দুর্গেশনন্দিনী/দ্বিতীয় খণ্ড/অষ্টম পরিচ্ছেদ
অষ্টম পরিচ্ছেদ
আরোগ্য
দিন যাবে। তুমি যাহা ইচ্ছা তাহা কর, দিন যাবে—রবে না। যে অবস্থায় ইচ্ছা সে অবস্থায় থাক, দিন যাবে―রবে না। পথিক! বড় দারুণ ঝটিকা-বৃষ্টিতে পতিত হইয়াছ? উচ্চরবে শিরোপরি ঘনগর্জ্জন হইতেছে? বৃষ্টিতে প্লাবিত হইতেছ? অনাবৃত-শরীরে করকাভিঘাত হইতেছে? আশ্রয় পাইতেছ না? ক্ষণেক ধৈর্য্য ধর, এ দিন যাবে—রবে না। ক্ষণেক অপেক্ষ কর; দুর্দ্দিন ঘুচিবে, সুদিন হইবে; ভানূদয় হইবে, কালি পর্য্যন্ত অপেক্ষ কর। কাহার না দিন যায়? কাহার দুঃখ স্থায়ী করিবার জন্য দিন বসিয়া থাকে? তবে কেন রোদন কর?
কার দিন গেল না? তিলোত্তমা ধূলায় পড়িয়া আছে, তবু দিন যাইতেছে।
বিমলার হৃৎপদ্মে প্রতিহিংসা কালফণী বসতি করিয়া সর্ব্বশরীর বিষে জর্জ্জর করিতেছে, এক মুহূর্ত্ত তাহার দংশন অসহ্য; এক দিনে কত মুহূর্ত্ত! তথাপি দিন কি গেল না?
কতলু খাঁ মস্নদে; শত্রুজয়ী; সুখে দিন যাইতেছে। দিন যাইতেছে—রহে না।
জগৎসিংহ রুগ্নশয্যায়; রোগীর দিন কত দীর্ঘ কে না জানে? তথাপি দিন গেল!
দিন গেল। দিনে দিনে জগৎসিংহের আরোগ্য জন্মিতে লাগিল। একেবারে যমদণ্ড হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া রাজপুত্র দিনে দিনে নিরাপদ হইতে লাগিলেন। প্রথমে শরীরের গ্লানি দূর; পরে আহার; পরে বল; শেষে চিন্তা।
প্রথম চিন্তা—তিলোত্তমা কোথায়? রাজপুত্র যত আরোগ্য পাইতে গাগিলেন, তত সংবর্দ্ধিত ব্যাকুলতার সহিত সকলকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন; কেহ তুষ্টিজনক উত্তর দিল না। আয়েষা জানেন না; ওস্মান বলেন না; দাস-দাসী জানে না, কি ইঙ্গিত-মতে বলে না। রাজপুত্র কণ্টকশয্যাশায়ীর ন্যায় চঞ্চল হইলেন।
দ্বিতীয় চিন্তা—নিজ ভবিষ্যৎ। “কি হইবে” অকস্মাৎ এ প্রশ্নের কে উত্তর দিতে পারে? রাজপুত্র দেখিলেন, তিনি বন্দী! করুণহৃদয় ওস্মান ও আয়েষার অনুকম্পায় তিনি কারাগারের বিনিময়ে সুসজ্জিত, সুবাসিত শয়নকক্ষে বসতি করিতেছেন; দাস-দাসী তাঁহার সেবা করিতেছে; যখন যাহা প্রয়োজন, তাহা ইচ্ছাব্যক্তির পূর্ব্বেই পাইতেছেন; আয়েষা সহোদরাধিক স্নেহের সহিত তাঁহার যত্ন করিতেন; তথাপি দ্বারে প্রহরী; স্বর্ণপিঞ্জরবাসী সুরস পানীয়ে পরিতৃপ্ত বিহঙ্গমের ন্যায় রুদ্ধ আছেন। কবে মুক্তিপ্রাপ্ত হইবেন? মুক্তিপ্রাপ্তির কি সম্ভাবনা? তাঁহার সেনা সকল কোথায়? সেনাপতিশূন্য হইয়া তাহাদের কি দশা হইল?
তৃতীয় চিন্তা—আয়েষা। এ চমৎকারকারিণী, পরহিত-মূর্ত্তিমতী, কেমন করিয়া এই মৃন্ময় পৃথিবীতে অবতরণ করিল?
