দুনিয়ার দেনা/ফকিরের ফাঁক

ফকিরের ফাঁক

 প্রসাদপুরের রাজা মানুষটি এক নতুন রকমের জীব। বাপের মৃত্যুর পর, কোথায় রাজা হবেন—না রাজ্যটি প্রজাদের দান করে বসলেন। মন্ত্রীদের কত উপরোধ, অনুরোধ, প্রজাদের কত কাকুতি-মিনতি, কিছুতেই তাঁর মন ফেরাতে পারল না।

 রাজা হয়ে তিনি রাজ্যে বাস করবেন না, এই তাঁর মতলব। সঙ্কল্প থেকে কোনক্রমে তাঁকে না টলাতে পেরে, সকলে মিলে একজোট হয়ে এসে তাঁকে বল্লে, আপনি রাজা না থাকুন আমাদের সকল কাজের মধে আপনাকে কিন্তু যুক্ত থাকাতেই হবে, তা না হলে আমরা ছাড়ব না। রাজা বল্লেন, বেশ!

 পরদিন থেকে রাজাহীন রাজ্য প্রজাদের দ্বারা পরিচালিত হতে লাগল। রাজা তাদেরই মধ্যের একজন হয়ে রাজ্যের কাজে দিন রাত্রি পরিশ্রম করতে লাগলেন কিন্তু রাজা রইলেন না।

 তাঁর নাম ছিল দেবব্রত। সকলে এখন থেকে তাঁকে দেবদূত বলেই ডাকতে লাগল

 শোনা যায় দেবদূতের বয়স যখন সতের তখন নাকি তিনি নৌকা চড়ে একদিন নদীতে বেড়াতে যান। ঝড়ের মুখে পড়ে মাঝ্ নদীতে নৌকাডুবি হয়। একটি প্রণীও বেঁচে ফেরে নাই। দলবল সহ দেবদূতের মৃত্যু হয়েছে স্থির করে নেওয়া হয়।

 তিন বৎসর পরে হঠাৎ একদিন একখানি ভাঙ্গা নৌকায় চড়ে নদীপথে দেবদূত বাড়ী ফিরে আসেন।

 এ তিন বৎসর কোথায় ছিলেন কি ভাবে ছিলেন কেউ তা জানে না, জিজ্ঞাসা করতেও কেউ সাহস করেনি। তাঁর পিতা ভূতপূর্ব্ব মহারাজা জানতেন কি না তাও জানা যায়নি। কিন্তু তখন থেকে রাজকুমার দেবদূতের একটা আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন ঘটেছে।

 মহারাজের সকল কাজেই তিনি যোগ দেন কিন্তু রাজপ্রসাদে থাকেন না। নদীতীরে একটি কুটীর তৈরি করে তাতেই বাস করেন। সাধারণ খাবার খান, সাধারণ পোষাক পরেন, ঝি চাকর একজনও সঙ্গে রাখেন না। নিজের কাজ সব নিজেই করে থাকেন।

 রাজা তাঁর এ ভাবটা বদলাবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন সফল হন্‌নি। শেষে তাঁকে নিজের ইচ্ছামতই চলতে দিয়েছিলেন।

 দেবদূতের একটি মাত্র সখ ছিল প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় রাজ্যের একদল করে লোক নিয়ে নৌকা চড়ে নদীতে বেড়ান।

 একদিন শিশুদের, একদিন বালক বালিকাদের একদিন যুবাপুরুষদের, একদিন বৃদ্ধবৃদ্ধাদের, একদিন অন্ধ আতুরদের, ও একদিন সন্ন্যাসী সাধু ফকিরদের নিয়ে তিনি যান। আর একটি দিন রাখেন যার খুসী সে যেতে পারে বলে।

 সারাদিন পরিশ্রমের পর এই একটি আনন্দময় ব্যাপার ছিল তাঁর নিত্য নৈমিত্তিক কাজের মধ্যে।

