দুর্গেশনন্দিনী/দ্বিতীয় খণ্ড/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ



দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

অলৌকিক আভরণ

 মহোৎসব উপস্থিত। অদ্য কতলু খাঁর জন্মদিন। দিবসে রঙ্গ, নৃত্য, দান, আহার, পান ইত্যাদিতে সকলেই ব্যাপৃত ছিল। রাত্রিতে ততোধিক। এইমাত্র সায়াহ্ন কাল উত্তীর্ণ ইয়াছে; দুর্গমধ্য আলোকময়; সৈনিক, সিপাহী, ওমরাহ, ভৃত্য, পৌরবর্গ, ভিক্ষুক, মদ্যপ, নট, নর্ত্তকী, গায়ক, গায়িকা, বাদক, ঐন্দ্রজালিক, পুষ্পবিক্রেতা, গন্ধবিক্রেতা; তাম্বূলবিক্রেতা, আহারীয়বিক্রেতা, শিল্পকার্য্যোৎপন্নদ্রব্যজাতবিক্রেতা; এই সকলে চতুর্দ্দিক্‌ পরিপূর্ণ। যথায় যাও, তথায় কেবল দীপমালা, গীতবাদ্য, গন্ধবারি, পান, পুষ্প, বাজী, বেশ্যা। অন্তঃপুরমধ্যেও কতক কতক ঐরূপ। নবাবের বিহারগৃহ অপেক্ষাকৃত স্থিরতর, কিন্তু অপেক্ষাকৃত প্রমোদময়। কক্ষে কক্ষে রজতদীপ, স্ফটিকদীপ, গন্ধদীপ স্নিগ্ধোজ্জ্বল আলোক বর্ষণ করিতেছে, সুগন্ধিকুসুমদাম পুষ্পাধারে, স্তম্ভে, শয্যায়, আসনে আর পুরবাসিনীদিগের সঙ্গে বিরাজ করিতেছে; বায়ু আর গোলাবের গন্ধের ভার বহন করিতে পারে না। অগণিত দাসীবর্গ কেহ বা হৈমকার্য্যখচিত বসন, কেহ বা ইচ্ছামত নীল, লোহিত, শ্যামল, পাটলাদি বর্ণের চীনবাস পরিধান করিয়া অঙ্গের স্বর্ণালঙ্কার প্রতিদীপের আলোকে উজ্জ্বল করিয়া ভ্রমণ করিতেছে। তাহারা যাঁহাদিগের দাসী, সে সুন্দরীরা কক্ষে কক্ষে বসিয়া মহাযত্নে বেশ-বিন্যাস করিতেছিলেন। আজ নবাব প্রমোদমন্দিরে আসিয়া সকলকেই লইয়া প্রমোদ করিবেন; নৃত্যগীত হইবে। যাহার যাহা অভীষ্ট, সে তাহা সিদ্ধ করিয়া লইবেক। কেহ আজ ভ্রাতার চাকরি করিয়া দিবেন আশায় মাথায় চিরুণী জোরে দিতেছিলেন। অপরা, দাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া লইবেন ভাবিয়া অলকগুচ্ছ বক্ষঃ পর্যন্ত নামাইয়া দিলেন। কাহারও নবপ্রসূত পুত্রের দানস্বরূপ কিছু সম্পত্তি হস্তগত করা অভিলাষ, এজন্য গণ্ডে রক্তিমাবিকাশ করিবার অভিপ্রায়ে ঘর্ষণ করিতে করিতে রুধির বাহির করিলেন। কেহ বা নবাবের কোন প্রেয়সী ললনার নবপ্রাপ্ত রত্নালঙ্কারের অনুরূপ অলঙ্কার কামনায় চক্ষুর নীচে আকর্ণ কজ্জল লেপন করিলেন। কোন চণ্ডীকে বসন পরাইতে দাসী পেশোয়াজা মড়াইয়া ফেলিল; চণ্ডী তাহার গালে একটা চাপড় মারিলেন। কোন প্রগল্‌ভার বয়োমাহাত্ম্যে কেশরাশির ভার ক্রমে শিথিলমূল হইয়া আসিতেছিল, কেশবিন্যাসকালে দাসী চিরুণী দিতে কতকটি চুল চিরুণীর সঙ্গে উঠিয়া আসিল; দেখিয়া কেশাধিকারিণী দরবিগলিত চক্ষুতে উচ্চরবে কাঁদিতে লাগিলেন।

