আপ্পা সাহেব ভোঁসলা, মহারাষ্ট্রের পেশোয়া বাজিরাও, অযোধ্যার বেগম, পাঞ্জাবের সর্দ্দার শ্যাম সিং আতিরিওয়ালা, ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ, তাঁতিয়া টোপি, দামরাওনের মহারাজ কুনওয়ার সিং, নানা সাহেব এবং আরও বহু বীরের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের পূর্ব্বপুরুষরা বুঝতে পারেন নি, বৃটিশ সমগ্র ভারত গ্রাস করতে উদ্যত। কাজেই তাঁরা সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি। পরিশেষে ভারতীয় জনগণ যখন অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পারল তখন তারা একত্রিত হল। ১৮৫৭ অব্দে বাহাদুর শাহের অধীনে তারা স্বাধীন জাতি হিসাবে শেষ সংগ্রাম করল। যুদ্ধের প্রথম দিকে কয়েকবায় জয়লাভ সত্ত্বেও মন্দভাগ্য এবং ভ্রান্ত নেতৃত্ব ধীরে ধীরে তাদের এনে দিল চরম পরাজয় ও পরাধীনতা। তবু ঝাঁসীর রাণী, তাঁতিয়া টোপি, কুনওয়ার সিং এবং নানা সাহেব জাতীয় আকাশে চিরন্তন নক্ষত্রের মত জ্যোতিষ্মান হয়ে আমাদের আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতার প্রেরণা দিচ্ছেন।

 ১৮৫৭ অব্দের পর বৃটিশরা ভারতীয়দের নিরস্ত্র করে দেয় এবং আতঙ্ক ও পাশবিকতার রাজত্ব সৃষ্টি করে। এর পর কিছুকাল ভারতবাসীরা হতমান এবং হতবাক হয়ে ছিল। ১৮৮৫ অব্দে কংগ্রেসের জন্মের পর ভারতের নবজাগরণ শুরু হল। ১৮৮৫ অব্দ থেকে প্রথম মহাযুদ্ধ পর্য্যন্ত ভারতীয় জনগণ তাদের হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন, প্রচার কার্য্য, বৃটিশ-দ্রব্য বর্জ্জন, সন্ত্রাসবাদ, ধ্বংসাত্মক আন্দোলন প্রভৃতি সকল উপায়—এবং অবশেষে সশস্ত্র বিপ্লবের পথও অবলম্বন করেছে। কিন্তু সবই সাময়িকভাবে ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হয়েছে। অবশেষে ১৯২০ অব্দে ব্যর্থতার গ্লানিতে সমাচ্ছন্ন ভারতবাসীরা যখন নতুন পথের সন্ধান করছিল, তখন মহাত্মা গান্ধী অসহযোগিতা এবং আইন অমান্য আন্দোলনের নূতন অস্ত্র নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন।

 এর পর কুড়ি বৎসরকাল ভারতবাসী নানাপ্রকার দেশাত্মমূলক কাজ করছে। মুক্তির বার্ত্তা ভারতের প্রতি ঘরে ঘরে পৌঁছেচে। ভারতবাসী শিখেছে স্বাধীনতার জন্যে নির্য্যাতন সহ্য করতে, আত্মত্যাগ করতে এবং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে। শহর থেকে সুদূর গ্রাম অবধি জনগণ একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে সমবেত হল। এইভাবে ভারত শুধু রাজনৈতিক চেতনা লাভই করল না, ভারত আবার একটি অখণ্ড রাজনৈতিক সত্তায় পরিণত হল। এর পর তারা একস্বরে কথা বলতে শিখল এবং এক সাধারণ লক্ষ্যের জন্যে একপ্রাণে একমনে সংগ্রাম করতে পারল। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ অব্দ পর্য্যন্ত আটটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিমণ্ডলের কাজের দ্বারা ভারতীয় জনগণ প্রমাণ দিল যে তারা প্রস্তুত, নিজেদের শাসন-ব্যবস্থা করার মতো ক্ষমতা তারা অর্জ্জন করেছে।