দেবদূতের কাণ্ডকারখানা দেখে লোকে তাঁকে রাজা ভাববে কি প্রজা ভাববে, আমীর ভাববে কি ফকির ভাববে বুঝেই উঠতে পারে না।

 ফুলের প্রতি তাঁর বড় আদর। নিজের কুটীরের পাশে তিনি এক মস্ত ফুলের বাগান তৈরী করেছেন। সে বাগানের সকল কাজ তাঁর নিজের। গাছগুলি সব নিজের হাতে বসানো। নিজের পরিশ্রম ও যত্নের গুণে এই সকল গাছে প্রতিদিন তিনি রাশি রাশি ফুল ফুটিয়ে তোলেন।

 দূর থেকে কত লোক এই বাগান দেখতে আসে ও দেখে পুলকিত হয়ে ফিরে যায়।

 নৌকা থেকে ফিরে এসে ঘরে বাতি জ্বালানর সঙ্গে একটি করে সুন্দর ফুল প্রতিদিন দেবদূত নদীতে ভাসিয়ে দেন। কেউ জানেনা কেন।

 একদিন দুপুর রোদে দেবদূত বাগানে মাটি কোপাচ্চেন এমন সময় এক বুড়ী এসে বল্‌ল বাবা আমার ছেলে আমাকে খেতে দেয় না, বাড়ী থেকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। শুনে তিনি বুড়ির সঙ্গে তৎক্ষণাৎ তার বাড়ী গিয়ে উপস্থিত। ছেলেকে ডেকে বল্লেন “মাকে খেতে দাওনি কেন?” ছেলে বল্লে “আমার যা আছে তাতে সংসার চলে ন।, তার উপর মা ঝগড়াঝাঁটি চেঁচামেচি করে বাড়ী মাথায় করে তোলে, আর জ্বালাতন সইতে না পেরে রাগ করে মাকে বকেছি, তাই আপনার কাছে গিয়ে নালিশ করেছে।” দেবদূত বল্লেন “তুমি কি কাজ কর”? ছেলে বল্লে কোন কাজ করিনা ঘরে বসে থাকি”

 দেবদূত বল্লেন, “অলসব্যক্তির বাড়ী ঘর জমিজমা টাকাকড়ি সব সরকার বাজেয়াপ্ত করবে আজ থেকে এ রাজ্যে এই নিয়ম হল”।

 এই শুনে বুড়ীর ছেলে দেবদূতের পায়ে প’ড়ে কান্নাকাটি করতে লাগল। মাকে এখন থেকে যত্নে ভরণপোষণ করবে ও কায়িক পরিশ্রমের দ্বারা আগামী কাল থেকেই অর্থোপার্জ্জন আরম্ভ করবে বলে বারবার শপথ করতে লাগল।

 দেবদূত তাকে ছেড়ে দিলেন কিন্তু বাড়ী ফিরে প্রজাদের সঙ্গে পরামর্শ করে রাজ্যময় এই নিয়মজারী করলেন যে, যে কেউ বিনা পরিশ্রমে অলস হয়ে দিন কাটাবে, খবর পাওয়া মাত্র, তার সমস্ত সম্পত্তি সরকারে বাজেয়াপ্ত করা হবে। সকলে এ আদেশ মাথা পেতে স্বীকার করে নিল।

 দেবদূতের গায়ে ছিল অসুরের বল। বার ক্রোশ পথ হেঁটে গিয়ে তিনি আবার তখনি ফিরে আসতে পারতেন। একমন বোঝা অনায়াসে বয়ে দুই ক্রোশ পথ চলে যেতেন।