 কুমুমবনে স্থলপদ্মবৎ, বিহঙ্গকুলে কলাপিবৎ এক সুন্দরী রেশবিন্যাস সমাপন করিয়া কক্ষে কক্ষে ভ্রমণ করিতেছিলেন। অদ্য কাহারও কোথাও যাইতে বাধা ছিল না। যেখানকার যে সৌন্দর্য্য, বিধাতা সে সুন্দরীকে তাহা দিয়াছেন; যে স্থানের যে অলঙ্কার, কতলু খাঁ তাহা দিয়াছিল; তথাপি সে রমণীর মুখ-মধ্যে কিছুমাত্র সৌন্দর্য্য-গর্ব্ব বা অলঙ্কারগর্ব্ব-চিহ্ন ছিল না। আমোদ, হাসি কিছুই ছিল না। মুখকান্তি গম্ভীর, স্থির; চক্ষুতে কঠোর জ্বালা।  বিমলা এইরূপ পুরীমধ্যে স্থানে স্থানে ভ্রমণ করিয়া এক সুসজ্জীভূত গৃহে প্রবেশ করিলেন, প্রবেশানন্তর দ্বার অর্গলবদ্ধ করিলেন। এ উৎসবের দিনেও সে কক্ষমধ্যে একটি মাত্র ক্ষীণালোক জ্বলিতেছিল। কক্ষের এক প্রান্তভাগে একখানি পালঙ্ক ছিল। সেই পালঙ্কে আপাদমস্তক শয্যোত্তরচ্ছদে আবৃত হইয়া কেহ শয়ন করিয়াছিল। বিমলা পালঙ্কের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, “আমি আসিয়াছি।”

 শয়ান ব্যক্তি চমকিতের ন্যায় মুখের আবরণ দূর করিল; বিমলাকে চিনিত পারিয়া শয্যোত্তরচ্ছদ ত্যাগ করিয়া, গাত্রোত্থান করিয়া বসিল, কোন উত্তর করিল না।

 বিমলা পুনরপি কহিলেন, “তিলোত্তমা! আমি আসিয়াছি।” .

 তিলোত্তমা তথাপি কোন উত্তর করিলেন না। স্থিরদৃষ্টিতে বিমলার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন।

 তিলোত্তমা আর ব্রীড়া-বিবশা বালিকা নহে। তদ্দণ্ডে তাঁহাকে সেই ক্ষীণালোকে দেখিলে বোধ হইত যে, দশ বৎসর পরিমাণ বয়োবৃদ্ধি হইয়াছে; দেহ অত্যন্ত শীর্ণ, মুখ মলিন। পরিধান একখানি সঙ্কীর্ণায়তন বাস। অবিন্যস্ত কেশভারে ধূলিরাশি জড়িত হইয়া রহিয়াছে। অঙ্গে অলঙ্কারের লেশ নাই; কেবল পূর্ব্বে যে অলঙ্কার পরিধান করিতেন, তাহার চিহ্ন রহিয়াছে মাত্র।

 বিমলা পুনরপি কহিলেন, “আমি আসিব বলিয়াছিলাম—আসিয়াছি। কথা কহিতেছ না কেন?”

 তিলোত্তমা কহিলেন, “যে কথা ছিল, তাহা সকল কহিয়াছি, আর কি কহিব?”

 বিমলা তিলোত্তমার স্বরে বুঝিতে পরিলেন যে, তিলোত্তমা রোদন করিতেছিলেন; মস্তকে হস্ত দিয়া তাহার মুখ তুলিয়া দেখিলেন, চক্ষুর জলে মুখ প্লাবিত রহিয়াছে; অঞ্চল স্পর্শ করিয়া দেখিলেন, অঞ্চল সম্পূর্ণ আর্দ্র। যে উপাধানে মাথা রাখিয়া তিলোত্তমা শয়ন করিয়াছিলেন, তাহাতে হাত দিয়া দেখিলেন, তাহাও প্লাবিত। বিমলা কহিলেন, “এমন দিবানিশি কাঁদিলে শরীর কয় দিন বহিবে?”