জগৎসিংহ দেখিলেন―আয়েষার বিরাম নাই, শান্তিবোধ নাই, অবহেলা নাই। রাত্রিদিন রোগীর শুশ্রূষা করিতেছেন। যত দিন না রাজপুত্র নীরোগ হইলেন, তত দিন তিনি প্রত্যহ প্রভাতে দেখিতেন, প্রভাত-সূর্য্যরূপিণী কুসুম-দাম হস্তে করিয়া লাবণ্যময় পদ-বিক্ষেপে নিঃশব্দে আগমন করিতেছেন। প্রতিদিন দেখিতেন, যতক্ষণ স্নানাদি কার্য্যের সময় অতীত না হইয়া যায়, ততক্ষণ আয়েষা সে কক্ষ ত্যাগ করিতেন না। প্রতিদিন দেখিতেন, ক্ষণকাল পরেই প্রত্যাগমন করিয়া কেবল নিতান্ত প্রয়োজনবশতঃ গাত্রোত্থান করিতেন, যতক্ষণ না তাঁহার জননী বেগম তাঁহার নিকট কিঙ্করী পাঠাইতেন, ততক্ষণ তাঁহার সেবায় ক্ষান্ত হইতেন না।
কে রুগ্ন-শয্যায় না শয়ন করিয়াছেন? যদি কাহারও রুগ্ন-শয্যার শিয়রে বসিয়া মনোমোহিনী রমণী ব্যজন করিয়া থাকে, তবে সেই জানে রোগেও সুখ!
পাঠক! তুমি জগৎসিংহের অবস্থা প্রত্যক্ষীভূত করিতে চাহ? তবে মনে মনে সেই শয্যায় শয়ন কর, শরীরে ব্যাধি-যন্ত্রণা অনুভূত কর; স্মরণ কর যে শত্রুমধ্যে বন্দী হইয়া আছ; তার পর সেই সুবাসিত সুসজ্জিত, সুন্নিগ্ধ শয়নকক্ষ মনে কর। শয্যায় শয়ন করিয়া তুমি বারপানে চাহিয়া আছ; অকস্মাৎ তোমার মুখ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল; এই শত্রুপুরীমধ্যে যে তোমাকে সহোদরের ন্যায় যত্ন করে, সেই আসিতেছে। সে আবার রমণী, যুবতী, পূর্ণবিকসিত পদ্ম! অমনি শয়ন করিয়া এক দৃষ্টে চাহিয়া আছ, দেখ কি মুর্ত্তি! ঈষৎ―ঈষৎ মাত্র দীর্ঘ আয়তন, তদুপযুক্ত গঠন, মহামহিম দেবী-প্রতিমা স্বরূপ! প্রকৃতি-নিয়মিত রাজ্ঞী স্বরূপ। দেখ কি ললিত পাদবিক্ষেপ! গজেন্দ্রগমন শুনিয়াছ? সে কি? মরালগমন বল? ঐ পাদবিক্ষেপ দেখ; সুরের লয়, বাদ্যে লয়; ঐ পাদবিক্ষেপের লয়, তোমার হৃদয়মধ্যে হইতেছে। হস্তে ঐ কুসুমদাম দেখ, হস্তপ্রভায় কুসুম মলিন হইয়াছে দেখিয়াছ? কণ্ঠের প্রভায় স্বর্ণহার দীপ্তিমান্ হইয়াছে দেখিয়াছ? তোমার চক্ষের পলক পড়ে না কেন? দেখিয়াছ, কি সুন্দর গ্রীবাভঙ্গী? দেখিয়াছ, প্রস্তরধবল গ্রীবার উপর কেমন নিবিড় কুঞ্চিত কেশগুচ্ছ পড়িয়াছে? দেখিয়াছ, তৎপার্শ্বে কেমন কর্ণভূষা দুলিতেছে? মস্তকের ঈষৎ―ঈষৎমাত্র বঙ্কিম্ ভঙ্গী দেখিয়াছ? ও কেবল ঈষৎ দৈর্ঘ্যহেতু। অত একদৃষ্টে চাহিতেছ কেন? আয়েষা কি মনে করিবে?