 একদিন রাত্রে দেবদূত ঘুমোচ্ছেন দুজন চোর এসে তাঁর কুটীরে সিঁদ কেটে ঢুকেছে। একটুখানি শব্দ হতেই তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠেই দুহাতে চোর দুজনকে জাপটে ধরে বল্লেন কি চাস? আমার কি সোনা দানা আছে যে তোরা চুরী করতে এসেছিস? ঘটি বাটি যা আছে তাত চাইলেই পেতিস, তার জন্যে সিঁদ কাটা কেন? ঐ যা দুচার খানা কাপড় চোপড় আছে তাই নিয়ে চলে যা। আর কখনো চুরী করিসনে, খেটে খাগে। তাহলে রাতে আরামে ঘুমিয়ে বাঁচবি। ঘুমের সময়টা এমন করে ঘুরে ঘুরে মরিসনে।

 চোর দুজন লজ্জায় মাথা হেঁট করে বেরিয়ে গেল এক টুকরা ছেঁড়া ন্যাকড়াও সঙ্গে নিয়ে গেল না।

 এইভাবে দেবদূতের দিন কাটে। কোনদিন তাঁর কোন কাজের একচুল ব্যতিক্রম হয় না। সেই সারাদিন পরিশ্রম, সন্ধ্যায় নৌকা চড়া, ফিরে এসে ফুলটি ভাসান ও শেষে স্বপাক অন্ন খেয়ে রাতে নিদ্রা যাওয়া।

 বয়স যখন তাঁর সত্তর একদিন এক নূতন ঘটনা ঘটল। সন্ধ্যার সময় নৌকা নিয়ে দেবদূত ঘাটে বসে আছেন কালো মেঘে আকাশ পৃথিবী সব ঢেকে গেছে মুহূর্ত্তের নাধাই মুষলধারে বৃষ্টি নাম্‌ল। কোলের মানুষ দেখা যায় না এমনি অন্ধকার, আকাশ ভেঙ্গে পড়ে এমনি জোর বৃষ্টির ধারা।

 একটি মানুষও আজ নৌকায় যাবার জন্যে এল না। আজ যার খুসী তার যেতে পারার দিন।

 দেবদূত ঘাটের কিনারায় বসে আছেন, নড়েন না।

 কিছুক্ষণ পরে সেই ঝাড় বাদল মাথায় করে এক ফকির ঘাটে এসে উপস্থিত। তিনি দেবদূতকে জিজ্ঞাসা করলেন “আজ নৌকাযাত্রা হবে না”?

 দেবদূত বল্লেন “হবে বই কি, এই আপনার জন্যেই অপেক্ষা।”

 খুসী হয়ে ফকির বল্লেন “চলুন তবে নৌকায় ওঠা যাক।”

 দুজনে নৌকায় চড়লেন। জল ঝড়ের মুখে নৌকা ভেসে চল্‌ল। বৃষ্টির জোর যত বেশী ছিল ঝড়ের তত নয়! তাই কোন রকমে নৌকাখানা এগোতে লাগল।

 উভয়েই নিস্তব্ধ। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ফকির বলে উঠলেন “দেবদূত আজ এই অন্ধকারটা আমার বুকের উপর বড় বেশী করে চেপে ধরছে, তার উপরে এই ঝড় বাদল আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা তুফান তুলছে, আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন না করে থাকতে পারছি নে। তুমি বল তোমার জীবনের রহস্য আমাকে। তোমার জীবনের রহস্যটি ভাঙলে আমার বুকের এই অন্ধকারের চাপ সরে গিয়ে যেন একটু আলো দেখা দেবে, যেন আমি হাল্কা হয়ে বাঁচব আমার মনে হয়”।

 দেবদূত বল্লেন “এতে যদি তোমার উপকার হয়, তোমার বুকের বোঝা এতে যদি নেমে যায় তবে শোন আমার কাহিনী! এই বলে দেবদূত নিজের পূর্ব্বকথা বলতে আরম্ভ করলেন্—