 তিলোত্তমা আগ্রহসহকারে কহিলেন, “বহিয়া কাজ কি? এতদিন বহিল কেন, এই মনস্তাপ।”

 বিমলা নিরুত্তর হইলেন। তিনিও রোদন করিতে লাগিলেন।

 কিয়ৎক্ষণ পরে বিমলা দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন, “এখন আজিকার উপায়?”

 তিলোত্তমা অসন্তোষের সহিত বিমলার অলঙ্কারাদির দিকে পুনর্ব্বার চক্ষুঃপাত করিয়া কহিলেন, “উপায়ের প্রয়োজন কি?”

 বিমলা কহিলেন, “বাছা তাচ্ছিল্য করিও না। আজও কি কতলু খাঁকে বিশেষ জান না? আপনার অবকাশ অভাবেও বটে, আমাদিগের শোক-নিবারণার্থ অবকাশ দেওয়ার অভিলাষেও বটে, এ পর্য্যন্ত দুরাত্মা আমাদিগকে ক্ষমা করিয়াছে; আজ পর্য্যন্ত আমাদিগের অবসরের যে সীমা, পূর্ব্বেই বলিয়া দিয়াছে। সুতরাং আজ আমাদিগকে নৃত্যশালায় না দেখিলে না জানি কি প্রমাদ ঘটাইবে।”

 তিলোত্তমা কহিলেন, “আবার প্রমাদ কি?”

 বিমলা কিঞ্চিৎ স্থির হইয়া কহিলেন, “তিলোত্তমা, একবারে নিরাশ হও কেন? এখনও আমাদিগের প্রাণ আছে, ধর্ম্ম আছে; যত দিন প্রাণ আছে, তত দিন ধর্ম্ম রাখিব।”

 তিলোত্তমা তখন কহিলেন, “তবে মা! এই সকল অলঙ্কার খুলিয়া ফেল; তুমি অলঙ্কার পরিয়াছ, আমার চক্ষুশূল হইয়াছে।”

 বিমলা ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “বাছা, আমার সকল আভরণ না দেখিয়া আমাকে তিরস্কার করিও না।”

 এই বলিয়া বিমলা নিজ পরিধেয় বাসমধ্যে লুক্কায়িত এক তীক্ষ্ণধার ছুরিকা বাহির করিলেন; দীপপ্রভায় তাহার শাণিত ফলক বিদ্যুদ্বৎ চমকিয়া উঠিল। তিলোত্তমা বিস্মিতা ও বিশুষ্কামুখী হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কোথায় পাইলে?”

 বিমলা কহিলেন, “কাল হইতে অস্তঃপুরমধ্যে একজন নূতন দাসী আসিয়াছে দেখিয়াছ?”

 তি। দেখিয়াছি -আশমানি আসিয়াছে।

 বি। আশমানির দ্বারা ইহা অভিরাম স্বামীর নিকট নিকট আনাইয়াছি।

 তিলোত্তমা নিঃশব্দ হইয়া রঙ্গিলেন; তাহার হৃদয় কম্পিত হঠতে লাগিল। ক্ষণেক পরে বিমল জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এ বেশ অঙ্গ ত্যাগ করিবে না?”

 তিলোত্তম কহিলেন, “না।”

 বি। নৃত্যগীতাদিতে যাইবে না?