 বর্ত্তমান মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে এইভাবে ভারতের মুক্তি-সংগ্রামের জমি তৈরী হয়। এ যুদ্ধে জার্ম্মানী ইউরোপে বৃটিশের উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। এদিকে জাপানও তার মিত্রদের সহযোগিতায় পূর্ব্ব এশিয়ায় বৃটিশের উপর প্রচণ্ড আঘাত করে। বিভিন্ন অবস্থার যোগাযোগে ভারতীয় জনগণ তাদের জাতীয় মুক্তি অর্জ্জনের অভূতপূর্ব্ব সুযোগ পেয়েছে।

 বিদেশে ভারতীয়গণ রাজনৈতিক চেতনা লাভ করেছে এবং একটি প্রতিষ্ঠানে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে। ভারতের ইতিহাসে এ ঘটনা নূতন। তারা তাদের দেশবাসীর সঙ্গে সমানভাবে চিন্তাই শুধু করছে না, স্বাধীনতার পথ ধরে সমতালে এগিয়ে চলেছে। পূর্ব্ব এশিয়ায় আজ কুড়ি লক্ষেরও অধিক ভারতবাসী এক সুসংবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে। তারা পূর্ণ সমরায়োজন ধ্বনিতে অনুপ্রাণিত হয়েছে। তাদের সম্মুখে রয়েছে ভারতের আজাদী ফৌজ—তাদের মুখে এক কথা ‘দিল্লী চলো’।

 ভণ্ডামির দ্বারা ভারতীয়দের হতাশাচ্ছন্ন করে, লুঠতরাজ করে, তাদের অনাহার ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে বৃটিশ শাসকরা ভারতীয়দের শুভেচ্ছা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এখন তাদের অবস্থা বিশেষ সঙ্কটজনক। সেই অস্বস্তিকর শাসনের শেষচিহ্ন ধ্বংস করার জন্য মাত্র একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের প্রয়োজন। সেই স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টির ভার আজাদী ফৌজের উপর। স্বদেশে অসামরিক জনগণের সমর্থনে এবং বিদেশে আমাদের অজেয় মিত্রবর্গের সহায়তা ও আত্মশক্তির উপর নির্ভর করে ভারতীয় আজাদী ফৌজ তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করতে পারবে বলে বিশ্বাস রাখে।

 পূর্ব্ব-এশিয়ায় ভারতীয় স্বাধীনতা-লীগ আজাদ-হিন্দ ফৌজের অস্থায়ী গবর্নমেণ্ট গঠন করেছেন। এখন আমরা পূর্ণ দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে অবতীর্ণ হচ্ছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা তিনি আমাদের কাজ এবং মাতৃভূমির মুক্তির জন্যে আমাদের সংগ্রামকে আশীর্ব্বাদ করুন। দেশমাতৃকার মুক্তি ও মঙ্গলের জন্যে এবং বিশ্বের দরবারে তাঁকে উন্নীত করবার জন্যে আমরা আমাদের এবং সঙ্গী সহকর্ম্মীদের জীবন পণ করছি।

 অস্থায়ী গবর্নমেণ্ট প্রত্যেক ভারতীয়ের আনুগত্য দাবী করে, এবং এই গবর্নমেণ্ট আনুগত্য লাভের যোগ্য। এই গবর্নমেণ্ট ধর্ম্মগত স্বাধীনতা এবং সমস্ত অধিবাসীর জন্যে সমান অধিকার ও সমান সুযোগ সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। দেশের সমস্ত সন্তানকে সমান ভাবে পালন করে এবং বিদেশী গবর্নমেণ্ট সৃষ্ট সর্ব্বপ্রকার বিভেদ অতিক্রম করে সমগ্র দেশের এবং দেশের প্রতি অংশের সুখ-সমৃদ্ধি বিধানের ব্যবস্থা করতে এই গবনর্ণমেণ্ট দৃঢ়সংকল্প।

সিঙ্গাপুর, ২১শে অক্টোবর, ১৯৪৩