 “সতের বছর বয়সে, বাপের আদরের ধন, বংশের একমাত্র সন্তান, রাজ্যের আশা ভরসা স্থল আমি ডুবে মরেছি জেনে রাজ্যময় যখন হাহাকার পড়ে গিয়েছিল, আমি তখন নদীর তলে তলিয়ে তাচেতন। কোথায় কদিন ছিলুম জানিনে। জ্ঞান হলে চোখ মেলে দেখি মাথার উপর সূর্য্য-কিরণ ঝলমল করছে। একদিকে নদী কলকল শব্দ বয়ে চলেছে, আর একদিকে দূর দিগন্ত পর্য্যন্ত সবুজ ঘাসে ঢাকা।

 কোথায় অন্ধকারময় নদীগর্ভে জলের তলে অচেতনে তলিয়ে যাওয়া, আর কোথায় খোলা আকাশের নীচে ঝলমলে আলোর মধ্যে, হাল্কা বাতাসে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া।

 স্বপ্নের মত দুটো ঝাপসা অনুভূতি একত্র হয়ে মাথাটা আমার গুলিয়ে দিলে।

 জানিনে কতক্ষণ এই ভাবে কেটেছে! চেয়ে দেখি মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া কালো চুল, হাঁটুর উপর পর্য্যন্ত কাপড়, বড় বড় চোখ, শ্যামবর্ণ, জোয়ান চেহারার একটি মানুষ, আমার মুখের মধ্যে কি ঢেলে দিচ্ছে। তারই পাশে একটি ছোট্ট মেয়ে, বয়েস নয় কি দশ, দেখতে পরীর মত আমারই মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

 আমাকে বেঁচে উঠতে দেখে মেয়েটির চোখ ছুটি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল; হাততালি দিতে দিতে, সামনের রাস্তা ধ’রে সে ছুটে চল্‌ল এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা ছেঁড়া কম্বল এনে তাই দিয়ে আমার সর্বাঙ্গ ঢেকে দিলে।

 আমি চোখ বুজলুম। ক্লান্তিতে আমার শরীর অবসন্ন। মনে হল যেন ঘুম আসছে। আধঘুমে বুঝলুম সেই জোয়ান লোকটি আমাকে তুলে কাঁধে ফেলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

 হঠাৎ তারা থামল। ভারী গলায় পুরুষটি হেঁকে বল্‌ল “মইনু এগিয়ে দরজা খোল”। দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল। তখন আমার তন্দ্রা একটু ছুটেছে। পরক্ষণেই একটা কুঁড়ে ঘরের মধ্যে, একটা পায়া ভাঙ্গা খাটিয়ার উপরে আমি শুয়ে আছি বুঝলুম।

 ঘুম, খুব ঘুম, এমন ঘুম আর কখনো ঘুমোইনি। যখন জাগলুম দেখি মন বুদ্ধি অনেখানি তাজা হয়েছে কিন্তু সর্ব্বাঙ্গে ব্যথা হাত পা নাড়ারবার ক্ষমতা পর্য্যন্ত নেই।

 কএকদিন বাস করতেই জানলুম এবং এরা বাপ ও মেয়ে, জাতে এরা জেলে, নদীতে মাছ ধ’রে সেই মাছ গাঁয়ে বেচাই বাপের ব্যবসা। ছোট মেয়েটি ঘরকন্নার সব কাজ করে। রাঁধা বাড়া, ঘর উঠান ঝাঁট, একটি দুধালী ছাগল আছে তাকে চরান, বাপকে প্রাণ দিয়ে যত্ন করা, স্নানের সময় তেল মাখানো, নেয়ে এলে গরম গরম ভাত মাটির থালায় বেড়ে সামনে বসে খাওয়ানো। আমিত দেখে অবাক্। এতটুকু মেয়ের কাজের কি শৃঙ্খলা, প্রতি কাজে কি প্রাণের টান! আর কি সুন্দর তার হাওয়ার মত হাল্কা চলা ফেরা, হাত পা নাড়ার ভঙ্গী।