 তি। “না।”

 বি। তাহাতেও নিস্তার পাইবে না।

 তিলোত্তম কাঁদিতে লাগিলেন। বিমলা কহিলেন, “স্থির হইয়া শুন, আমি তোমার নিষ্কৃতির উপায় করিয়াছি।”

তিলোত্তমা আগ্রহসহকারে বিমলার মুখপানে চাহিয়া রহিলেন। বিমলা তিলোত্তমার হস্তে ওস্মানের অঙ্গুরীয় দিয়া কহিলেন, এই অঙ্গুরীয় ধর; নৃত্যগ্রহে ঘাইও না; অন্ধরাত্রের এ দিকে উৎসব সম্পূণ হইলবেক না; সে পর্য্যন্ত আমি পাঠানকে নিবৃত্ত রাখিতে পারিব। আমি সে তোমার বিমাতা তাহ। সে জানিয়াছে, তুমি আমার সাক্ষাতে আসিতে পরিবে না, এই ছলে নৃত্যগীত সমাপা পর্য্যন্ত তাহার দর্শন-বাঞ্ছী ক্ষান্ত রাখিতে পারিব। অদ্ধরাত্রে অন্তঃপুর-দ্বারে বাইও; তথায় আর এক ব্যক্তি তোমাকে এইরূপ আর এক অঙ্গুরীয় দেখাইবে। তুমি নির্ভয়ে তাহার সঙ্গে গমন করিও, বেপানে লইয়া সাইতে বলিবে, সে তোমাকে তপার লইয়। যাইবেক। তুমি তাঙ্গকে অভিরাম স্বামীর কুটীরে লষ্ট। যাইতে কহিও।”

 তিলোত্তম শুনিয়া চমৎকৃত হইলেন; বিস্ময়ে হউক বা আহলাদে হউক, কিয়ৎক্ষণ কথা কহিতে পারিলেন না, পরে কহিলেন, “এ বৃত্তাস্ত কি? এ অঙ্গুরীয় তোমাকে কে দিল?”

 বিমল কহিলেন, “সে সকল বিস্তর কথা; অল্প সময়ে অবকাশ-মত কহিব। এক্ষণে নিঃসঙ্কোচচিত্তে, যাহা বলিলাম, তাই। করিও।”

 তিলোত্তম কহিলেন, “তোমার কি গতি হইবে? তুমি কি প্রকারে বাজির হইবে?”

 বিমলা কহিলেন, “আমার জন্ত চিন্তা করি ও না। আমি অন্ত উপরে বাহির হইয়া কাল প্রাতে তোমার সহিত মিলিত হইব।”

 এই বলিয়া বিমলা তিলোত্তমাকে প্রবোধ দিলেন; কিন্তু তিনি বে তিলোত্তমার জন্য নিজ মুক্তিপথ রোধ করিলেন, তাঙ্গ তিলোত্তমা কিছুই বুঝিতে পারিলেন না।  অনেক দিন তিলোত্তমার মুখে হৰ্ষবিকাশ হয় নাই; বিমলার কথা শুনিয়া তিলোত্তমার মুখ আজ হৰ্ষোৎফুল্লচ্ছইল।

 বিমলা দেপিয়া অন্তরে পুলকপূর্ণ হইলেন: বাষ্পগদগদম্বরে কছিলেন, “তবে আমি চলিলাম।”

 তিলোত্তম কিঞ্চিৎ সঙ্কোচের সহিত কঙ্গিলেন, “দেখিতেছি, তুমি ভুর্গের সকল সংবাদ পাইয়াছ, আমাদিশের আত্মীয়বর্গ কোথায়? কে শকেমন আছে বলিয়। যা ও”

 সিমলা দেখিলেন এ বিপদসাগরে ও জগংসিংহ তিলোত্তমান মনোমুধ্যে জাগিতেছেন। বিমল রাজপুত্রের নিষ্ঠুর পত্র পাষ্টয়াছেন, তাহাতে তিলোত্তমার নাম ও নাই; এ কথা তিলোত্তম। শুনিলে কেবল দগ্ধের উপর দগ্ধ হইবেন মাত্র; অতএব সে সকল কথা কিছুমাত্র না বলিয়া উত্তর করিলেন, “জগংসিংহ এই ফুর্গমধেষ্ট আছেন; তিমি শারীরিক কুশলে আছেন।”

 তিলোত্তম, নীরব হইয়। রছিলেন।

 বিমলা চক্ষু মুছিতে মুছিতে তথা হইতে গমন কবিলেন।