দীর্ঘকেশী/প্রথম পরিচ্ছেদ

দীর্ঘকেশী।


প্রথম পরিচ্ছেদ।

◇◇◇◇◇◇

 কলিকাতার মারকুইস্‌ স্কোয়ার নামক স্থানটী কলিকাতার পাঠকবর্গের নিকট উত্তমরূপে পরিচিত। মেছুয়াবাজার ষ্ট্রীটের পার্শ্বে ঐ বৃহৎ স্কেয়ারটী এখন স্কুল ও কলেজের বালকগণের ক্রীড়া স্থল। ঐ স্থানটীর এখনও নাম আছে দীঘিপাড়। আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় ঐস্থানে একটী প্রকাণ্ড পুষ্করিণী ছিল, ঐ পুষ্করিণীর নাম ছিল দীঘি। ঐ দীঘিকে এখন স্কোয়ারে পরিণত করা হইয়াছে। ঐ দীঘির চতুস্পার্শ্ববর্ত্তী স্থান সকল দীঘির পাড় বা দীঘির পাড়া নামে অভিহিত হইত। ঐস্থানে যে সকল লোক বাস করিত, তাহারা সমস্তই প্রায় নিম্নশ্রেণীর মুসলমান ও চোর ও বদমায়েস। ঐ স্থানে কোন ভদ্র মুসলমানকে বাস করিতে আমি দেখি নাই।

 ঐ পুষ্করিণীর জল অতিশয় গভীর ছিল ও উহার উত্তর পশ্চিম অংশে একটী বৃহৎ অশ্বত্থবৃক্ষ অর্ধশায়িত অবস্থায় ঐ পুষ্করিণীর জলে আপনার প্রতিবিম্বকে প্রতিভাত করিত, এবং বর্ষাকালে অর্থাৎ যে সময় ঐ পুষ্করিণীর জল বর্দ্ধিত হইত, সেই সময় ঐ বৃক্ষের দুই একটী শাখাও ঐ জলের মধ্যে অর্দ্ধনিমগ্ন অবস্থায় অবস্থিতি করিত।

 একদিবস প্রত্যুষে সংবাদ আসিল যে, ঐ দীঘির জলের মধ্যে একটী মনুষ্য-মস্তক দৃষ্টিগোচর হইতেছে।

 এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া আমি সেই স্থানে গমন করিলাম। দেখিলাম, আলুলায়িত কেশযুক্ত একটী মনুষ্য-মস্তক, পূর্ব্বকথিত বটবৃক্ষের একটী অঙ্গে নিমগ্ন শাখায় সংলগ্ন হইয়া জলের মধ্যে ভাসিতেছে। আমি সেই অর্দ্ধশায়িত অশ্বত্থ বৃক্ষের উপর উঠিয়া যতদূর সম্ভব ঐ মস্তকের নিকট গমন করিলাম; দেখিলাম, উহার উপর প্রায় দুই ফিট জল থাকিলেও ঐ স্থানের জলের গভীরতা অধিক; মস্তকের চুল দীর্ঘ বলিয়া অনুমান হইল, সুতরাং মনে করিলাম, উহা কোন স্ত্রীলোকের মৃতদেহ হইবে। আরও মনে করিলাম, ঐ পাড়ার কোন স্ত্রীলোক জলমগ্ন হইয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছে, মৃতদেহ উপরে উঠাইলেই উহা যে কাহার মৃতদেহ তাহা কোন না কোন ব্যক্তি বোধ হয় সহজেই চিনিতে পারিবে।

 মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া ঐ মৃতদেহ উপরে উঠাইবার বন্দোবস্ত করিলাম। ডোম ডাকাইয়া ঐ মৃতদেহ ধীরে ধীরে তীরে আনিতে কহিলাম। উহারা আদেশ প্রতিপালন করিতে সেই অশ্বত্থ বৃক্ষের সাহায্যে সেই স্থানে গমন করিল ও ঐ মস্তক স্পর্শ করিয়াই কহিল, “ইহা দেখিতেছি কেবল মস্তক, ইহার সহিত দেহ নাই।”

 ডোমের এই কথা শুনিয়াই ভাবিলাম, আমি পূর্ব্বে যাহা মনে করিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি তাহার বিপরীত। মনে করিয়াছিলাম যে, কোন স্ত্রীলোক জলমগ্ন হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে, কিন্তু এখন দেখিতেছি, তাহা নহে; যে মস্তকের সহিত দেহ সংযুক্ত নাই, তাহা কোন প্রকারেই জলমগ্নের মস্তক হইতে পারে না। যাহা হউক, উহা উপরে উঠাইয়া ভালরূপ পরীক্ষা করিয়া না দেখিলে কোনরূপ মতামত প্রকাশ করা যাইতে পারে না।

 মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময়ে ডোম ঐ মস্তক পুষ্করিণীর তীরে উঠাইয়া আনিল। দেখিলাম, উহা প্রকৃতই একটী স্ত্রীলোকের মস্তক, কোন তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের দ্বারা উহাকে উহার দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করা হইয়াছে, ও উহার নাক মুখ প্রভৃতি স্থানে এরূপ ভাবে অস্ত্রাঘাত করা হইয়াছে যে, উহার মুখ দেখিয়া সহসা কেহই চিনিতে পারিবে না যে উহা কাহার মস্তক। তথাপি ঐ মস্তকটী দেখিয়া অনুমান হয় যে, ঐ স্ত্রীলোকটী কোন দরিদ্র ঘরের কন্যা বা বনিতা ছিল না, ও বিশেষ রূপবতীই ছিল বলিয়া বিবেচনা হয়। মস্তকের কেশরাশি অতিশয় ঘন নিবিড় কৃষ্ণবর্ণ ও দীর্ঘ। সদা সর্ব্বদা স্ত্রীলোকগণের মস্তকে যেরূপ দীর্ঘ কেশ দেখিতে পাওয়া যায়, ইহা তাহা অপেক্ষা অনেক দীর্ঘ অর্থাৎ মাপিলে কোনক্রমেই চারিফিটের কম হইবে না। উহার চুল আলুলায়িত কিন্তু দুই তিনখানি ইষ্টক ঐ চুলের সহিত আবদ্ধ রহিয়াছে। দেখিলে অনুমান হয় যে, যাহাতে ঐ মস্তক জলের উপরে ভাসিয়া উঠিতে না পারে তাহার জন্যই ইষ্টক বাঁধিয়া উহা পুষ্করিণীর অগাধ জলে নিক্ষেপ করা হইয়াছে।

 মস্তকটী পুষ্করিণীর ভিতর প্রাপ্ত হওয়ায় স্বভাবতই মনে হইল যে, মৃতদেহটীও নিশ্চয়ই ঐরূপে পুষ্করিণীর মধ্যে নিক্ষেপ করা হইয়াছে। মনে মনে ঐরূপ ভাবিয়া যাহাতে ঐ পুষ্করিণীর মধ্যে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা যাইতে পারে, তাহার উদ্যোগ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। সেই সময় পুষ্করিণীর ভিতর অনুসন্ধান করিতে হইলে জাল ও জেলিয়ার আবশ্যক হইত, সুতরাং অনুসন্ধান করিয়া তাহাই সংগ্রহ করিতে হইল। কতকগুলি জেলিয়াকে ধরিয়া বৃহৎ বৃহৎ জাল সমেত ঐ পুষ্করিণীর ভিতর নামাইয়া দিলাম। পুষ্করিণীটী বহু পুরাতন ছিল, সুতরাং উহার জল নানারূপ পুরাতন জঙ্গলে পূর্ণ ছিল। বহু বৎসরের মধ্যে ঐ পুষ্করিণীর যে কোনরূপ পঙ্কোদ্ধার হইয়াছিল ইহা অনুমান হয় না। একজন জেলিয়া ঐ পুষ্করিণী জমা লইত, সে মধ্যে মধ্যে উহা হইতে মৎস্য ধরিয়া লইলেও সম্পূর্ণরূপ মৎস্য শূন্য করিতে পারিত না, বা ঐ পুষ্করিণী কোনরূপেই পরিষ্কার রাখিতে সমর্থ হইত না। জেলিয়াগণ তাহাদের সাধ্যমত ঐ পুষ্করিণীতে জাল ফেলিয়া বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিল, কিন্তু মৃতদেহের কোনরূপই সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিল না। এইরূপ গোলযোগে প্রায় সমস্ত দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, কোনরূপেই আমাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইল না।

 আমরা যে স্ত্রীর মুণ্ড প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহা দেখিয়া কাহারও সাধ্য ছিল না যে, চিনিতে পারে উহা কাহার মস্তক। অনেক লোক ঐ ছিন্নমুণ্ড দর্শন করিল, কিন্তু কেহই চিনিয়া উঠিতে পারিল না, বা অনুমান করিতে পারিল না যে, উহা কাহার মুণ্ড! উহা যে কাহার মন্তক, তাহা জানিবার উপায়ের মধ্যে কেবল একমাত্র তাহার দীর্ঘ কেশরাশী। এখন আমাদের একমাত্র ভরসার মধ্যে এই রহিল যে, যদি কেহ বলে,—কোন দীর্ঘকেশী সুন্দরীকে পাওয়া যাইতেছে না, তাহা হইলে আমাদের কার্য্য সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হউক বা না হউক, অনুসন্ধান করিবার কতকটা রাস্তা হইবে। মনে মনে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া, আমরা ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারীগণকে আমাদের অভিমত জ্ঞাপন করিলাম।

 ইহার একঘণ্টা পরেই ঐ মন্তক ও তাহার ঘোর কৃষ্ণবর্ণ সুদীর্ঘ কেশরাশীর বর্ণনযুক্ত বিজ্ঞাপন মুদ্রিত হইয়া সহর ও সহরতলীর প্রত্যেক থানায় প্রেরিত হইল। উহাতে এইরূপ আদেশ রহিল যে, ঢোল সোহরতের দ্বারা এই সংবাদ প্রত্যেক রাস্তায় রাস্তায় ও প্রত্যেক গলিতে গলিতে এরূপভাবে প্রচারিত করা হউক, যেন এই বিষয় জানিতে কাহারও বাকী না থাকে।