 আমার সেবার ভার পড়েছে এখন সেই মেয়েটির উপর। কলের মত মেয়েটি যখনই আমার কাছে আসে আমার চারিদিকে যেন ফুল ফুটে ওঠে। তার সবই যেন ফুলের মত। মুখখানি ফোটা ফুল—হৃদয়টি তারই সুগন্ধে ভরা। এমনতর সহজ, সুন্দর, স্নিগ্ধ, কোমল পরিপূর্ণ যত্ন কখনো দেখিনি। মানুষ যে কত সুন্দর হতে পারে এই প্রথম আমি তা দেখলুম।

 তাদের খাদ্য ছিল ভাত ও মাছ সিদ্ধ, তাতে তেল নুন মাখা। আর চাক ভাঙ্গা মধু, যত চাও। সময়ে সময়ে দু’চারটে বুনো ফলও মইনু পেড়ে আন্‌ত।

 ছাগ্‌লী যা দুধ দেয় আজকাল আমিই তার সবটুকু পাই—রুগ্ন বলে।

 তাদের যত্নে মাস দুয়েকের মধ্যেই আমি বেশ সুস্থ হয়ে উঠলুম। ভাবি এইবার বাড়ী যাব—যদিও জানিনে বাড়ী এখান থেকে কত দূরের পথ। কিন্তু এদের ছেড়ে যেতে মন একেবারেই চায় না—বিশেষত মইনুকে। মইনু, সে যে আগাগোড়াই ফুলের সুবাসে ভরা, সে যে দেবলোকের একটি মাত্র সাদা পারিজাত।

 ভাবি আজ যাব, কাল যাব, এমনি করে তিনমাস কাটল যাওয়া হল না। মইনুর বাপের নাম সূর্ত্তি, সবাই তাকে সূর্ত্তি জেলে বলে। একদিন আমি বল্লুম “সূর্ত্তি আমিও তোমার সঙ্গে মাছ ধরতে যাব, তোমার উপর বসে বসে আর কত খাই?” সূর্ত্তি বল্লে “বেটা তোর ননীর দেহ তুই মাছ ধরতে পারবি ক্যানে?”

 আমি বল্লুম “খুব পারব তুমি নিয়েই চল না” “আচ্ছা কালকে যাস”, এই বলে সে কাঁধে জাল ফেলে চলে গেল। রোজ যেমন নৌকা চড়ে যায়, এদিনও সে তেমনি গেল কিন্তু বেলা যায় সন্ধ্যা হয় আজ আর সূত্তি ফেরে না। রাত্রি হল সূর্ত্তির দেখা নেই। সারারাত মইনু আর আমি দাওয়ায় বসে—সূর্ত্তি আসে না। ভোরের সময় প্রতিবেশী জেলে সিন্দি এসে বল্লে “মইনু তোর বাপ কাল মরেছে মাথায় বাজ পড়ে। সঙ্গে আমি ছিনু ট্যাঁক থেকে তার সাতগণ্ডা পয়সা খুলে এনেছি তোর জন্যে, এই নে” বলে পয়সাগুলো সিন্দি দাওয়ার উপর ছড়িয়ে দিলে।

 বাপের মরা খবর শোনামাত্র মইনু জ্ঞানশূন্য হয়ে দাওয়া থেকে নীচে উল্টে পড়ে গেল। চোখে মুখে জল দিতে দিতে জ্ঞান ফিরে এলে তাকে ঘরের মধ্যে আমি তুলে শোয়ালুম।

 কি তার কান্না! দিন রাত্রি কেঁদে কেঁদে তিনদিনের মধ্যে মইনু শুকিয়ে যেন এতটুকুটি হয়ে গেল। প্রাণপণ চেষ্টায় একটু করে ছাগল দুধ ও একটুখানি মধু এই তাকে খাওয়াতে পেরেছিলুম। তিনদিন পরে সে একটু শান্ত হল। তখন আমাকে আর একেবারেই ছাড়তে চায় না। সেই দশ বছরের মেয়ে মইনু যেন আমার কণ্ঠের হার হয়ে আমার বুকে ঝুলতে লাগল, তাকে ফেলে যাই কোথা?