যতদিন জগৎসিংহের রোগের শুশ্রূষা আবশ্যক হইল, ততদিন পর্য্যন্ত আয়েষা প্রত্যহ এইরূপ অনবরত তাহাতে নিযুক্ত রহিলেন। ক্রমে যেমন রাজপুত্রের রোগের উপশম হইতে লাগিল, তেমনি আয়েষারও যাতায়াত কমিতে লাগিল; যখন রাজপুত্রের রোগ নিঃশেষ হইল, তখন আয়েষার জগৎসিংহের নিকট যাতায়াত প্রায় একেবারে শেষ হইল; কদাচিৎ দুই একবার আসিতেন। যেমন শীতার্ত্ত ব্যক্তির অঙ্গ হইতে ক্রমে ক্রমে বেলাধিক্যে রৌদ্র সরিয়া যায়, আয়েষা সেইরূপ ক্রমে ক্রমে জগৎসিংহ হইতে আরোগ্য-কালে সরিয়া যাইতে লাগিলেন।
একদিন গৃহমধ্যে অপরাহ্ণে জগৎসিংহ গবাক্ষে দাঁড়াইয়া দুর্গের বাহিরে দৃষ্টিপাত করিতেছেন; কত লোক অবাধে নিজ নিজ ঈপ্সিত বা প্রয়োজনীয় স্থানে যাতায়াত করিতেছে, রাজপুত্র দুঃখিত হইয়া তাহাদিগের অবস্থার সহিত আত্মাবস্থা তুলনা করিতেছিলেন। একস্থানে কয়েক জন লোক মণ্ডলীকৃত হইয়া কোন ব্যক্তি বা বস্তু বেষ্টনপূর্ব্বক দাঁড়াইয়াছিল। রাজপুত্রের প্রতি দৃষ্টিপাত হইল। বুঝিতে পারিলেন যে, লোকগুলি কোন আমোদে নিযুক্ত আছে, মন দিয়া কিছু শুনিতেছে। মধ্যস্থ ব্যক্তি কে, বা বস্তুটি কি, তাহা কুমার দেখিতে পাইতেছিলেন না। কিছু কৌতূহল জন্মিল। কিয়ৎক্ষণ পরে, কয়েক জন শ্রোতা চলিয়া গেলে, কুমারের কৌতূহল নিবারণ হইল; দেখিতে পাইলেন, মণ্ডলীমধ্যে এক ব্যক্তি একখানা পুতির ন্যায় কয়েকখণ্ড পত্র লইয়া তাহা হইতে কি পড়িয়া শুনাইতেছে। আবৃত্তিকর্ত্তার আকার দেখিয়া রাজকুমারের কিছু কৌতুক জন্মিল। তাহাকে মনুষ্য বলিলেও বলা যায়, বজ্রাঘাতে পত্রভ্রষ্ট মধ্যমাকার তালগাছ বলিলেও বলা যায়। প্রায় সেইরূপ দীর্ঘ, প্রস্থেও তদ্রূপ; তবে তালগাছে কখন তাদৃশ গুরু নাসিকাভার ন্যস্ত হয় না। আকারেঙ্গিতে উভয়ই সমান। পুতি পড়িতে পড়িতে পাঠক যে হাত-নাড়া মাথা-নাড়া দিতেছিলেন, রাজকুমার তাহা অবাক্ হইয়া দেখিতে লাগিলেন। ইতিমধ্যে ওস্মান গৃহমধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
পরস্পর অভিবাদনের পর ওস্মান কহিলেন, “আপনি গবাক্ষে অন্যমনস্ক হইয়া কি দেখিতেছিলেন?”
জগৎসিংহ কহিলেন, “সরল কাষ্টবিশেষ। দেখিলে দেখিতে পাইবেন।”
ওস্মান দেখিয়া কহিলেন, “রাজপুত্র, উহাকে কখন দেখেন নাই?”
রাজপুত্র কহিলেন, “না।”
ওস্মান কহিলেন, “ও আপনাদিগের ব্রাহ্মণ। কথা-বার্ত্তায় বড় সরস; ও ব্যক্তিকে গডমান্দারণে দেখিয়াছিলাম।”
রাজকুমার অন্তঃকরণে চিন্তিত হইলেন। গড়মান্দারণে ছিল? তবে এ ব্যক্তি কি তিলোত্তমার কোন সংবাদ বলিতে পারিবে না?
এই চিন্তায় ব্যাকুল হইয়া কহিলেন, “মহাশয়, উহার নাম কি?”
ওসমান চিন্তা করিয়া কহিলেন, “উহার নামটি কিছু কঠিন, হঠাৎ স্মরণ হয় না, গনপত? না;―গণপত―গজপত না; গজপত কি?”
“গজপত? গজপত এদেশীয় নাম নহে, অথচ দেখিতেছি ও ব্যক্তি বাঙ্গালী।”
“বাঙ্গালী বটে, ভট্টাচার্য্য। উহার একটা উপাধি আছে, এলেম―এলেম কি?”
“মহাশয়! বাঙ্গালীর উপাধিতে ‘এলেম’ শব্দ ব্যবহার হয় না। এলেমকে বাঙ্গালার বিদ্যা কহে। বিদ্যাভূষণ বা বিদ্যাবাগীশ হইবে।”
“হাঁ হাঁ, বিদ্যা কি একটা, রসুন, বাঙ্গালায় হস্তীকে কি বলে, বলুন দেখি?”
“হস্তী।”
“আর?”
“করী, দন্তী, বারণ, নাগ, গজ―”
“হাঁ হাঁ, স্মরণ হইয়াছে; উহার নাম গজপতি বিদ্যাদিগ্গজ।”
“বিদ্যাদিগ্গজ! চমৎকার উপাধি! যেমন নাম, তেমনি উপাধি। উহার সহিত আলাপ করিতে বড় কৌতূহল জন্মিতেছে।”
ওস্মান খাঁ একটু একটু গজপতির কথাবার্ত্তা শুনিয়াছিলেন; বিবেচনা করিলেন, ইহার সহিত কপোপকথনে ক্ষতি হইতে পারে না। কহিলেন, “ক্ষতি কি?”
উভয়ে নিকটস্থ বাহিরের ঘরে গিয়া ভূত্যদ্বারা গজপতিকে আহ্বান করিয়া আনিলেন।
―――