 সূর্ত্তির জন্যে আমার প্রাণেও বড় কান্নাটাই জেগেছিল। মইনুর জন্যে সেটা আমি চেপে রেখেছিলুম। আমি কাঁদলে তার শোক উথলে উঠবে। সূর্ত্তি আমাকে বাঁচাল, এ প্রাণটা এক রকম তারই দেওয়া, কিন্তু তার বদলে সে আমার কাছ থেকে, আমার রাজা বাপের কাছ থেকে, কোন পুরস্কার না নিয়েই চলে গেল। সে জানল না যে সে এক রাজপুত্রকে বাঁচিয়েছে তার অনেক দাবী, অনেক পাওনা। তাকে যে আর কখনো মাছ ধ’রে খেতে হবে না এ কথা সে শুনে গেল না। হায় হায় কি দুঃখ! যাই হোক্ এর কিছু প্রতিদান তো আমাকে দিতেই হবে। তার মইনুকে চিরজীবন আমার গলায় গেঁথে রাখতেই হবে। তাতে যাই হোক্‌।

 একেই মইনু আমার চোখের সামনে, হৃদয়ের সামনে ফুলের মত ফুটে থাকে তার উপর এই কৃতজ্ঞতা তার কাছে যেন আমাকে বিকিয়ে দিল। আমার সবটা এখন তারই।

 মইনুর বাপের একখানা ভাঙ্গা নৌকা ছিল। সেখানা পড়ে থাকত—কাজে লাগত না। আমি সেখানা সারিয়ে নিলুম। মইনুকে সঙ্গে নিয়ে সেই নৌকায় চড়ে মাছ ধ’রে প্রতিদিন গাঁয়ে বেচে আসতে আরম্ভ করলুম। এতেই এখন মইনুর ও আমার চলে।

 দু বৎসর কেটে গেল মইনু আমাকে ছেড়ে থাকেনি আমিও মইনুকে ছেড়ে থাকিনি।

 মইনুর শরীর অসুস্থ, সকালে উঠেই জানাল আজ সে আমার সঙ্গে যেতে পারবে না। সেদিন আমি একাই গেলুম। ফিরে এসে দেখি মইনুর ভয়ানক জ্বর গা পুড়ে যাচ্ছে। দেখেই ভয়ে আমার বুকটা কেঁপে উঠল। সে চমকে উঠে আমাকে বল্লে “ঐ যে বাবা এসেছে, দেখতে পাচ্ছ না। তুমি আমার কাছে এসে বস, আমার ভয় করছে, বাবা আমাকে নিয়ে যাবে”। আমি বল্লুম, “মইনু কি বলছ, এখানে তো আর কেউ নেই কেবল আমি আর তুমি, ঘুমোও”। আমার কথা শুনে একটু সচেতন হয়ে মইনু বলে “ওঃ তুমি আর আমি, কি ভুল বকছিলুম। এখানে বস আমি তোমার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমোই। দেখ যেন ঘুম ভাঙ্গলে, চোখ মেলে তোমাকে আবার দেখতে পাই। আমার ভয় করে পাছে জেগে তোমাকে আর না দেখি”।

 মইনুর মাথাটি কোলে নিয়ে সারারাত আমি জেগে বসে রইলুম। সারারাতের মধ্যে মইনুর আর জ্ঞান হল না। ভোরের দিকে দু একবার জল জল বলে চীৎকার করেই মইনু চুপ করল—তার পরেই সব শেষ। কিছুক্ষণ আমার জ্ঞান ছিল না। পরে বার বছরের মেয়ের সেই ছোট্ট শরীরটিকে, সেই সাদা ধবধবে মইনু ফুলটিকে একলাই কাঁধে করে বয়ে নদী তীরে এনে শুক্নো কাঠ জড় করে জ্বালিয়ে দিলুম। চোখের সামনে যেমনি সব পুড়ে ছাই হল অমনি আমি দেখলুম আমার বুকের ভিতরটায় মস্ত বড় একটা ফাঁক—প্রকাণ্ড কাঁক। বাতাস যেন সেখান দিয়ে হায় হায় করে বয়ে যাচ্ছে; আকাশ যেন নিজের শূন্যতা নিয়ে সেখানটায় হাঁ করে পড়ে রয়েছে।

 তখুনি, সেই শ্মশান থেকেই সেই ভাঙ্গা নৌকায় চড়ে আমি যাত্রা করলুম। কোথায় যাচ্ছি কোন ঠিকানা নেই, যাচ্ছি তো যাচ্চি। কত গ্রাম কত সহর, কত নদ নদী পার হলুম। দিনের পর রাত্রি, রাত্রির পর দিন চলেইছি।

 ক্রমে এই আকাশ বাতাস আমার বুকে গভীর সান্ত্বনা বয়ে আনতে লাগল। বুকে আমার নিত্যি যেন তারা হাত বুলিয়ে দেয়। সে কি নিবিড় আরাম কি সুগভীর শান্তি!

* * * *

 তারপর দেখি আমার বুকের মাঝে কি ভীড়। হাজার হাজার মানুষ কি বিষম ঠেলাঠেলি করে আমার বুকের মধ্যে ঢুকছে। আমার বুকের ফাঁকটা ক্রমেই যেন তারা ভরে তুলতে চাচ্ছে। যেখানে যত মানুষের মুখ দেখি সবাই আমার বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ফাঁক পেয়ে এইখান দিয়ে আনাগোনা তাদের সহজ হয়েছে, বুঝেছ হে ফকির! তাই আমার বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, রাতদিন তাই আমার বুকের দরজা খোলা রাখতে হয়। আস্‌তে চাইলে কাউকে তো আমি “না” বলতে পারিনে।

 ফকির অবাক হয়ে দেবদূতের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। অন্ধকারে দেখা যায় না তবু প্রাণপণে দেবদূতের মুখ দেখতে চেষ্টা করতে লাগলেন। দেবদূত বল্লেন “এইভাবে এক বৎসর ঘুরে শেষে বাবার রাজ্যে ফিরে আসি তারপর তোমরা তো জানই কি ভাবে আমার দিন কেটেছে”! একটু পরে ফকির বলে উঠলেন “দেবদূত আপনার বুকের সে ফাঁকটা কি জিনিষ যার ভিতর দিয়ে জগৎ সুদ্ধ লোক আনাগোনা করে?”

 দেবদূত বল্লেন “তুমি ফাঁক চেন না—ফকির হয়েছ! ফাঁক না হলে কি কেউ ফকির হতে পারে হে!”

 যত শোনেন ফকির ততই অবাক হন। আবার বল্লেন “ফুলটি তুমি ভাসাও কেন দেবদূত? কোথায় পাঠাও, কোনদিকে?

 দেবদূত বল্লেন “স্বর্গের দিকে। স্বর্গ আমার জন্যে নয় তবু স্বর্গ খুব সুন্দর বলে আমি এই ভাবে তাকে স্মরণ করে থাকি।” ফকির নিস্তব্ধ মুগ্ধ। দেবদূত বল্লেন “আামার কাজ শেষ হয়েছে। যা বাকি ছিল তোমাকে দিয়ে গেলুম। তুমি এই নিয়ে সংসারে ফিরে যাও আমি একটু বিশ্রাম করি।” এই বলে ফকিরের কোলে তিনি মাথা রাখলেন। পরক্ষণেই ফকির দেখলেন দেবদূতের প্রাণশূন্য দেহ তাঁর কোলে।

 এই ঘটনায় ফকিরের বুকের ভিতরটা একেবারে ফাঁক হয়ে গেল।

 ওদিকে বাইরে আকাশ পরিস্কার হয়ে ভোরের আলো দেখা দিয়েছে।